জ্বলদর্চি

বায়ু রথ হুজুগ পথ /শুভশ্রী রায়

বায়ু রথ হুজুগ পথ
শুভশ্রী রায়
    

খুব সহজে হাজার রকম গুজব রটে যায়। প্রথমে হয়তো কথাটা থাকে একেবারে এইটুকুনি, তারপরে কত জনের কান-মুখ-উদ্ভট চিন্তা গায়ে লাগিয়ে ফুলেফেঁপে যায়। আমি নিজেও কত রকম গুজব শুনেছি। এই পরিণত বয়সে এসে মনে হয়, কিছু কথা রটে সত্যি, কিছু কথা রটে মিথ্যে আর কিছু কথা রটে সত্যমিথ্যা মিশিয়ে। তাই গুজব শুনে বিশ্বাস করতে নেই। দরকার হ'লে খোঁজখবর নেওয়া উচিৎ তবে বেশিরভাগ লোকেরই অত সময় থাকে না। তবে এটা ঠিক যে কিছু একটা কানে এলে মজা পায় তারা।
   শত শত গুজব রটে, কানে আসে, কিছু ভুলে যাই কিছু মনে রাখি। আজ অবধি যত গুজব কানে এসেছে সবগুলোর কথা বলতে গেলে আমার জীবদ্দশায় শেষ হ'বে না। 
এই লেখায় আমি সামান্য কয়েকটা জনশ্রুতির উল্লেখ করব যেগুলোর কয়েকটা বৃহত্তর পরিসরে ঘটেছে আর কিছু হয়েছে আমার সীমিত চেনাজানা গন্ডীর ভেতরে।           
     গুজবের প্রসঙ্গে উনবিংশ শতাব্দীর একটা রটনার কথা উল্লেখ করি। হুতোম প্যাঁচার নকশা'য় 'হুজুকে কলকাতা’-র এক অদ্ভুত ঘটনার বর্ণনা দেওয়া হয়েছে। হঠাৎ রটে গেল, গত দশ বছরের সমস্ত মৃত মানুষ সে বছরের ১৫ কার্তিক (রবিবার) মরপৃথিবীতে ফিরে আসবেন । লোকের মুখে মুখে বিষয়টিকে ‘মরাফেরা’ বলা হচ্ছিল। নদিয়ার রামশর্মা আচার্যের মতো পন্ডিত মানুষ নাকি এই বক্তব্য রেখেছেন। অমনি লোকজন জল্পনাকল্পনা শুরু করে দিল। খালিখালি মৃতদের ধরায় ফিরে আসা নিয়ে আলোচনা। ১৫ কার্তিক নিমতলা এবং কাশী মিত্রের শ্মশানে ভীড় জমে গিয়েছিল। আশা আশঙ্কায় জমাট মানুষের ভীড়ে শ্মশান সরগরম। খুব স্বাভাবিক, পরলোক থেকে কেউ ফিরে আসেনি। সে দিনটার অবসান হয়ে যাওয়ার পরে হুজুগপ্রিয় কলকাতাবাসীর বিভ্রম কেটেছিল।

চলতি বছরে কিছু দিন আগেই হুজুগপ্রিয় মহানগরীতে সম্মোহনের গুজব রটেছিল। এক দল লোক নাকি সম্মোহন করে কিশোরী ও তরুণী মেয়েদের অপহরণ করছে। সম্মোহনের উপায়টা কি রকম? অপহরণকারী ঠিকানা লেখা একটা কাগজ কলকাতার রাস্তায় কোনও মেয়ের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে হিন্দি এমন কী বাংলাতেও বলছে- এই জায়গায় কী করে যাব একটু বলে দেবেন! মেয়েটি ঠিকানা পড়ে নিয়ে লোকটার মুখের দিকে তাকিয়ে কথা বলতে শুরু করা মাত্রই লোকটা দৃষ্টির সাহায্যে মেয়েটাকে সম্মোহিত করে ফেলছে। মেয়েটা লোকটার পেছন পেছন হেঁটে যাচ্ছে। লোকটা তাকে নিজেদের মানে অপরাধীদের ডেরায় নিয়ে গিয়ে হাত-পা বেঁধে বন্দী করে ফেলছে। তারপরে মওকা বুঝে ট্রাক-ট্রেন-চার চাকায় তুলে ভিন রাজ্যে পাচার। 
       ব্যাস, সম্মোহনের গুজবে রাজ্য উত্তাল হয়ে উঠল। কলকাতার রাস্তায় মেয়েদের একা ছাড়তে বাবা-মায়েরা ভয় পাচ্ছিলেন। সোশাল মিডিয়ার কল্যাণে ভালো মন্দ সব খবরই আজকাল দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে, গুজব ছড়িয়ে পড়তেই বা কি অসুবিধা?! ক্রমে রাজ্যের সব জায়গাতেই আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ল। কাগজেও লেখালিখি হচ্ছিল। পরে পুলিস থেকে স্পষ্টিকরণ দেওয়া হ'ল। মানসিক ভারসাম্যহীন একটি অবাঙালি লোক যে নাকি এক সময়ে একটি দোকানের মালিক ছিল, তাকে কেন্দ্র করে গুজবের উৎপত্তি। তাও পুলিস লোকটিকে থানায় নিয়ে গিয়ে তার সঙ্গে কথাবার্তা বলে, খোঁজ নিয়ে দেখেছে সে অপরাধী মানসিকতার নয় তবে কথাবার্তা অসংলগ্ন। কি কান্ড! তত দিনে লোকটার ছবিও সোশাল মিডিয়ায় ভাইরাল হয়ে গিয়েছে।
      যাই হোক, অবশেষে পুলিস বলে দিল- সম্মোহন করে অপহরণের  মিথ্যে গুজবে কান দেবেন না। তারপরে আতঙ্ক প্রশমিত হ'ল।

     আরেকটা অদ্ভুত গুজব রটেছিল আমাদের সেই সময়কার পাড়ায়। তখন আমরা উত্তরোত্তর কলকাতায় থাকতাম। উত্তর কলকাতার উত্তর দিকটাকে আমি এইভাবে উল্লেখ করতেই পছন্দ করি। আজ থেকে অনেক দিন আগেকার কথা এ সব। তখন মোবাইল আসেনি। হিসেব করলে  পাড়ায় পঞ্চাশটা বাড়ীর মধ্যে একটিতেও ল্যান্ড ফোন ছিল কিনা সন্দেহ। একটি শিক্ষিত পরিবারের মেধাবী পুত্রসন্তানকে নিয়ে এই না হওয়া ঘটনা। তখন সে ছেলে স্নাতকোত্তর পরীক্ষা দিয়েছে কিন্তু ফল বেরোয়নি। ইতিমধ্যেই সে চাকরির সন্ধান করতে শুরু করে দিয়েছে। সেনার একটি চাকরির পরীক্ষা দেওয়ার জন্য লখ্নৌ যাওয়ার ডাকও এল এক সময়ে। বাবা-মা সম্মতি দিলেন। 
       ওমা, ছেলে গন্তব্যে পৌঁঁছনোর দিন তিনেক পরে লখ্নৌ-এর সেনা কর্তৃপক্ষ থেকে ছেলের বাড়ীতে টেলিগ্রাম! "ইয়োর সান ইজ সিরিয়াসলি ইনজিওর্ড অ্যান্ড হসপিটালাইজড।" বাবা-মা দৌড়ে লখ্নৌ গেলেন।  
ছেলেকে নিয়েও এলেন তবে কিছুটা সময় লেগেছিল। তখন ট্রেন, টিকিট, রিজার্ভেশন ইত্যাদি এখনকার মতো সহজে হ'ত না। এই অবধি যা বললাম স্বাভাবিক একটি ঘটনা বা দুর্ঘটনা। কিন্তু এই দুর্ঘটনার সঙ্গে এমন একটা গুজব রটেছিল যা মানুষের ঈর্ষাপরায়ণ সন্দিগ্ধ দিক সম্পর্কে জানিয়ে দেয়।
         যত দিন বাবা-মা ছেলেকে নিয়ে বাড়ী আসেননি, তত দিন পাড়ায় বিষয়টা নিয়ে খুব চর্চা হচ্ছিল। কিছু লোক বলতে শুরু করল, ও সব ইনজুরি টিনজুরি কিছু নয়। আসল কথা, ছেলেটা নির্দিষ্ট পরিকল্পনামাফিক বাইরে গিয়ে বিয়ে করেছে, বাড়ীতে সরাসরি বলতে পারছে না, তাই টেলিগ্রামে মিথ্যে খবর পাঠিয়েছে। ছেলে আর ছেলের বৌকে নিয়ে বাবা-মা এই ঢুকল বলে! ব্যাপার হল-  পরিবারটিতে সবাই লেখাপড়ায় ভালো আর প্রতিষ্ঠিত বলে অনেকেই ঈর্ষা করত। এই সুযোগে গায়ের জ্বালা মিটিয়ে নেওয়া আর কি!
          দু' তিন দিন পরে বাবা-মা সারা গায়ে ব্যান্ডেজ বাঁধা ছেলেকে নিয়ে বাড়ী ঢুকলেন। তখন অবশ্য সব চুপ। আহত ছেলেটিকে আমি নিজেও দেখেছিলাম। মুখের অর্ধেকটা ব্যান্ডেজ দিয়ে ঢাকা ছিল। অনেক দিন সে শয্যাশায়ী ছিল। দীর্ঘ দিন ক্রাচ নিয়ে হাঁটত। এরকম কী করে হ'ল? শারীরিক সক্ষমতার পরীক্ষা দেওয়ার সময়ে পরীক্ষার্থীদের একটা পাঁচিল থেকে ঝাঁপ দিয়েই দৌড় শুরু করতে বলা হয়েছিল। এই ছেলে পাঁচিল থেকে লাফ দেওয়া মাত্রই পাঁচ-ছ'টা ছেলে লাফ দিয়ে তার গায়ের ওপর পড়ে যায়। আঘাত সইতে না পেরে সঙ্গে সঙ্গে সে অজ্ঞান হয়ে যায়। সেখান থেকে সেনা হাসপাতাল। সংক্ষেপে এই হ'ল
ঘটনা। 
🍂

          কিন্তু কি বিচ্ছিরি গুজবই না রটেছিল! কত সহজে ভিত্তিহীন ব্যাপারস্যাপার রটে যেতে পারে, এই ঘটনা তার নজির। সত্যি, মানুষের মিথ্যা উদ্ভাবনের ক্ষমতা দেখলে অবাক লাগে।
      এবার, আমার স্কুল জীবনে শোনা একটা অদ্ভুত গুজবের কথা বলি। সেটা উনিশশো ছিয়াশি সাল, আমি দশম শ্রেণীর ছাত্রী। হঠাৎ শোনা গেল সিঁথি থেকে টবিনরোড এমন কি ডানলপেও সারা গায়ে ব্যান্ডেজ সহ একটা কিছু ঘুরে বেড়াচ্ছে যার নাম হয়ে গেল 'ব্যান্ডেজ ভূত'। এক দিন প্রতিবেশী এক কাকু এসে বললেন, সিঁথির ও দিকে কোন পুকুরে একটা মাছ নাকি মুখে ব্যান্ডেজ নিয়ে সাঁতার কাটছে।
কে জানে, আসল ব্যাপারটা কি ছিল! কোথা থেকে এই গুজবের উৎপত্তি? এখনো মাঝেমাঝে চিন্তা করি কিন্তু নির্দিষ্ট কিছু বুঝতে পারি না। ব্যান্ডেজ সারা গায়ে লাগিয়ে মানুষ ঘুরে বেড়াচ্ছে, এরকম কিছু তো কখনোই হ'তে পারে না তবু রটেছিল। তবে এ সব কথা কিছু লোকে বিশ্বাসও করে নেয়। আসলে মানুষের মনের একটা অন্ধকার জায়গা থেকে এই সব গুজব ছড়ায়। যাদের মনে এসব গুজব রেখাপাত করে তারা আরো কিছু মালমশলা জুড়ে দেয়।
  মনে রাখতে হ'বে - সে সময়ে খুব লোডশেডিং হ'ত। অন্ধকারকে কাজে লাগিয়ে মনের অন্ধকার আরো বাড়িয়ে অপরাধ ঘটত না, তাও নয়। সে রকম কোনও অপরাধী চক্রের কারবার থেকেই হয়তো এমন গুজব। স্থির সিদ্ধান্তে আসা যায় না।
     এবার আসি এমন একটা গুজবে যেটা সত্যি হ'লে আমি অন্তত খুশি হতাম। আমরা তখন পাইকপাড়ার এই আবাসনটিতে নিজেদের ফ্ল্যাটে চলে এসেছি। রং, বিবর্ণতা, সুখ, দুঃখ সব মিলিয়ে জীবন কাটছে। আমাদের ব্লকের (তখন অবধি) একমাত্র শিশুটি আমাদের যথেষ্ট আনন্দও দিচ্ছেন। তিনি গাবলুগুবলু, দুরন্ত এবং বড়ই প্রাণোচ্ছল হওয়ায় তাঁকে নিয়ে আমাদের ভালোই সময় কেটে যাচ্ছিল। শিশুটির মা, পরোপকারী, কাজেকর্মে তুখোড়, বুদ্ধিমতী বৌদি আমার মায়ের ভীষণ প্রিয়। শিশুর বয়স তখন এই বছর পাঁচেক। বৌদি এক দিন ওপরে এসে হাসতে হাসতে বললেন, এখানে রটে গেছে গাবলুর ভাই হয়েছে। অনেকে দেখতেও আসছে। আমরা তো অবাক!
   তবে এই গুজবটা সত্যি হ'লে মন্দ হ'ত না। আরেকটা বাচ্চা ওপরে এসে "পিতি পিতি" বলে ডাকত এবং বাল্ব ও ঘড়িটড়ি ভেঙে আমরা কিছু না বলা সত্বেও নিজেই কাঁদতে শুরু করে দিত! সারা দিন নিষ্পাপ শৈশবের কাছাকাছি থাকার সুযোগ পাওয়া একটা সৌভাগ্য।

Post a Comment

3 Comments

  1. AnonymousJune 27, 2023

    খুব ভালো লিখেছেন

    ReplyDelete
    Replies
    1. AnonymousJune 27, 2023

      অফুরন্ত ধন্যবাদ

      Delete
  2. AnonymousJune 29, 2023

    বাহ বেশ মজার লেখা। ভালো হয়েছে।

    ReplyDelete