জ্বলদর্চি

ভোলগা নদীর খোঁজে – ৪/ বিজন সাহা


ভোলগা নদীর খোঁজে – ৪ 

বিজন সাহা

তরঝক 

তভের শহরের ৬৩ কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমে তভেরৎসা নদীর পাশে গড়ে ওঠা জনপদ তরঝকের অবস্থান ভালদাই মালভুমির পাদদেশে। আগে যেহেতু নদী পথই ছিল ব্যবসা বানিজ্যের প্রধান উপায় – তাই জনপদ বা বানিজ্য কেন্দ্র গড়ে উঠত কোন না কোন নদীর ধারে। শহরকে দুই ভাগে বিভক্ত করে বয়ে যাচ্ছে তভেরৎসা নদী। রাশিয়ার অন্যতম প্রাচীন শহরের একটি এই তরঝক ঠিক কবে ও কারা প্রতিষ্ঠা করেছিল সেটা সঠিক জানা নেই তবে ধারণা করা হয় যে দশম ও একাদশ শতাব্দীর সন্ধিক্ষণে নভগোরাদের বনিকরা এই শহরের গোড়াপত্তন করে। প্রত্নতাত্ত্বিক খননকার্য এই তত্ত্ব সমর্থন করে। নবতরঝক ক্রেমলিনের নীচের স্তরে সুপ্রাচীন কাঠের ফুটপাথ একাদশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে তৈরি। বিশেষণ হিসেবে লাভরেন্তি দিনপঞ্জিতে ৬৫২৩ সালের গ্রীষ্মে নবতরঝস্কির এফিমের উল্লেখ আছে। ৬৫২৩ সাল খ্রিষ্টীয় ক্যালেন্ডার অনুযায়ী ১০১৫ সাল। এফিম ছিলেন কিয়েভের রাজা ভ্লাদিমিরের ছেলে বরিসের সাথীদের একজন। তবে সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য উল্লেখ পাওয়া যায় ১১৩৯ সালের নভগোরাদের দিনপঞ্জিতে যা যুবরাজ ইউরি দলগোরুকির দ্বারা সুজদাল দখলের সাথে জড়িত। উল্লেখ করা যেতে পারে যে যুবরাজ ইউরি দলগোরুকিই ১১৪৭ সালে মস্কো শহরের গোড়াপত্তন করেন। 

তরঝক শহরের নামের সাথে তর্গ বা বানিজ্য বা হাট, বাজার এসব শব্দ জড়িত। বিভিন্ন সময় নভি তর্গ ও তরঝক দুটো নাম প্রচলিত থাকলেও শেষ পর্যন্ত তরঝক নামেই পরিচিত হয় যদিও এখনও পর্যন্ত তরঝকের অধিবাসীদের তরঝস্কি, নভতরঝস্কি বা নভতরি নামে ডাকা হয়। প্রতিষ্ঠার পর থেকে ১৪৭৮ সাল পর্যন্ত তরঝক বিভিন্ন সময় বিভিন্ন রাজ্যের অংশ ছিল, তবে ১৪৭৮ সালে ইভান গ্রজনি বা ইভান দ্য টেরিবল নভগোরাদ মস্কোর দখলে আনলে তরঝক মস্কো রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়। 

আমরা যখন তরঝক এসে পৌঁছুই তখন ছয়টা বেজে গেছে। তবে বছরের এই সময়ে সেটা দুপুর না হলেও পড়ন্ত বিকেল নয়। কিন্তু আমাদের আরও অনেক দূরে যেতে হবে। তাই এই শহরের জন্য খুব বেশি সময় বরাদ্দ করা সম্ভব ছিল না। আসলে দিলীপ একটা নির্দিষ্ট পরিকল্পনা নিয়ে রাশিয়া এসেছে। যদি এটা আমার জন্য ছিল স্রেফ ভ্রমণ, দিলীপের জন্য এটা যাকে বলে এসাইনমেন্ট। তাই এটা যতটা না ছিল দেখা তারচেয়ে বেশি তথ্য সংগ্রহ। তবে তরঝকে এবারই আমার প্রথম আসা নয়। এর আগে ২০১১ সালের ৪ জুন এখানে এসেছিলাম একটা এক্সারশনে। ফলে এই শহরের দর্শনীয় স্থানগুলো তখনই দেখা হয়েছিল। শুধু তাই নয় রীতিমত গাইডের কাছে থেকে এই শহরের ইতিহাস শোনা হয়েছিল। এই দশ বছরে শহরের অনেক পরিবর্তন হয়েছে। শুধু এই শহর কেন, সমস্ত রাশিয়াই বদলে গেছে। রাশিয়াই একটা প্রবাদ আছে – রাশিয়ার দুটো সমস্যা – “দারোগি ই দুরাকি” মানে “রাস্তাঘাট ও বোকা লোকজন।” তবে এখন, বিশেষ করে ২০১৪ সালের পর থেকে রাস্তাঘাটের প্রভূত উন্নতি হয়েছে। সেটা নিজের চোখেই দেখছি। ২০১১ সালে শহরের যে দুরাবস্থা দেখেছিলাম সেটা অনেকাংশেই দূর হয়েছে। আসলে সে সময় শুধু তরঝক নয় রাশিয়ার অধিকাংশ ছোট শহরের অবস্থা ছিল এরকম। সোভিয়েত আমলে সব শহর, গ্রাম ছিল কমবেশি স্বয়ংসম্পূর্ণ। ছিল কর্মসংস্থান, ছিল স্কুল, কলেজ, ছিল সাংস্কৃতিক কেন্দ্র। সবই চলত সরকারি ব্যবস্থাপনায়। কিছু কিছু ছিল লাভজনক, কিছু চলত কেন্দ্রের ডোনেশনে। কিন্তু জীবন ছিল। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন ও পুঁজিবাদের উত্থান সেই সামাজিক সম্পর্ক ভেঙ্গে ফেলে। সরকারের জায়গায় আসে ব্যক্তিমালিকানা। জনস্বার্থ নয় লাভ – এটাই হয় যেকোন প্রতিষ্ঠানের মূল স্লোগান। ফলে লোকজন ছুটে বড় শহরের দিকে। ছোট ছোট শহর বা গ্রাম পরিণত হয় ভুতুড়ে জনপদে যেখানে বাস করে মূলত বয়স্ক লোকজন আর কর্মক্ষম মানুষ আসে উইকএন্ডে। তবে এখন ধীরে ধীরে সেটা বদলাচ্ছে। অনেকেই শহর ছেড়ে গ্রামের দিকে ছুটছে। বিশেষ করে করোনাকালীন অনলাইন কাজের সুবাদে অনেকেই আস্তানা গাড়ছে প্রকৃতির আশেপাশে। 

মানুষ যখন আগে ঘুরে যাওয়া কোন স্থানে ফিরে আসে সে তখন কেমন যেন একটু আবেগ তাড়িত হয়। তার মনে পড়ে আগের যাত্রার বিভিন্ন ঘটনা, সে আগের অভিজ্ঞতার সাথে মিলিয়ে দেখতে চায় বর্তমানকে – দেখতে চায় কি কি বদলিয়েছে তার দীর্ঘ অনুপস্থিতিতে। সেটা কোন জায়গায় কেউ দুই দিন ছিল না দুই বছর তার উপর নির্ভর করে না। বিশেষ করে তার সাথী যদি হয় নবাগত তাহলে সে তার অভিজ্ঞতা প্রকাশ করতে চায়, নিজেকে জাহির করতে চায়। আমিও ব্যতিক্রম নই।    

     দীর্ঘ তিরিশ বছর ধরে নিয়মিত : জ্বলদর্চি। 

জ্বলদর্চি অ্যাপ ডাউনলোড করে নিন।👇
🍂
তরঝকের দর্শনীয় স্থানের মধ্যে অন্যতম তভেরৎসা নদীর তীর। ভারাঙ্গিয়ান থেকে গ্রীক পর্যন্ত জলপথ ছিল ইউরোপের অর্থনৈতিক ধমনী আর তরঝক ছিল এই পথে। এই নদীপথে নভগোরাদ সাথে দক্ষিণের বিভিন্ন রাজ্যের ব্যবসা বানিজ্য চলত।  আঠারো শতকে অন্যান্য অনেক শহরের মত তরঝককেও নতুন করে ঢেলে সাজানো হয়, এভাবেই নদীর দুই তীরে গড়ে ওঠে অপূর্ব সুন্দর স্থাপত্য। তিন তিনটে সেতু, যার একটা পায়ে হাঁটার জন্য, শহরের দুই অংশকে নিবিড় আলিঙ্গনে বেঁধে রেখেছে। এই নদীর তীরেই শোভা পাচ্ছে বরিসোগ্লেব মনাস্তির। যদিও লোকে বলে এই মনাস্তির স্থাপন করা হয়েছিল ১০৩৮ সালে তবে ইভান গ্রজনির মানে আইভান দ্য টেরিবলের সময় এর নির্মাণ কাজ চলছিল বলে লিখিত তথ্য পাওয়া যায়। আরও একটা দেখার মত স্থাপত্য হল ভস্ক্রেসেনস্কি মনাস্তির। এছাড়া অল-রাশিয়ান ঐতিহাসিক ও নৃতাত্ত্বিক যাদুঘরের জন্যও তরঝক প্রসিদ্ধ। নভতরঝস্কি ক্রেমলিন ৩০০ বছর আগে আগুনে পুড়ে ধ্বংস হয়ে যায়। বর্তমানে যেটা দাঁড়িয়ে আছে সেটা পুনর্নির্মিত। তবে দিনলিপি থেকে জানা যায় এই জায়গায়ই ১১৩৯ সালে ইউরি দলগোরুকির সেনাবাহিনী আস্তানা গাড়ে। তরঝক ছিল সোনালি সুতা দিয়ে সেলাইয়ের জন্য বিখ্যাত। এমনকি সোভিয়েত আমলেও সেখানে এই শিল্পের ইনস্টিটিউট ছিল। আগের সেই জৌলুষ না থাকলেও এখনও শিক্ষার্থীরা এখানে পড়াশুনা করে। ২০১১ সালে আমরা তাদের সাথে দেখা করেছিলাম। এই শিল্পের উপর একটা যাদুঘরও সেখানে আছে। আর আছে পুশকিন মিউজিয়াম। রুশ সাহিত্যের প্রধান কবি আলেক্সান্দর পুশকিন যখন সেন্ট পিটার্সবার্গ থেকে মস্কো আসতেন বা মস্কো থেকে সেন্ট পিটার্সবার্গ যেতেন তখন তিনি এই শহরে বিশ্রাম করতেন, সময় কাটাতেন। সেই স্মৃতিকে অমর করে রাখা হয়েছে এই যাদুঘরে। এছাড়া আছে পুরানো মোটর সাইকেলের বিশাল সংগ্রহ আর হেলিকপ্টারের মিউজিয়াম। এই মিউজিয়ামের পাশে দাঁড়িয়ে আমি আর দিলীপ বেশ কিছু ছবি নিয়েছিলাম। আছে ১৪০ মিটার দীর্ঘ সিঁড়ি। আর আছে স্তারোভজনেসেনস্কি কাঠের চার্চ, আছে স্পাস-প্রিঅব্রাঝেনস্কি ক্যাথেড্রাল, ইলিয়া ও আরখানগেলস্ক গির্জা। আর আছে ইয়েকাতেরিনার প্রাসাদ যেখানে দুই রাজধানীর মধ্যে যাতায়াতের সময় সম্রাজ্ঞী অবসর যাপন করতেন। এক কথায় জারের রাশিয়ায় তরঝক ছিল জমজমাট শহর। ছোট্ট এই শহরে এতগুলো গির্জার উপস্থিতি প্রমাণ করে যে অনেক বিত্তশালী লোকের বসবাস ও আনাগোনা ছিল এখানে। তবে বিপ্লবের মাত্র দুই দিন পরে মানে ৯ নভেম্বর ১৯১৭ সালে স্থানীয় শ্রমিকরা এখানে সোভিয়েত রাজ কায়েম করে। তবে তরঝক তার অতীতে আটকে নেই। এখানে আছে ইলেক্ট্রনিক্স শিল্পের কারখানা, আছে রাশিয়ান রেলওয়ের লোকোমোটিভ তৈরির কনস্ট্রাকশন ব্যুরো, আছে অগ্নি নির্বাপণের জন্য বিভিন্ন যন্ত্রপাতি তৈরি কারখানা। বর্তমানে এই শহরের জনসংখ্যা মাত্র ৪১ হাজার যা ১৯৮৭ সালের জনসংখ্যা থেকে ১০ হাজার কম। 

গ্রীষ্মের বিকেল। পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন নদী তীরে অনেকেই বাচ্চাদের নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। দূরে দেখা যাচ্ছে বরিসোগ্লেবস্কি মনাস্তির। খুব ইচ্ছে করছিল গিয়ে দেখতে এই দশ বছরে কি রকম পরিবর্তন হয়েছে সেখানে। কিন্তু সামনে অনেক পথ। যেতে হবে আস্তাশকভ। সেখানেই আমরা রাত কাটাবো বলে ঠিক করেছি। একটা ক্যাফেতে ঢুকে হাল্কা কিছু খেয়ে আমরা আবার পথে নামলাম।  

তরঝকের উপর বেশ কিছু ছবি পাওয়া যাবে আমার ফটো সাইটে
http://bijansaha.ru/albshow.html?tag=97

আর এই সফরের সময় তোলা ছোট্ট ভিডিও এখানে 
https://www.youtube.com/watch?v=nlzKbrqImas           

Post a Comment

0 Comments