পর্ব ৭৪
শ্রীরামকৃষ্ণের সন্ন্যাসী সন্তানেরা
প্রীতম সেনগুপ্ত
বিলে তখন যুবক। কলেজে পাঠরত। নরেন্দ্রনাথ। কথামৃতকার শ্রীম'র বর্ণনায় --“...দেখিতে দেখিতে রবিবার আসিয়া পড়িল। বরাহনগরের নেপালবাবুর সঙ্গে বেলা ৩টা-৪টার সময় তিনি দক্ষিণেশ্বরের বাগানে আসিয়া পৌঁছিলেন। দেখিলেন, সেই পূর্বপরিচিত ঘরের মধ্যে ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ ছোট তক্তপোশের উপর বসিয়া আছেন। ঘরে একঘর লোক। রবিবারে অবসর হইয়াছে, তাই ভক্তেরা দর্শন করিতে আসিয়াছেন। এখনও মাস্টারের সঙ্গে কাহারও আলাপ হয় নাই, তিনি সভামধ্যে একপার্শ্বে আসন গ্রহণ করিলেন। দেখিলেন, ভক্তসঙ্গে সহাস্যবদনে ঠাকুর কথা কহিতেছেন।
একটি ঊনবিংশতিবর্ষ বয়স্ক ছোকরাকে উদ্দেশ করিয়া ও তাঁহার দিকে তাকাইয়া ঠাকুর যেন কত আনন্দিত হইয়া অনেক কথা বলিতেছিলেন। ছেলেটির নাম নরেন্দ্র। কলেজে পড়েন ও সাধারণ ব্রাহ্মসমাজে যাতায়াত করেন। কথাগুলি তেজঃপরিপূর্ণ। চক্ষু দুটি উজ্জ্বল। ভক্তের চেহারা।
মাস্টার অনুমানে বুঝিলেন যে, কথাটি বিষয়াসক্ত সংসারী ব্যক্তির সম্বন্ধে হইতেছিল। যারা কেবল ঈশ্বর ঈশ্বর করে, ধর্ম ধর্ম করে তাদের ওই সকল ব্যক্তিরা নিন্দা করে। আর সংসারে কত দুষ্ট লোক আছে, তাদের সঙ্গে কিরূপ ব্যবহার করা উচিত -- এ-সব কথা হইতেছে।
নরেন্দ্র -- আমি মনে করব কুকুর ঘেউ ঘেউ করছে।
শ্রীরামকৃষ্ণ ( সহাস্যে )-- না রে, অত দূর নয়। ( সকলের হাস্য ) ঈশ্বর সর্বভূতে আছেন। তবে ভাল লোকের সঙ্গে মাখামাখি চলে; মন্দ লোকের কাছ থেকে তফাৎ থাকতে হয়। বাঘের ভিতরেও নারায়ণ আছেন; তা বলে বাঘকে আলিঙ্গন করা চলে না। ( সকলের হাস্য ) যদি বল বাঘ তো নারায়ণ, তবে কেন পালাব। তার উত্তর -- যারা বলছে ‘পালিয়ে এস’ তারাও নারায়ণ, তাদের কথা কেন না শুনি?” ( শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ কথামৃত, শ্রীম-কথিত, অখণ্ড, পৃ: ২১-২২, উদ্বোধন কার্যালয় )
আবার দেখতে পাওয়া যায় নরেন্দ্র'র সঙ্গে হোমাপাখির তুলনা করছেন ঠাকুর। বলছেন --“এই ছেলেটিকে দেখছ, এখানে একরকম। দুরন্ত ছেলে বাবার কাছে যখন বসে, যেমন জুজুটি, আবার চাঁদনিতে যখন খেলে, তখন আর এক মূর্তি। এরা নিত্যসিদ্ধের থাক। এরা সংসারে কখনও বদ্ধ হয় না। একটু বয়স হলেই চৈতন্য হয়, আর ভগবানের দিকে চলে যায়। এরা সংসারে আসে লোকশিক্ষার জন্য। এদের সংসারের বস্তু কিছু ভাল লাগে না -- এরা কামিনীকাঞ্চনে কখনও আসক্ত হয় না।
বেদে আছে হোমাপাখির কথা। খুব উঁচু আকাশে সে পাখি থাকে। সেই আকাশেতেই ডিম পাড়ে। ডিম পাড়লে ডিমটা পড়তে থাকে -- কিন্তু এত উঁচু যে, অনেকদিন থেকে ডিমটা পড়তে থাকে। ডিম পড়তে পড়তে ফুটে যায়। তখন ছানাটা পড়তে থাকে। পড়ত পড়তে তার চোখ ফোটে ও ডানা বেরোয়। চোখ ফুটলেই দেখতে পায় যে, সে পড়ে যাচ্ছে, মাটিতে লাগলে একেবারে চুরমার হয়ে যাবে। সে পাখি মার দিকে একেবারে চোঁচা দৌড় দেয়, আর উঁচুতে উঠে যায়।” ( শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ কথামৃত, শ্রীম-কথিত, অখণ্ড, পৃ: ২৬-২৭, উদ্বোধন কার্যালয় )
শ্রীম অনিন্দ্যসুন্দর দিব্য মুহূর্তের বর্ণনায় প্রয়াসী হয়েছেন। যার কেন্দ্রবিন্দুতে শ্রীরামকৃষ্ণ ও নরেন্দ্রনাথ। তিনি লিখছেন --“সভা ভঙ্গ হইল। ভক্তেরা এদিক ওদিক পায়চারি করিতেছেন। মাস্টারও পঞ্চবটী ইত্যাদি স্থানে বেড়াইতেছেন, বেলা আন্দাজ পাঁচটা। কিয়ৎক্ষণ পরে তিনি শ্রীরামকৃষ্ণের ঘরের দিক আসিয়া দেখিলেন, ঘরের উত্তরদিকের ছোট বারান্দার মধ্যে অদ্ভুত ব্যাপার হইতেছে!
শ্রীরামকৃষ্ণ স্থির হইয়া দাঁড়াইয়া আছেন। নরেন্দ্র গান করিতেছেন, দুই-চারিজন ভক্ত দাঁড়াইয়া আছেন। মাস্টার আসিয়া গান শুনিতেছেন। গান শুনিয়া আকৃষ্ট হইয়া রহিলেন। ঠাকুরের গান ছাড়া এমন মধুর গান তিনি কখনও কোথাও শুনেন নাই। হঠাৎ ঠাকুরের দিকে দৃষ্টিপাত করিয়া অবাক্ হইয়া রহিলেন। ঠাকুর দাঁড়াইয়া নিস্পন্দ, চক্ষুর পাতা পড়িতেছে না; নিঃশ্বাস-প্রশ্বাস বহিছে কি না বহিছে! জিজ্ঞাসা করাতে একজন ভক্ত বলিলেন, এর নাম সমাধি। মাস্টার এরূপ কখনও দেখেন নাই, শুনেন নাই। অবাক্ হইয়া তিনি ভাবিতেছেন, ভগবানকে চিন্তা করিয়া মানুষ কি এত বাহ্যজ্ঞানশূন্য হয়? না জানি কতদূর বিশ্বাস-ভক্তি থাকলে এরূপ হয়। গানটি এই:
চিন্তয় মম মানস হরি চিদ্ঘন নিরঞ্জন।/ কিবা, অনুপমভাতি, মোহনমূরতি, ভকত-হৃদয়-রঞ্জন।/ নবরাগে রঞ্জিত, কোটি শশী-বিনিন্দিত;/ ( কিবা ) বিজলি চমকে, সেরূপ আলোকে, পুলকে শিহর জীবন।
গানের এই চরণটি গাহিবার সময় ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ শিহরিতে লাগিলেন। দেহ রোমাঞ্চিত! চক্ষু হইতে আনন্দাশ্রু বিগলিত হইতেছে। মাঝে মাঝে যেন কি দেখিয়া হাসিতেছেন। না জানি ‘কোটি-শশী-বিনিন্দিত’ কী অনুপম রূপদর্শন করিতেছেন! এরই নাম কি ভগবানের চিন্ময়-রূপ দর্শন? কত সাধন করিলে, কত তপস্যার ফলে, কতখানি ভক্তি-বিশ্বাসের বলে, এরূপ ঈশ্বর-দর্শন হয়? আবার গান চলিতেছে:
হৃদি কমলাসনে ভজ তাঁর চরণ,/ দেখ শান্ত মনে, প্রেম নয়নে, অপরূপ প্রিয়দর্শন! আবার সেই ভুবনমোহন হাস্য! শরীর সেইরূপ নিস্পন্দ! স্তিমিত লোচন! কিন্তু কি যেন অপরূপ রূপদর্শন করিতেছেন! আর সেই অপরূপ রূপদর্শন করিয়া মহানন্দে যেন ভাসিতেছেন! এইবারে গানের শেষ হইল। নরেন্দ্র গাহিলেন: চিদানন্দ রসে ভক্তিযোগাবেশে, হও রে চিরমগন।/ ( চিদানন্দরসে, হায় রে ) ( প্রেমানন্দরসে )।।
সমাধির ও প্রেমানন্দের এই অদ্ভুত ছবি হৃদয়মধ্যে গ্রহণ করিয়া মাস্টার গৃহে প্রত্যাবর্তন করিতে লাগিলেন।” ( শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ কথামৃত, শ্রীম-কথিত, অখণ্ড, উদ্বোধন কার্যালয়, পৃ: ২৮ )
বহুপ্রতিভাসম্পন্ন ছিলেন নরেন্দ্রনাথ। তার মধ্যে অন্যতম সঙ্গীতপ্রতিভা। এই বিষয়ে স্বামী প্রজ্ঞানানন্দ লিখছেন -- “উচ্চাঙ্গগণিতের মতো উচ্চাঙ্গসঙ্গীতের প্রতি তাঁর আগ্রহ সমধিক। তাই স্বামী বিবেকানন্দ শুধুই শাস্ত্রবেত্তা, ধর্মসেবী, পরিব্রাজক, প্রচারক, সাধক ও অধ্যাত্ম-তত্ত্বদ্রষ্টাই ছিলেন না, ছিলেন তিনি সাহিত্যিক, ঐতিহাসিক, শিল্পী, বৈজ্ঞানিক ও সঙ্গীতজ্ঞানকুশলী। তাছাড়া রন্ধনবিদ্যা, দাবাখেলা, নাটকানুষ্ঠান ও অভিনয়, বিভিন্ন ক্রীড়া ও ব্যায়াম, নৌকাচালানো, লাঠি ও অসিচালনা প্রভৃতি বিষয়েও তিনি দক্ষতা অর্জন করেছিলেন। আবাল্য ছিলেন তিনি মেধাবী, তেজস্বী, প্রত্যুৎপন্নমতি, প্রখরবুদ্ধিসম্পন্ন ও সহৃদয়, -- যেজন্য সকল রকম শিক্ষা ও অভিজ্ঞতার পথকে করেছিলেন তিনি সমুজ্জ্বল ও সুষমায়িত।” ( সঙ্গীতপ্রতিভায় স্বামী বিবেকানন্দ, স্বামী প্রজ্ঞানানন্দ প্রণীত, শ্রীরামকৃষ্ণ বেদান্ত মঠ, পৃ: ১১-১২ )
0 Comments