কালিম্পং ডায়েরি
পর্ব-২
সুমিত্রা মাহাত
যাওয়ার দু-একদিন আগে এক কান্ড ঘটে যায় । আগের দিন আমার একটা পরীক্ষা ছিল । বনধ এর কারণে তা হুমড়ি খেয়ে পড়ে , যাওয়ার দিনে। যথেষ্ট চিন্তার বিষয় । রাত্রি ন টা বেজে চল্লিশ মিনিটে ট্রেন, কলকাতা স্টেশন থেকে । ঝাড়গ্রাম থেকে সময়ের মধ্যে কলকাতা পৌঁছানো মুখের কথা নয় । এ বনগাঁ লাইন নয় যে দশ-পনেরো মিনিট অন্তর সমস্যার সমাধান হয়ে যায় । সবেধন নীলমণি কয়েকটি ট্রেন টিম্ টিম্ করে চাকুরীজীবী তথা আপামর জনসাধারণের মান সম্মান বাঁচিয়ে রেখেছে । তার মধ্যে আবার সব ট্রেন সব দিন চলে না । টিকিট কাটা রয়েছে ইন্টারসিটি তে । তবে যতটুকু বুঝতে পারছি আমার দল থেকে বিচ্ছিন্ন হবার সম্ভাবনা প্রবল। ট্রেনের সময় ও পরীক্ষার সময়ের মধ্যে সংঘর্ষ বাধতে থাকে । আমি বুদ্ধি আঁটতে থাকি সমতা আনা যায় কীভাবে । ঠিক হয় হাজব্যন্ড ছেলে মেয়ে ইন্টারসিটিতে গিয়ে হাওড়া স্টেশনে অপেক্ষা করবে । আমি পরীক্ষা দিয়ে বেরোনোর আগেই ভোলানাথ ড্রাইভার এর সঙ্গে গাড়ি নিয়ে উপস্থিত থাকবে । বেরোনোর সঙ্গে সঙ্গেই ছোঁ মেরে নিয়ে গিয়ে পৌঁছে দেবে খড়গপুর স্টেশনে । আর সেখানে পৌঁছানো মানেই আর কোন চিন্তা নেই । দুনিয়ার ট্রেন এসে জড়ো হয় এখানে , অতএব মুশকিল আসান হবেই । এ প্রসঙ্গে বলে রাখি হাজব্যন্ড বলে দিয়েছে যেখানেই যাই দেশলাই বাক্স ও প্যান্ডোরার বাক্স সাথে নিতে হবে । লাগেজ এর দায়িত্ব যে যার । তাই করতে হয় ।
ঝাড়গ্রাম থেকে যে দল কালিম্পং যাচ্ছে সেই প্রসঙ্গে কিছু বলা প্রয়োজন । যারা খেলতে যাচ্ছে সবাই অভিজিৎ স্যার এর ছাত্র-ছাত্রী । ঝাড়গ্রামে যে কজন মানুষ শরীর চর্চার আঙিনা কে আলোকিত করে রেখেছেন ইনি তাঁদের মধ্যে অন্যতম । শরীর চর্চা ও একধরনের সাধনা । কিকবক্সিং এর প্রতি রয়েছে তাঁর গভীর অনুরাগ । প্রতিটি ছাত্র-ছাত্রী কে তিনি যেভাবে আন্তরিক ভালোবাসা ও নিষ্ঠা সহকারে শারীরিক ও মানসিক শক্তি লাভের পথ দেখান বর্তমান দিনে তা কম দেখা যায় । রয়েছে পঁচিশ জন প্রতিযোগী ও তাদের বাবা,মা,ভাই, বোন সব মিলিয়ে মোট বাহান্ন জন । একেবারে হৈহৈ-রৈরৈ কান্ড, যদিও যাওয়ার দিন কলকাতা পর্যন্ত আমি তাতে অংশ নিতে পারিনি ।
যাওয়ার দিনে আমার বেহাল অবস্থার একটু বর্ণনা দেওয়া দরকার । ভ্রমণ কাহিনীতে আমি ইঁট , কাঠ ,পাথর ,পাহাড়-পর্বত কোনকিছুকেই বাদ দিতে চাই না । মানুষের মনকে নিয়ন্ত্রণ করার ওষুধ বিজ্ঞানীরা এখনও তেমনভাবে আবিষ্কার করতে পারেন নি অতএব বর্ষার পেখম ঢালা ময়ূরের মতো মনকে নদীর স্বাভাবিক গতিপথে স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে বয়ে যেতে দিতে চাই ।
ছেলে , মেয়ে রেডি হতে থাকে , আমি ঘন্টা দেড়েক আগে বেরিয়ে যাই , ঝাড়গ্রাম থেকে উত্তরে ৬-৭ কি.মি. যাবো । প্রায় এক ঘন্টা আগেই পরীক্ষা কেন্দ্রের গেটে হাজির হই । সময়ের অনেক আগে পৌঁছেছি তাই ভেতরে যেতে ইচ্ছে হয় না । গেট থেকে কিছুটা দূরে একটি যাত্রী প্রতীক্ষালয় , সেখানে অনেক ছেলে-মেয়ে বসে গোলমাল করছে । তারা পরীক্ষার্থী ।পূর্বমেদিনীপুর, পশ্চিম মেদিনীপুর, কলকাতা ,চব্বিশ পরগনার নানা জায়গা থেকে এসেছে , তাদের কথা বার্তা তেই তা উঠে আসছে । জীবনে কোন কঠিন পরিস্থিতি তেই আমি কোন চাপ নিই নি । ছোট বেলায় মা চিৎকার করত " ইয়ার দুনিয়া ড্যুবল্যে এক হাঁঠু" । সারাবছর পড়তাম আর পরীক্ষার আগের দিন আরামে ঘুমাতাম ।
আজকের দিনটাও তাই । সকাল থেকেই ফুরফুরে মেজাজে রয়েছি । আমি সামনের একটা বন্ধ দোকানের পাশে ফাঁকা বাঁধানো জায়গায় বসি , চারপাশের পরিবেশ উপভোগ করতে থাকি । বাবা,মা পরিবেষ্টিত হয়ে একটি মেয়ে এগিয়ে আসতে থাকে । তারা এমনভাবে মেয়েটিকে প্রভাবিত করছে যেকোন মূল্যে যেন সেই জয়ী হয় । হঠাৎ একটি ছেলেও এসে তাদের সঙ্গে জুটে যায় । পরীক্ষা দিতে এসেই তাদের আলাপ । টাকা পয়সা সেটিং ইত্যাদি নিয়ে এমন বিশ্রী আলোচনা শুরু করে দেয় , আমার ভালো লাগে না । এটা কুড়মী অধ্যুষিত গ্রাম । রাস্তার ধারে দু-চারটা দোকানদানি । কোনটা খোলা , কোনটা বন্ধ । আচমকা এত মানুষের আগমনে হতচকিত হয়ে তারাও নিজেদের মধ্যে সরস আলোচনা জুড়ে দিয়েছে ।
যাইহোক যথা সময়ে পরীক্ষা শুরু হয় । হল থেকে বেরোনোর সাথে সাথেই সটান হাজির ভোলানাথ । যেমন কথা তেমন কাজ । দশ মিনিটের ব্যবধানে ব্যাগসহ আমাকে গাড়িতে টেনে তোলে । প্রচন্ড রোদে গরমে আমার গা গোলাতে থাকে । সে জানায় ইন্টারসিটি প্রায় দেড় ঘন্টা লেট । মাত্র কিছুক্ষণ আগে সবাই ট্রেনে চেপেছে। কোনমতে খড়গপুর স্টেশন পৌঁছানোই এখন একমাত্র ভাবনা ।
গাড়ির ড্রাইভার রুমার হাজব্যন্ড। একেবারে জেন্টলম্যান । যতটা তাড়াতাড়ি সম্ভব নিজ দায়িত্বে সঠিক সময়ে স্টেশন পৌঁছে দেয় । রুমা আমাদের তত্ত্বাবধানে বড়ো হয়েছে । পড়াশোনার প্রতি আগ্রহ থাকায় কিছু পজিটিভ মেন্টালিটির মানুষের সাথে ও জুড়ে থেকেছে সবদিন। সুন্দর স্বভাবের জন্য ই সব জায়গায় সে আদৃত ।
গাড়িতে বসেই আমার রুটি কালাকান্দ খেয়ে নেওয়ার কথা । টিফিন বাক্স ফেরৎ পাঠাতে হবে , নেওয়ার জায়গা নেই । প্রখর তাপ গরম বাতাসের হল্কা য় আমি ক্রমশ নেতিয়ে পড়ি । কথা বলতেও ভালো লাগে না । এ বছর গরম খুব বেশি । ৪১-৪২-৪৩ ডিগ্রী, তাপমাত্রা কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে কে জানে ! কর্কট রোগ যেমন একজায়গায় ঘাঁটি গেড়ে , ডালপালা বিস্তার করে ধীরে ধীরে সমগ্র মানব শরীর কে গ্রাস করে নেয় , পরিণতি নিশ্চিত মৃত্যু , এক্ষেত্রে সময় খুব গুরুত্বপূর্ণ । তেমনই আধুনিক সভ্যতার করাল গ্রাসে অসহায় পৃথিবী প্রতি মুহূর্তে একটু একটু করে ডুবে যাচ্ছে , পরিণতি নিশ্চিত মৃত্যু , এক্ষেত্রেও সময় খুব ই গুরুত্বপূর্ণ । এখনও সময় আছে , দুঃখের বিষয় পরিবেশ রক্ষায় তেমন দৃষ্টান্তমূলক ভাবনা বা পদক্ষেপ এখনও কারো নেই। পাখির সংখ্যা কমে যাওয়ার ফলে স্বাভাবিক ভাবে গাছ পালা আর তেমন বাড়ছে না । একেকটা প্রাণী বিলুপ্ত হচ্ছে আর হাড় হিম হয়ে যাচ্ছে , এই বোধ হয় আমাদের পালা !
যাইহোক গাড়ি থেকে নেমেই ভোলানাথ লিফট এর দিকে হাঁটা দেয় । একজন দায়িত্বশীল পুলিশ কর্মী পাকড়াও করে আমাদের ড্রাইভারকে। লিফট টি চারদিক কভার করা , আমার দমবন্ধ লাগে । মোবাইল অ্যাপে লোকাল ২ নং প্ল্যাটফর্ম এ দেখালেও লাইন ফাঁকা । দৈনন্দিন ব্যবসার সাথে যুক্ত থাকা এক মাঝবয়সী মহিলা দেখিয়ে দেয় আমাদের অনেক টা এগিয়ে যেতে হবে । গাঁদা , রজনীগন্ধা ফুল , গুগলী, সিজ্নাল শাকসব্জি এমনকি নিমপাতা , বেলপাতা, আকন্দফুল ইত্যাদির ব্যবসার সাথে যুক্ত এই মাঝবয়সী মহিলাদের আমি খুব সাপোর্ট করি । হা-পিত্যেশ করে স্বামী-সন্তানের করুণার ভিখারী হয়ে বসে না থেকে , নিজের বুদ্ধি , শক্তি যেটুকু আছে তা কাজে লাগিয়ে তারা নিজেরা সচ্ছল হয় , সংসারেও সাহায্য করে । মেলামেশা করে দেখেছি কি অসীম ধৈর্য্য এদের ! কত কঠিন পরিস্থিতির সাথে বুক চিতিয়ে একাই লড়াই করে । ডেইলি প্যাসেঞ্জার রা যদিও এদের ধারালো মুখের ই গুণগান করে , আমি মনে করি টিকে থাকার জন্য এটুকু প্রয়োজন ।
একদম ফাঁকা ট্রেন, হাতে গোনা দু-চারজন । সামনের ভদ্রলোক কে লক্ষ্য রেখে, ফাঁকা সীটে আমি জানালার ধারে গিয়ে বসি । ব্যাগ থেকে সুতির ওড়না বের করে মুড়ে নিই নিজেকে । ঠান্ডা বাতাস রোদ গরম সবই আটকাবে । এভাবে সম্পূর্ণ একা যাই নি কখনো । কোনোমতে দুটো রুটি একটু মিষ্টি মুখে দিই । খাওয়া শেষ করে টিফিন বাক্স সহ ভোলানাথ কে হাসিমুখে বিদায় করি ।
0 Comments