জ্বলদর্চি

মরদ ঢুঁড়া /সুমিত্রা মাহাত

মরদ ঢুঁড়া 

সুমিত্রা মাহাত

জগু খুড়ার ঘাড়ের শিরাগুলো রগরগ করছে। দরদর করে মাথার ঘাম পায়ে পড়ছে। পায়ের পাতাগুলো আর উঠতে চাইছে না , মনে হয় দু-পা লুটপুটিয়ে পড়ে যাবে । পিঠে পঞ্চাশ কেজির চালের বস্তা । বাবু গোডাউন থেকে দোকানে নিয়ে যেতে বলেছে । বাইরে যেন আগুন বইছে , জল ঝড়ের দেখা নাই । 
 
জগমোহন মাহাত , বয়স ছাপান্ন কি সাতান্ন । অম্বর সাহার দোকানের পুরানো কর্মচারী । জৈষ্ঠ্য মাসের গুমোট গরম জগমোহনের শরীরের সমস্ত দেহরস টেনে বার করছে । চওড়া ছাতির উপর বিচিত্র ছিদ্র বিশিষ্ট সাদা স্যান্ডো গেঞ্জি টা ঘামে ভিজে চপচপ করছে । কোমরে লুঙ্গি , তা গুটিয়ে হাঁটুর উপর সাঁটানো , তাও ওপর থেকে ভিজে ভিজে নামছে । জগু দাঁতে দাঁত চেপে বিড়বিড় করে " আইজ আর পাইরবনায় মঅনেএ হঅছেএ । ই বস্তার তলেই জাঁকা পইড়বঅ। "

নিজেকে সামলায়, " হামিও মরদ বঠি , মইরবঅ তবু ছাইড়বঅ নায় ।"

কোনও মতে চালেরবস্তা পিঠ থেকে দোকানের মেঝেতে থসড়ায়। ইদানীং লিভারের ব্যথাটা খুব বেড়েছে তার। ডাক্তার বলেছে বিশ্রাম নিতে । 
জগু র মন বলে " বিশরাম  লিলে কি হবেক ! খাব কি ! ডাকতর পাতি দেখাতে তঅ জঅমি জাইগা যা ছিল কাইরখানার মালিক কে সওব আধামূলায় দিলি । যত্ টুকু আছে ছানাটায় চাষ করেএ। তাও ভালঅ চাষ হয় নায় । কারখানার জইন্যে মাটি আর আগের মতন নায় । কত কষ্টে পড়হালি , চাকরি-বাকরি কিছুই হইল নায়। চাষেই যদি কইরবেক তঅ পড়হাশুনা করার কনঅ দরকার ছিল নায় , কত আশা ছিল ইবার দুউখঅ ঘুইচবেক।" 
নিরক্ষর জগুকে পড়াশোনার মর্ম বোঝানো খুব কঠিন । সে যত সহজ সরল ভাবে জীবনের হিসেব মেলানোর চেষ্টা করে, জীবনের অঙ্ক তত সহজে মেলে না। অবশ্য তার দুঃখ কষ্ট জর্জরিত, দারিদ্র্য ক্লিষ্ট জীবনে এর চেয়ে উন্নত তর ভাবনা আর কিই বা হতে পারে ! 

মালিকের বাজখাই গলার আওয়াজে তার সম্বিত ফিরে , "ভালো করে কাজ করতে পারিস না , ক্ষতি ছাড়া তো লাভ কোনও দিন করিস না । এরা দেবে আমার ব্যবসা করে । "
জগু অবাক হয়ে দেখে পরিষ্কার , সরু চাল , বস্তা ফেটে সমস্ত মেঝেতে ছড়িয়ে পড়েছে । 
" আমি সেচছায় করিই নায় বাবু " এই বলে জগু তাড়াতাড়ি আরেকটা বস্তা এনে প্রাণপণ চেষ্টায় বাবুর লাভের অঙ্ক সঠিক রাখার চেষ্টা করে । ওদিক থেকে অনবরত গালিবর্ষণ চলতে থাকে । জ্বলন্ত সূর্যের মতো অম্বরের মেজাজ ও টগবগ করে ফুটতে থাকে ।

কেন জানিনা জগু আর আগের মতো কথার জ্বালা সহ্য করতে পারে না । প্রথমে অসহায় ভাবে মেনে নিলেও ধীরে ধীরে তার শিরা উপশিরায় পৌরুষ সত্ত্বা জাগ্রত হতে থাকে । জগু ভাবে " কনঅ দিনঅ চাইর পইসার জিনিস ইধার উধার করি নাই । "
আজ তো নয় প্রায় কুড়ি বছর সে এই দোকানে কাজ করছে। তখন জগুর জ্ঞাতি গুষ্টির অনেকেরই দোকান ছিল এই বাজারে । ধীরে ধীরে কমতে কমতে এখন তা শূন্যে ঠেকেছে । এদের দ্বারা ব্যবসা পাতি হবে না । মানুষ ঠকানোর অভ্যাস টা এরা কিছুতেই রপ্ত করতে পারে না । ভগবান সেজে তো আর বাণিজ্য হবে না । তাই সব খুয়ার করেছে । 

হঠাৎই এক জাঁদরেল মহিলা এসে ইয়া লম্বা এক লিস্ট ধরায় মালিকের হাতে । মালিক তা ছুঁড়ে দেয় জগুর দিকে । জগু জাহান দিয়ে লিস্ট মিলিয়ে মিলিয়ে, জিনিস ভরে, এক জায়গায় জড়ো করতে থাকে । মনে হয় খাওন- দাওন আছে ।  এত জিনিস কি করে নিয়ে যাবে ভগবান জানে ! মালিক অবস্থা দেখে জগুকে নির্দেশ করে একটা বস্তার মধ্যে সব জিনিস ভরে দিতে । পেটের ডান দিকটা ব্যথা ব্যথা করছে ।  একটু হাত বুলিয়ে নিয়ে জগু বস্তায় জিনিস ভরতে থাকে । বস্তার মুখ জড়ো করে ধরে বস্তা সেলাই করার জন্য হাতে বড় সুচ ও সুতলি নেয় । ততক্ষণে ভদ্রমহিলা তাগাদা দিতে শুরু করে দিয়েছে, " এই তাড়াতাড়ি করো । "
জগু বস্তার একধার কুঁচি দিয়ে ধরে সুতলি পেঁচিয়ে , বস্তার দুদিকের মুখ জড়ো করে সুচ ঢুকিয়ে দেয়। দ্বিতীয়বার সুচ এফোঁড় ওফোঁড় করতেই সরষে তেলের প্যাকেট ফুটো হয়ে যায় , ফিনকি দিয়ে তেল বেরোতে থাকে । জগুর হৃৎপিন্ড কেঁপে ওঠে । তাড়াতাড়ি প্যাকেট তুলে মালিকের দিকে একবার তাকায় , তারপর কড়া নির্দেশে লুজ তেলের টিনের উপর ধরে। তেল ঢালা শেষ হলে বস্তা থেকে সমস্ত জিনিস বের করে ন্যাকড়া দিয়ে মোছে । নতুন তেলের প্যাকেট সহ অন্য বস্তায় ভরে , সুতলী দিয়ে সেলাই করে দেয়। পিচ রাস্তায় টোটো দাঁড়িয়ে আছে ।  জগু বস্তা পিঠে করে নিয়ে গিয়ে টোটোতে  তুলে দেয় । ভদ্রমহিলা খুশি হয়ে তাকে দশ টাকা দিতে চায় । সে নেয় না । 

জগু ফিরে আসতেই মালিক তার রাগের ঝলকানি দেখাতে থাকে । আজ সকাল থেকেই সে তার অনেক ক্ষতি করেছে । এমনিতেই শরীর খারাপের অজুহাতে দুদিন কামাই করে দোকানে এসেছে । 
"দূর হয়ে যা! আর তোকে দোকানে আসতে হবে না , এই রকম লোক  আমি ঢের পাবো । আর এক মুহূর্ত ও তুই দোকানে থাকবি না । " এই বলে ঠেলে তাকে দোকান থেকে বের করে দেয় অম্বর , সঙ্গে ছিঁড়া গামছা, দুউপহইরা , ত্যাবড়ানো জলের বোতল ভরা নাইলনের ব্যাগ টাও । 
জগু পিছন ফিরে তাকিয়ে বলে " বাবু হামার টাকাটা । " 
মালিক ঝাঁঝিয়ে ওঠে " এহ ! দু-দিন কাজ করেছে তার আবার টাকা , যা যা পরে লোক  দিয়ে পাঠিয়ে দেব ।" 
জগু নাইলনের ব্যাগ টা হাতে তুলে নেয় , ছিঁড়া গামছায় কপালের ঘাম মোছে , ত্যাবড়ানো বোতল থেকে সামান্য জল গলায় ঢালে । " আহা বড় মিঠা ।"ঘরের কুঁয়ার জল। 
জগু বিড় বিড় করে , " এখন তঅ বলবিসেই , বয়স হঞেছে । অত দিন যে দঅকান জঅগালি তার কঅনঅ দাম নায় । " 
জগু কোনওদিন মিথ্যা কথা বলেনি। দোকান থেকে একছটাক জিনিস বা টাকা সরায়নি । তা করলে আজ তার মাটির কাঁথ , টালির ছাউনি থাকত না । সামান্য টাকার বিনিময়ে সে গাধার খাটনি খেটেছে দিনের পর দিন । বেইমানি করেনি । তার মন বলে , " তরহা তঅ এমন মুনিস খুজিস, যারহাকে কম টাকায় গাধার খাটনি খাটানা যায় । "
জ্বলদর্চি অ্যাপ ডাউনলোড করে নিন।👇
এবার জগু মনে বল নিয়ে মালিকের দিকে ঘুরে চোখে চোখ রেখে বলে, " রাখ তর দঅকান, কুড়ি বছর ধরিঞ ঢের করিঞছি , আর তর দঅকানে কাজ কইরবঅ নায় । তবে হামার নায্য পাওনা ছাইড়বঅ নায় । য দিন কাজ করিঞছি তার টাকা দেএ, হামি এখনেই যাবো , নাইহলে এক পা লইড়ব নায় ।" 
মালিক চমকে ওঠে , আজ যেন জগুর চোখে আগুন জ্বলছে ।  নিরক্ষর জগু প্রতিবাদ করতে শিখেছে । দীর্ঘদিনের অবলা প্রাণী টা নির্বিচারে মাথার ঘাম , প্রায় বিনামূল্যে দেওয়ার পরও এমন অপমান হজম করতে পারে না । সে তো ইচ্ছে করে কিছু করেনি। আজ তার শরীর মানছে না । 
তাড়াতাড়ি ক্যাশ বাক্সে হাত ঢুকিয়ে টাকা বের করে অম্বর পাশের কর্মচারীকে দেয় , জগুকে দিয়ে দিতে বলে। জগু তার ন্যায্য পাওনা বুঝে নিয়ে আর পিছন ফিরে তাকায় না । ধ্যার ধ্যারে পুরানো সাইকেল টা বাগিয়ে নিয়ে প্যাডেল মারে । ভর দুপুর, শুনশান পিচ রাস্তা । শহর ছেড়ে পাঁচ-ছ কিলোমিটার এঁকে বেঁকে জগুর সাইকেল গাঁয়ে ঢোকে । এখন তার শরীর বড়ো হালকা,মনে বড়ো ফূর্তি। এবার শান্তিতে বিশ্রাম নিতে পারবে সে । 
গাঁয়ে- গাঁয়ে এখন মরদ ঢুঁড়া চলছে । দলে দলে মানুষ রাজনৈতিক দল ছেড়ে সামাজিক আন্দোলনে যোগ দিচ্ছে। গ্রামের মাথায় পতপত করে উড়ছে লাল সূর্য আঁকা হলুদ পতাকা । জগু আজ গর্ব করে বলতে পারবে সেও ছেড়ে বেরিয়ে এসেছে , তবে রাজনৈতিক দল থেকে নয় গোলামি থেকে !

Post a Comment

0 Comments