জ্বলদর্চি

সুবচনী /ভাস্করব্রত পতি

পশ্চিমবঙ্গের লৌকিক উৎসব, পর্ব - ৭১
সুবচনী

ভাস্করব্রত পতি

তখন কলিঙ্গ রাজ্যের সিংহাসনে উৎকল রাজাদের রাজত্ব। সেসময় সেই রাজ্যের বুকে এক গরীব ব্রাহ্মণী তাঁর একমাত্র ছেলেকে নিয়ে বসবাস করতেন। দিন আনা দিন খাওয়া অবস্থা। ব্রাহ্মণীর ছেলে রোজ পাঠশালায় যায় আর অন্য ছেলেদের নানা রকম খাবার দাবার খেতে দেখে। সে একদিন পাঠশালা থেকে এসে তাঁর মায়ের কাছে মাংস খাওয়ার ইচ্ছে প্রকাশ করে। তখন ব্রাহ্মণী তাঁর অপারগতার কথা জানায়। তাঁরা তো গরীব লোক। তাই তাঁর পক্ষে মাংস জোগাড় করা সম্ভব নয়। তখন ব্রাহ্মণীর ছেলে বললো, 'আমি নিজেই মাংস এনে দেবো'। পরের দিন খুব সকাল বেলা উঠে মাংস জোগাড় করতে সারা এলাকায় হন্যে হয়ে ছুটে বেড়ালো। 

সেই রাজ্যের রাজার পশুশালায় অনেক হাঁস ছিল। আর সেগুলি পাহারা দেওয়ার লোক নিযুক্ত ছিল। তাঁরা সবসময়ে পাহারা দিত সেগুলো। হাঁসগুলো রোজই সারাদিন বিভিন্ন পুকুরে চরে সন্ধ্যের সময়ে ঘরে ফিরে আসতো। একদিন হাঁসগুলো সন্ধ্যায় যখন তাঁদের বাসস্থানে ফিরে আসছিল, তখন একটা খোঁড়া হাঁস সকলের পিছনে যাচ্ছিল। ব্রাহ্মণীর ছেলে সেটাকে ধরে আছাড়ে মেরে ফেললো। আর তাঁর মাকে এনে দিল। তারপর সেই হাঁসটাকে রান্না করে খেয়ে ফেললো।

এদিকে, রাজা রোজই তাঁর হাঁসগুলোকে একবার করে দেখতেন। সেদিন তিনি দেখতে পেলেন যে, খোঁড়া হাঁসটাই নেই। তখন সেই খোঁড়া হাঁসটাকে খুঁজে আনবার জন্য সকল হাঁস পালকদের হুকুম দিলেন। হাঁসটা কোথায় গেল, খুঁজে আনা চাই। তাঁরাও চারিদিকে খুঁজতে লাগলো। কিন্তু হাঁসের কোনো সন্ধান পেল না।

অবশেষে সেই ব্রাহ্মণীর বাড়ির কাছ দিয়ে যাওয়ার সময় হাঁসপালকরা দেখতে পেল যে, ব্রাহ্মণীর বাড়ির পেছনের আস্তাকুঁড়ে তে হাঁসের কিছু পালক পড়ে রয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে তাঁরা ব্রাহ্মণীর ছেলেকে গ্রেফতার করে রাজ দরবারে নিয়ে গেল। ঘটনা শুনে প্রচণ্ড ক্রুদ্ধ রাজা তৎক্ষণাৎ হুকুম দিলেন, 'এই নরাধমকে অবিলম্বে কারাগারে আটকে ওঁর বুকে পাথর চাপিয়ে দাও।' তাই শুনে ব্রাহ্মণী তো ভয়ে কাঠ। অনাগত ভবিষ্যতের কথা ভেবে প্রচণ্ড কান্নাকাটি শুরু করলো। সেদিন তাঁদের এলাকায় সুবচনীর পুজো চলছিল। তা জানতে পেরে ব্রাহ্মণী সেখানে হাজির। কাঁদতে কাঁদতে মনে মনে প্রার্থনা জানাল যে, তাঁর ছেলে এখন রাজ কারাগারে বন্দী আছে। যদি তাঁর ছেলে ছাড়া পেয়ে বাড়ি ফিরে আসে, তাহলে সে সুবচনীর পুজো করবে। 

দেবী সুবচনী ব্রাহ্মণীর কান্না আর কাতর ডাক শুনতে পেল। তাঁর খুব দয়া হল। তারপর রাজা যখন রাত্তিরে ঘুমোচ্ছিলেন, তখন সেখানে গিয়ে স্বপ্নে রাজাকে বললেন, 'শোন, খোঁড়া হাঁস খেয়েছে বলে যাঁকে তুই বন্দী ক'রে রেখেছিস, সে আমার পূজা করে। তাঁকে এখনি সসম্মানে মুক্তি দিয়ে তোর কন্যার সাথে বিয়ে দে। সেইসাথে রাজ্যও তাঁকে সঁপে দে। যদি এটা না করিস, তবে তোর রাজ্য এখনই ধ্বংস হয়ে যাবে।' স্বপ্ন শেষ হতেই রাজার ঘুম ভেঙে গেল। তিনি ধড়ফড়িয়ে উঠে ব্রাহ্মণীর ছেলেকে কারাগার থেকে এনে তাঁর কাছে ক্ষমা চাইলেন। আর তাঁকে রাজসিংহাসনে বসিয়ে দিলেন। শেষে রাজকন্যার সঙ্গে ব্রাহ্মণীর সেই ছেলেকে বিয়েও দিলেন। অবশেষে ছেলে তাঁর নতুন বৌকে নিয়ে বাড়ি এলো। মাকে প্রণাম করে, মায়ের সামনে হাত জোড় করে দাঁড়ালো দুজনে। ব্রাহ্মণী তখন মহাখুশি হয়ে উঠোনে জল ছিটিয়ে ছেলে ও বৌমাকে বরণ করে ঘরে নিয়ে গেল। এবং তারপর থেকে সুবচনীর পুজো শুরু করলো। 

এই হল সুবচনী পূজোর কাহিনী। এই সুবচনী ব্রতের কোনো নির্দিষ্ট সময় নেই। সাধারণত, বাড়িতে যে কোনো মঙ্গল অনুষ্ঠানকে সামনে রেখে সুবচনীর পূজা করা হয়। আমপাতা দেওয়া ঘট, খই, নাডু, আমডাল, সুপুরি, পিটুলি, তিল, সিঁদুর, আর দক্ষিণা লাগে এই ব্রতর উপচারে। 

'সুবচনী' স্ত্রী [ন + স্ত্রী ঈ ( ভীষ)] ( গোপীচন্দ্র, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, ১৯২২)। সুবচনী হলেন এক ধরনের দেবী বিশেষ। অর্থাৎ শুভচণ্ডী। আর 'শুভচণ্ডী' অর্থে যাঁহার বাক্য সফল। স্ত্রীপূজ্য দেবীবিশেষ। [স্ত্রীলোকেরা বিপদে ইঁহার পূজা মানসিক করেন। আচারমার্তণ্ডে ‘শুভসূচনী' নাম আছে।] 'লীলাবতী'তে আছে 'সুবচনীর কথা'। অর্থাৎ সুবচনী দেবীর পূজা প্রচারের বৃত্তান্ত। সংস্কৃতে বলে 'শুভসূচনী'। 

মূলতঃ বাড়ির উঠোনের মধ্যে চারকোণা একটা ঘর কাটতে হয়। সেখানে আলপনা দিয়ে, পাশাপাশি চারজোড়া হাঁস আঁকতে হয় এরপর। আমপাতা দিয়ে সুন্দর করে ঘট বসানো হয়। সেখানে একটি ছোট গর্ত খুঁড়ে তাতে দুধ ভরতি করা হয়। পূজো শেষের আগে শাঁখ বাজাতে হয়। বাড়ির নব বিবাহিত বর বধূর কল্যাণেই এই পুজো হয়। পুজোর শেষে, এয়োস্ত্রীদের পান, কলা, তিলের নাড়ু, খই ও সিঁদুর দিতে হয়। সবশেষে সারি করে সধবা মেয়েদের এক যায়গায় দাঁড় করিয়ে ব্রতকারিণী তাঁদের পায়ে জল ঢেলে তাঁর আঁচল দিয়ে মুছিয়ে দেবে। সেই ভেজা কাপড়ের আঁচল নববিবাহিত ছেলে বৌয়ের মাথায় বুলিয়ে দেবে। এতে নাকি তাঁদের মঙ্গল হয়। এবার প্রসাদ সকলকে বিলি করতে হয়। পুরোহিতকে দেওয়া হয় সাধ্যমতো দক্ষিণা। সবশেষে নতুন বৌ জল ভরা কলসী কাঁধে নিয়ে ঘরে নিয়ে যাবে এবং সবাই ব্রতকথা শুনবে।
জ্বলদর্চি অ্যাপ ডাউনলোড করে নিন।👇




Post a Comment

0 Comments