পশ্চিমবঙ্গের লৌকিক উৎসব, পর্ব -- ৭৬
জিতাষ্টমী
ভাস্করব্রত পতি
এক সময় এক দেশে শালিবাহন নামে একজন ধার্ম্মিক রাজা ছিলেন। রাজা রাণী দুঃখ করতেন ছেলেমেয়ে নেই বলে। কত মাদুলী, কত কবচ, কত হোম, কত যাগযজ্ঞ করলেন, কিন্তু কিছুতেই কিছু হল না। সেই জন্যে রাজা রাণী তাঁদের অগাধ সম্পত্তিতেও সুখী ছিলেন না।
একদিন রাত্রে রাণী স্বপ্ন দেখলেন যে, হাঁসের পিঠে চড়ে একজন দেবতা বলছেন, “রাণী, তুমি জিতাষ্টমীর ব্রত কর, তাহলেই তোমার ছেলে হবে"। ঘুম ভাঙতেই রাজাকে স্বপ্নের কথা সব বলেন রাণী। রাজা আশ্বিন মাসের কৃষ্ণা অষ্টমীর দিন উঠোনে একটি ছোট পুকুর কাটিয়ে পুকুরের মাঝখানে কলাগাছ আর বেলগাছ পুঁতে, মটর ও ফলের নৈবেদ্য দিলেন। রাজা রাণী সমস্ত দিন উপোস থেকে জিতাষ্টমীর পূজো করে একটি পুত্র আর একটি কন্যা বর চেয়ে নিলেন।
পুত্রের নাম জীমূতবাহন, আর কন্যার নাম সুশীলা রাখা হল। তারপর ছেলেমেয়ে বড় হলে বিয়ে দিলেন। এদিকে ছেলের বউয়ের যত ছেলেপুলে হয়, সব মারা যায়। শাশুড়ী যখন উঠোনে পুকুর কেটে জিতাষ্টমীর ব্রত করতো, তা দেখে বউমা খুব ঠাট্টা তামাশা করতো। আর সেই পাপেই বউয়ের ছেলেপুলে মারা যেতো।
এক বছর আশ্বিন মাসে শাশুড়ী বাড়ির উঠোনে যখন পুকুর কেটে জিতাষ্টমী পুজোর আয়োজন করছে, বউমা তখন শাশুড়িকে বলে “মা, এখনও কি তোমার ছেলেখেলা গেল না”? তখন শাশুড়ী বলল, “এস বউমা, তুমিও জিতাষ্টমীর পূজো করবে এসোএসো। তা'হলে দেখবে, আর তোমার ছেলেপুলে মরবে না”। বউ অট্টহাসি হেসে বলে, “না মা, ঐ ধরনের ছেলেখেলা আমি করতে পারবো না”। শাশুড়ী তখন সেই স্বপ্নের কথা জানায় বৌমাকে। তখন বউমার একটু ভয় করতে লাগলো। মানসিক পরিবর্তন ঘটল তাঁর। শাশুড়ীর কথানুযায়ী তখন ভক্তি ক'রে শাশুড়ীর সঙ্গে জিতাষ্টমীর পূজো করতে শুরু করল।
এরপরই ঘটল সেই অভাবনীয় ঘটনা। সেই বউমার ছেলে মেয়ে হল। কিন্তু আর ছেলেমেয়ে মরল না। জীমূতবাহন খুব ধুমধাম করে জিতাষ্টমীর ব্রত প্রচার করা শুরু করল। সেই থেকে জিতাষ্টমীর পূজা দেশে দেশে প্রচার হলো।
এই জিতাষ্টমী লৌকিক উৎসবটি আয়োজিত হয় আশ্বিন মাসের কৃষ্ণপক্ষের অষ্টমী তিথিতে। সেদিন বাড়ির উঠোনে ছোট একটি পুকুর কাটাতে হয়। তার মাঝখানে একটা কলাগাছ ও একটা বেলগাছ পুঁতে দিতে হয়। তারপর সারাদিন উপোস করে থেকে, সন্ধ্যেবেলায় জীমূতবাহনের পুজো করতে হয় মটর কড়াই ও ফলের নৈবেদ্য দিয়ে। পুজোর শেষে সেই প্রসাদ ব্রতী নিজে খাবে ও অন্যান্য সকলকে খাইয়ে উপরের ব্রতকথাটি শুনবে।
'জিতাষ্টমী' আসলে জীমূতবাহন দেবতার পূজা। কুড়মালি “জিতিআ” শব্দের অর্থ জননী বা মা। সারাদিন উপবাসে থেকে সধবা মহিলারা তাঁদের আদিমাতা ষষ্ঠীদেবীর পূজা (জিতা ষাইঠ) করেন মাতৃত্বের স্বাদ পেতে। শশা বা ক্ষীরাকে কাঁখ (কোল) হড় (মানুষ/সন্তান) হিসাবে ব্যবহার করা হয়। সধবা স্ত্রীলোকেরা সন্তানের কামনায় আশ্বিন মাসের কৃষ্ণপক্ষের অষ্টমী তিথিতে সন্ধ্যের সময় এটি পালন করে। এতে প্রয়োজন হয় নানারকমের ফল, ভেজানো মটর কড়াই, আতপ চাল, নানা নৈবেদ্য, ধূপ, দীপ, ফুল ইত্যাদি।
যেদিন জিতাষ্টমীর পূজা হয়, তার পরের দিন তথা কৃষ্ণানবমীতে কোথাও কোথাও শারদীয়া দুর্গাপূজার প্রথম বোধন শুরু হয়। এই উৎসবটি 'জিতা' বা 'বড়ষষ্ঠী' নামেও পরিচিত।
দীর্ঘ তিরিশ বছর ধরে নিয়মিত : জ্বলদর্চি।
জ্বলদর্চি অ্যাপ ডাউনলোড করে নিন।👇
🍂
0 Comments