জ্বলদর্চি

রহইন /ভাস্করব্রত পতি

পশ্চিমবঙ্গের লৌকিক উৎসব, পর্ব -- ৭৫
রহইন

ভাস্করব্রত পতি

“বার দিনে বারনি / তের দিনে রহনি,
চালচিড়া পয়সা দে / নাই দিবি ত জবাব দে,
হাবুডাবু খেইলব নাই / না দিলে যাব নাই"। 

'রোহিনী' নক্ষত্রের নাম থেকেই এই কৃষি পরবের নাম হয়েছে 'রোহিন' বা 'রইহন' বা 'রহইন'। আসলে রোহিনী নক্ষত্রের বিশেষ অবস্থানের জন্য ধরৈন (জৈষ্ঠ্য) মাসের ১৩ তারিখেই রইহন পরব শুরু হয়। তবে ১২ ই জৈষ্ঠ্যকে বলে 'বার অহনি'। এটি রহইনের প্রস্তুতির দিন। অন্য একটি ছড়ায় আছে ---
"বারো দিনে বারণি, তের দিনে রহনি।
দে না দাদা ঠেঙা কাট্যে, বহু যাবেক বাগালি।।"

কেউ কেউ বলেন, কৃষি দেবতা বলরামের মায়ের নামে সৃষ্ট এই নাম। রহইন পরব পালন করলে বৃষ্টিপাত হবে এবং এরফলে ফসলের উৎপাদন ভাল হয়। হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় 'রোহীন' শব্দের বিশ্লেষণে লিখেছেন, -- রোহী(-হিন্) বিণ [vরুহ্ +ইন্ (ণিনি); স্ত্রী -হিণী ]। 'রোহীন' অর্থে জাত বা উৎপন্ন। Gaspare Gorresio র রামায়ণে আছে 'নগেন্দ্রবনরোহিন্'। আবার 'রোহীন' অর্থে বোঝায় 'পুনঃপুনঃ ছিন্ন হইলেও যাহা অঙ্কুরিত হয় তথা রোহণশীল'। রায় গুণাকর ভারতচন্দ্র রায় উল্লেখ করেছেন 'শিবরোহিণী' শব্দটি। যার অর্থ আরোহী। 'রোহিনী' অর্থে রোহিতকবৃক্ষও বোঝায়। এগুলি হল বট, অশ্বত্থ ইত্যাদি। তবে Capparis zeylanica নামের একটি গাছ (Family - Capparidaceae) পরিচিত রোহিনী, কালিকেরা, বাগনাই নামেও। সাপে কামড়ালে এর মূল বিষনাশক হিসেবে ব্যবহৃত হয়। শিক্ষক গৌতম মাহাতো লিখেছেন, "কোনও কোনও বুঢ়া পুরখাদের মতে-- রহ্(রাখা/থাকা/ সংরক্ষণ) > ঐন্(শুরু/প্রারম্ভিক)। অর্থাৎ রহৈন হল ধারন করে রাখার এক প্রারম্ভিক সময়ের উদ্যাপন। এই সময় বীজ ধান পরীক্ষা করে সংরক্ষিত বা গচ্ছিত করে রাখার যে প্রথা তাইই রহৈন"।

ফি বছর ১৩ ই জ্যৈষ্ঠ হল রইহন পর্বের জন্য নির্ধারিত দিন। আনুষ্ঠানিক ভাবে এই দিন রইহনের সুচনা হলেও তারপর সাত দিন ধরে চলে রহইন বা রহিন। এই এক সপ্তাহ হল ধানের বীজ বপনের সেরা সময়। বিশ্বাস যে, “রহইন বতর” বা “ধুলা বতর”-এ বীজ বুনলে বীজ তলায় বা ফসলে রোগপোকার প্রাদুর্ভাব অপেক্ষাকৃত কম দেখা যায়। এই সাত দিনের গুরুত্ব সম্পর্কে গবেষক রাখহরি মাহাতো জানিয়েছেন, "রহইনের পর সাত দিন বিরাজ করে “ডা”। “ডাহা”। কুড়মাব্দ ২৭৭২ অনুযায়ী ডা ৭ ভাগে বিভক্ত (আম ডা, জাম ডা, নিম ডা, পিতথিমি ডা, অগনি ডা, মিরগি ডা ও নিরবিস ডা)। “ডা” চলাকালীন বীজ বপন করা চলে না। “ডা” এর পরে আসে “কেতকি”। কেতকি বিরাজ করে পাঁচ দিন (দাঁত গিজড়া, সুরু মইনা, হাই সুইননা, হাই ভাত ও কুহু ভাত)। এই “কেতকি বতরে” বীজ বপনের কাজ সমস্ত সম্পূর্ণ করে ফেলা হয়। “কেতকি” আসার সাথে সাথে নেমে আসে আকাঙ্খিত বর্ষা। কেতকিতে মাটি পুরোপুরি সরস হয়ে উঠে। “কেতকি বতরে” বীজ বপন করলে সাথে সাথে অঙ্কুরোদগম। পশুপাখি, কীটপতঙ্গ দ্বারা বিশেষ ক্ষতি হয় না। বেশীর ভাগ বীজ থেকেই চারা উৎপন্ন হয়"। উল্লেখ্য ২৬ শে জ্যৈষ্ঠ্য থেকে শুরু হয় ‘কোৎকাহ ই’ বা ক্ষেতকী বা কেতকি। 
রহইন পরব শুরুর দিন খুব ভোর উঠে অন্ধকার থাকতে থাকতে প্রথম কাজ গোবর দিয়ে ঘরের চারপাশের দেওয়ালে রেখা টানতে হয়। এবার ঘরের মূল ঢোকার দরজার দুপাশের দেওয়ালে গোবরের সূর্য আঁকতে হয়। এই সূর্যের উপর সিঁদুর দিয়ে ৫ - ৭ টি তিলক টানা হয়। যাতে কোনও অশুভ শক্তির প্রভাব না পড়ে ঘরের মধ্যে। এবার বেলা বাড়তে থাকলে ঘরের চারদিক ঝেঁটিয়ে গোবর গোলা জল দিয়ে ছড়া ফেলানো হয়। আসলে এটি এক ধরনের শুদ্ধিকরণ করার পদ্ধতি। এই ঘরদোর পরিস্কারের সময় গ্রামের কিশোর কিশোরীরা কালিঝুলি, ধুলোবালি, কাদামাটি সারা গায়ে মেখে 'রইহন খেলায়' উতল হয়ে ওঠে। মাদল ধামসার সুরের সাথে পা মিলিয়ে নানাভাবে আনন্দে উদ্বেলিত হয়ে ওঠে। তাঁরা নানা ধরনের গান গেয়ে নাচতে নাচতে গ্রাম জুড়ে ঘুরে ঘুরে মাঙন করে। সেই মাঙন থেকে পাওয়া জিনিস পত্র দিয়ে সন্ধ্যায় নিজেদের মতো চড়ুইভাতি করে। নিকোনো ঘরের চৌকাঠ, প্রবেশ পথ, উঠোন, তুলসী মন্দির, খামার ইত্যাদি এলাকায় আতপ চালের গুঁড়ি জলে মিশিয়ে চৌখপুরা দিতে হয়। অনেকটা ঠিক আলপনার মতো। 
এবার বাড়ির মহিলারা হামারঘর থেকে বীজধান এনে আলাদা করে বেছে রাখেন বাঁশের তৈরি টুকরি বা টোকা বা ঝুড়িতে। সন্ধ্যার একটু আগে বাড়ির প্রধান কর্তা শুদ্ধাচারী হয়ে সেই বীজ ধান নিয়ে নিজের জমিতে যান। সেখানে গিয়ে মাটিতে তা বপন করে প্রাক প্রতীকিভাবে।  জমির ঈশান কোণে একটি পছন্দমতো জায়গা তথা ‘ভাঁড়ারকুন’ এ কোদাল দিয়ে মাটি কুপিয়ে ভগবানকে স্মরণ করে ধানের মুঠ ফেলার পর ধান ছড়িয়ে চারদিকে জমির আলের মতো করে দেওয়া হয়। মূলতঃ মুঠো ভরা ধান ছড়িয়ে জমির উর্বরতা পরীক্ষা করা হয়। তাই এই উপচারকে বলা হয় 'ধানমুইঠ্যা'। বিশিষ্ট গবেষক রামামৃত সিংহ মহাপাত্র এই উপচার সম্পর্কে উল্লেখ করেছেন, "যাওয়ার সময় একটি ছোট ডালিতে করে নিড়ানি বা পাসনি, পাঁচ কিংবা তিন পোয়া ধান, একটি হরিতকী, সিঁদুর, পান সুপারি, নিয়ে যাওয়া হয়। যাবার সময় ডালিটিকে একটি নতুন কেনা গামছা বা লাল শালু দিয়ে ঢেকে নিয়ে যাওয়া হয়। জমির ঈশান কোনে পূর্বদিকে মুখ করে বসে পাসনি দিয়ে সামান্য পরিমাণ মাটি খোঁড়া হয়। ওই মাটিতে আড়াই মুঠো ধান ছড়ানো হয়। তারপর ঐ থানে সিঁদুর, হরিতকী, পান সুপারী নামিয়ে লক্ষী পুজো করা হয়"। এবার তিনি ফিরে আসেন বাড়িতে। তখন বাড়ির মহিলারা তাঁর পা হলুদ জলে ধুইয়ে আঁচল দিয়ে মুছিয়ে দিয়ে গুড়জল খেতে দেয়। কুড়মালি আচারে একে ‘তুলসা খাওয়া' বলা হয়। ডালাটিতে থাকা ধানগুলি অন্য বীজ ধানের সঙ্গে মিশিয়ে দেওয়া হয়। সেখানে সবাই মিলে রহইন ফল, রহইন পিঠা, পায়েস, রহইন মাটি খায়। 

সন্ধ্যার প্রাক মুহূর্তে শুরু হয় রহইন মাটি সংগ্রহের উপচার। এই মাটি সংগ্রহের কাজ বর্তায় অবিবাহিত মেয়েদের ওপর। তবে কোথাও কোথাও অনেক ক্ষেত্রে পুরুষরা মাথায় পাগড়ি বেঁধে, হাতে লাঠি নিয়ে মাটি আনার জন্য যায়। এই মাটি সংগ্রহ নিয়ে একটি গেঁও ছড়ার খোঁজ মেলে -- 'রোইনী খেলায় নতুন ডালা / তাথে লিয়ে শেওড়া পালা / মাটি আনবে ঢেলা ঢেলা / গুয়ালকোনে র‌্যা্খে মাটি / চান করবে পরিপাটি'। 
তাঁরা যখন মাটি আনার জন্য যায়, সেসময় তাঁদের মৌনব্রত অবলম্বন করতে হয়। কোনও ভাবে কেউ মৌনতা ভেঙে ফেললে ফের মাটি আনতে যেতে হয়। সেসময় তাঁদের মন সংযোগ নষ্ট করে মৌনতা ভাঙানোর জন্য অন্যান্য ছেলেছোকরার দল নানা ধরনের অঙ্গভঙ্গি করে তাঁদের সামনে। কিন্তু মেয়েরা তাঁদের লক্ষ্যে অবিচল থেকে কার্যসম্পাদন করে। বাঁশের তৈরি টুকরিতে মাটি আনার সময় তা শেওড়া গাছের ডাল দিয়ে ঢেকে আনে। বাড়িতে নিয়ে এসে তা খামার গোয়াল ইত্যাদি জায়গায় রাখা হয় এবং বীজধানের সঙ্গে মিশিয়ে দেওয়া হয়। এই মাটি সারা বছর কাজে লাগানো হয় নানা কাজে। এই রইহন মাটি ঘরে এনে রাখলে গবাদি পশুর রোগজ্বালা হয় না বলে বিশ্বাস। এমনকি বাড়ির প্রত্যেকের সাপের কামড়ের ভয় থেকে রেহাই মেলে বলে ধারণা। রাতে বাড়িতে এসকা পিঠা, মাংস খাওয়া চলে জোরদার। কোথাও কোথাও নানা গ্রামীণ উৎসবের আয়োজন করা হয়। আর এভাবেই পালন করা হয় 'ধুলা পরব' বা 'রহইন পরব'।
জ্বলদর্চি অ্যাপ ডাউনলোড করে নিন।👇



Post a Comment

0 Comments