জ্বলদর্চি

কালের অতল তলে কলোরাডো/ পর্ব-৬/ চিত্রা ভট্টাচার্য্য

কালের অতল তলে কলোরাডো   
পর্ব-৬  
চিত্রা ভট্টাচার্য্য

নীল আকাশে সাদা মেঘের দল দেশান্তরের অভিযাত্রী হয়ে পাড়ি দিয়েছে অজানায়।  মেঘের ওপর মেঘের ভীড় জমে গিয়ে হঠাৎ দুই এক পশলা ঝিরঝিরে বৃষ্টি মৃদু তালে ঝরতে লাগলো। তেমনি হাড় কাঁপানো ঠান্ডা হাওয়া। তারপর সোনালী রোদের ছোঁয়ায় পাহাড়ের মুখে বাঁধন হারা হাসির ঝিলিক।প্রকৃতির এমন খেয়ালী মর্জি  পাহাড়ের কোলে উম্মুক্ত প্রাঙ্গণে বসে দেখার আনন্দ অপরিসীম। বৃষ্টি এড়াতে মাউন্টেন স্কী রিসোর্টের এক পাবলিক রেস্টরুমের কাঠের শেডের তলে একাকী বসে ছিলাম। দুটো দিন এখানে ব্রতীনদের কনফারেন্স চলবে ,আইস পার্কের সামনে বসে বরফের মধ্যে মানুষের মেলা দেখে ,নোটবুক আর কলমের মিলনে রোজনামচা লিখে ভেবেছি  দিব্যি সময় কাটিয়ে দেবো। 

 সবেমাত্র গুছিয়ে বসেছি , এক লালচে চুল টিকোলো নাক প্রায় ৬ফুট, - ইউরোপীয়ান দের মত চেহারার , গোলাপি ফর্সা সাহেব এক মুখ হাসি নিয়ে চোখ থেকে সানগ্লাস খুলে ছোট্ট তোয়ালে দিয়ে মাথার জল মুছে আমার টেবিলে বসার অনুমতি চাইলেন। মিঃ স্যামুয়েল কলোরাডো ইউনিভার্সিটির রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক ,এখানে ২২বছর ধরে আছেন। পুরোদস্তুর সাহেবী কায়দায় আলাপ সেরে যখন নিখুঁত বাংলায় বললেন আমি  শ্যামলাল বাসু , কলকাতার বরানগরের ছেলে ,যাদবপুর ইউনিভার্সিটির 85--86  year-  Pass out ,মনে প্রাণে একজন বাঙালি হলে ও মার্কিন মুলুকে এসে বন্ধু দের উচ্চারণে মিঃ স্যামুয়েলে রূপান্তরিত হয়েছি।  আমি বিষম খেয়ে আৎকে উঠলাম। ওনার সাজসজ্জা চলন বলন ব্যবহার দেখে মোটেই বুঝিনি তিনি কলকাতার ছেলে। আড্ডাবাজ বাঙালি আমরা দেশে বিদেশে যেখানেই যাই না কেন স্বজাতি পেলে গল্প জমে উঠবেই। আর এককথায় গল্পখোর আমি কতক্ষণ ডায়েরি লিখবো?  হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। নিজের মাতৃ ভাষায় অন্তত কিছুটা সময় মন খুলে বকবক করতে পারবো।             
জ্বলদর্চি অ্যাপ ডাউনলোড করে নিন।👇
আত্মপরিচয় ও কলকাতা সমাচার পর্ব  সেরে শুরু হলো এই শীত কাতুরে বরফাচ্ছাদিত  পাহাড়ে নগর গড়ে ওঠার  গল্প।  তিনি বললেন সারা বছর ধরেই আস্পেন জনপ্রিয় এক পর্যটন শিল্প কেন্দ্র। তার বিশেষ খ্যাতি রয়েছে এই স্কী ক্লাব গুলোর জন্য। বহু প্রাচীন যুগ থেকেই পাহাড়ের  হাজার হাজার ফিট উঁচুতে আদি মানব সমাজের  বসতি গড়ে উঠেছিল এবং শীত প্রধান কলোরাডোর এ পাহাড়ি  অঞ্চল বারো মাসই প্রায় তুষারের কবলে ঢাকা থাকায়  তাদের  জীবন ধারন মহা সংকট ময়,দুর্ভোগের ছিল। স্তূপীকৃত জমা বরফের আস্তরণে নিমজ্জিত মানুষের পায়ের পাতা চলার পক্ষে মোটেই  উপযুক্ত না হওয়ায় বন্য প্রাণী শিকারে তারা বারে বারে ব্যর্থ হতো। তুষারাবৃত মাঠ ঘাটে পাহাড় প্রান্তরে বেঁচে থাকার প্রয়োজনে মানুষ স্বীয় বুদ্ধির জোরে দ্রুতগামী চলার জন্য স্কী আবিষ্কার করেছিল এবং তখন এটি নিত্য প্রয়োজনীয় বরফে চলাচলের জন্য অন্যতম ব্যবহাররিক সম্পদ।   
                                                     
সর্বত্র ঘন বরফ আচ্ছাদিত রাজ্যের পথে প্রান্তরে  উপত্যাকায় , বনে জঙ্গলে খাদ্য অন্বেষণে ,পশু শিকারে বা যুদ্ধ ক্ষেত্রে দ্রুত পলায়ন বা যোগ দেওয়ার জন্য স্কীয়ারের ব্যবহার অত্যন্ত গুরত্ব পূর্ণ হয়ে ওঠে।সেই সময় স্কী বোর্ড গুলো তৈরী হতো বার্চ ,ওক বা যে কোনো শক্ত গাছের কাঠের টুকরো কে গাছের ছাল , শিকড় দিয়ে কিম্বা পশুর চামড়া দিয়ে শক্ত করে মুড়ে বেঁধে। 
                                                                          ১৮৭৯ সালে হেনরী বি গিলেস্পি দ্বারা প্রতিষ্ঠিত এই রাজ্যের  কিছু  রুপালি খনির সন্ধান পাওয়া গেলে পৃথিবীর নানা প্রান্তের মানুষের দল সিলভার বা রুপা র খোঁজে এসে এই শহরে স্থায়ী নিবাস গড়ে তুলেছিল।  তাদের সংস্কৃতি ও আমোদ প্রমোদ , বিনোদনের প্রসারের জন্য কলোরাডোর এই পশ্চিম ঢালে বরফের পাহাড় কাজে লাগিয়েই নানা স্কী রিসোর্ট ক্লাব ক্রমশ বৃদ্ধি পায়। 
                                                  
  আদিম যুগের প্রাণ ধারণের জন্য ব্যবহৃত , নিত্য প্রয়োজনীয় বেঁচে থাকার  অবলম্বন স্কীইং স্কীয়ার  -- আধুনিক কালে হয়ে উঠলো ঐতিহ্য ময় প্রোমোদের যোগ্য , বিনোদনের সামগ্রী। নিত্য উৎসব প্রিয় আমুদে জাতির স্কিইংয়ের নতুন ভাবনা নিয়ে বৃদ্ধি পেলো আস্পেন কলোরাডোর অন্যতম জনপ্রিয় অবকাশ কেন্দ্র গুলো। পরবর্তী কালে সিলভার বা রুপালী বাজারে মন্দা দেখা দিলে ২০ শতকের মাঝামাঝি সময়ে আস্পেন মাউন্টেনের এই পার্বত্য এলাকা জুড়ে অনেক প্রযুক্তি ও অর্থ ব্যয় করে নির্মিত হলো  বিশাল স্কী রিসোর্ট ও আস্পেন মিউজিক ফেস্টিভ্যাল এন্ড স্কুল ,আস্পেন ইনস্টিটিউট এবং সেন্টার ফর ফিজিক্স ইত্যাদি সাংস্কৃতিক কেন্দ্র গুলো পর্যটন ও  বিনোদনের ব্যবসার কাজে  ব্যবহৃত  হয়ে শহরের আর্থিক সমৃদ্ধির উৎস সুদৃঢ় হতে থাকে। 

   এই পাহাড়ের ওপর বেশ খানিকটা উঁচুতে বসে  স্কিইং দেখছি। নানা রঙের টুপি মাথায়, নানা রঙের পোশাকে সাজা ছোট বড়ো মানুষ গুলো পায়ের তলায় তুলোর মত রাশি রাশি তুষার উড়িয়ে স্কীবুট পরে চাকার মত স্কীতে ছুটছে। কখনো ওপরের ঢালু থেকে গড়িয়ে নীচে নামছে ,কেউ আবার সোজা রাস্তায় তুষার কণা উড়িয়ে চলেছে ,বৃষ্টি তে ও দমছে না। চারদিকে বালির গুড়োর মত   ওদের গায়ে মাথায় বরফের গুড়ো জমছে , সাদা ধোঁয়ায় সব আবছা লাগছে।  আমি নাতিশীতোষ্ণ দেশের মানুষ বরফে নেমে এমন খেলা!  ভাবতেই পারি না। হাত,পা ঠাণ্ডায় অবশ হয়ে আসে। বিস্ময়ে ! চোখের পলক পড়ে না।    
                                                                                       মিস্টার বাসু বললেন , আশপাশ মিলিয়ে স্নো হোয়াইট রিভার ন্যাশানাল ফরেষ্টে এই ছোট্ট পাহাড়ি শহরটি তে চারটি গুরুত্ব পূর্ণ স্কী এলাকা গ্রীষ্মকালীন বিনোদনের জন্য বিখ্যাত হয়ে উঠেছে। ৪৪ টি গ্লোবাল স্কী রিসর্টের একটি সমীক্ষা অনুসারে প্রতি বর্গ ফুটের ভিত্তিতে আস্পেনের স্কী রিসর্ট গুলো সবচেয়ে ব্যয় বহুল। আস্পেন হাই ল্যান্ডস ,  বাটারমিল্ক এবং চিরপরিচিত স্নোমাস স্কি রিসোর্ট সুন্দর বেড়ানোর জায়গা। রোপওয়ে বা গন্ডোলাতে চড়ে আকাশ থেকে রকি পাহাড়ে নেমে , স্কীইং ক্লাবের স্থান গুলো যেমন দেখা যাবে তেমনি রকি ও বেড়ানো হবে।  দেশ বিদেশ থেকে স্কীয়াররা এখানে প্র্যাক্টিস করতে ও প্রতিযোগিতায় অংশ গ্রহণে আসে। কথার ছলে জানলাম , মিস্টার বাসু ও একজন সুদক্ষ স্কীয়ার। বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়েছেন। এবং বহু প্রাইজ ও জিতেছেন। প্রথম দিকে  তিনি ও  অবাক হতেন,এই ঠান্ডায় বরফের মধ্যে ছুটে বেড়ানো ? কিন্তু এখন নিজেই কেমন করে এই স্কীয়ার ক্লাবের life time  member হয়ে গিয়েছেন। সব যেন ঐ ছোটবেলার মত কাদা মাটি মাখা মাঠে ফুটবল পায়ে নিয়ে দৌড়োনোর নেশার মত।                                                                                            আস্পেন শহরের গোড়া পত্তনের গল্প চলছিল। মোবাইলে পারভীনের ম্যাসেজ ঢুকলো 'কোথায় তুমি ' ?  ও কে দেখতে পেয়ে ডেকে নিলাম। এবার গল্পের পালে আরো জোরদার হাওয়া লাগলো। তিনি যে আমার থেকে ও এককাটা বেশী আড্ডাবাজ। আমেরিকার আদিবাসীদের জীবন নিয়ে সোশ্যাল সাইন্সের একাধিক প্রশ্ন ওর মাথায় সর্বক্ষণ ঘুরছে। ওর রিসার্চ পেপার, নেটিভ আমেরিকান , আমেরিকান ইন্ডিয়ান ,বা আমেরিন্ডিয়ান দের নিয়ে। ও আজ বেশ খুশী ,এক প্রাচীন পুয়েব্লো গোষ্ঠীর  কোমাঞ্চ উপজাতির সাথে এখানে দেখা হয়েছে। ওর জমার খাতায় অনেক তথ্য হয়তো সংগ্রহ হয়েছে।   
            পারভীন বলে, আমেরিকা মূলতঃ অভিবাসীদের দেশ এবং এরা এশীয় বংশোদ্ভুত। পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে বিভিন্ন সময় আগত অগণিত প্রজন্ম এবং স্প্যানিশরা এই নতুন ভূমিতে নিশ্চিন্তে আবাস গড়ে তুলেছে। কলোরাডোর পশ্চিমের এই অঞ্চল গুলোতে প্রায় ১৩,০০০ বছরের ও বেশী সময় ধরে বসবাস করে আসছে  যখন থেকে ওরা আগুনের ব্যবহার শেখেনি। বন্য প্রাণী শিকার করে  কাঁচা মাংস খাওয়ার চল ছিল। ঝলসে বা পুড়িয়ে খাওয়া জানতো না।চাষবাস ফসল  উৎপন্ন করতে ও শেখেনি। সহস্রাধিক বছর আগে বিগহর্ন ক্যানিয়নে ক্রোইন্ডিয়ান এবং আরো অন্যান্য আদিবাসীরা থাকতো। আমেরিকান সরকার তাদের জমি দখল করে নিরীহ মানুষ গুলোর ওপর অন্যায় অত্যাচার, নৃশংস ভাবে হত্যা করে তাদের প্রাণ কেড়ে নিয়েছিল।  এবং  রিজার্ভেশনে পাঠিয়ে দিয়ে অনেক জায়গার ক্রমাগত উন্নতি সাধন করে জাতীয় পার্কগুলো গড়ে তোলে।                      

প্রত্নতাত্বিক গবেষণায় সেখানে তাদের ছড়িয়ে থাকা বসবাসের যথেষ্ট চিহ্ন এখনো পাওয়া যায়।                                                                                                             মনে হলো প্রফেসর বাসু বলার চেয়ে ও শোনায় বেশী  আগ্রহী।  তিনি পারভীনের কথা মন দিয়ে শুনছিলেন। এবং ওকে সমর্থন করেই বল্লেন, 
নেটিভ আমেরিকান দের পূর্বপুরুষের ভিটে থেকে উৎখাত করে নতুন ভূমি তে ক্রমশঃ আধুনিক সভ্যতা গড়ে উঠেছিল। বিশাল আমেরিকা ময় ছড়িয়ে আছে এদের নানাগোষ্ঠী। এদের মধ্যে অনেক জাতি আছে যারা বিভিন্ন সভ্যতার ধারক।  এদের লম্বাটে গড়ন ও চ্যাপ্টা নাক ,এরা রেড ইন্ডিয়ান হিসেবে স্বপরিচিতি  দিতে পছন্দ করে। শ্বেতাঙ্গ দের অত্যাচার ,স্বভূমি থেকে উৎখাত ,যুদ্ধ বিগ্রহ লড়াই মহামারী ইত্যাদিতে এদের সংখ্যা বিলুপ্তির দিকে হলে ও বহু পরিবর্তনের পর অনেক ঝড় ঝঞ্ঝা পেরিয়ে এরা আধুনিক হয়ে উঠছে।    এক সময় পুরো আমেরিকা জুড়ে রেড ইন্ডিয়ানদের রাজত্ব থাকলে ও এখন তাদের সংখ্যা কমে এসেছে।  
এই আমেরিন্ডিয়ান জন গোষ্ঠীর সদস্য ও প্রাচীন পুয়েব্লো এবং নাভাহো, এপাচে ,কোমাঞ্চ ,উটাহ  ইত্যাদি জাতি, উপজাতিদের অজানা গল্পে সময় সুন্দর কেটে গেল। পারভীনের দৃঢ় বিশ্বাস গ্রেট বেসিনের পথে আমরা ঐ নাভাহো দেরই উত্তরসুরি জনগোষ্ঠীর মানুষ কে দেখেছিলাম ,যারা আজ সংখ্যায় অনেক কম,হলে ও অনেক বেশী  আধুনিক জন জীবনের সাথে মিশে গিয়েছে।                                                                                                                                                            গল্পে মশগুল হয়ে লাঞ্চ টাইমের খেয়াল ছিল না। ,ইয়মের রেকী করা ইতালীয়ান রেস্তোরাঁয় ব্রতীন ,অতনু পৌঁছে গিয়ে ,আমাদের ডাকছে। ওরা সোজা কনফারেন্স রুম থেকে বেরিয়ে ওখানেই টেবিল বুক করেছে।  প্রফেসর ও আমার অনুরোধে এক সাথে লাঞ্চে এলেন।  মেনুকার্ডে প্রচুর খাবারের ছবি বেশীর ভাগ বীফ , শুয়োর বিভিন্ন ধরণের মাংসের প্রিপারেশন। চিংড়ি দিয়ে পাস্তার ছবিটা থেকে চোখ সরাতে পারছিলাম না। ব্রতীন বুঝতে পেরেছে ওর মত আমার ও পছন্দ পাস্তার ডিস টি। সেখানে চিকেন পিস দিয়ে টপিং করা মার্গারেট পিজ্জা ,স্পাগেটি ও পাস্তা দিয়ে সবাই নিজের পছন্দ মত লাঞ্চ সেরে নিয়েছিলাম। ইতালীয়ান রেস্তোরাঁয় এ খাবারের স্বাদ অতুলনীয়। এবং বিদায় নেবার আগে ইয়ং লেডীসদ্বয়  পারভীন ও ইয়ম কে অনেক সাধুবাদ জানিয়ে  কিছু স্কী রিসোর্ট ও রোপওয়ের পাস গিফ্ট করলেন যাতে  টিকিটের ক্ষেত্রে ওরা বেশ কিছু স্টুডেন্টস  সুবিধা পায়।                                                                                                                                         এবারে চলেছি এই ছোট্ট পাহাড়ি শহরটির বিখ্যাত চারটি স্কি এলাকায়। আস্পেন মাউন্টেন থেকে ,আস্পেন হাইল্যান্ডস বাটারমিল্ক এবং চিরপরিচিত স্নোমাস স্কি রিসোর্টে।সামনেই রোপওয়ে ষ্টেশন। টিকিট কেটে উঠে বসলাম গন্ডোলায়। লম্বা তারের মধ্যে ঝুলন্ত কাঁচের বক্স গুলোয় বসে শূন্যে ভেসে চলেছি , সে এক অনবদ্য অভিজ্ঞতা। রকির এক পাহাড় থেকে আর এক পাহাড়ের কোলে। কেবেল কার বা গন্ডোলা চড়ার সময় টুকু ,মনের মাঝে  বেশ বালিকা সুলভ আনন্দে খুশির তুফান বইছিল।  কিন্তু  নীচের দিকে তাকালে বিশাল বরফের চাদরে মোড়া গভীর খাদ।  রোমহর্ষক সে দৃশ্যে গা ছমছম করে। ত্বকের লোম খাড়া হয়ে ওঠে ,বুকের রক্ত হিম হয়ে যায়। কী এক অজানা ভয়ে আমার চোখ বুজে আসে।  বরফের পাহাড় ভেদ করে আস্পেন আর সবুজ পাইনের তির্যক মাথা গুলো আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। দূরে তুষার শুভ্র সৌম্য ঋষির মত ধ্যান মগ্ন রকি পর্বতের সুউচ্চ শৃঙ্গ নিশ্চল স্থবির।  অত উঁচুর থেকে নীচে মানুষ গুলোকে লিলিপুটের মত ছোট্ট লাগছে। ঘর বাড়ি গাড়ি এতবড় শহর যেন ছোট্ট এক পুতুল খেলার জগৎ। অতনু ইয়ম দের খুশির বাঁধ ভেঙেছে ,ওরা যে যৌবনের দূত। ভয় শব্দ টা ওদের জানা নেই। 
                                                                          পৌঁছলাম স্নোমাস স্কি রিসোর্টে। পাহাড়ের এতো উঁচুতে থৈ থৈ সাদা বরফ ,সূর্যের আলোয় কলস ভরা তরল রুপালী স্রোতে চোখ ধাঁধিয়ে যাচ্ছে তেমনি সুতীব্র ঠান্ডা হাওয়ার দংশন। আকাশ থেকে এত কাছে মেঘের মিনার হাত বাড়ালেই যেন ছোঁয়া যাবে।  কোথাও মেঘপরীরা পাহাড়ের বুকে নেমে এসে শুভ্রতায় মিশে একাকার হয়ে ধোঁয়ার মত ভেসে চলেছে।

  আস্পেনের বৃহত্তম এবং সর্বাধিক জনপ্রিয় স্কী রিসোর্টের  এলাকায়  3,332 একর স্কী যোগ্য ভূমি বিস্তৃত রয়েছে। তাছাড়া 150 মাইল ট্রেইল লিফ্ট এবং ছোট্ট একটি সাজানো চমৎকার পাহাড়ি গ্রাম ও  দেখতে পেলাম । স্কীয়ারদের বিশাল প্রাকটিস চলছে ,ওদের এই বালির মত বরফ উড়িয়ে একাগ্র চিত্তে স্কীবোট  নিয়ে ছুটোছুটির অধ্যাবসা দেখছিলাম। সদ্য স্কুল গার্ল রা বেড়াতে এসে তুষারের বল মুঠোয় নিয়ে খেলছে।       
        
ইয়মের স্কী করার বেশ অভ্যাস আছে।  ওর মতে স্কী করা কিন্তু বেশ কঠিন ব্যাপার । বলে স্কীবুট আর পোশাকের সাথে সানগ্লাস ও হালকা নাতিদীর্ঘ্য স্কীয়ার চাই। স্কী করার সময় যাতে নিজের ইচ্ছে মত থামানো যায়।একটু অন্যমনস্ক হলে বিপদের আশঙ্কা। কারণ বরফে সর্বত্র ঢাকা স্থান উঁচু নীচু স্পট গুলো সাবধানে স্কীইং করে পেরোতে হবে। একটু অসতর্ক হলেই কোথায় ছিটকে গিয়ে যে পড়বে তার ঠিকানা নেই। প্রতিমুহূর্তে দুর্ঘটনা ওঁৎ পেতে আছে। বাস্তবে স্নো মাস স্কী রিসোর্ট উপত্যকাটি অত্যাধুনিক প্রযুক্তি প্রয়োগে তৈরী ।
প্রত্যেক স্কিয়ারের কাছে একটি  স্বপ্নে জড়ানো আদর্শ স্কিয়িংয়ের প্লেস। এখানে  স্কীইং করে  নিজেকে স্কীয়ার হিসেবে সাফল্যের জাল বুনে প্রতিষ্ঠিত করতে চায় প্রতিটি ক্রীড়া প্রেমী। ইয়ম দৌড়ে গিয়েছিল স্কী করার জন্য টিকিট কাটতে। কিন্তু এখানে স্টুডেন্টস কনসেশন নেই , টিকিটের দাম ও আকাশ ছোঁয়া ওর বাজেটের বাইরে।     

 এরপর পঞ্চাশ বছর ধরে সেলিব্রেটি স্কীয়ার দের জন্য বানানো আস্পেন হাইল্যান্ডসের স্কী পার্কটি তে  এসেছি  যেখানে সেলিব্রেটিরা নির্জনে সময় কাটাতে আসে। দূর থেকে এক ঝলক দেখে চলতে গিয়ে তুষার জমা গুড়ো ঢিবিতে বে কায়দায় পা ফেলে হোঁচট খেয়ে পড়ে যাচ্ছিলাম ,ইয়ম পাশেই ছিল ধরে সামলে নিল। কিন্তু এর একটু দূরেই  বাটার-মিল্ক স্কী রিসোর্ট এলাম। মাত্র 21মাইল চওড়া স্কী রিসোর্ট টি প্রথম স্কী নিয়ে দৌড় শেখার জন্য আদর্শ জায়গা।  ছোটছোট ফুলের মত বাচ্চা গুলো স্কীইং শিখছে ,বরফে গড়াগড়ি দিচ্ছে। এখানে কনসেশনের পাস টি কাজে লাগলো , ইয়ম পারভীন খুব খুশি। ওরা স্কীবুট ,ড্রেস , স্কীয়ার ভাড়া পেয়েছে। মনে হচ্ছে নিজেরাও কিছুটা সময় ওদের সাথে ঐ অন্তহীন শুভ্র শীতলতায় গা ভাসিয়ে দিয়ে একাত্ম হয়ে যাই । 
একটি স্বদেশী পরিবারের সাথে আলাপ হলো , ওদের ক্যামেরায় একটা গ্রূপ ছবি তুলে  দিলাম।  বেশ ঘন্টা খানেক সময় রকির পাহাড়ের মাথায় ঘুরে বেড়াচ্ছি। বালির মত বরফের স্তূপএড়িয়ে চলেছি পা দিলে সরসর করে ভিতরে ডুবে যাবো । রক্তিম  রকির সব টুকু লাল ঢাকা পরে গিয়েছে শান্ত শীতল স্বচ্ছ সাদা আবরণে। তবে মাথার ওপরে অবাধ আকাশে মুক্তির আশ্বাস। সবুজবরণ ডালপালায় বরফের ভার বহন করে আস্পেন, পাহাড়ি পাইন বার্চ  নীরবে দাঁড়িয়ে আছে।  রোদের উষ্ণ পরশে টুপ টাপ শব্দে  বিন্দু বিন্দু করে বরফ গলে পরছে ।       
                                                                                      হাতের রোড ম্যাপ খুলে অতনু জানায়-- 'জন ডেনভার অভয়ারণ্যে' খুব বেশী দূর নয়। রিও গ্র্যান্ডে পার্কের আস্পেন আর্ট মিউজিয়ামের কাছে। এ শহরের  প্রিয় শিল্পী জন ডেনভারের স্মৃতি রক্ষার্থে এ পার্ক টি নির্মিত হয়েছিল। সেখানে তাঁর স্মৃতির ফলক ,তার গাওয়া কিছু বিখ্যাত গানের লাইন পাথরের গায়ে লেখা আছে।  সিজিনের নানা রকম ফুলের বাগান ও আশ্চর্য জনক খোদাই করা পাথর দিয়ে গাছ গাছালিতে ভরা সাজানো উদ্যানটি শহরের প্রিয় শিল্পী কে স্মরণের আবরণে যত্নে ঢেকে রেখেছে। কিছুক্ষণ সে উদ্যানে নীরবে কাটিয়ে তাঁর স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে  ভাবছি  আজ তবে এইটুকুই থাক। অতনু ও বলে ভীষণ পরিশ্রান্ত লাগছে এবার ঘরে ফেরা যাক। একবাক্যে সবাই রাজী। ঘরের ফেরার ডাক শুনতে পেয়ে  এগিয়ে চলেছি ।

Post a Comment

0 Comments