দেশান্তরী -২৫
হিল্লোল রায়
ইণ্টারভিউ দিতে ফার্গো থেকে ফিলাডেলফিয়ার পথে
!!হেক্টর ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্ট, ফার্গো!!
!!নর্থ ডাকোটা!!
শনিবার, নভেম্বর ২২, ১৯৭৫; সকাল ৯-২৫
আজ ঘুম থেকে উঠেছি খুব সকালে। সম্ভবতঃ ৬-৪৫। কাল রাত্রে ঘুমিয়েছি বটে, কিন্তু ভাল করে ঘুম হয় নি আজকের ফিলাডেলফিয়া অভিমুখে যাত্রাপথের কথা চিন্তা করে। নর্থ ডাকোটা বিশ্ববিদ্যালয়ে এনভায়রণমেণ্টাল ইঞ্জিনীয়ারিং এ এম এস (M.S.) করতে এসেছিলাম গত সেপ্টেম্বর ২, ১৯৭৫। ফল (Fall)Semester শেষ করেছি নভেম্বর ২০, ১৯৭৫। গত বুধবার সন্ধ্যা সাড়ে সাতটা নাগাদ ফিলাডেলফিয়া থেকে মেজমামা ডঃ প্রদ্যোৎ নিয়োগী আমার নর্থ ডাকোটার কুঠুরীতে (১৫২৬-১২ নং স্ট্রীট নর্থ , ফার্গো, নর্থ ডাকোটা ৫৮১০২; ফোন (৭০১) ২৩৫-৭১২৪ টেলিফোন করেছিলেন। পেনসিল্ভ্যানিয়া স্টেট সিভিল সার্ভিস কমিশনের ইঞ্জিনীয়ার -১ পদের জন্য গৃহীত পরীক্ষায় সাফল্য লাভ করায় ইন্টারভিউ দেওয়ার সু্যোগ পেয়েছি। সেই খবরটা দেওয়ার জন্যই মেজমামার টেলিফোন। বৃহস্পতিবার অর্থাৎ ২০ শে নভেম্বর , ১৯৭৫ বিকাল তিনটেয় আমার পরীক্ষা শেষ করেছি। ফল সেমেস্টার শেষ হবার পর দিন দশেকের ছুটী পেয়েছি। আগামী ডিসেম্বর ১, ১৯৭৫ থেকে Winter সেমেস্টার শুরু হবে। তাই দিন দশেকের নিশ্চিন্ত ছুটি পেয়েছি।
গতকাল সিভিল ইঞ্জিনীয়ারিং ডিপার্টমেণ্ট-এ গিয়ে আমার মেল বক্স (Mail Box) চেক করতে গিয়েছিলাম বেলা ১টা নাগাদ।
আমার ছোট ভাই চঞ্চলের চিঠি পেলাম। সমস্ত খবর পেয়ে আনন্দে চোখে জল এসে গেল। তারপর মেমোরিয়াল ইউনিয়ন বারবার শপে (Memorial Union Barber Shop) গিয়ে চুল কাটতে হল ইণ্টারভিউয়ের কথা চিন্তা করে। দাক্ষিণ্য চার ডলার , সেই সংগে পঁচিশ সেন্ট বকশীষ অর্থাৎ $4.25 এর একটা চেক দিয়ে বেরিয়ে এলাম। বন্ধুবান্ধবদের সংগে খানিক গল্পগুজব করে বাড়ীতে ফিরলাম বিকাল সাড়ে চারটা নাগাদ। একটা কথা বলতে ভুলে গি্যেছি- ফার্গো ও ফিলাডেলফিয়ার মধ্যে সময় পার্থক্য ঠিক এক ঘণ্টা। মেজমামার পরামর্শমত Pennsylvania State Civil Service Commission এর জনৈক Mr. Kilbert kyle, Assistant Director, Bureau of Resources Programming, HARRISBURG Pennsylvania কে ইন্টারভিউ দেওয়ার দিনক্ষণ (Date & Time) জানাবার জন্য আমার বাসা থেকে ফোন করেছিলাম বেলা দশটা নাগাদ (ফার্গো সময়) অর্থাৎ ফিয়াল্ডেলফিয়ায় তখন বেলা এগারোটা। দুর্ভাগ্যবশতঃ Mr. Kyle ওঁর অফিসে ছিলেন না। ওঁর Secretary কে আমার ইন্টারভিউ দেওয়ার দিনক্ষণ অর্থাৎ মংগলবার , নভেম্বর ২৫, ১৯৭৫ সকাল সাড়ে এগারটা জানিয়ে দিলাম, সেই সংগে আমার টেলিফোন নম্বর।
🍂এরপর অর্ধস্নান সম্পূর্ণ করে লাঞ্চ সেরে ফেললাম বেলা দুটোয়। তারপর ডিপার্টমেন্টে গিয়ে চিঠি পেলাম। সন্ধ্যা ৬টা নাগাদ আমার বন্ধু বোম্বাই অধিবাসী (NADIR. JAL BILLIMORIA, Electrical Engineer, ) বর্ত্তমানে নর্থ ডাকোটা স্টেট ইউনিভার্সিটিতে Industrial Engineering এ M.S. করছেন। ওঁর সংগে গিয়ে আমার কাপড় জামা কেচে নিয়ে এলাম “পিগলি
উইগলি” (DEPARTMENTAL STORE) থেকে। তারপর 'বিগ্ বয়' রেস্টুরেন্টে ডিনার সেরে বাড়ীতে ফিরলাম রাত ৮-৩০। ঝোড়ো হাওয়া বইছিল। বাইরের তাপমাত্রা ১৮ ডিগ্রী ফারেনহিট। বাড়ী ফিরে ব্যাগ গুছিয়ে নিলাম। আমার বাড়ীওয়ালী আমাকে সাহায্য করছিলেন। খুব সুন্দর ভদ্রমহিলা। গোছগাছ করে শুতে গেলাম রাত ১০-৩০। কখন ঘুমিয়েছি ঠিক নেই।
ঘুম থেকে সকাল ৬-৪৫ নাগাদ উঠেছি আজ। দাড়ি কামিয়ে ব্রেকফাস্ট সেরে ফেলেছি সকাল ৭-৪৫ এর মধ্যেই। আমার অপর এক বন্ধু Mr. Javid Quddus` (যিনি বর্তমানে Bio Chemistry-তে M.S. করছেন আমার স্কুলেই)- কে ফোন করলাম ঠিক ৮-১০ সকাল। মিঃ কুদ্দুস আমাকে ওর সম্প্রতি কেনা গাড়ীতে করে এয়ারপোর্টে পৌঁছে দেবেন কথা দিয়েছেন। ঠিক ৮টায় ফোন করলাম মেজমামাকে, ফিলাডেলফিয়ায় আমার অবতরণ সময় জানিয়ে। মিঃ কুদ্দুস ঠিক ৯টার সময় আমার আস্তানায় এসে হাজির। ওর গাড়ীতেই বেরিয়ে পড়লাম বাড়ীওয়ালীকে “টা টা” করে।
বাড়ী থেকে বেরিয়েছি ঠিক ৯-১০ সকাল (স্থানীয় সময়)। এয়ারপোর্টে ঢুকবার রাস্তা খুঁজে পেতে একটু বেগ পেতে হল। শেষ পর্যন্ত এয়ায়রপোর্টে ঢুকলাম সকাল ৯-৩০ নাগাদ। হেকটর এয়ারপোর্টের লাউঞ্জে বসে ডাইরী লিখছি। একটু আগেই (মিনিট পাঁচেক মত) সিকিউরিটি চেকিং হয়ে গেল। ঘড়িতে এখন 9—৪০ । প্লেনে উঠবার জন্য সময় গুনছি।
ফার্গো হেক্টর বিমানবন্দর ত্যাগ !!
হেক্টর এয়ারপোর্ট-এ এসে আমার টিকিট নিজেই করে নিলাম। ভাড়া ১০৪ ডলার ৭৪ সেন্ট ফার্গো থেকে ফিলাডেলফিয়া। প্লেনে উঠবার জন্য সময় এগিয়ে আসছে। আমার Flight No. 336, NORTHWEST ORIENT Airlines. Departure at 10-50 AM. From Fargo।
চেকিং হবার পর প্লেনের দিকে এগুচ্ছি। ঠিক ১০-২৫ নাগাদ ঢুকে পড়লাম। ১০-৫০ নাগাদ আমার প্লেন রানওয়ের উপর ছুটতে শুরু করেছে। সীট বেল্ট বেঁধে নিলাম। মিনিট পাঁচের মধ্যেই অনেক উঁচুতে উঠে পড়েছি। আমার সীট নং 10A Left Window. একেবারে জানালার পাশে। বাইরের দৃশ্য দেখছি। ডাইরি লিখছি। ভীষণ ভালো লাগছে। কোন উদ্বেগ নেই। নীচের রাস্তাগুলো খুব সরু লাগছে। বাড়ীঘর খেলনা বলেই মনে হচ্ছে। মেঘের মধ্যে দিয়ে উড়ে চলেছি। নীলাকাশ, সূর্য্যালোক- এ এক অভূতপূর্ব দৃশ্য। এর বর্ণনা দেওয়া আমার পক্ষে সম্ভব নয়। কানদুটো এখন কটকট করতে শুরু করেছে। ক্রমশঃ উঁচুতে উঠছি। প্লেনের মধ্যে বসে আমার আজকের এই ডায়েরি লিখছি। ভাল লাগছে বেশ। এয়ার হোস্টেসদের কর্মব্যস্ততা শুরু হয়েছে। সীট বেল্ট খোলার নির্দেশ এল। নির্বিঘ্ন, নিরুদ্বেগ হোক আমার যাত্রা ভগবানের কাছে একান্ত প্রার্থনা। নিচের জিনিস আবছা লাগছে।
মিনিয়াপোলিশ অভিমুখে !!
প্লেন এখন দুলছে, আরও উপরে উঠছে। চোখ দুটো একটু জ্বালা করছে। তন্দ্রা আসছে। গত রাত্রে ভালমত ঘুম না হবার জন্যই এ অবস্থা। আমরা বর্ত্তমানে ২৭০০০ ফুট উঁচুতে। মিনিয়াপোলিশ এর তাপমাত্রা ১৭ ডিগ্রী ফারেনহাইট এবং পৌঁছাবো বেলা ১১-৩৫ নাগাদ। কফি খাচ্ছি, ডায়েরি লিখছি। আমার ঘড়িতে এখন বেলা ১১-১৮ মিনিট। দেশে থাকতে প্লেনে চাপার স্বপ্ন দেখতাম। ভবিষ্যতে কোনদিন চাপতে পারব মনে হয় নি। যদিও নিরলস প্রচেষ্টা চালিয়েছি আমেরিকা আসার ব্যাপারে। ভগবানের করুণায় আজ আমার এত দূর দেশে আগমন, বিমান ভ্রমণ। তাঁর কৃপা না হলে প্লেনে না চড়ার ব্যথা বুকে নিয়েই হয়ত পৃ্থিবী ত্যাগ করতাম। মিনিয়াপোলিশের কাছাকাছি এসে পড়েছি। সীট বেল্ট বাঁধার নির্দেশ এসেছে। বেঁধে নিলাম। 'স্নো' পড়েছে, গত কয়েক সপ্তাহ ধরে। তার নমুনা পাচ্ছি মিনিয়াপোলিশে। প্লেনের মধ্যে বসে নীচের দৃশ্য দেখছি। চারিদিকে সাদা হয়েছে স্নো জমে গেছে। এইমাত্র সূর্য্যিমামার দর্শন পেলাম। ঝকঝকে সূর্য্যের আলো জানলার কাঁচ ভেদ করে আমার মুখে ঠিকরে পড়ছে। 'সাটার' টেনে দিলাম। ঘড়িতে ১১-৩০। প্লেন ক্রমশ:ই নীচে নামছে। স্নো-এর স্তূপ পড়ে আছে। মিনিয়াপোলিশ রানওয়ে স্পর্শ করল ১১-৩২ । সুস্থির হল ঠিক ১১-৩৫।
ক্রমশঃ
0 Comments