জ্বলদর্চি

কালিম্পং ডায়েরি /পর্ব-৮/সুমিত্রা মাহাত

কালিম্পং ডায়েরি
পর্ব-৮
সুমিত্রা মাহাত

ব্রেকফাস্ট প্রায় তলানিতে। পাহাড়ি যুবকেরা পরিবেশন করে ক্লান্ত হয়ে , নিজেরা খাওয়া-দাওয়া শুরু করে দিয়েছে। আমার মতো কিছু দলছুট ব্যক্তি হাজির হচ্ছে। হাসিমুখে মাথা নেড়ে পরিবেশনকারী যুবকদের সম্মতি নিই। গামলা থেকে তুলে নিই দুটি কলা,দু-পিস পাঁউরুটি,স্যালাড, চাটনি,ডিমসেদ্ধ। মাঠে খেলা চলছে। ছোটোদের আগে শুরু হয়েছে। খেতে খেতে ফোন আসে ছেলে প্রথম রাউন্ডে জিতেছে। এরপর দ্বিতীয় রাউন্ড। এই মুহূর্তে আমি ছেলের কোন কাজে আসব না উপরন্তু আমায় দেখলে ও ঘাবড়ে যাবে। তার চেয়ে যা হয় হোক। আমি সবেতেই খুশি। খাওয়া শেষ করে গেট থেকে বেরোই। মাঝে ঢালু পিচ্ রাস্তা ওপর থেকে নীচে গেছে। রাস্তা সাবধানে পেরোতে হয়। সবসময় দ্রুত গতিতে দু-চাকা, চার-চাকা নীচ থেকে উপরে উঠছে , নামছে। সাবধানে রাস্তা পেরিয়ে স্টেডিয়ামে ঢুকি। গ্যালারির একপাশে বসি। হাজব্যন্ড ছেলেকে নিয়ে আসে। খেলা শেষ। ছেলে ব্রোঞ্জ পদক পেয়েছে। তাতেই খুশিতে লাফালাফি করতে থাকে। হাসি পায়। ভাবি শুধু আকারেই বড়ো হয়েছে। শিশু সুলভ প্রবৃত্তি যায় নি। তা একশো ভাগ সত্য প্রমাণিত করে মাঠের মধ্যে বালি জড়ো করে খেলতে শুরু করে দেয়। তাকে টেনে তুলে হাত পা ঝেড়ে দিই। হাজব্যন্ড মেয়ের কাছে থাকে। আমি ছেলেকে নিয়ে স্টেডিয়ামের বাইরে বেরোই। স্থানীয় মানুষজনের সঙ্গে একটু কথা বলা যাবে আর ছেলের ইচ্ছে সে মোমো খাবে। যেদিক দিয়ে ঢুকেছি তার উল্টো দিকের গেট দিয়ে বেরোই। প্রায় পঁচিশ-তিরিশ টা বড়ো বড়ো সিঁড়ি অতিক্রম করে তবে স্টেডিয়ামের বাইরে আসি। এপাশে বাসস্ট্যান্ড, বাজার। গেটের মুখে এক দিদি গরম চুলায় মোমো সেদ্ধ করছে। একটি ছোট্ট টেবিলের উপর তার সমস্ত সরঞ্জাম রয়েছে। মোমো যা তুলছে সঙ্গে সঙ্গেই সব  বিক্রি হয়ে যাচ্ছে। মানুষের সংখ্যা তো কম নয়। আরো অনেক জায়গাতেই মোমো খেয়েছি তবে এখানকার মতো নয়। এই স্বাদই শেষ পর্যন্ত মুখে লেগে ছিল। শুধু বাঁধাকপি আর পেঁয়াজের পুর ভরা , তবু চাটনী সহযোগে দারুণ। ছেলের ভাগ্যে জোটে। আমাকে অপেক্ষা করতে হয়। 
ফুটন্ত জল থেকে ওঠা জলীয়বাষ্পের দিকে তাকিয়ে 
আর কতক্ষণ থাকা যায়। আমি পাশে চা-কফি নিয়ে বসে থাকা মাঝবয়সী মানুষ টিকে পাকড়াও করি। টুকটুকে ফর্সা রং রোদে পুড়ে তামাটে বর্ণ ধারণ করেছে। চুল উসকো খুশকো। পোশাক ময়লা। আমি জিজ্ঞাসা করি অসুখ বিসুখ করলে তারা কি করে,এত প্রতিকূল পরিবেশ। বিশেষ করে শিশু,বয়স্ক বা প্রসূতি মা এর ক্ষেত্রে। বলে , এখান থেকে কিছুটা উঁচুতে উঠে হাসপাতাল রয়েছে। তবে সেখানে সবসময় সব রকম চিকিৎসা করা যায় না। তখন তিন ঘন্টা নীচে নেমে শিলিগুড়িতে নিয়ে যেতে হয়। অন্ধকার রাতে যা খুবই বিপজ্জনক। মনে ভাবি কত অল্প কারণে অস্থির হয়ে উঠি আমরা। অথচ কত কষ্ট সহ্য করে ভয়ঙ্কর প্রতিকূল পরিবেশে নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রেখেছে মানুষ। জীবনের কঠিনতম পাঠ নিই। তবুও মন মানে না।
কৌতূহল হয় মানুষ এত নিশ্চিন্তে আছে কী করে ! রহস্য ভেদ করার চেষ্টা করি। খাদ্যাভ্যাস ও কঠোর পরিশ্রমের কারণে এখানকার মানুষের রোগ অসুখ কম হয়। যা হয় তার অধিকাংশই প্রাকৃতিক উপায়ে সেরে যায়। বেশ কয়েক টি পথ্যের কথা জানতে পারি। একটা না উল্লেখ করলে নয়। বিশেষ কোন রোগে তারা প্রজাপতির মথ ও পিপলের ছাল বেঁটে পথ্য হিসেবে ব্যবহার করে। রোগের নাম মনে নেই। পরে মেয়ে খুবই আশ্বস্ত হয়েছিল। রোগের নাম মনে থাকলে হয়ত এই পথ্য তাকে গিলতে হত। আরও কয়েকটি ভেষজ কম্বিনেশন বলেছিল। দুর্বল মেধার কারণে আমি সমস্ত গুলিয়ে ফেলেছি। পরের বার পাহাড়ে গেলে সব ছেড়ে আগে গাছ গাছড়ার ওষুধ শিখব। এলোপ্যাথি ওষুধ আমার মোটেও ভালো লাগেনা। তাই বিশেষ জরুরী। 
🍂

ছেলের প্লেট থেকে একটা মোমো নিয়েছিলাম। তাই আমার প্লেট থেকে সে একাধিক সাবাড় করে। খাওয়া সেরে দুজনে পাশের দোকানে যাই। যত রকমের ভাজা ও শুকনো খাবার সাজানো রয়েছে। এছাড়াও রয়েছে নানা রকমের আচার। সরু ফিতের আকারে চাউমিন। এক ধরনের শাক শুকনো করে প্যাকেট করা। এটা গরম জলে ভিজিয়ে টক ঝোল রান্না করা হয়। নাম জিজ্ঞেস করতে বলল 'গুঁদরুক'। আমার কানের দোষ ও হতে পারে। অলিভের আচার , চাউমিন ও গুঁদরুক এক প্যাকেট কিনি। শিশুদের দোকানে নিয়ে যাওয়া এক বিড়ম্বনা। হামেশাই এটা ওটা ধরে টানাটানি শুরু করে দেয়। ছেলের বায়না দেখে এক মাঝবয়সী স্থানীয় মানুষ এগিয়ে আসেন। বলেন,খেলতে এসেছো!বাহ!খুব ভালো । শরীরে শক্তি বাড়াতে হলে কি খেতে হবে জানো? আমি কৌতূহলী হই , ভাবি এখানকার মানুষ কী ভাবছে জানা দরকার। শরীর স্বাস্থ্যের ব্যাপারে তারা অনেক এগিয়ে। জানালেন রোজ নিয়ম করে খেতে হবে সেদ্ধ শাকসব্জি, দেশি মুরগির মাংস,আর প্রচুর পরিমাণে ড্রাই ফ্রুটস। ছেলের সঙ্গে বেশ ঠাট্টা জুড়ে দিলেন। এখানকার মানুষের এই স্বাভাবিক স্বতঃস্ফূর্ততা বেশ আকর্ষণ করে আমাকে। তবে একটা কথা শুনে এত সব কিছুর মাঝেও মন খারাপ হয়ে গেল। কথা প্রসঙ্গে একজন জানালেন অপেক্ষাকৃত নিম্নবিত্ত পরিবার গুলোতে ছেলেরা বেশিরভাগ নেশা করে পড়ে থাকে, মেয়েরাই কঠোর পরিশ্রম করে সংসার টেনে নিয়ে যায়। বাচ্চার দেখাশোনা করে। এ যেন খুবই চেনা সমস্যা। এই ধরনের অসামঞ্জস্যতা সহ্য হয় না। পাহাড়ের রূপ, রহস্য, দুর্গমতার আড়ালে এ যেন এক ছায়াময় দিক। রুজি রোজগার ও চিকিৎসার সমস্যায় পীড়িত হয় মানুষ। আর শুনতে ভালো লাগে না। দ্রুত স্থান ত্যাগ করি। 

সামান্য ফুসরৎ পেয়েছি। সকলেই মাঠে। ছেলেকে টুক করে রুমে নিয়ে যাই। একটু ফ্রেশ হয়ে নেয়। এরপর সারাদিন নানারকম অনুষ্ঠান। আর সময় পাবে না। ড্রেস পরিয়ে পুনরায় মাঠে পৌঁছে দিই। ইতিমধ্যে মেয়ের খেলা শেষ হয়েছে। সে তার প্রতিদ্বন্ধী র কাছে হেরে গেছে। প্রবল উত্তেজনা ও মানসিক চাপে সকাল থেকে প্রায় কিছুই খায়নি। শরীর সাথ দেয়নি। প্রচন্ড মনোকষ্টে সে ভেঙ্গে পড়ে। মায়েদের কত রকম পরিস্থিতির সামাল দিতে হয়। একদিকে ছেলে পদক পেয়েছে তা যেমন অ্যাপ্রিশিয়েট করতে হবে । আবার মেয়ে পায়নি তার মধ্যে ভারসাম্য আনতে হবে। সান্ত্বনা দিয়ে বলি,ভাই এর পাওয়া মানেই তোমার পাওয়া। তাকেও একটু নিয়ে বেরোই। স্টেডিয়ামের চারপাশ টা ঘুরিয়ে রুমে নিয়ে যাই। সামান্য অশ্রু বিসর্জন, লড়াই এর বিবরণ শেষে মেয়ে স্নান করে নেয়। হাজার হোক বাথরুমের লড়াই এর ময়দান এখন ফাঁকা আছে। 
স্নান শেষে মেয়েকে নিয়ে মাঠে পৌঁছাই। শুরু হয় লাঞ্চ ব্রেক। সকলে মিলে লাঞ্চ সারি। আমার সুখেই দিন কাটছে। রান্না বান্নার বালাই নেই। খাবার হাতে তুলে দিচ্ছে সুন্দর যুবকেরা। সর্বদা নিয়োজিত রয়েছি সৃষ্টিশীল ভ্রমণে। গতানুগতিক চলমান জীবনের মাঝে এই সাডেন ব্রেক মন্দ নয়!
সকলে মাঠে আসি। এরপরই শুরু হয়ে যায় চরম ট্র্যাজিক সিচুয়েশন। কালিম্পং এসে আমার নার্সারি যাওয়া হবে না তা আমি কল্পনাও করিনি। ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি শুরু হয়ে যায়। খেলা বন্ধ হয়। কোনোমতে ভিজে ভিজে সাধারণ অনুষ্ঠান চালিয়ে নিয়ে যায়। আমি ও হাজব্যন্ড প্যান্ডেলের তলায় বসি। প্রতি জেলার টিম সারা মাঠ প্রদক্ষিণ করে। অনেক বিশেষ ব্যক্তিত্ব উপস্থিত ছিলেন। এখানে বক্তার বক্তব্য থেকে আমি একটি লাইন শিখেছি। 'জোরদার থাপ্পড়ি'। কিছুই বুঝতে পারিনি। শুধু এই লাইনটার মানে বুঝে জোরে জোরে হাততালি দিয়ে গেছি। আমার কান্নায় গলা বুজে আসছিল। নার্সারি যাওয়ার লোভ আমি কিছুতেই সামলাতে পারি না। এই বৃষ্টিতে পিছল পাহাড়ি ঢালু রাস্তায় হেঁটে নার্সারি যাওয়া মানে সাক্ষাৎ মৃত্যুর মুখোমুখি হওয়া। হাতের নাগালে থাকা সত্ত্বেও নার্সারি যাওয়া হল না। একদল পাহাড়ি মেয়ের বৃষ্টি স্নাত নাচ দেখে মনটা একটু ভালো হল। বিভিন্ন জেলার ছেলে মেয়েরা দল বেঁধে তাদের সঙ্গে ফটো তুলতে উঠে পড়ে লাগে। মেয়েও বাদ যায় না। অবশেষে ঘন অন্ধকার, ঝমঝম বৃষ্টিকে সঙ্গে নিয়ে জীবনের দ্রুততম ডিনার সন্ধে সাতটা তে সারি। এরপর আর কোন কথা নয়। রাস্তার সামান্য আলোয় সিঁড়ির ধাপ হাঁতড়ে হাঁতড়ে একেবারে রুমে। জানালা দিয়ে পাহাড়ের গায়ে আলোর মালা দেখে আর আকাশের তারা গুনে মনের দুঃখ দূর করি। খেলার হার-জিত, অসময়ে খেলা বন্ধ হয়ে যাওয়া,প্রতিপক্ষের বাড় - বাড়ন্ত , পাহাড়ি নৃত্য শিল্পীদের উজ্জ্বল উপস্থিতি,অকাল বৃষ্টি , সারাদিনের নানান মুখরোচক আলোচনার মধ্যে দিয়ে আজকের দিনটি শেষ হয়।

Post a Comment

0 Comments