বাগদি চরিত (চতুর্দশ পর্ব)
শ্রীজিৎ জানা
লোখা জানে, বাগদির হাড়ে উন্নতি নাই। মাটির মালিক হতে পারবে না তাদের জাত। জমিজমা তাদের কপালে নাই। বাপ ঠাকুর্দা জমি ধরে রাখতে পারেনি। দু'কাঠা চার কাঠা জমিতেই তাদের সারা বছরের লবরচবর। খাল বিল নদীর মাছ, গেঁড়ি কাঁকড়া আর জন খাটা এইসব নিয়েই তাদের বেঁচেবর্তে থাকা। লোখা তার মায়ের মুখে শুনেছে কুলিপুকুরের ধারে তাতের চার বিঘার বন্দ ছিল। ঠাকুর্দা নাকি তখনের সময় পঞ্চাশ টাকায় বিক্রি করে দেয় ঘোষদের। এখন সেই ঘোষদের ঘরেই জন খাটতে যায় লোখা। লোখার মতো অনেকেই জন খাটতে ছুটে সকাল হলেই। লুঙ্গি ভাঁজ করে পরে,কাঁধে গামছা ফেলিয়ে চলল সকাল হতে না হতেই। বাগদির কপালে টাকাকড়ি সম্পত্তি সারাক্ষণ লাফাইঝাঁপাই করে। কেউ যদি তাকে জব্দ করে রাখতে পারে ত রইল,নইলে ফতুর ফাঁই। তার উপরে বাহাল্লি দ্যাখানা বাগদির স্বভাব। নিশিকান্তকে তেমন রোগেই পেয়েছে। পাড়ার লোক বলত,
—-বুজলু লোখা,তোর দাদা ত রে গাছে না উঠতেই এক কাঁদি। বাছুর হালিঘাস খেলে যেমন ছ্যারে তোর দাদাও দেখিঠি ত্যামনি। হাতে কাঁচা পয়সা পেয়ে ধরাকে সরা মনে করেঠে যে রে।
—আমি ছোট ভাই। দাদার মুখের উবরে কী কিছু বলা যায়!
—-শুনিঠি নাকি মোদের জাতের মেইছ্যানাকে বিয়া করবেনি, নিশা। মাহিষ্যর মেইয়ার সঙে ভাব ভালবাসা হইচে যে?
—-আমিও শুনেচি। এখন শুনা কথার বুনা ধান। সে যেদি তাই মনে করে,আমি কী আপত্তি কত্তে পারবো,বল দেখি।
লোখা আপত্তি করতে পারে নি। তার পক্ষে করা সম্ভব নয়। তার সান দাদা আলাদা ধরনের। কারো কথাকে গায়ে মাখে না। তার উপরে সোনার কাজে মুঠা মুঠা রোজগার। বাইরে সে ঘর কিনেছে। নিজের জাতকে সে নিজেই পছন্দ করে না। নিশিকান্ত মনে করে বাগদিদের সব মেয়েই তার সাগরী বৌদির মতো। কথায় কথায় ঝগড়া করে। মুখে আচালিপচালির খই ফুটে। পুকুর ডোবা খাল বিলে মাছ ধরে বেড়ায়। জামবাটিতে পান্তাভাত আর টক আমানি নিয়ে গাল গাল খায়। কালো কেলেন্দি গায়ের রঙ। শরীরের যত্ন জানে না। চুলের যত্ন জানে না। সে বিয়ে করলে অন্য জাতের মেয়েকেই বিয়ে করবে। ফর্সা ধবধবা মেয়ে। তার গা থেকে বেলফুলের গন্ধ বেরোবে। আর এই গ্রামে সে থাকবে না কোনো দিন। করলও সে তাই। নিশিকান্ত বিয়ে করে কাঁসাইপারে। কিভাবে যোগাযোগ হয় কেউ জানে না। অনেকে বলে,
—-মাহিষ্য হলে কী হবে,মেইছ্যানার বাপের উদ খেতে খুদ নাই। দেখেছে ছ্যানার টাকা আছে তাই গতি দিছে।নাইলে বাগদি ঘরে মাহিষ্যর মেইয়া দেই কখন!
নিশিকান্ত হঠাৎ কাউকে না জানিয়ে বিয়ে করে নেয়। বরদার বিশালাক্ষী মন্দিরে বিয়ে হয়। তারপর সোজা বাইরে নিয়ে চলে যায়। নতুন বউ শ্বশুরের ভিটেতে উঠে নি। বিয়ের মাস ছয়েক পর নতুন বউকে ঘরে নিয়ে আসে। মাঝে লোখাকে একবার শুধু ফোনে জানায় নিশিকান্ত। মনে মনে কষ্ট পায় লোখা। রাগও হয়েছিল তার। নিশিকান্তর বিয়ের মাস ছয়েক আগে লোখা বিয়ে করে। পাঁচ ভাইয়ের ঘর হলেও বাবা মা গত হওয়ার পর থেকে সব ছিন্নভিন্ন হয়ে যায়। মাঝে সেজদাদা জয়রামের নিরুদ্দেশ হওয়া সংসারে মাথায় বাজ পড়ার মতো । লোখা নিজেকে একা ও অসহায় বোধ করে।বড় মেজ কোন কিছুতেই নাক গলাতে চায় না। নিশিকান্ত তখন বোম্বে। সব ঝড় একা পোহাতে হয় লোখাকে। আরতি বৌদি বাপের বাড়ি চলে যাওয়ার পর আরো মুষড়ে পড়ে লোখা। সেই সময় একমাত্র ভরসার স্থল হয়ে দাঁড়ায় খগেন মাস্টার। মাস্টার তাকে পরামর্শ দ্যায়। বাখুলের বড়রা তাকে বোঝায়,
—--ঘরে একটা মেইয়ামানুষ না থাকলে চলবেনি,বুজলু! তুই একা পুরুষ মানুষ কুন দিক সামলাবি।
—--কাজ থিকে এসে হাত-পা পুড়িয়ে রাঁদা তোর দ্বারায় সম্ভব নয়,বুজলু লোখা।
—--একটা বিয়া কর,দিখি। সব ঠিক হই যাবে।
লোখা মহা ফাঁপরে পড়ে যায়। সকলকে বোঝানোর চেষ্টা করে সে,
—--সবই বুজিঠি। কিন্তু এখনো সানদ্দা বিয়া করে নি। মোর বিয়া করাটা কী ঠিক হবে। লোকে কী বলবে?
খগেন মাস্টার ধমক দ্যায়,
—--লোকে অনেক কিছু বলবে। এখন লোককে বল দিখি তোর সংসারের হালটা ধত্তে! দেখি কজন এগি এসে। সবাই ছুঁত খুঁজার অস্তাদ।
🍂খগেন মাস্টারের কথা এড়িয়ে যেতে পারে না লোখা। কিন্তু মনের ভিতর হাজারটা চিন্তা জট পাকায়। কাকে বলবে সে এসব চিন্তার কথা। মাস্টারকে বলা মানে লোখা জানে সব কথাকে সে ফুঁ দিয়ে উড়িয়ে দেবে। তার কাছে কোন সমস্যার সমাধান নেই বলে নয়। লোখার মনে যে সব ভাবনা জলকে ঘোলা করছে সেগুলো সমস্যা নয়, তাকে বলে মনঃকষ্ট। ছ্যাঁকা লাগা জ্বলুনির মতো। বুকের ভিতরে সারাক্ষণ জ্বালা করে। লোখা বলে,
—মাস্টার তুমি বই পড়েছো,কতকিছু জানো, কিন্তু মানুষের মনটা জানা অত সজা নয়। বইয়ে মানুষের কথা লিখা থাকে, মনের কথা থাকে নি। চোখের আড়ে কত যোগ বিয়োগ গুন ভাগের লিখাপড়া চলেঠে তুমি ধত্তে পারবেনি মাস্টার। লোখা অত পড়াশুনা করে নি ঠিকই কিন্তু বুজতে পারে। শুদু বুজাতে পারে নি।
বিয়ের কথাটা ওঠার দিন থেকে রাতে লোখার চোখে ঘুম আসত না সহজে। একটু তন্দ্রা আসত কী নিমিষে তা উড়ে চলে যেত চোখের পাতা থেকে। ঘরটাকে তখন লোখার অমাবস্যা রাতের কালসাবা মাঠের মতো মনে হত। পুরু ঘুটঘুটে কালো ঝুলকালিতে ঢেকে যাওয়া একটা মাঠ। চারিদেকে তার শূন্যতা। কোথাও একটু আলোর রেখা নেই। পাঁচ ভাইয়ের ঘর অথচ জনপ্রাণী হীন শূন্যপুরী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে তাদের বাক্সবারান্দা। ভগী খুড়ার কাছে হাউমাউ করে কেঁদে ফেলেছিল লোখা,
—-সবাই বলেঠে বিয়া কর,বউ আন ঘরে।কিন্তু বিয়া বল্লেই কী বিয়া খুড়া? কী দেখে মোকে মেইছ্যানা দিবে বল দিখি। তাবাদে মাথার উবরে কেউ নাই মোর। দাদারা থেকেও নাই। মা বাপ ত কবেই ফেলি রেখে চলে গ্যাছে। যদি তারা থাকত থাইলে কী লোখার এই দুদ্দশা হত! কে মাথা হবে? কে এগি এসে দাঁড়ি থেকে লোখার বিয়া দিবে! মা বাপ যার নাই তার কেউ নাই গো খুড়া। সংসার বল্লেই কী সংসার। পরের ঘরের মেইছ্যানা এসে চোখের জল ফেলাবে তা হবে নি। মাস্টার এসব বুজেনি খুড়া। সংসার সে ত করেনি। তুমি বয়স্ক জ্ঞানমান লোক। তুমি ঠিকই বুজবে। মা বাপ ঘরের খুঁটা। খুটাটাই যার নাই সে ঘরের চাল ত ভেঙে পড়বেই, জানো। বাপ মা না থাকলে লোকে বলে দাদারা নাকি বাপের মত কাজ করে। সেখিনেও মোর কপালে ছ্যাঁদা। বাপ বোলতো, শালার ভাগ্য কুম্ভরাশ/ থাকিস থাকিস যাস যাস। লোখার ভাগ্যেও কুম্ভরাশ
ভগীরথ খুড়া লোখাকে সান্ত্বনা দ্যায়,
—-অত ভেঙে পোড়িসিনি লখি। মা কালীকে জানা সব ঠিক হই যাবে। দাদারা নাইবা মাথা হল তোর জেঠা খুড়ারা ত আছে। এখন ত ভাগারি দিয়াজি উঠে যায়নি। তুই যেদি বলু আমার লজরে একটা মেইছ্যানা আছে থাইলে কথা বোলবো। তাবাদে তোর জেঠা খুড়াদের সঙেও কথা বোলবো। খগেন মাস্টারকেও শুনাব দেখি কী বলে।
—-মন থিকে জোর পাইনি বুইলে খুড়া। তাবাদে মোর মত লটম্বরা ছ্যানাকে কে মেইয়া দিবে!
—--সব দিবে। মেইয়ার বাপও গরীব। তাবাদে তুই ত কুড়া নোউ। খেটেলুটে দুটা পেট চালাতে ঠিকই পারবি।বাগদি ঘরের ছেনা অত রাশ হাল্কা কত্তে নাই। কথায় বলে জানু---বাদি জাত হোরাল জাত/ যদি না মানে পোষ/ পঁদ ঘসটিয়ে পঁদ ঘসটিয়ে/ যাবে আড়াই কোশ। মোদের ঢোলের ফলহারিনী মা সব ঠিক করে দিবে। চিন্তা করিসিনি।
ভগীরথ খুড়ার দৌলতে লোখার বিয়ের তোড়জোড় শুরু হয়। মেয়ের বাপের বাড়ি মেটাসরায়। খগেন মাস্টার একদিন মুচকি হেসে বলে,
—-থাইলে লোখা তোর ভাগ্যে মেটা বাগদির মেইছেনা জুটল!
লোখা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায়। বিয়ে সে তো করতেই চাইছিল না। ভাগ্য তার সহায় নয়। সবসময় অশুভ চিন্তা তার মাথা কুরেকুরে খায়। মাস্টারের কথা শুনে লোখার মুখ কালো হয়ে যায়। ভাবে মেটা বাগদি মানে অপয়া অশুভ হবে। শুকনো মুখে খগেন মাস্টারের কাছে জানতে চায় লোখা,
—-কী বলঠ মাস্টার। ঠিক করে বল। মেটা বাগদি কী বাগদি নয়? তুমি ত জান মাস্টার মোর জাতের মেইছেনা ছাড়া আমি বিয়া কোরবোনি। খারাব কিছু হলে মোকে কেউ রাজি করাতে পারবে নি।
লোখার চোখমুখের অবস্থা দেখে মুখ টিপে হাসতে থাকে মাস্টার। আর বেশিক্ষণ লোখাকে কষ্ট দিতে তার মন সায় দেয় না। তাকে আস্বস্ত করে বলে,
—-আরে মেটা বাগদিও বাগদি। বাগদির জাত চার ধরনের। অই যে কথায় কথায় বোলুনু তেতুলা বাগদির কথা। সেই তেঁতুলিয়া, কাঁসাইকুল্যা,কুশমেটা,মল্লমেটা নিয়ে চার ধরণের বাগদি আছে। তোর হবু শ্বশুর ঘর মানে মেটাসরার বাগদিরা হল মেটাবাগদি।এরও অনেক গল্প আছে জানু। একবার নাকি শিবের বউ পার্বতী মেছানীর বেশ ধরে শিবকে পরীক্ষা করে। শিবের চরিত্ত খারাপ নাকি। শিব তা জানতে পেরে যায়। তখন রেগে জিয়ে বলে তমার ছেনারা সব বাগদি হবে। মাছ ধরে পেট চালাবে।
—-তার মানে মোদের জাতের জন্ম মা দুগ্গার গভ্যে!
—--তা বলতে পাবোনি। তবে কি জানু পুরানের আর সব গল্প সত্যি কিন্তু যেই মোদের জাত নিয়ে কুনু আখ্যান থাকবে অম্নি উঁচু জাতের পন্ডিতদের মাথায় চড়কা পড়ে যাবে। ইসব কথা ত মোদের জাতের লোক লিখেনি। লিখেছে ত অরা। থাইলে মানতে এত যন্তনা কিসের?
—-সে তারা মানে না মানবে। মোদের ছ্যাঁড়া গেল। কিন্তু জাতের চার ভাগের বাথ্যাটা দও।
—--আরেকটা কাহিনী বলচে,শিব ঠাকুর নাকি তখন কোচবিহার অঞ্চলে সংসার কচ্ছিল। পার্বতী ঠাকরুন জেলানীর বেশে কোচদের ফসল নষ্ট কত্তে থাকে। তখন শিব ওই জেলানিকে মায়া দিয়ে বশে আনে। তাদের একটা করে বেটাছ্যানা আর মেইছেনা হয়। তারা আবার পরে দুজনে বিয়া করে। তাদতের বেটাই নাকি মল্লরাজ হাম্বীর। সেই রাজা হাম্বীরের চারটি মেইছ্যানা হয়। শান্তু,নেতু মন্টু ও ক্ষেতু নামের মেইছ্যানাদের নামেই মোদের জাতের চার ভাগের নাম। অই যে তোদের মাল পদবী, সেটা মল্ল নাম থিকে এসেছে।
1 Comments
কথ্যভাষা যা আখ্যানটিতে শুরু থেকেই বিরাজমান তা সংশ্লিষ্ট যে অঞ্চলটিকে চিনিয়ে দেয় সেটা কিন্তু যথেষ্ট গলদযুক্ত। এখানে দু তিন খানা আঞ্চলিক ভাষা প্যার্টান ককটেল হয়েছে মনে হয়।
ReplyDelete