আমার জীবনের ঘটনা-১৪
মলয় রায়চৌধুরী
কমলকুমার মজুমদার ও একশ টাকার নোট
হিন্দি সাহিত্যিক ফণীশ্বরনাথ রেণুকে আমি কমলকুমার মজুমদারের ‘অন্তর্জলী যাত্রা’র একটি কপি দিয়েছিলুম । উনি বাংলা জানতেন । সতীনাথ ভাদুড়ীর গুণগ্রাহী ছিলেন । আলোচকদের মতে ফণীশ্বরনাথ রেণু হিন্দিতে সতীনাথের ফর্ম আর গদ্যবিন্যাস নিয়ে গিয়েছিলেন । পাটনা থেকে কলকাতায় আসলে ওনার জন্য বাংলা বই নিয়ে যেতে হতো । উনি জানতে চাইতেন বাংলা গদ্যে কারা নতুন কাজ করছেন । সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়ের গদ্যের প্রশংসা করতেন এবং বলতেন যে যাক এতদিনে বাংলা গদ্যে আবার নতুন করে কাজ আরম্ভ হয়েছে । ক্রিয়াপদকে নিয়ে বাঙালি লেখকদের মতন হিন্দি গদ্য লেখকরাও ভাবনাচিন্তা করছিলেন । হিন্দির লেখকদের সমস্যা ছিল ‘হ্যায়’ শব্দটি । এই শব্দটিকে বাদ দিয়ে কী ভাবে বাক্যগঠন করা যেতে পারে সে-ব্যাপারে ভাবনাচিন্তা চলছিল ।
সম্ভবত দাদার কাছে উনি কমলকুমার মজুমদারের গদ্য নিয়ে কাজের কথা শুনেছিলেন । আমি কলকাতা থেকে ওনাকে এক কপি ‘অন্তর্জলী যাত্রা’ এনে দিয়েছিলুম । ওনার রাজেন্দ্রনগরের ফ্ল্যাটে মাঝেমধ্যে মদ্য বা তাড়িপানের সান্ধ্য আড্ডা হতো । অমন একটা আড্ডার আশায় ওনার ড্রইংরুমে গিয়ে দেখলুম টেবিলের ওপর বইটি রাখা । একা বসে আছেন, চিন্তান্বিত । বললেন, তোমার জন্য অপেক্ষা করছিলুম ।
বইটি হাতে নিয়ে বললেন, ওহে, এই গদ্য যে কমলকুমার মজুমদার লিখেছেন, কী ভাবে লেখেন জানো? ওনার বাড়ি গিয়ে দেখেছ কখনও কী ভাবে উনি এই গদ্য তৈরি করছেন ? ওনার পাণ্ডুলিপি তুমি কখনও দেখেছ ? ওনার সবকটি বই-ই কি সাধু বাংলায় লেখা, এই গদ্যে ?
আমি জানিয়েছিলুম যে কমলকুমার মজুমদারের সঙ্গে আমার মাত্র তিনবার কথা হয়েছে, রাস্তায় দাঁড়িয়ে ; ওনার পাণ্ডুলিপি দেখার সুযোগ আমার হয়নি কেননা ওনার সঙ্গে আমার সেরকম সান্নিধ্য ছিল না । ওনার যে কয়টি লেখা আমি তখন পর্যন্ত পড়েছিলুম সবই এই বিশেষ গদ্যবিন্যাসে লেখা । রেণুজি বললেন, বইটা পড়ার পর থেকে উনি নানা ভাবে হিন্দিতে কমলকুমারের গদ্যরীতি প্রয়োগ করার চেষ্টা করেছেন, এমনকি তুলসীদাসের রামচরিত মানস থেকে পংক্তি নিয়ে পারমুটেশান-কম্বিনেশান করে দেখেছেন, এভাবে হিন্দিতে লেখা অসম্ভব । কম বয়স থেকে অভ্যাস করলে হয়তো কিছু করা যেতে পারত ।
আমি বললুম যে যতদূর জানি, কমলকুমার মজুমদার ফরাসি ভাষায় পারঙ্গম এবং সম্ভবত সেই ভাষা থেকে বাক্যগঠনের ধারাটি নিয়ে থাকবেন ।
বস্তুত আমি আজও জানি না কমলকুমার মজুমদার কবে থেকে অনুশীলন আরম্ভ করেন এবং কী ভাবে এই বিশেষ গদ্যশৈলী আয়ত্ত করেছিলেন। ওনার বহু বাক্য বুঝে ওঠার জন্য আমি বারদুয়েক পড়েছি আর তা সাধুভাষার জন্য নয়, তা গদ্যবিন্যাসটির জন্য । আমাদের আন্দোলনের সময়ে আমরা কেউ-কেউ চিন্তা করতুম কী ভাবে ক্রিয়াপদের জেলখানা থেকে বেরোনো যায় বা ওই কারাগারকে বাগানে পাল্টে ফেলা যায় ।
আমি যে-সময়ের কথা বলছি সে-সময়ে আমার মকদ্দমা চলছিল ব্যাংকশাল কোটে । একে কোর্টের খরচ তায় আবার কলকাতায় আমার মাথা গোঁজার ঠাঁই ছিল না । কখনও সুবিমল বসাকের জ্যাঠামশায়ের স্যাকরার দোকানে রাত কাটাতুম বইঠকখানা পাড়ায় আর হাগতে যেতুম শেয়ালদায় দাঁড়িয়ে থাকা কোনো প্যাসেঞ্জার ট্রেনে । উনি বাইরে থেকে তালা দিয়ে যেতেন বলে যেদিন তারিখ পড়ত তার আগের দিন হিন্দি লেখক শরদ দেওড়ার বড়োবাজারের গদিতে গিয়ে শুতুম আরও নানা ব্যাবসাদারদের পাশাপাশি । দিনের পর দিন চান করার সুযোগ পেতুম না । রাস্তার কলে করা যেতে পারত কিন্তু তার জন্য গামছা দরকার ।
অমন পনেরো দিন কাটাবার পর আমার জামা আর প্যান্টের অবস্হা ঘামে-ঘামে পচতে শুরু করেছিল ; গেঞ্জি জাঙিয়া আগেই শেয়ালদায় বিসর্জন দিয়েছিলুম । পকেটে বাড়তি পয়সা ছিল না যে এক সেট কিনি । অনেকের কাছে সাহায্য চেয়েছিলুম কিন্তু কেউই বিশেষ গা করত না ; সত্যি বলতে কি বেশির ভাগ লেখক আমায় দেখলে অন্য দিকের ফুটপাতে চলে যেতেন । কেটি বা বিডি যেতে হলে কাউকে আঁকড়ে ওমুখো হতুম ।
একবার কেটিতে ঢোকার আগে এক পুরিয়া গাঁজা কেনার জন্য পাশের সরকারি দোকানটা থেকে খুপরিতে হাত ঢূকিয়ে ভিড়ের ভেতর থেকে কোনো রকমে একটা পুরিয়া কিনে পেছন ফিরেছি দেখি সামনেই কমলকুমার মজুমদার । আমাদের পরস্পরের পরিচয় ছিল না । সাহিত্যিকরা আমার ওপর চটা অনুমান করে আমি বড়ো একটা যেচে আলাপ করতুম না তাঁদের সঙ্গে । যাঁরা তাঁদের কাগজে আমার সম্পর্কে আবোল-তাবোল লিখতেন তাঁদের সঙ্গে অবশ্য গিয়ে মুখোমুখি হতুম ।
কমলকুমার মজুমদার একেবারে সামনে । ্যভ
ভ্যাবাচাকা খেয়ে কী বলব বুঝতে পারলুম না দেখে উনিই বললেন, তুমিই তো মলয়, দেখেছি খালাসিটোলায় তোমার বন্ধুদের সঙ্গে । তারপর স্তম্ভিত করে দিয়ে একটা একশো টাকার নোট আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে বললেন, এ নাও, এর চেয়ে বেশি কিছু করতে পারব না । বলে, সোজা এগোলেন ওয়েলিংটনের দিকে । ওই টাকায় আমি সবচে প্রথমে একটা বুশশার্ট আর প্যান্ট কিনলুম । দোকান থেকে বেরিয়ে পুরোনোগুলো ফেলে দিলুম ডাস্টবিনে ।
নোটটায় ওনার সই নিয়ে রেখে দেয়া উচিত ছিল । সেন্স অব হিস্টরি না থাকলে যা হয় ।
দীর্ঘ তিরিশ বছর ধরে নিয়মিত : জ্বলদর্চি।
জ্বলদর্চি অ্যাপ ডাউনলোড করে নিন।👇
🍂
0 Comments