জ্বলদর্চি

শব্দে গাঁথা মনি-মালা -১ /সালেহা খাতুন

শব্দে গাঁথা মনি-মালা -১

সালেহা খাতুন

আমি মনি। কোনো এক শনিবার মাতৃজঠর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পৃথিবীর আলো দেখেছিলাম। এই আগমনে সাহায্য করেছিলেন মায়ের সেজো ঠাকুমা। অত্যন্ত স্মার্ট মহিলা তিনি। কুলোয়  করে সদ্যোজাত আমাকে তুলে ধরেছিলেন আমার দাদুর দিকে। আমি নাকি বড়ো বড়ো চোখ করে আর কাউকে নয় শুধুই আমার দাদুকে দেখছিলাম। ধর্মীয় রীতি মেনে দাদু আমার কানে দিয়েছিলেন আজানের ধ্বনি।  সেদিন থেকেই আমি ছিলাম দাদুর নয়নের মনি। অবশ্য  ছোটোবেলায় দাদু আমাকে বলতেন ‘আমার কানন দেবী’। আমার দাদুরা চার ভাই। সবাই অত্যন্ত গুণী। দাদুরা কলকাতায় থেকে পড়াশোনা করেছেন। দাদুর বাবার বড়োবাজারে ডিমের দোকান ছিল। সারাদিন পড়াশোনার পর দাদুরা দোকানে বসতেন। ইংরেজরা ওঁদের দোকান থেকেই কেনাকাটা করতো। কারণ দাদুরা সব ভাই ইংরেজিতে তুখোড় ছিলেন। কথোপকথনে কোনো সমস্যা হতো না।  তবে ছাত্র জীবনে দাদুদের একবার ইংরেজরা ধরে নিয়ে গিয়েছিল তাদের গাড়িতে করে অন্যান্য ছেলেদের সঙ্গে। আমার দাদুও সেই সময় বন্দেমাতরম ধ্বনি উচ্চারণ করেছিলেন ইংরেজদের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে। আমি যখন কলেজে পড়ি, দাদু তখন আমার কাছে আফশোস করতেন ‘ডকুমেন্টের অভাবে আমার ফ্রিডম ফাইটার হওয়া হলো না’। আমার দাদু মেজো। বড়ো দাদু এবং আমার দাদু দুজনেই পোস্টমাস্টার ছিলেন। একজন প্রেসিডেন্সির আর একজন সেন্ট জেভিয়ার্সের ছাত্র। তাঁদের  চেহারা কথাবার্তা আচার-আচরণ স্বভাব চরিত্র যে কোনো মানুষের সম্ভ্রম আদায় করে নিতো অতি সহজেই। আর দাদুদের ছোটো  দুই ভাই সেজোদাদু এবং ছোটোদাদু দেশভাগের সময়ে দেওয়া অপশন অনুযায়ী ভারতের আদি বংশ পরম্পরার ভিটে বাগনান থেকে বাংলাদেশে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে চলে গিয়ে নতুন ভাবে জীবন শুরু করেন। তাঁরাও ছিলেন ব্রিলিয়ান্ট স্টুডেন্ট এবং প্রেসিডেন্সির ছাত্র। সেজোদাদু মহ. আতাউল হক হয়েছিলেন বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি আবু সইদ  চৌধুরীর পার্সোনাল অ্যাসিস্ট্যান্ট। তিনি  খেলাধুলায় যথেষ্ট পারদর্শী।  লম্বা লম্বা পদ যুগলের অধিকারী সেজোদাদুকে টিমে দেখে বিরোধীপক্ষ ‘ওরে আতাউল আসছে’ বলে সরে যেত। উনি বাংলাদেশের সুপ্রিম কোর্টের অ্যাডভোকেট হয়েছিলেন। সেজোদাদুর পাইলট হওয়ার সমস্ত যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও আকাশে উড়তে পারেননি। আমার দাদুর বাবা সেখ ইয়াসিন এর অনুমতি পাননি বলে। ছোটোদাদু আয়নাল হক বাংলাদেশে শিক্ষকতা পেশায় নিযুক্ত হন। সেজো দাদুর পরিবার পরবর্তীতে ভারতের মূল ভিটের সঙ্গে যোগাযোগ রাখলেও ছোটোদাদু অজ্ঞাত কারণে সংযোগসূত্র ছিন্ন করেন। এঁদের সন্তান-সন্ততিরা বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছেন। দেশভাগের যন্ত্রণা আমার মাতৃকুল এবং শ্বশুরকুলে আজো সমান ব্যথার।
জ্বলদর্চি অ্যাপ ডাউনলোড করে নিন।👇
দাদুর দুই বোন সোনাতন ও সুফিয়া সুন্দরী এবং অত্যন্ত মার্জিত স্বভাবের। দাদুর ছোটো বোনের দুর্দান্ত রেজাল্টের জন্য বাগনানের চন্দ্রভাগ গার্লস স্কুল স্থায়িত্ব লাভ করে। ক্লাস সিক্সে পড়াকালীন আমার ঐ দিদা ফজলুল হকের হাত থেকে রূপোর মেডেল পান। আমার মা আর  মেজো মাসি সবাই ওই স্কুলে পড়াশোনা করেছেন আর বড়ো মাসি রিজিয়া খাতুন মুগকল্যাণ গার্লস স্কুলে পড়াশোনা করেছেন। আই এ পাশ। ১৯৬০ সালে আরামবাগ পোস্ট অফিসে ক্লার্কের পোস্টে চাকরি করতেন ১৯৬২ তে বিয়ের পর শ্বশুর বাড়ির চাপে চাকরি ছাড়েন। আমার দিদা বাগনানেরই শ্যামপুরের শিবগঞ্জের কালীদহ গ্রামের মেয়ে। স্কুলে পড়াশোনা করেছেন। বড়পীর নবীজির জীবনী শোনাতেন। ছোটোবেলায় মা মাসিদের পড়াশোনার ভার তাঁরই হাতে ছিল। আহা তাঁর কাছ থেকে কী যত্নই না পেয়েছি। মা বলেন আমি ভাদ্র মাসে জন্মেছিলাম। প্রচুর বৃষ্টি তখন। ছোটো শিশুর কাঁথা কাপড় শুকানোর জন্য দিদা বিশেষ ব্যবস্থা করতেন আর বলতেন ভাদ্র মাসে আমার ভাদুড়ী  এসেছে।  মনি নামটা মেজো মাসির দেওয়া। আমার জন্মের দিন নাকি রানীগঞ্জের কয়লা খনি থেকে মনি উদ্ধার হয়েছিল। তবে আমার জন্মস্থান বাগনানের গোহালবেড়িয়ায় আমি মামনি নামেই পরিচিত। সালেহা নামে কেউ চেনে না। এই নামটা আমার সেজো কাকার দেওয়া। তবে আমার মেজো মামা চেয়েছিলেন আমার নাম হোক ওয়াহিদা রহমান। কিন্তু নামকরণে পিতৃকুল জিতে যায় কেননা ওই নামেই রয়েছে আমার বড়ো পিসি সুফিয়ার তৃতীয়া কন্যা। শেষ পর্যন্ত  আমার পোস্টমাস্টার মামার স্বপ্ন পূরণ হয়েছিল আমি যখন ক্লাস সেভেনে পড়ি। ওই বছর মামার বিয়ে হয় আর আশ্চর্য মামিমার নাম ওয়াহিদা রহমান। মামিমা বি.এ. পার্ট ওয়ান পাশ। এখনো বাচ্চাদের স্কুলে পড়ান। 
আমার একটা গর্বের জায়গা যেটা আমাকে জীবনে বেশ তৃপ্তি  দেয় তা হলো আমার পূর্ব মহিলারা মা মাসি দিদা এঁরা সবাই শিক্ষিত। মায়ের কথাই বলি। মা বাগনানের ঠাকুরতলা প্রাইমারি স্কুলে পড়াশোনা সম্পূর্ণ করে ১৯৬৫-৬৬ সাল থেকে চন্দ্রভাগ বালিকা বিদ্যালয়ের পড়াশোনা করেন। ১৯৭১-৭২ এ পড়তে আসেন বাগনান কলেজে। কদিন আগে মা আফশোস  করছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়েও পড়তে পারতেন কিন্তু বড়ো মাসির মেয়েদের দেখভাল করতে গিয়ে নিজের সময় অনেকটাই নষ্ট করেছেন।  দুঃখ করছিলেন ২০২১ এ মা যখন নিজের স্বামীকে হারান সেই বোনঝিরা কেউ একবারও দেখা করতে আসেনি। মা তাঁর স্কুলের দিদিমণিদের কথাও বেশ মনে রেখেছেন। নলিনী ভৌমিক অঞ্জলি গঙ্গোপাধ্যায় প্রমুখের কথা এই ৭০ বছর বয়সেও সুন্দর করে বলেন। অঞ্জলি গঙ্গোপাধ্যায় হেড মিস্ট্রেস ট্রিপল এম. এ. ছাত্রীদের অত্যন্ত যত্ন করতেন। সেই সময়ে স্কুল থেকে মায়েদের দীঘাও নিয়ে গেছেন। স্কুলে নাচ গান সবই শেখানো হতো। সেই শিক্ষাতেই মা আমাদের ছোটোবেলায় নাচ গানের তালিম দিতেন-
 ও কর্মী উজলা ভাইয়ো 
   দিক  ধাইয়ো  কো  
      ভূপালী ভোলাইছো।
 দরজা বন্ধ করে এই গানের সঙ্গে নাচ শেখাতেন।
 আমি যখন মাতৃগর্ভে মায়ের বিশ্রামের জন্য ঠাকুরমা মাকে পাঠিয়ে দেন আমার দিদার কাছে। আমার জন্মের দু-তিন মাস পর আমাকে নিয়ে আসেন আমার পৈতৃক ভিটেতে।  সাহাপুর, হাওড়ায়। দাদীমা, ছোটোবাবু সদ্যোজাত  আমাকে দেখতে যান বাগনানে। বাবাও আমাকে দেখে ভীষণ খুশি। আমি মেয়ে হয়ে জন্মানোয় কেউই অসুখী হয়নি। সংসারের কাজকর্মের মধ্যেই মা আমাকে বড়ো করে তোলেন। ছোটো বয়স থেকেই বইপত্র কিনে পড়াতে শুরু করেন। পড়াশোনায়  আমার আগ্রহ ছিল।  মাঝে মাঝে দুষ্টুমি করতাম। মা বন্দী করে দিতেন । 

আড়াই বছর পরে বোন জন্ম নিল বোনকে আদর করতাম। তবে বোন হওয়ার পর মেজো মাসি আমার অনেক যত্ন করতেন। মেজো মাসির নাম ছিল বিলকিস বেগম। আমরা সবাই বলতাম বিলি মাসি। বোন যখন খুব ছোটো তখন আমার কানে কিছু একটা সমস্যা হয়েছিল যাতে হাসপাতালে পর্যন্ত যেতে হয়। মেজো মাসি হাসপাতালে নিয়ে গিয়ে চেকআপ করিয়ে আনতেন। আজ মেজো মাসি আর নেই। করোনার সময় তাঁর মৃত্যু হওয়ায় আমিও মেদিনীপুর থেকে ফুলেশ্বরে যেতে পারিনি। শেষ দেখা হয়নি। কিন্তু মেজো মাসির সঙ্গে অনেক স্মৃতি। মেজো মাসি ছোটোমামা আর আমার মা আমার যখন তিন বছর বয়স আর বোনের মাত্র ছ মাস আমাদের নিয়ে মেদিনীপুর শহরে এসেছিলেন। একদিন দুদিন থেকেও ছিলেন। আবছা আবছা মনে আছে সে সময়ের ঘটনা। যে বাড়িটায় ছিলাম সেই বাড়ির একটা পেয়ারা গাছ থেকে পেয়ারা পেড়ে বোনকে দিচ্ছিলাম। আর ছোটোমামা আমাকে কোলে নিয়ে এক অন্ধকার সুড়ঙ্গ পথে কোন এক মাজারে টর্চ জ্বেলে জ্বেলে যাচ্ছিলেন। মনে হয় জোড়া মসজিদের উরুষের সময় এসেছিলেন। অদ্ভুত যোগ মেদিনীপুরের সঙ্গে। এর প্রায় পঁচিশ বছর পর  মেদিনীপুরে আসি মেদিনীপুর কলেজে অধ্যাপনায় যোগ দিতে। সেই তিন বছর বয়সেই  কি ভবিতব্য নির্ধারিত হয়ে যায়?
 আমার যখন  ছবছর বয়স আমার ভাই জন্মালো। তখন থেকে ছোটোবেলার চিত্রটা বেশ উজ্জ্বল হয়ে আছে। ভাই, বোন ও আমি - আমরা তিনজনেই বাগনানে মামার বাড়িতে জন্মেছি। বোনের জন্মের সময়ের কোনো কথাই মনে নেই। কিন্তু ভাই যখন হল তখন মায়ের সঙ্গে মামার বাড়িতেই আছি। মা সারাদিন দিদার কাছে অনেক কাজ করেছিলেন। এমনকি মনে আছে মা বারান্দা/দালান/উসরা মাটি দিয়ে ভালো করে ন্যাতা দিয়েছিলেন। মাটি দিয়ে লেপে দেওয়া যাকে বলে আর কি। তারপর দাদুদের বিরাট পুকুরে যে পুকুরটা সারা অংশ হেঁটে বেড়ালেও পায়ে একটুও কাদা লাগতো না সেই পুকুরে মা দুপুরে স্নান করতে গিয়ে কানের সুন্দর দুল হারিয়ে ফেলেন।। দিদা মাকে দুঃখ করতে বারণ করেন বলেন "ভাবিস না। সোনা হারিয়েছিস সোনা পাবি। সোনা(সন্তান) আসছে তোর ঘরে।" তারপর সব কাজ শেষে দিদা বিকালে পুকুরে স্নান করতে গিয়ে অনেক দোয়া দরুদ পড়ে মায়ের কানের দুল খুঁজতে যান। আশ্চর্য দিদার পায়ের বুড়ো আঙুলের মাথায় মায়ের কানের দুলটা আটকে যায়। মা ফিরে পান তাঁর সুন্দর কানের দুলটা। 

 মন চলো নিজ নিকেতন। মায়ের হারিয়ে যাওয়া দুলটা পরে আবার হারিয়ে যায়।সে কথা পরে হবে। মায়ের যেদিন প্রকৃত সোনা এলো অর্থাৎ ভাই জন্মালো সেদিনের কথায় আবার ফিরে যাই। যে দালানটা আমার মা সুন্দর করে লেপেছিলেন সেখানে সন্ধ্যাবেলা ধর্মীয় অনুষ্ঠান হলো - কোরআন পাঠ, মিলাদ, প্রার্থনা ইত্যাদি। খাওয়া-দাওয়ার পর রাতে মায়ের সঙ্গে দুই বোন ঘুমিয়ে পড়লাম। ওমা রাত বারোটার সময় দেখি মা পাশে নেই। দাদু আমাদের নিয়ে রয়েছেন। মা চলে গেছেন পাশের ঘরে সন্তানের জন্ম দিতে।

(ক্রমশ)

Post a Comment

0 Comments