প্রতীক্ষা
প্রবীর কুমার চৌধুরী
বিছানায় মাঝরাতে হটাৎ ঘুম ভেঙে গেলো শ্যামলীর । অন্ধকারে অভ্যাসমত হাত বাড়িয়ে বিভাসকে ছুঁতে যেতেই অনুভব করলো বিছানা শূন্য ,বিভাস নেই। পরণের শাড়িটা একটু গুছিয়ে খাট থেকে নেমে এসে দেখলো বিভাস বারান্দায় একা দাঁড়িয়ে আছে বাইরের শূন্য রাস্তাটার দিকে তাকিয়ে।
শ্যামলী যে পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে বিভাস খেয়াল করেনি কারণ সে গভীর চিন্তায় বিভোর। শ্যামলীর ডাকে তার সম্বিৎ ফেরে - কিগো তুমি একা বাইরে দাঁড়িয়ে আছো এতো রাতে,ঘুমাবে না ?
মনের মধ্যের যুদ্ধটাকে থামিয়ে বিভাস হেসে বলে - হ্যা ,চলো।
শ্যামলী জিজ্ঞাসা করে তুমি এতো মগ্ন হয়ে কি দেখছিলে রাস্তার দিকে ?
বিভাস উওর না দিয়ে শ্যামলিকে জড়িয়ে ধরে ঘরে ঢোকে।
ঘরে ঢুকেও শ্যামলী জিজ্ঞাসা করে আজ একমাস হলো বিয়ে হয়েছে আমাদের কিন্তু লক্ষ্য করেছি তুমি সব সময় চিন্তায় ডুবে আছো কি চিন্তা কর এতো? ঘরে একটা নতুন বউ এসেছে তাকে এখনো ঠিক মতো কাছেও নাওনি আর গভীর ভাবে আদরও করোনি। কিন্তু একটা মেয়ে তো তার স্বামীর কাছে এসব আশা করে ?
বিভাস কোন কথা বলে না। নীরবে শোনে স্ত্রীর কথা। কি বলবে ? কি করে বলবে বিয়ের তিন আগে মার বহু পুরানো স্মৃতিলোপ পাওয়া রোগটা আবার বাড়ে। আগেও দুবার হয়েছিল। এই রোগে আক্রান্ত হলে মা কাউকেই চিনতে পারে না। । আপন খেয়ালে ঘোরে। সবার অলক্ষ্যে বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে যায় যেমন আগেও গেছিলো। এবারেও তাই গেছে।অনেক খুঁজেছে । পাড়া, প্রতিবেশী, থানা,পুলিশ ,হাসপাতাল মর্গে ... কোথায় যায়নি সে ,তন্ন তন্ন করে খুঁজেও পাইনি মাকে। সর্বদা একটা অভাব তার বুকটাকে কুরে কুরে খায়। ঘরের যেখানে যায় সেখানেই মায়ের আস্তিত্য অনুভব করে। মা শূন্য ঘর তার কাছে যেন শ্মশানপুরীর নিস্তব্ধতা এনে দেয়। আড়ালে চোখের জল ফেলে। বুক ঠেলে হাহাকার ওঠে।কিন্তু শ্যামলিকে কিছুই বলতে পারেনা। একটা মিথ্যাকে প্রতিষ্ঠিত করতে চায় প্রতিমুহূর্তে। মা মাসির বাড়ি গেছে একমাসের জন্যে ।আমার বিয়ের তিনদিন আগে মাসির হার্ট এট্যাক হয়েছে কেউ দেখাশুনা করার নেই মেসো বাইরে পোস্টিং তাই মা তাঁর কাছে গেছেন । একটু সুস্থ হলেই বাড়ি ফিরবেন। কিন্তু যতদিন যাচ্ছে ততই বিভাসের চিন্তা বাড়ছে। একমাস কাটতে চলেছে এরপর ... এরপর শ্যামলিকে কি অজুহাত দেবে সে। তখন তো আসল সত্য প্রকাশে পাবে,শ্যামলীর যদি খারাপ ধারণা করে,,যদি ভাবে মা পাগল । তাহলে ?
ইদানিং বিভাস লক্ষ্য করে শ্যামলী আর মায়ের কথা জিজ্ঞাসা করেনা। একদিন শুধু মায়ের ছবি দেখতে চেয়েছিল আর মায়ের বিষয়ে কিছু কথা জানতে চেয়েছিল। কি নাম, মার নিজের লোকেরা কে কে আছে,কোথায় তাদের বাড়ি ইত্যাদি ইত্যাদি। বিভাস ডিটেইলসে জানিয়ে ছিল। ব্যাস এই অবধি যদিও মার ছবিটা সে আর ফেরত দেয়নি। বিভাসও আর চাইনি।
একদিন সকালে শ্যামলী বললো সে কদিনের জন্যে বাপের বাড়ি যাবে সেখান থেকে কদিনের জন্যে বনগাঁয় যাবে তার এক আত্মীয়ের বাড়ি। বিভাস না করলো না। শ্যামলীর সব কথাই সে মেনে নেয় নীরবে তার দুর্বলতা আড়াল করার জন্যেই হয়তো।। একটু শান্তি থাক সংসারে। বরং এই কদিন সে মাকে খুঁজতে পারবে। যেটা শ্যামলী বাড়ি না থাকলে তার পক্ষে সুবিধা জনক।
অফিস বেরোনোর আগে শ্যামলীর হাতে তার হাত খরচ বাবদ বেশ কিছু টাকাও দিয়ে দিল।
শ্যামলী যাবার পরদিন থেকেই বিভাস আবার মায়ের খোঁজ শুরু করলো। আত্মীয় স্বজনদের বাড়ি যাচ্ছে,থানায় ,বিভিন্ন বৃদ্ধাশ্রম ... সব জায়গা থেকেই বিফল হয়ে ক্লান্ত ,অবসন্ন হয়ে বাড়ি ফিরছে অনেক রাতে। খাওয়া, দেওয়ার ঠিক নেই ফলে শরীরও ভাঙতে শুরু করেছে।
এইভাবে যখন হতদ্দশায় দিন কাটছে ঠিক এমনি সময় একদিন শ্যামলী বিভাসকে ফোন করে জানালো কাল ভোরে উঠেই যে সে বোনগাঁয় চলে আসে। ঠিকানাও দিয়ে দিল। বিভাস কি ব্যাপার জিজ্ঞাসা করায় কোন উত্তর না দিয়ে শুধু বললো ভীষণ জরুরি দরকার আছে।
পরদিন বিভাস নিদিষ্ট ঠিকানায় যখন পৌঁছালো দেখলো বাড়ি ভর্তি লোক।বিভাসকে দেখে বাড়ি আনন্দ উচ্ছল হলো। বাড়িময় একটা আনন্দের ঢেউ বয়ে চললো জামাইকে পেয়ে।
জামাই বলে কথা তার পর বিয়ের পর প্রথম আগমন।
দুপুর বেলায় খাবারের মেনু দেখে তো বিভাসের মাথায় হাত। কাঁসার ভাতের থালা ঘিরে পর পর নানা পদের রান্নর বাটি সাজানো অনেকটা সিনেমার দৃশ্যের মতো। । কোন রান্নাই বাদ নেই। শশুর, শালারাও খেতে বসেছে সাথে। শালিকার দল মজা করছে তাকে নিয়ে।
শ্যামলী বললো নাও নাও খেয়ে নাও। তোমার মহা বিস্ময় তোলা আছে। বিভাস বললো সেকি আমার জন্যে বিস্ময়। কিন্তু খাবার মুখে দিতেই সত্যই চমক। এতো মায়ের হাতের রান্নার স্বাদ। শেষে পায়েস মুখে দিতেই বিভাসের চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ল। এতো সেই ছোট বেলার জন্মদিনে মায়ের হাতের পায়েস যা খেয়ে বিভাস আল্লাদে আটখানা হতো।হুবহু,একগন্ধ,এক স্বাদ, একই উপকরণ।
শ্যামলী বললো কেমন হয়েছে রান্না? বিভাসের মুখদিয়ে কথা সড়ছিল না। তার চোখদুটি জল ছলছল। গলা ভারী । মা-হারা শোকে জর্জরিত মন। জড়ানো গলায় শুধু বলতে পারলো- মায়ের মতো। শ্যামলী বললো যিনি তোমার জন্যে এগুলো রান্না করলেন তাকে দেখে ধন্যবাদ দেবে না ?
বিভাসের উপর দিকে তাকাবার তখন উপায় নেই তার দুচোখে তখন শ্রাবনের ধারা, গড়িয়ে পড়ছে গণ্ড বেয়ে,বাকরুদ্ধ। শ্যামলীর চোখ এড়ায় না। বলল - কাঁদার সময় অনেক পাবে, একবার এদিকে তাকাও। সেই মুহূর্তে তার আজীবন শোনা চির পরিচিত কণ্ঠস্বর বেজে উঠলো - খোকা আমি তো ...
চমকে ওঠে জলভরা চোখে তাকিয়ে দেখে বিভাস তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে আরাধ্যা দেবী। তার মা স্বয়ং।
বিস্ময়ে,আনন্দে বিহ্বল হয়ে এটো হাতেই গিয়ে জড়িয়ে ধরলো মাকে বিভাস। কোথায় ছিলে এতদিন মা আমায় ছেড়ে? আমি কোথায় না খুঁজেছি তোমায় ? মা ছেলের মাথায় স্নেহের হাত রেখে বলে - আমার লক্ষীকে ঘরে এনেছিস না। মালক্ষী আমাকে আর কোথাও যেতে দেবে না। আমিও লক্ষীকে ছেড়ে কোথাও যেতে পারবো না। বিভাস জিজ্ঞাসু চোখে তাকাতেই শ্যামলী বললো সে অনেক ইতিহাস, পাশের বাড়ির নীলা বৌদির কাছে আমি সব শুনেছি। ওই জন্যেই তোমার কাছে ছবি আর মায়ের ব্যাপারে সব জানতে চেয়েছিলাম। বাড়ি গিয়ে সব বলবো। শুধু এ টুকু শুনে রাখো আমার মেজদা পুলিশের ক্ৰাইম ডিপার্টমেন্টের বিশাল অফিসার ওঁর চেষ্টাতেই মাকে আজ খুঁজে পেয়েছি।
বিকালবেলায় সবার কাছে বিদায় নিয়ে ওরা তিনজন হাসি মুখে আগামী দিনের সুন্দর একটা সংসারের পরিকল্পনা করতে, করতে বাড়ি অভিমুখে রওনা হলো।
( সমাপ্ত )
0 Comments