জ্বলদর্চি

বাগদি চরিত (দ্বাদশ পর্ব) /শ্রীজিৎ জানা

বাগদি চরিত (দ্বাদশ পর্ব) 

শ্রীজিৎ জানা


কোলের ছেলেটাকে আঁকড়ে ধরে বাঁচতে চায় আরতি। স্বামীর সোহাগ তার কপালে লেখেনি ভগবান। এমনটাই সে ভাবে। তাতে তার তেমন আক্ষেপ নেই। তাদের জাতের অনেক মেয়েরই কপাল ফাটা। জয়রামের কোন এক পিসির বিয়ে হয় বিহারে। একসময় বিহার উত্তরপ্রদেশ থেকে একদল অবাঙালি লোক বিয়ে করতে আসত। বাগদির মেইছ্যানেদের আইবুড়ো নাম ঘুচিয়ে হত দরিদ্র কন্যাদায় গ্রস্ত বাবা-মায়েদের উদ্ধার করত তারা।। ঘটকও হত আশেপাশের গ্রামের। সবার পরিচিত ঘটক সে। কিভাবে যে তারা ওইসব পাত্রের সন্ধান করে আনত বোঝা মুশকিল।  ঘটক পাত্রের সম্পত্তির বহর শোনাত কনের মা বাবার কাছে। উপরন্তু মোটা টাকা কনের বাপকে দেওয়ার লোভ দেখাত সে। একে অভাব, সাথে অতগুলো মেয়ের বোঝা, তার উপর মোটা টাকা কন্যাপণ পাবার সুযোগ সহজে মওকা কে ছাড়তে চায়। সেক্ষেত্রে পাত্রের কোন খোঁজ খবর না নিলেও চলে। পাত্রের বয়স যদি বেশি হয় তাতেও দোষ নেই। সেদেশে তার আরো বিয়ে আছে কিনা, পাত্র মাতাল নাকি চরিত্রহীন, জমিজমা আদৌ আছে কিনা তার খোঁজ খবরের কোন বালাই থাকে না। মেয়েকে ঘাড় থেকে নামাতে পারলেই বাঁচে তারা। বাগদির ঘরে পনর ষোল বছর পেরোনো মেয়ে থাকা মানেই কথার শেষ নেই। তার উপরে গায়ের রঙ, উচ্চতা আর আর মুখের গড়নরযদি ভালো না হয় তবে তো দুশ্চিন্তার শেষ নেই।  থাকার মধ্যে শুধু ফোলাফাঁপরা গতর টুকুই সম্বল। চুলের যতন জানে না,লেখাপড়া দুক্লাস,ওই তো কালো কেলেন্দি রঙ তার কপালে কি রাজপুত্তুর জোটে। জোটে না। গরিব কলাপাতায় চাল ঢেলে মেয়েকে বিদায় দিতে পারলেই বাঁচে। মেয়ের বাপের ইচ্ছে হয়তো হয়, মেয়েকে রাজরানী সাজিয়ে ধুমধাম করে ভালো পাত্রের হাতে তুলে দেওয়ার। কিন্তু বাগদির ঘরে এসব ভাবা মানে ছেঁড়া কাঁথায় শুয়ে লাখ টাকার স্বপ্ন দেখার মতো।

এসব ক্ষেত্রে বাগদি তো মরেছে অবুঝ হয়ে। আর এঁড়েমির গুঁতায়।  তাদের সংসার জীবনে একসময় মূলমন্ত্র ছিল,পাতে না থাউ ভাত/ বাড়ু মোর পাত। বৌয়ের ছ্যানা বন্ধের নাড়ি তারা বাঁধতে চাইনি সহজে। অনেক সময় টাকার টোপ ফেলে পুরুষকে ক্লীব করতে উৎসাহিত করেছে প্রশাসন। সেক্ষেত্রেও কম ঝক্কি পোহাতে হয়নি স্বাস্থ্য দপ্তরকে। বাগদি পাড়ায় ঢুকে তুমুল গালিগালাজ খেতে হয়েছে দিদিমণিদের। কোথাও আবার পাড়া থেকে প্রাণ বাঁচিয়ে পালাতে পথ পাইনি তারা। যদিও তার আগে পাত বেড়ে গ্যাছে অগুন্তি। তার উপর ছেলে হওয়ার তীব্র আকুতি। ব্যাটাছ্যানা জন্ম না দিতে পারলেই সেই বউকে কত গালমন্দ শুনতে হয়েছে তার ইয়ত্তা নেই। বউটিকে বহুবার গর্ভধারণ করতে হবে। একটা ব্যাটা পেতে গিয়ে বাগদির কুঁড়াঘরে পাঁচছটা মেয়ে জন্মানোর ছবি চোখে পড়বে হামেসাই। তাও শেষমেষ যদিও একটা ব্যাটাছ্যানা হল, তার পরেও পাড়ার গিন্নীবান্নিদের উপদেশ বাণী শুনতে হবে অহরহ। 
—-এক টাকাও আবার  টাকা! একটা বেটাও বেটা! লাড়ি এখুনি বাঁধিসিনি বউ। এর পরে তোর আবার ব্যাটাছ্যানাই হবে,দেখে লিবি।
পাড়ার দাইবুড়ি একজন প্রসূতি বিশেষজ্ঞের মতো শরীরতত্ত্বের ব্যাখ্যা দিয়ে বলবে,
—-আমি ত তোর ছ্যানার লাড় কাটতে জিয়ে দেখলম। কুনু সাদা গাঁট নাই লাড়ে,এরপর সব কাল গাঁট। মানে এরপর তোর সব ব্যাটা হবে। চারিদ্দি তো ঠিকই বোলচে।
এই কথা শ্বশুর শ্বাশুড়ির কানে ওঠা মানেই আবার একবার বাড়ির বউকে ঢুকতে হবে আঁতুড় ঘরে। সন্তানের জন্ম দিতে দিতেই মেয়েবউদের শেষ শক্তিটুুকু যেন নিঃশেষ হয়ে যায়।

জয়রামের পিসি গরীব ঘরের সেই মেয়ে যাকে যেনতেন প্রকারে বিদায় দিতে পারলেই মা-বাবার শান্তি। মহেন্দ্র রুইদাস বেতের ধামা কুলা,পুয়া,কঁচা তৈরি করে ফেরি করত। দুরদুরজন্তের গ্রামে তার যাতায়াত। সাথে ঘটকালিও করে। সেই মহেন্দ্র সম্বন্ধ নিয়ে আসে জয়রামের পিসির। বরের নাম ওমপ্রকাশ। বিহারে বাড়ি। অঢেল জমিজমা। মোটা টাকা সঙ্গে এনেছিল। বিয়ের সব খরচ ওমপ্রকাশই দ্যায়। বিকেলে প্রস্তাব আনে মহেন্দ্র আর রাতে বিয়ে হয়। যাকে বলে ধরাচটকার বিয়ে। নাপিত বামুন বরকনের সাজপোশাক দু'দশ জনের খাওনদাওন তাতেই বিয়ে সুসম্পন্ন হয়।বরযাত্রী বলতে ওমপ্রকাশের সাথে আসা দুজন লোক। মহেন্দ্র বর কনে দুপক্ষেরই। কিন্তু বিয়ের পর কনে বিদেয় হয় না। বরযাত্রী দুজন ফিরে যায় বিহার। ওমপ্রকাশ থেকে যায় একমাস। এই একমাস বাজার হাট করে আনে এমপ্রকাশ আর জয়রামের পিসি ঝড়ি। সে কি আনন্দের দিনযাপন। তারপর ওমপ্রকাশ বাড়ি যেতে চায়। মাত্র এক সপ্তাহর জন্য। একমাস থেকে ওমপ্রকাশ সবার বড্ড আপন ও বিশ্বস্ত হয়ে গ্যাছে। ঝড়ির কাছে তো আরো আপনজন। শরীরে মনে তার সেই আপনত্বের ছটা যেন ঠিকরে বের হয়। ওমপ্রকাশ বিহার ফিরে যায়। যাওয়ার আগে তার শেষতক বেঁচে থাকা টাকা ঝড়ির হাতে গুঁজে দিয়ে যায়। তার পর দিন গড়িয়ে সপ্তাহ। শেষে মাস। ওমপ্রকাশ ফিরে আসে না। ইতিমধ্যে ঝড়ির গর্ভে নতুন প্রণের সঞ্চার হয়েছে। ঝড়ির চোখে শিলাইয়ের বান ডাবে। পাড়ায় যেখানে সেখানে কথার আসর বসে। শেষে সালিশি সভা ডাকা হয়। মহেন্দ্রর ডাক পড়ে।  ওমপ্রকাশের সঙ্গে তার আলাপপরিচয়ের ঘটনা জানতে চাওয়া হয়। উত্তরে সন্তুষ্ট না হওয়ায় পিঠমোড়া করে বেঁধে কয়েক ঘা লাগানোর নিদান আসে সভা থেকে। হাজার কথা ঘুরপাক খেতে থাকে ঝড়ির চারদিকে। ঝড়ির মা বাপের চারদিকে।
—--বুইলে নি লোভ, লোভ। টাকার লোভে মেইছ্যানাটাকে এরকম করে ভাসি দিল!
—-- কুনু খোঁজখবর লিয়া নাই,কুন জাতের তার ঠিক ঠিকানা নাই মেইয়ার বিয়া দিবি বর্লেই দিয়া
—--এবার বুজ। দোপড়া মেইছেনার আর বিয়া দিতে পারবি।
—--দোপড়া হলেও না হয় কথা ছিল,তার উবরে মাস পেরাতেই পৈতি হয়ে গেছে শুনিঠি
—--বলঠ কি গো। থাইলে মোদের ঝড়িটার কপালে ত দুখ্যুর শেষ নাই।
—--অর অন্য বোন গুলানেরও কি দশ হয় ইবার দেখ। মোর ঝিয়ের গলায় দড়িকলসি দিয়ে জলে ফেলি দুব,তবু অমন করে বিয়া দুবনি কখন।
পথে ঘাটে নানা অকথা কুকথা শুনতে হয় ঝড়িকে। সব কথাকে সেভাবে কানে তোলে না সে। সিঁথির সিঁদূর সে মুছবে না। পেটের ছ্যানা নষ্ট সে করবে না। তবে একা থাকবে বলে  সে পণ করে। সেইখেকে ঝড়ি একাই দিন কাটায়।
আরতি নিজেকে ঝড়ির চেয়ে কিছুটা সুখী ভাবে। স্বামী তাকে ঠকায় নি। ভগবানের নাম নিয়ে চলে গ্যাছে মঠমন্দিরে। মনে মনে আরতি গর্বই অনুভব করে। তবু মেয়ে মানুষের মন। হাতে শাঁখা পলা আছে, সিঁথায় সিঁদুর আছে অথচ স্বামী নেই। আজীবন তাকে এভাবে স্বামীহীনা এয়োতির বেশে কাটাতে হবে। আত্মহত্যার কথা প্রথম প্রথম মাথায় এলেও পরে ছেলেটার মুখের দিকে চেয়ে নিজেকে সংযত করে। দুই ঘর মিলে তার বিয়ে দেওয়ার কথাও উঠেছিল। আরতি মায়ের কাছে সেই কথা জানতে পেরে ক্ষেপে উঠে,
—--তমরা কি আমাকে ওরকম মেইছেনা ভাব। তার পরানা শাঁখা সিঁদুর ফেলি দিয়ে আবার একজনের হাতে পরব। মোর মন বলে কি কিছু নাই। তমাদের বংশেরও কি মানইজ্জত থাকবে তাতে, বল দিখি/
সেইবার থেকেই আরতির বিয়ে নিয়ে আর কেউ মাথা ঘামায় নি।  তার দিকে কুনজরে তাকাতেও কেউ সাহস পায়নি। বাপের বাড়ি থেকে হামেশাই চলে আসে স্বমীর ভিটায়। পাড়া গ্রামের পূজা অনুষ্ঠান বাদেও প্রতিবছর অঘ্রান পৌষ মাস শ্বশুর ঘরেই থাকে আরতি। লোখার ঘরে খায়দায়। ময়না তার এই জাকে কোনদিন দুচ্ছি করে না। আরতি তার স্বামীর অংশের জমিটুকু ভাগে দিয়ে দ্যায়। লোখা ইচ্ছা করেই আর চাষ করে না। ভাগের ধান বিক্রি করে দ্যায় আরতি। তবে দু'তিন মণ ধান লোখাকে দ্যায় খোরাকির জন্য। এই দু'মাস আরতি লক্ষ্মী পূজা করে খুব যত্ন করে। সংসার যখন এক জায়গায় ছিল তখনও খেতলক্ষ্মীর পূজার সব কাজ আরতিই করত।
লোখা জানে সব ধানের গোছ কাটলে হবে না। গোছবিঁড়ার জন্য গোটা একটা ধানের গোছ রাখতে হবে। পৌষ সংক্রান্তি তিখিতে গোছবিঁড়া পূজা হয় খামারে। সেই দিন ভোরে বাড়ির ছোটরা মকরডুব দেয় লোদা পুকুরে। মুখে মুখে ছড়া কাটে,এক ডুবে শুচি/ দু' ডুবে মুচি/ তিন ডুবে মুসলমান/ চার ডুবে গঙ্গাস্নান। সকালে দলবেঁধে তারা যাবে মকর দিতে সব ঠাকুর থানে। সন্ধ্যায় রান্না ঘরে আরতিরা সব জায়ে মিলে পিঠা করতে বসে। তার পরে ইঁদুর মাটির ল্যাবা দ্যায় খামারে,তুলসিতলায় আর বাক্সপ্যাঁটরায়।জয়রাম ঘরে থাকার সময় পৌষ সংক্রান্তিতে আউনিবউনি পাকাত। নতুন খড়কে পাকিয়ে তার ডগায় সরসে ফুল বাঁধত। সেই আউনিবউনি খামারে,তুলসীতলায়,চালের কলসিতে,পয়সাকড়ির বাক্সে দিত। আউনিবউনি পাকানোর সময় জয়রামকে ঘিরে বসত ছোটরা। জয়রাম ছড়া কাটত,আউনিবউনি / তিন দিন পিঠা খাওনি?। মানে পৌষ সংক্রান্তির তিন দিন পিঠা খেতে হয়। তারপর জয়রাম জেগে থাকত সার ধরার জন্য। খামারে খেতলক্ষ্মীর থানে জলের ঝারা দিতে হয়। তাকে সার ধরা বলে। যতক্ষণ পর্যন্ত না শেয়াল ডাকে ততক্ষণ অব্দি সার ধরা যাবে না। আরতি ডাক দিত জয়রামকে,
—কি গো শুবে নি। রাত যে গল হতে যায়।
—তুই শু। এখনো বনি লাকাড়ে নি। সার ধরব কি করে
আরতি জানে বনি মানে শেয়াল। সার ধরার আগে তার নাম ধরতে নাই। তবে তার বাপের ঘরে বনি বলে না, বলে বাম। জয়রামের চলে যাওয়ার পর এসব রীতি আর কেউ করে না এ বাড়িতে। শুধু ল্যাবা দেওয়া আর আউনিবউনি পাকানোর রীতি ধরে রেখেছে লোখা। তাও তার বৌদি আরতির চাপে পড়ে।

দীর্ঘ তিরিশ বছর ধরে নিয়মিত : জ্বলদর্চি। 
জ্বলদর্চি অ্যাপ ডাউনলোড করে নিন।👇
🍂


Post a Comment

0 Comments