জ্বলদর্চি

ছোটোবেলা বিশেষ সংখ্যা ১৩৭

 ছোটোবেলা বিশেষ সংখ্যা ১৩৭
সম্পাদকীয়,
তোমরা এটাকে 'ওয়াদা' বলতে পারো, অনেকে বলবে 'মানত'। আমি বলি 'শপথ'। বলব না কেন? জুনের শেষ হতে চলল, আষাঢ় পড়ে গেল তবু এলো না! রোজই শুনি আসছে, আসছে। শেষে ঠিক করলাম, যতক্ষণ না সে আসে ছোটোবেলা প্রকাশ করব না। তাই তো আগের সপ্তাহে ছোটোবেলা প্রকাশ করিনি। আমার গোঁ ভাঙাতে এল খয়রাপাখ পাপিয়া। কুন্তল আঙ্কেল তার ছবি টুক করে তুলে পাঠিয়ে দিল। আমি প্রচ্ছদে দেওয়া মাত্রই পাপিয়াটা বলে উঠল, রিম ঝিম রিম ঝিম.... ব্যস আমার মান ভেঙে গেল। শুধু কি প্রচ্ছদ?  দিলীপ জেঠুর লেখা গল্পে কাকেদের ঠেলায় ছোটোবেলা প্রকাশ না করে যাই কোথায়? কাক যখন এল, কোকিল না এসে যায় কোথায়? সুমিত্রা পিসি নিয়ে এল কোকিলের ছড়া। আর তোমাদের বন্ধু মৌনর বন্ধু টিয়াটাও এল। অমনি সেও এল। বর্ষার আগমনে সব পাখিরা ছোটোবেলায় এসে মেলা বসালো। মেলা বসাবে না কেন? রথের মেলার ছবি এঁকেছে আয়ুস্মিতা। আরে বৃষ্টি কি শুধু এখানে? লাচুঙেও বৃষ্টি। লাচুঙে আপেল বনে, এলাচের জঙ্গলে বৃষ্টি। দেখেছো কখনো? আমি তো দেখিনি। চলো শ্রীকান্ত আঙ্কেলের লেখায় দেখে আসি। তারপর শ্যামদেশ ঘুরে আসি বাসবদত্তা আন্টির সঙ্গে। শ্যামদেশ কোনটা জানতে পড়ে নাও লেখাটা। আর দোলনচাঁপা আন্টির স্মরণীয় দিবস পড়ে রুদ্রাংশের আঁকা দেখে জানিও কেমন লাগলো আমাদের বৃষ্টি আগমণের আনন্দে প্রকাশ পাওয়া ছোটোবেলা। তারপর অসীম আঙ্কেলের মতো পাঠ প্রতিক্রিয়া লিখে হয়ে যাও ছোটোবেলার সেরার সেরা পাঠক। - মৌসুমী ঘোষ।

ছোটগল্প-
পিয়াল এক স্বপ্নের দেশ
দিলীপকুমার মিস্ত্রী

স্কুল কিংবা খেলার মাঠ,বাড়ি ফিরে তমোনাশ রোজ মামের কাছে গুচ্ছের নালিশ করে। বলে,গ্রামের ছেলেগুলো কেমন কেমন যেন। বিচ্ছিরি ঢঙে কথা বলে। নোংরা,অগোছালো জামাকাপড়। মাম,তুমিই বল,এদের সঙ্গে মেলামেশা,বন্ধুত্ব করা যায়?  বড্ড আনস্মার্ট ছেলেগুলো।
          তমোনাশ ক্লাস সিক্সে পড়ে। ওর বাবা ডাক্তার। সম্প্রতি দুর শহর থেকে বদলি হয়ে পিয়াল গ্রামীণ হাসপাতালে এসেছেন। হাসপাতাল লাগোয়া স্টাফ কোয়ার্টারে সপরিবারে থাকছেন। কিন্তু জমজমাট শহর ছেড়ে হঠাৎ অজ গ্রামের পরিবেশে এসে কিশোর তমোনাশের একেবারে দমবন্ধ অবস্থা। তার কষ্টের কথা মন দিয়ে যেটুকু শোনে তা একমাত্র তার মাম।
              একদিন মাম কর্তাকে বলল,এই শুনছো,গ্রামে থাকতে তোমার ছেলের কিন্তু খুব কষ্ট হচ্ছে। তুমি ওকে শহরের কোনও হোস্টেলে রাখার ব্যবস্থা কর। তানাহলে, ছেলেটা একেবারেই নষ্ট হয়ে যাবে।
            গিন্নির কথা শুনে কর্তামশাই বলল,সুরঞ্জনা,শেষ পর্যন্ত তুমিও এমন অদ্ভুত ভাবনা ভাবতে শুরু করেছ! শোনো সুরঞ্জনা,আমাদের দেশের সত্তর ভাগ মানুষ আজও গ্রামে বসবাস করে। গ্রাম থেকেই দেশের বেশিরভাগ সেরারা উঠে আসছে। আমিও তো গ্রামের ছেলে। আজ ডাক্তার হয়েছি। সুরঞ্জনা,তুমি অযথা দুশ্চিন্তা করছ। তমোনাশ শহর থেকে সবে পিয়াল গ্রামে এসেছে। এখানকার জল-হাওয়া,পরিবেশ,মানুষজনকে মানিয়ে নিতে ওর একটু সময় লাগবে বৈকি। তুমি দেখবে,একদিন তোমার ছেলে এই গ্রাম ছেড়ে শহরে ফিরতেই চাইবে না। আর একটা কথা,স্কুল কিংবা খেলার মাঠ থেকে ফিরে আসার পর,তমোনাশের যেসব সমস্যা তোমার কানে আসছে;ওগুলো স্বাভাবিক। ছোটোদের অমন আড়ি-ভাব,খুনসুটির মধ্যে বড়োদের না ঢোকাই ভালো। একদিন ওসব ওরা নিজেরাই মিটিয়ে ফেলবে।
              এক রবিবারের সকাল। তমোনাশ বাবার সঙ্গে বারান্দায় বসে চা খাচ্ছে। এমন সময়,তাদের উঠোনে এসে জড়ো হয়েছে বেশ কয়েকটা কাক।উপস্থিত হয়েছে তাদের দু'টো ছানাও। বাবা তমোনাশকে বলল,মামের কাছ থেকে দু'টো বিস্কুট নিয়ে এসো তো।
        বাবার কথা শেষ হওয়া মাত্র তমোনাশ এক-ছুটে গিয়ে বিস্কুট হাতে নিয়ে ফিরে এল। তারপর,বিস্কুট ভেঙে ভেঙে উঠোনের মাঝে ছুঁড়ে ফেলতে লাগল। আর সেই বিস্কুটের দখল নিতে কাকগুলোর মধ্যে বেঁধে গেল তুমুল ঝগড়া,জোর  মারামারি। তা দেখে তমোনাশ নেমে গেল উঠোনে। তাকে দেখে কাকগুলো মারামারি থামিয়ে উড়ে পালাল যে-যেদিকে পারল। কিন্তু ছানা দু'টো রয়ে গেল উঠোনে। কারণ ওরা তেমন উড়তে শেখেনি। তারা কা-কা শব্দে চিৎকার করে শুধু লাফাতে লাগল।
           তমোনাশ একটা ছানাকে ধরে ফেলল। আনন্দে তাকে নিয়ে বারান্দায় এসে  বাবার পাশে বসেও পড়ল। কাকের ছানা ধরতে পেরে তার চোখেমুখে যেন খুশির ফোয়ারা ফুটছে। কিন্তু মুহূর্তে তার সেই খুশি উধাও হয়ে গেল। মা-কাকের ডাকাডাকিতে চারদিক থেকে উড়ে এল শত শত কাক। তাদের সমবেত চিৎকারে বাড়িশুদ্ধু লোকের কান একেবারে ঝালাপালা। শেষে,কাকের দল রণং দেহি মুর্তিতে তমোনাশের দিকে তেড়ে এল বারান্দা পর্যন্ত। কাকেদের এমন মারমুখী চেহারা তমোনাশ আগে কখনও দেখেনি। সে খুব ভয় পেয়ে গেল। ভয়ে ছানাটাকে বাবার হাতে দিয়ে সে থরথর করে কাঁপতে লাগল। বাবা দেরি না করে ছানাটাকে ছেড়ে দিল উঠোনের মাঝে। ছানাকে ফেরৎ পেয়ে কাকেদের দল ধীরে ধীরে শান্ত হল। ছানাটাকে নিয়ে তারা চলেও গেল সেখান থেকে।
           কাকগুলো চলে যাওয়ার খানিক পর বাবা তমোনাশের চোখে চোখ  রেখে জিজ্ঞেস করল,তমোনাশ,কিছু বুঝলে কাকেদের ব্যাপার-স্যাপার ? তমোনাশ কোনও উত্তর দিল না। বাবা আবার বলল,দেখলে তো,বিস্কুটের ভাগাভাগি নিয়ে কাকগুলোর মধ্যে কত ঝগড়া,কত মারামারি। কিন্তু যেই তুমি ওদের একটা ছানাকে ধরে আনলে,অমনি ওরা নিজেদের সব বিবাদ ভুলে গিয়ে ছানাটাকে উদ্ধারে একসঙ্গে ঝাঁপিয়ে পড়ল। তমোনাশ,এটা শুধু কাকেদের মধ্যে নয়,এটা পিয়াল গ্রামে সব মানুষের মধ্যেও  রয়েছে। সেই জন্যেইতো তোমাকে বলি,স্কুলে,খেলারমাঠে বন্ধুদের সঙ্গে মনোমালিন্য হলেও একটু মানিয়ে চলতে শেখো। দেখবে,বিপদের দিনে ওরাই বন্ধু হয়ে তোমার পাশে দাঁড়াবে। তোমাকে সাহায্য করতে ওরা সেসময় দু'বার ভাববে না। এটাই তো গ্রামের আসল বৈশিষ্ট্য। 
            তমোনাশ বাবার কথা মন দিয়ে শুনল। কিন্তু কোনও উত্তর দিল না। শুধু মনে মনে বলল,হুঁ,গেঁয়ো মদন বসন্ত অনাদিদের সঙ্গে বন্ধুত্ব! ওরা সবাই এক-একটা গাঁইয়া ভূত। ওরা শহরের স্মার্ট লোকদের শুধু হিংসে করতে জানে।
              মাসখানেক পর একদিনের ঘটনা। তমোনাশ স্কুল থেকে বাড়ি ফিরছে। শীতের বিকেল যাই যাই করছে। রাস্তায় তার পাশে আর কেউ নেই। তার অনেক পিছনে দলবেঁধে আসছে কৃষ্ণ মদন বসন্ত অনাদি বিপুলরা। হঠাৎ একটা নেড়ি কুকুর ঘেউ-ঘেউ করে তমোনাশের দিকে তেড়ে এল। তমোনাশ ভয়ে চিৎকার করে প্রাণপণে ছুটতে লাগল। স্কুলব্যাগ নিয়ে ছুটতে ছুটতে বার দু'য়েক রাস্তায়  সে আছাড় খেয়ে পড়লও। কিন্তু কুকুরটা কিছুতেই তার পিছু ছাড়ল না।
          তমোনাশের পিছনেই গল্পে গল্পে হাঁটছিল কৃষ্ণ-মদনরা। তমোনাশের চিৎকার কানে আসতেই  তাদের সব গল্প থেমে গেল। তারা সেদিকে তাকাতেই চমকে উঠল। কোনও কিছু না ভেবে তারা তমোনাশের দিকে ছুটতে শুরু করল। সঙ্গে  সঙ্গে  সমস্বরে চিৎকার করে  উঠল,হেই,হ্যাট্ হ্যাট্। এতগুলো ছেলে চিৎকার করে তার দিকে ছুটে আসছে দেখে,কুকুরটা খুব ভয় পেয়ে গেল। ভয়ে সে অন্য দিকে ছুটে পালাল। সবাই তমোনাশের কাছে এসে দেখল,সে ভয়ে ধরধর করে কাঁপছে। ভয়ে তার ঠোঁট দু'টো নীল হয়ে গেছে। তার জামাপ্যান্ট,হাতে-পায়ে ধুলো ভর্তি। ডান হাতের কনুই,কপাল সামান্য ছড়ে গেছে। বসন্ত নিজের স্কুলব্যাগ থেকে জলের বোতল বের করে তমোনাশের হাত-মুখ ঘুয়ে দিল। কৃষ্ণ,মদন তার জামাপ্যান্ট,মাথার ধুলো ঝেড়ে  পরিস্কার করে দিল। তারপর তারা বলল,তমোনাশভাই,চল আমরা তোমাকে বাড়ি পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে আসি। তমোনাশ অবাক হয়ে সবাইকে দেখতে লাগল,খানিকটা বোকার মতো। কৃষ্ণ তার কাঁধে হাত রেখে বলল,ভাই,তুমি শহর থেকে আমাদের এই গ্রামে নতুন এসেছ। তোমার বাবা ডাক্তারবাবু। তোমার সঙ্গে আমাদের তফাৎ আছে বৈকি। কিন্তু তুমিও তো আমাদের গ্রামের একজন। তুমি আমাদের নতুনবন্ধু। আত্মীয় হলে যে গো।
          সবাই একসঙ্গে বাড়ির পথে পা বাড়াল। কিন্তু দু'পা এগিয়েই সকলে থমকে দাঁড়াল। অনাদি তো সঙ্গে নেই। মদন পিছন ফিরে দেখল,অনাদি একহাতে স্কুলব্যাগ অন্য হাতে হাওয়াই চটি ধরে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে তাদের দিকে এগিয়ে আসছে। মদন দৌড়ে গেল তার কাছে। হাত থেকে  তার স্কুলব্যাগটা কেড়ে নিয়ে তাকে ধরে ধরে এগিয়ে নিয়ে এল। সে কাছে আসতেই সবাই দেখল,তার ঠোঁট ফেটে রক্ত ঝরছে। বাঁ-হাঁটুতে গভীর ক্ষত। সেখান থেকেও রক্ত গড়িয়ে নামছে।
        তমোনাশের সঙ্গে অনাদিকেও ধরাধরি করে সবাই তমোনাশের বাড়ি পৌঁছাল। ওর বাবা,ডাক্তারবাবু অনাদিকে দেখে ওষুধ দিলেন। এবার সবার ঘরে ফেরার পালা। তমোনাশ অনাদির হাত ধরে বলল,আজ তোমাদের সবার জন্য আমি দুষ্টু-কুকুরটার হাত থেকে বেঁচে গেলাম। কিন্তু আমাকে  বাঁচাতে গিয়ে তোমার এমন দুরবস্থা হল। আমার জন্যই যে তোমাকে এতটা যন্ত্রণা ভোগ করতে হচ্ছে। অনাদিভাই,তুমি আমাকে ক্ষমা করে দাও।
               অনাদি মৃদু হেসে বলল,কি যে বল তমোনাশভাই। আমি তো দৌড়াবার সময় পড়ে গেছি। তাও সেটা হাওয়াই চটির ফিতে ছিঁড়ে পা আটকে যাওয়ার জন্য। এতে তোমার দোষ কোথায়! তুমি শুধু শুধু মনে দুঃখ নিচ্ছ। দেখ ভাই,তুমি আমাদের গ্রামে নতুন এসেছ। অর্থাৎ তুমি আমাদের গ্রামের নতুন অতিথি। তোমার বিপদে আমরা সবাই এগিয়ে আসার সুযোগ পেয়েছি,এটা কি কম আনন্দের বিষয় ? এখন আমাদের বন্ধুত্বটা আরও শক্তপোক্ত হল। তুমি মনে কোনরকম দুঃখ রেখো না। তোমার বাবা,ডাক্তারবাবু আমার ছড়ে যাওয়া জায়গায় ওষুধ লাগিয়ে ব্যান্ডেজ বেঁধে দিয়েছেন। আমি খুব তাড়াতাড়ি সেরে উঠব। ভাই,এখন আমরা সবাই চলি। বাড়ি ফিরতে দেরি হচ্ছে। সবার বাড়িতে মা-বাবা নিশ্চয়ই চিন্তা করছে।
         সবাই বাড়ি ফিরে গেছে। সন্ধে নেমেছে ঘন্টাখানেক আগে। তমোনাশ পড়ার টেবিলে বসে কিছু ভাবছে। বাবা পাশে এসে দাঁড়াতেই তার চোখ সরল। সে বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে বলল,বাপি,শহর থেকে এই গ্রামে এসে আমার ভালোই হয়েছে। পিয়াল গ্রামটা এমনিতেই খুব সুন্দর। সুন্দর এখানকার মাটি-জল-প্রকৃতি। দেখছি,মানুষগুলোও ভারি মিশুকে, খুবই সরল মনের। গ্রামের সবাই সকলকে আত্মীয় ভেবে মেলামেশা করে। এই গ্রামে এসে অল্প সময়ে আমি অনেক কিছু শিখলাম। আরও শিখতে পারবো ভবিষ্যতে। ঝগডুটে কাকেদের কাণ্ডকারখানা,আনস্মার্ট কৃষ্ণ-অনাদিদের খোলামন আমার চোখ খুলে দিয়েছে। আমার মনে হচ্ছে,যতদিন বাঁচব আমি এই গ্রামেই থেকে যাবো। আচ্ছা বাপি,তুমি এই পিয়াল গ্রামে আমাদের একটা বাড়ি করতে পারো না ?
          তমোনাশের কথা শুনে বাপি অবাক হয়ে গেল। অনেকক্ষণ তার মুখের  দিকে  চেয়ে রইল। তারপর তার মাথায় একটা হাত রেখে বলল,কেন পারবো না,তোমার মনের ইচ্ছে যখন এই,তখন এই গ্রামেই আমি একখানা সুন্দর বাড়ি করব। তুমি এখন মন দিয়ে স্কুলের হোমটাস্কটা করে ফেল তো। একথা বলে,বাবা তার সামনে থেকে দ্রুত চলে গেল।
           মাসকয়েক পর একদিন দুপুরবেলার ঘটনা। তমোনাশ তখন স্কুলে। তার বাপি আর মাম তার পড়ার টেবিলের সামনে বসে গল্প করছে। গল্পে গল্পে বাপি টেবিলের ওপর থেকে তমোনাশের ডায়েরিটা হাতে তুলে নিল। ডায়েরির প্রথম পাতাটা উল্টাতেই তার চোখ সেখানে আটকে গেল।সে  লেখাটা কয়েকবার মনযোগ সহকারে পড়ল। তারপর ডায়েরিটা তমোনাশের মায়ের হাতে তুলে দিয়ে বলল, নাও,পড়ে দেখ,তোমার ছেলে কি লিখে রেখেছে তার ডায়রিতে।
           মাম দু’চোখ  বড় করে,গড়গড় করে পড়তে লাগল লেখাটা। 'তমোনাশ বন্দ্যোপাধ্যায়। গ্রাম ও ডাক পিয়াল। পিয়াল,আমি তোমাকে সত্যিই খুব ভালোবাসি। ও আমার ছেড়ে আসা রাজপুর,তুমিও পিয়ালে চলে আসতে পারো। পিয়াল সত্যিই এক  স্বপ্নের দেশ। রাজপুর, তোমার জন্য রইল সাদর আমন্ত্রণ।‘  

মিষ্টি কোকিল
সুমিত্রা ঘোষ

মিষ্টি কোকিল মিষ্টি কোকিল
গাইছে মিষ্টি গান
মনযে আমার আকুল হল
থামাও তোমার কুহুতান
এস তুমি আমার বাড়ি
দুজনে করব খেলা
মা বাবা নেইকো সাথে
একলা কাটে বেলা।


ধারাবাহিক ভ্রমণ
শ্যামদেশ থেকে ফিরে
দ্বিতীয় পর্ব

বাসবদত্তা কদম

দ্বিতীয় পর্ব) সমুদ্র দেখলে তাকে না ছুঁয়ে থাকা যায় না। তোমরাও নিশ্চয়ই সহমত হবে আমার সঙ্গে। 
সূর্য উঠে গেছে তার অনেক আগে। তাই সূর্যোদয় দেখার প্রশ্ন সেদিন নেই কিন্তু মিঠে কড়া রোদ্দুরে দাঁড়িয়ে দেখছি সমুদ্র আর তার উপর ভাসমান অজস্র রঙিন নৌকা। মাঝেমধ্যে জুম জুম করে চলে যাচ্ছে স্পীড বোট। সে কি আওয়াজ। এও আরেক আকর্ষণ আমাদের মতো পর্যটকদের জন্য। বাইকের মত দেখতে স্পীড বোটগুলো জলে ফেনা রেখে কি মারাত্মক দ্রুত গতিতে যে ছুটে যাচ্ছে। 
বালির ওপর অজস্র বিদেশি মানুষ বসে আছেন। কেউ কেউ শুয়ে আছেন রোদ্দুরে পিঠ দিয়ে। এঁদের দেখলেই বোঝা যায় এরা থাইল্যান্ডের অধিবাসী নন। কেউ ইউরোপ, কেউ আমেরিকা থেকে এসেছেন। হয়ত বা ভয়ংকর ঠান্ডা সেসব জায়গায় রোদ্দুর খুঁজে পাওয়াই মুশকিল। তারা রোদ্দুরের খোঁজে প্রতিবছর শীতকালে থাইল্যান্ডে এসে ভিড় জমান। সান বাথ বা রৌদ্র স্নান করেন, প্রানভরে। 
গরমের দেশের মানুষ আমরা, এমনিই রাস্তায় বেরোলে এত রোদ্দুর যে রোদ্দুরে অকারণে বসে থাকার কথা ভাবতেই পারি না। তবে রৌদ্র স্নান না হলেও রোদ্দুর কিন্তু আমাদের সকলেরই প্রতিদিন কিছুক্ষণ দরকার শরীর সুস্থ রাখার জন্য, তা তোমরা নিশ্চয় জানো।
পশ্চিমের দেশগুলোর তুলনায় থাইল্যান্ডে থাকা খাওয়ার খরচ যথেষ্ট কম। একটা সাধারণ তুলনা থেকেই বুঝতে পারবে সেটা। 
থাইল্যান্ডের মুদ্রা ১ ভাট = ভারতীয় টাকায় ২.৫ টাকা
আমেরিকার ১ ডলার = ভারতীয় টাকায় প্রায় ৮০ টাকা
ব্রিটিশ মুদ্রা ১ পাউন্ড = ভারতীয় মুদ্রায় প্রায় ১০০ টাকা
ইউরোপের মুদ্রা ইউরো আরো অনেকটাই দামি।  
তাই শ্যাম দেশ বা থাইল্যান্ড আমাদের কাছে খুব সস্তা না হলেও পাশ্চাত্যের নাগরিকদের কাছে তা অবশ্যই খুবই সস্তা। 
অজস্র নৌকা জলে ভাসছে। অতি ছোট থেকে বেশ বড়ো পর্যন্ত। 
শুনলাম সামনেই জেটি। পরে দেখেওছিলাম একদিন। সেই জেটি থেকে নির্দিষ্ট সময়ে  
ঐ সব নৌকায় করে আশেপাশের দ্বীপে যেমন যাওয়া যায়, তেমনি বেশ কিছু দূরের ট্যুরও করানো হয় শুনলাম। সমুদ্রের বুকে তৈরি হওয়া ছোট ছোট দ্বীপে সেসব জায়গায় গড়ে উঠেছে হোটেল, রেস্টুরেন্ট। সেও এক দেখার জায়গা। বালি সেখানকার সোনালি নয় সাদা। রয়েছে বিনোদনের অজস্র উপকরণ আর রকমারি সামদ্রিক খাবার নিয়ে অজস্র ছোট থেকে অতি বড় সব দোকান। 
সাড়ে নটার কাছাকাছি বাজে তখন, আস্তে আস্তে রোদ চড়ছে, গরম বেড়ে চলেছে। বীচে দাঁড়িয়ে সমুদ্র আর নৌকা দেখা কষ্টকর হয়ে উঠছে। তখন হোটেলে ফিরে এলাম। বীচ আর রাস্তার মাঝখান দিয়ে দেখি ফুট চারেকের আরেকখানি রাস্তা কংক্রিটে বাঁধাই করা, হাঁটার জন্য। তার পাশে আরেকটি সরু সাইকেল চলার রাস্তা। কংক্রিটের রাস্তায় তখনো অনেক টুরিস্ট। তাঁরা হেঁটে ফিরছেন। সেই রাস্তার পাশে বীচের ওপর ডাবের দোকান সাজিয়ে বসে আছে থাই নাগরিক। ঠিক যেন পুরীর স্বর্গদ্বার সৈকত। 
হোটেলের বাগানে ঘুরে এবার অর্কিড গুলো ভালো করে দেখলাম। প্রতিটি বড় পাম গাছ, নারকেল গাছের গায়ে এঁরা অর্কিড লাগিয়েছেন। সে অর্কিড গাছের গায়ে গোল হয়ে বেড়ে উঠছে।
হোটেলে ফিরে আসতেই রিসেপসন থেকে বললেন, আমাদের ঘর রেডি।
-বাঁচা গেল। 
আগেরদিন মধ্যরাতে চেন্নাই থেকে প্লেন ছেড়েছিল। তারপর রাত তিনটের পরের গল্প তো তোমরা সবটাই জানো এতক্ষণে। ঘরে গিয়ে স্নান করে এক লম্বা ঘুম। তারপর উঠে হালুম হুলুম করে খেয়ে, আবার বীচে যখন গেলাম, তখন সেখানে মেলা বসে গেছে মনে হচ্ছিল।
সেটা রবিবার, অজস্র স্থানীয় পরিবার যেমন তাদের ছোট ছোট বাচ্চাদের নিয়ে এসেছে; আছেন প্রচুর বিদেশিও। অবশ্য আমরাও সেখানে বিদেশি। 
(ক্রমশ)


মিষ্টির টিয়া 
মৌন মন্ডল 
শ্রেনী - ষষ্ঠ, করিমপুর উচ্চ  বালিকা বিদ্যালয়, নদীয়া 


নীল কাকু এসেছে শুনেই মিষ্টি সোজা ঘরের ভেতর চুপটি  করে লুকিয়ে থাকে। 
এখন তো নীল কাকুকে মিষ্টিকে খুঁজতে হবে তাই তিনি মিষ্টিকে বলেন, " ক্যাপ্টেন মিষ্টি তুমি গুহার ভেতর থেকে বেরিয়ে এসো। দেখো আমি তোমার জন্য লজেন্স এনেছি। " 
সেটা শুনে মিষ্টি তার ঘরের ভেতর থেকে বেরিয়ে আসে আর নীল কাকুকে জড়িয়ে ধরে গালে হামি দেয়। এই মূল্যবান দুটো হামির জন্যই নীল কাকু সবার থেকে আলাদা।
আর একদিন নীল কাকু মিষ্টিদের বাড়ি আসেন এবং মিষ্টি কে ডাকেন, "ক্যাপ্টেন মিষ্টি গুহার ভেতর থেকে বেরিয়ে এসো দেখো আমি তোমার জন্য নতুন একটা জিনিস এনেছি।" কিন্তু তখন মিষ্টি ঘর থেকে বেরিয়ে আসে না। নীল কাকু মিষ্টির ঘরে গিয়ে দেখেন মিষ্টি খাটের ওপর মুখ ফুলিয়ে বসে আছে। 
নীল কাকু মিষ্টি কে জিজ্ঞাসা করেন, " কি হয়েছে ক্যাপ্টেন মিষ্টি? " 
মিষ্টি চেঁচিয়ে বলে, " তুমি একটা মিথ্যুক। আমি তোমার সঙ্গে একটাও কথা বলবো না।" "কেন আমি আবার কী করলাম?"
নীল কাকু অবাক গলায় জিজ্ঞাসা করলেন, "তুমি যে বলেছিলে টিয়ারা সুন্দর গান গায়, কথা বলে। সেই জন্য আমি বাবাকে বলে একটা টিয়া পাখি কিনলাম। কিন্তু এখন দেখছি, টিয়াটা কোন কথাই বলে না, শুধু খায় আর চিৎকার করে" , কাঁদো কাঁদো গলায় বলল মিষ্টি। 
মিষ্টি নীল কাকুকে বারান্দায় নিয়ে গিয়ে খাঁচার ভিতর টিয়া পাখিটাকে দেখায়। টিয়া পাখিটার গা ভর্তি সবুজ পালক আর লাল টুকটুকে ঠোঁট। তার গলায় গোল করে রামধনু রঙের পালক রয়েছে। ঘরের ভেতরে টেবিল থেকে নীল কাকু একটা  পাকা লঙ্কা নিয়ে আসেন। তারপর তিনি খাঁচার শিকের  পাশ দিয়ে পাকা লঙ্কাটা টিয়া পাখির মুখের কাছে ধরলেন এবং টিয়াটা পুরো পাকা লঙ্কাটা খেয়ে ফেলল। টিয়াটাকে পাকা লঙ্কা খাওয়ানোর পর নীল কাকু শিস দিলেন। 
নীল কাকুর  শিস্ শুনে টিয়াটা নীল কাকুর সাথে শিস দিল। মিষ্টি তো টিয়াটাকে কোনদিন খাওয়াতে পারতো না এমনকি তার মাও পারতো না। কিন্তু এখন টিয়াটা দিব্যি নিল কাকুর হাত থেকে পাকা লঙ্কাটা। খেয়েও নিল। মিষ্টি এসব দেখে অবাক গলায় বলে, " আমি তো টিয়াটাকে আমার ক্যাডবেরি একটা টুকরো খেতে দিয়েছিলাম। কিন্তু টিয়াটা সেটা খেতে চাইল না। অথচ তোমার হাত থেকে কী সুন্দর করে পাকা লঙ্কাটা খেয়ে ফেলল। আবার তোমার সাথে শীষও দিল। মিষ্টিকে নীল কাকু কোলের ওপর বসিয়ে বললেন,"মিষ্টি, টিয়ার সাথে কি তুমি মিশতে চেয়েছো?  প্রথমে ও দেখেছে তুমি ওকে খাঁচায় বন্দী করে রেখেছো। আমি টিয়াটাকে ওর প্রিয় খাবার পাকা লঙ্কা দিয়েছি। আবার আমি আদর করে টিয়াটার গায়ে হাত বুলিয়ে দিয়েছি। পাখিদের সঙ্গে ক্যাপ্টেনের মতো শাসন করে নয় বরং বন্ধুর মতো থাকতে হয়।"
নীল কাকু আরো বললেন, " বাঘ সিংহ হরিণ হাতি, এদের জঙ্গলে ভালো লাগে। চিড়িয়াখানায় খাঁচার ভেতরে এরা যেন মন মরা হয়ে পড়ে। মুক্ত বাতাসে উড়ে বেড়ানো পাখিদের খাঁচায় বন্দী করে হরে কৃষ্ণ, বন্দেমাতরম এসব কথা না শিখে তাদের খাঁচা থেকে বার করে মুক্ত আকাশে উড়ে বেড়াতে দেওয়া উচিত, তাই না ক্যাপ্টেন মিষ্টি ?" মিষ্টি কিছু না বলে বারান্দা থেকে পাখির খাঁচাটা নিয়ে ছাদের উপর চলে গেল।  নীল কাকু মিষ্টির পেছন পেছন আসছিলেন। মিষ্টি খাঁচার দরজাটা খুলল এবং পাখিটাকে ধরে আকাশের দিকে দু হাত তুলে "যা টিয়া তুই উড়ে যা" বলে টিয়াটাকে ছেড়ে দিলো। প্রথমে টিয়াটা উড়ে গিয়ে বসল টিভির এন্টিনার ওপর। তারপরে টিয়াটা আমাদের মাথার উপরে দু-এক পাক ঘুরে নিল। অবশেষে টিয়াটা শিস দিয়ে গান গেয়ে উড়ে যায়। মিষ্টি হেসে বলল, " দেখো নীল কাকু, কী অপূর্ব দৃশ্য! "

ধারাবাহিক উপন্যাস
লাচুঙের নেকড়ে
শ্রীকান্ত অধিকারী

পর্ব - ষোলো  

কবি শঙ্খ ঘোষ। তাই না? শাদুল মামাও যেন শান্ত হয়ে গেছে। এনাকে নিয়ে আরো দু’জন লেখকের লেখা সারা বিশ্বে সাড়া ফেলেছে-‘বুদ্ধ ফ্রম ডোল্পো’র লেখক সাইরাস স্টীর্ন্স।আর এন গায়ঙ্গ জ্যাংপোর ‘গুরু রিনপোচে: হিজ লাইফ অ্যান্ড টাইমস’। দুর্দান্ত দু’খানা বই। পড়ে দেখলে ক্ষতি হবে না। ছোটমামার কথায় রামসির মা’র ঠোটে এক ঝিলিক হাসি খেলে যায়। 
তখনো মনাস্ট্রির ভিতর বাইরের চারপাশ প্রকৃতির সঙ্গে একাত্ম হয়ে নীরব হয়ে রয়েছে। এ নীরবতা একদিনের কোনো আগন্তুক আসার জন্য হয়েছে বা ধর্মস্থানে নীরবতা বজায় রাখার মত নিয়ম নীতির অবস্থানের কারণে হয় নি।এ যেন বিশ্ব প্রকৃতির সৃষ্টি সূচনার নীরবতা। মাতৃক্রোড়ে ক্রীড়ারত সন্তানের মাতার নীরবতা।অখণ্ড শান্তির নীরবতা।সুউচ্চ পর্বত শীর্ষের মহারাজকীয় কীর্তি গরিমার নীরবতা। যুগ যুগ ধরে বহমান স্বর্গীয় সুখানুভূতির নীরবতা।  
পাশে যে লোকটা বাজনা বাজাচ্ছিল তার কাছে গিয়ে গ্যাটসো কিছু একটা দিল, হয়তো টাকার নোট এবং এটা রামসির নজর এড়িয়ে গেলেও রামসির ছোটমামার চোখে ধরা পড়ে। তবে এই ব্যাপারটা নিয়ে রামসিকে কিছু বলে না। কেননা রামসি জানলে প্রশ্নের পর প্রশ্ন করে মাথায় তুলত।-কেন এত টাকা দিল? এই লোকটাকে দেখতে ঠিক সেই আগের বাজনদারে মত। এখানে কেন?  
প্রশ্ন যে রামসির মাথায় আসছে না তা নয়। এসেছে বেড়াতে। পাহাড়ের মাথায় মাথায় চড়ে দূর আকাশে মেঘেদের বুকে ভেসে ভেসে এলাচ বনের ভেতর শিঙির সাথে লুকোচুরি খেলবে কিংবা কোন অজানা পাথরের খাঁজে খাঁজে ট্রেকিং করার মত কিছুটা উঠে গিয়ে ধপাস করে পড়ে যাবে দুই ভাই বোনে।ওহ কি মজা হবে তখন! কিন্তু সে সব না হয়ে এখানে আসা অবদি শুধুই বৃষ্টি আর বৃষ্টি।এলোমেলো বৃষ্টি।সঙ্গে বিচ্ছিরি হাওয়া।আর সঙ্গতে কনকনে ঠাণ্ডা। বড় মামি তো বড়মামাদের প্রতি খাপ্পা।মুখ গোমরা করে উইন্টার জ্যাকেটের ওপর রেনকোট চাপিয়ে জুবুথুবু হয়ে গাড়ির ভিতরেই বসে রয়েছে।অথচ গ্যাটসো বলেছিল এখানে নাকি আপেল বনের সঙ্গে এলাচগাছের জঙ্গল।সঙ্গে পাইন ওক বা সরলবর্গীয় নাম না জানা কত লম্বা লম্বা গাছের মাঝে হারিয়ে যেতে কী ভালোই না লাগে। সঙ্গে বড় বড় বুনো কাঠবেড়ালী গিরগিটি কত রং বেরঙের পাখিই না কাছে এসে ওদের সঙ্গে খেলা করবে। কিন্তু এখনো পর্যন্ত সে সব কিছুই হল না।উপরন্তু কিছু উটকো ঘটনা ওদেরকে কেমন ভয় পাইয়ে দিল। থমথমে করে তুলল পাহাড়ি পরিবেশ। গিয়ে বন্ধুদের কী বলবে?  
 অতি চেনা শালিখ বুলবুলি আর একটা কী যেন প্রুশিয়ান ব্লু বা কালো কালো তীক্ষ্ণ সুরেলা শিস দেয়া ছোট ছোট পাখি।কখনো ইলেক্ট্রিকের তারে কালো বাদামি আর মাঝে মাঝে সাদা স্পট দেওয়া লম্বা লেজঅলা মুখোশধারী পাখি।এই পর্যন্ত।সঙ্গে মেঘলা আকাশ।মাঝে মাঝে পাহাড়ভাঙা বৃষ্টি। 
মনাস্ট্রির দক্ষিণদিকে ঠিক যেখানে অনেকটা জায়গা জুড়ে সমতল,সবুজ উপত্যকার মত। তার পাশেই কিছুটা গিয়ে আবার খাড়াই হয়ে উঠে গেছে অনেক উঁচু হয়ে যার মাথাটা দেখা যাচ্ছে না,সেখানে বেশ ভিড় লক্ষ্য করে রামসি।ব্যাপারটা জানার আগ্রহ হতেই ছোট মামাকে খোঁজে, পাশেই পেয়ে যায়। বিভিন্ন পোজে আপেল গাছের গায়ে ঠেস দিয়ে মোবাইলে ছবি তুলছে। ছোট মামা কোনো ক্যামেরা সঙ্গে নেয়না।বলে, ‘ক্যামেরার ফিতে গলায় ঝুললে নিজেকে গৃহস্থের কুকুর মনে হয়। যার নিজের ইচ্ছে মত কোথাও যাওয়ার অধিকার থাকে না। আমার এই বেশ ভালো।’ ছবি তুলতে তুলতে বলে,‘এইভাবে ছবি তোলা আর বাড়ির বাগানে পেয়ারা গাছে ছবি তোলা এক। সে রকম কোনো বুনো ফিলিংস আসে না বুঝলি। যদি ঐ দূরের জঙ্গলে ঢুকে পথ হারানো যেত কিংবা বিভিন্ন পাখিদের আয় আয় চি চি করে ডাকতে ডাকতে কিংবা বন্য জন্তুদের পাশে গিয়ে ছবি তোলা যেত।নিদেনপক্ষে একটা কালো ভালুকের পিঠে চড়ে মধুর চাক নিয়ে টানাটানি করতাম  আহা কি মজায় না হত বল?’ ‘জঙ্গল বুকে’র মোগলির মত তরতর করে গাছ বেয়ে পাহাড়ের গা থেকে ঝুলন্ত অবস্থায় মধুর চাক ভাঙতে পাড়তাম কেমন লাগত বলত। কিংবা স্নো লেপার্ড বা লেপার্ড ক্যাটকে কোলে নিয়ে আদর করতাম।দু’দিনের জন্য কেমন কেলভিন রিচার্ডসন কিংবা ডীন স্নেইডার হয়ে যেতাম। আফ্রিকার জঙ্গলে নাইবা গেলাম।আমাদের দেশে কি কম আছে রে!
রামসির মাঝে মাঝে ছোট মামাকে কেমন লেলকু লেলকু লাগে।কে বলবে এই লোকটা কলেজে পড়ায়।-‘মামা,সে সব হবে’খন। ঐ যে বড়মামা ডাকছে।’ 
শাদুলমামা গাছে হেলান দিয়ে শুধু একবার আড়চোখে দেখে নিল।তারপরেই বলল,‘ওখানে
যাওয়ার কি খুব দরকার! সবেতেই কান দিতে নেয়। মনের শান্তি বিঘ্নিত হয়।কনসেন্ট্রেশন কমে। পৃথিবীতে কত জায়গায় কত ঘটনা ঘটে চলেছে অনবরত।সদা সর্বদা।সব কি খবর রাখা যায়! না রাখে কেউ? যা ঘটার ঘটতে দে।’  
 ছোট মামা এখন একজন দার্শনিক।ভাবে আপ্লুত,অভিভূত।এখন মহাগুরু রিনপো চের ভাবশিষ্য। মামার এমন ভাবলেশহীন কথাবার্তায় রামসিও যেন একটু অন্য জগতে বিরাজ করছিল বা হয়তো করতে যাচ্ছিল এমন সময় একটা ‘গরুড় পক্ষী’ ওদের সামনে এসে অদ্ভুত স্বরে ডাকতে থাকে। 
রামসি চমকে ওঠে। হয়তো ভয়ই পায়। 
ধারালো ছুঁচলো চঞ্চু,তীক্ষ্ণ নখ,বিশাল রঙ বেরঙের ডানার ঝাপটে একবার কাছে আসে আবার দূরে চলে যায়। কিছুক্ষণ পর খেয়াল হয় পাখিটা নাচছে। 
রামসি গরুড় পাখির নাম শুনেছে। কিন্তু দেখেনি কোনো দিন।এই সময়ে কেউ দেখেছে কিনা জানে না।বিহ্বল হয়ে যখন সে ছোট মামার দিকে কোনো রকমে ঘাড় ঘুরিয়েছে দেখে ছোটমামা হাসছে। ওদিকে রামসির মা, বড়মামা, বাবা সব্বাই তালে তালে হাততালি দিয়ে সোল্লাসে হেসে ওঠে।–‘সাবাস বেটা’। 
  হঠাৎ এমন কান্ড কারখানায় রামসি ভ্যবাচাকা খেলেও ভাবটা বেশিক্ষণ থাকে না।গরুড় পক্ষীটা মাথা খুলে ফেলে। ডানা ঝেরে দেয়। এখন রামসি সামনে তার বোন শিঙি। সেও হাসছে। তার মানে শিঙি এতক্ষণ গরুড় পাখির মুখোশ পড়েছিল! 
বিষ্ময়ের ঘোর তখনো কাটে নি।ছোটমামা জানায়,এখানে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উৎসব‘ছাম’ উৎসব। মুখোশ উৎসব।আমাদের দুর্গাপুজোর মত।ছোটমামা জিজ্ঞাসা করে,‘গ্যাটসো এই মুখোশ উৎসব তো নভেম্বর ডিসেম্বরে হয়।এখন কেন?’
‘আভি সে তৈয়ারী চল রাহা হ্যায় স্যার! নেহি তো ঠিক টাইম পর সব কুছ আচ্ছা নেহি হোগা। 
ওর কথায় যেটা বোঝা গেল,শীতের মরসুমে পরপর দুটো উৎসব হয়। ছাম বা মুখোশ উৎসব আর তারপরেই লোসার উৎসব। মানে আমাদের নবান্নের মত নতুন ফসলের উৎসব। কৃষি উৎসব। 
‘এখানে লেপাচা এবং সিক্কিমের আদি ভুটানি বা নেপালিরা গরুড়কে খুব মান্যতা দেয়। দেবতা রূপে পুজো করে।’ রামসির মা বলে। 
‘মুখোশ নাচ নাকি খুব আকর্ষনীয়।’ 
‘তব তো উইন্টার সিজন মে আপ লোগোকা আনা পরেগা।’গ্যাটসো বেশ খুশিতেই কথাগুলো বলে।  
হঠাৎ পাশ থেকে সাঙ্গ গ্যাটসোর কাছে এসে কিছু একটা বলতেই গ্যাটসোর মুখ চোখ কেমন হয়ে যায়। দ্রুত ছোট মামাকে বলে,‘ও যো বাঙালি বাবু থা আপকে সাথ সেম হোম মে,ও সুবা সে লা পাতা।’ 
(ক্রমশ)
স্মরণীয় দিবস
শিশু শ্রমের বিরুদ্ধে বিশ্ব দিবস (১২ই জুন)

কলমে - দোলনচাঁপা তেওয়ারী দে

শিশু শ্রমের বিরুদ্ধে বিশ্ব দিবস, যা প্রতিবছর ১২ই জুন তারিখে পালিত হয় সারা বিশ্বে। শিশু শ্রমের বিরুদ্ধে বিশ্বব্যাপী আন্দোলন কে সক্রিয় ও উৎসাহিত করার লক্ষ্যে এই দিনটি পালিত হয়।
শিশুশ্রমের বিরুদ্ধে বিশ্ব দিবস এটি আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা(আই এল ও) অনুমোদিত দিবস,যা ২০০২ সালে চালু হয়েছিল।
এই সংস্থার লক্ষ্য ছিল, শিশুশ্রম রোধে সচেতনতা ও সক্রিয়তা বৃদ্ধি করা। এটি আইএলও কনভেনশন নং ১৩৮ অনুমোদনের মাধ্যমে চাকরির জন্য সর্বনিম্ন বয়স এবং আইএলও কনভেনশন নং ১৮২ মাধ্যমে শিশু শ্রমের সবচেয়ে খারাপ ধরনটির দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়েছিল।
আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) মতে বিশ্বব্যাপী প্রায় ১৫২ মিলিয়ন শিশু, শিশুশ্রমে নিয়োজিত যা ভাবতে অবাক লাগে। এদের মধ্যে আবার ৭২ মিলিয়ন শিশু বেশ বিপদজনক কাজের সঙ্গে যুক্ত আছে। ২০০০ সালের পর থেকে শিশু শ্রমে প্রায় চার মিলিয়ন শিশু শ্রমিক হ্রাস পেয়েছে। সাম্প্রতিক বছরগুলিতে এই হ্রাসের হার দুই তৃতীয়াংশ।
আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা আইএলও এবং জাতিসংঘের সংস্থা, যা কাজের জগতকে নিয়ন্ত্রণ করে। শিশু শ্রমের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের প্রচেষ্টায় বিশ্ববাসীর মনোযোগ আনতে এবং বিশ্ববাসীর অংশগ্রহণের জন্য ২০০২ সালে বিশ্ব শিশু শ্রমবিরুদ্ধ দিবস চালু করে।
এই দিনটি সরকার, স্থানীয় কর্তৃপক্ষ, শিক্ষিত সমাজ, আন্তর্জাতিক শ্রমিক এবং নিয়োগকারী সংস্থাগুলিকে একত্রিত করে শিশু শ্রমের সমস্যাগুলিকে চিহ্নিত করে এবং শিশু শ্রমিকদের সাহায্য করার জন্য নির্দেশিকা নির্ধারণ করে।
আইএলও এর তথ্য অনুসারে সারা বিশ্বের লক্ষ লক্ষ মেয়ে এবং ছেলে এমন কাজে জড়িত যা তাদের পর্যাপ্ত শিক্ষা, স্বাস্থ্য, অবসর এবং মৌলিক স্বাধীনতা থেকে বঞ্চিত করে, এইভাবেই তাদের অধিকার লঙ্ঘিত হয়। এই শিশুদের মধ্যে অর্ধেকেরও বেশি শিশু শ্রমের নিকৃষ্ট কাজের মুখোমুখি হয়। তাদের বিপজ্জনক পরিবেশে বিভিন্ন ধরনের কাজ, দাসত্ব বা জোরপূর্বক শ্রম, মাদক পাচার ও পতিতাবৃত্তির মতো অবৈধ কার্যকলাপের পাশাপাশি সশস্ত্র  সংঘর্ষে জড়িয়ে পর্যন্ত পড়তে বাধ্য হয়।
এবছর শিশু শ্রমের বিরুদ্ধে বিশ্ব দিবসের থিম, শিশু শ্রমের উপর সংকটের প্রভাব কে কেন্দ্র করে তৈরি হয়েছে।
কোভিড নাইনটিন মহামারীর পরবর্তী অর্থনৈতিক মন্দা এবং শ্রমবাজারের ধাক্কা অনেকের জীবন ও জীবিকার উপর ব্যাপক প্রভাব ফেলেছে। এই সংকট লক্ষ লক্ষ শিশুকে শিশু শ্রমের দিকে ঠেলে দিচ্ছে।
🍂

পাঠ প্রতিক্রিয়া
( ছোটোবেলা ১৩৬ পড়ে অসীম হালদার যা লিখলেন)

বিশিষ্ট বিজ্ঞানী এবং প্রকৃতিপ্রেমিক ডঃ স্বপন সেনের একটি লেখায় পড়েছিলাম পাখিদের সম্বন্ধে। তাদের চলাফেরা, নিত্যদিনের কাজকর্ম তিনি কয়েক বছর ধরে ভাল করে লক্ষ্য করেছেন। পড়ে জানতে পারি বনজঙ্গলের মতো স্থানে আমাদের উপস্থিতি এবং কোলাহল নিয়ে তারা ভীষণ শঙ্কিত ও বিপর্যস্ত। তারা তাদের জগতে সেই গোলযোগ সহ্য করতে নারাজ। আসলে পাখিদের যাতায়াতই বলি, বা বনের অন্যান্য পশুদের বা জঙ্গলের সবুজ বনানী, সব স্থানেই শৃঙ্খলহীন জীবনযাপনে জগৎস্রষ্টা ভীষণভাবে ক্ষুব্ধ এবং বিরক্ত। পরিবেশ-বান্ধব হওয়ার চেষ্টা না করে কেবল আত্মসুখের উচ্চতাকে বাড়িয়ে চলেছি আর এড়িয়ে চলছি পরিবেশের বারতাকে। জলের প্রাণিরা যেমন, তেমনি স্থলে বসবাসকারী সবুজদের প্রাণ আজ ওষ্ঠাগত। ৫ই জুন পরিবেশ দিবসকে মাথায় রেখে আমাদের এখন নৈতিক দায়িত্ব নিতে হবে কিভাবে আমরা পরিবেশকে কলুষতামুক্ত করতে পারি, সেদিকে। 'জ্বলদর্চি'র এবারের সংখ্যা সেদিক থেকে বিশেষভাবে তাৎপর্যপূর্ণ এবং স্যাল্যুট জানাই সম্পাদিকা মৌসুমী ঘোষ দিদিকে।

পরিবেশের কথা নিয়ে কথা হচ্ছিল, তখন মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিল আমাদের হতবুদ্ধিতা, অসেচতনতা; যদিও তা নিয়ে সত্যি কথা বলতে কি, ভাবার অবকাশ হয় নি নিত্যদিনের ব্যস্ততার দিনপঞ্জিতে। তবু তা তো কোন মার্জনার যোগ্য হতে পারে না। কারণ আমরা যা কিছুই করি, সবটাই গ্রহণ করি পরিবেশ থেকে। অতএব, সে সম্বন্ধে যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়ে দেখাটাই কাম্য। 

যাইহোক, পরিবেশরক্ষার সরণী বেয়ে চলতে গিয়ে একটি লেখা পেলাম 'সাইকেল দিবস' নিয়ে। লেখিকা দোলনচাপা তিওয়ারী। খুবই সময়োপযোগী লেখা। ওসব দিবস টিবসের কথা মনে ছিল না, খানিকটা কাকতালীয় মনে হলেও আমি মোটামুটি ঐরকম সময়েই আমার অব্যবহৃত হারকিউলিস সাইকেলটিকে চালানোর যোগ্য করলাম, যেটিকে আমি পরম আদরে ঘরে তুলেছিলাম সেই ১৯৮৬-৮৭ সালে। বাবা হঠাৎ যখন সেটি বাড়িতে নিয়ে উপস্থিত, আনন্দের সীমা ছিল ন‍া। যদিও বহু আকাঙ্ক্ষিত BSA সাইকেলটি পাই নি বলে খানিকটা কষ্ট হয়েছিল। তবু সে দুঃখ ভুলেছি, কারণে অকারণে সাইকেলে করে এখানে সেখানে চলে যাওয়া, কখনও বা বন্ধুদেরকে পিছনে বসিয়ে বেরিয়ে আসা। সাইকেল চালানোর মধ্যে মজাটা আজও জেগে আছে মনে। আজ ঘরে বাইক থাকলেও তাকে কিন্তু ছাড়ি নি। কারণ বহু স্মৃতিবিজড়িত সাইকেলের মায়া আমি ছাড়তে পারি নি। সাইকেল নিয়ে যে রালীর কথা জানলাম বা অনেক সময় খবরের কাগজে পড়ে থাকি, তা নিয়ে ভাবা হয়তো হয় নি, তবু আমার সাইকেলটি ছিল আমার স্কুলে এবং কোচিং সেন্টারে যাওয়ার একমাত্র অত্যাবশ্যকীয় মাধ্যম। অন্যান্য প্রয়োজনীয়তা থাকলেও মূলতঃ পরিবেশ-বান্ধব এই বস্তুটির গুরত্ব সম্বন্ধে আজ জনমানসে সচেতনতা বেশ চোখে পড়ার মতো। তাছাড়া ভাবুন তো, গত দুই অভিশপ্ত বছর যখন মারণ ভাইরাসের কবলে বিশ্বব্যাপী স্তব্ধ, তখন বহু মানুষকে সাইকেল নিয়ে পথ চলতে হয়েছে কাজের জন্য। সে সময় সাইকেলের বিক্রিও হয়েছিল বহু। এসব এখন ইতিহাস হলেও সাইকেলের ব্যবহার সম্বন্ধে মানুষ বেশ সচেতন, এটাই গুরুত্বপূর্ণ। 

এবারের সংখ্যায় ঝাড়গ্রাম জেলার ঢাঙিকুসুম গ্রামের সংগৃহীত গল্প পেলাম, পড়ার পর মনটা সত্যিই ভাল হয়ে গেল। এমন গল্প এখন সাধারণতঃ পড়া হয় না। শিক্ষনীয় গল্পে উঠে এসেছে এক গৃহবধূর বুদ্ধিমত্তার কথা, রাজামশাই, সিপাই পালকি, বেয়ারাদের কথা এবং অবশ্যই সমাজের সাবেকী সংস্কারের কথা। বিষয়টি খুবই সাধারণ, তৃষ্ণার্ত চার অপরিচিত ব্যক্তিকে জলদান নিয়ে। কিন্তু গ্রাম্য বধূটির উপস্থিত বুদ্ধি এবং সৌজন্যবোধে গল্পটি শেষ অব্দি পাঠককে টেনে নিয়ে গেছে একটি শিক্ষনীয় পর্যায়ে। লেখক যিনিই হোন, পাঠকের মনে তৃপ্তিদায়ক হয়েছে, যা ছোট এবং বড়, সবার কাছেই ভাল লাগতে পারে। গল্পটা জানা হতো না, যদি না চিন্ময় দাশ আমাদের জঙ্গল মহলের এই লোকগল্পটি আমাদের গোচরে আনতেন। সেজন্য তাঁর প্রতি অন্তহীন কৃতজ্ঞতা।

'লাচুংএর নেকড়ে'র এবারের সংখ্যা এক কথায় মনের অন্দরে নাড়া দিল। সুগল্পকার শ্রীকান্ত অধিকারীর লেখার জাদুতে আকৃষ্ট না হয়ে পারি না। সাঙ্গ, শিঙি, গ্যাটসো, রামসি ... এসব নামের সাথে আমরা পরিচিত নই; আবার লাচুংএর মতো গাড়োয়াল অঞ্চলের মানুষের জীবনযাত্রা বা সেখানকার ভৌগোলিক চিত্র সম্বন্ধে পড়াশুনো যা করার তা তো সেই স্কুলজীবনে। তাই যখন এমন কাহিনী পড়তে বসি, মনে হয় যেন সত্যি সত্যি আমিও তাঁর গল্পের সাথে সাথে চলেছি লাচুংএর পাহাড়ী পথে। ত‍াঁর লেখনীতে উঠে এসেছে এসব ছাড়াও আরও অতিরিক্ত কিছু, যা একজন সুপাঠককে পড়তে বাধ্য করবে। এ কোন রচনাধর্মী গল্পকথা নয়, বরং কথার মোড়ে মোড়ে আছে অভিনবত্বের ছোঁয়া। যেমন এবারের সংখ্যায় দেখি, তিনি তুলে ধরলেন তান্ত্রিক গুরু রিন-পো-চেকে। আবার পেলাম বৌদ্ধভিক্ষু পদ্মসম্ভবকে। এঁদের কথা বলতে গিয়ে সিঙির মাকে দিয়ে বলিয়ে নিলেন 'বাবু এইভাবে ওনাকে স্মরণ করতে হয়।' আবার লিখলেন, 'ধ্যানস্থ না হলে যে ভেতরের শক্তি কখনোই জাগ্রত হবে না।' এসব তো যোগসাধনার কথা, ভিন্ন জগতে বসে আত্মজ্ঞানলাভের কথা। পশ্চাতে রয়েছে পর্বতের শিখরসমূহ, যেখানে লিখছেন, 'তোমার নিরাশা নেই, তোমার বিরাগ নেই, তোমার শূন্যতা শুধু আছে।' মূর্তির সামনে দাঁড়িয়ে শিঙিকে তার মা বলছেন হাতজোড় করে নমন জানাতে, হিমশৈলভূমির বুকে যিনি গুরুর মর্যাদায় পূজিত। এই মা তার কাছে অপরিচিত, কারণ এমন শিক্ষা তো মা তাকে কোনদিন দেন নি। শান্তির পথে তিনি উপদেশ দিলেন ভক্তিসহযোগে, পড়তে গিয়ে গল্পটির স্বাদ অমৃত মনে হল। এ আকর্ষণ তো কম কথা নয়! 'পদ্মসম্ভব' নামের বৌদ্ধভিক্ষু যে তিব্বতের বুদ্ধ নামে পরিচিত। তাও জানলাম।

এরপর ধারাবাহিক গল্পের প্রথম পর্বে শ্যামদেশের গল্প শোনাতে হাজির বাসবদত্তা কদম দিদি। কিশোর কিশোরীদের কাছে অত্যন্ত জনপ্রিয় ভাষার ব্যবহারে তিনি এবার আমাদের শ্যামদেশের পথে নিয়ে চললেন। ভিসা অফিসের কথা, ক্লোকরুমের কথা ইত্যাদির সাথে তো ছোটদের পরিচয় করালেনই, এর পাশে যেটা তিনি উল্লেখ করলেন, তা হলো সেখানকার নাতিশীতোষ্ণ আবহাওয়ার কথা। সমুদ্রসৈকতে বসে অসীম নীলে হারিয়ে যাওয়ার মজাই তো আলাদা। অপেক্ষায় রইলাম আরও অনেক কিছু জানার জন্য আগামী সংখ্যাগুলোয়।

কথায় আছে, 'যে রাঁধে, সে চুলও বাঁধে'। চতুর্থ শ্রেণীর অভ্ররাজ সুজয় নামের একটি ছেলের সম্বন্ধে যা লিখেছে, তাতে অবাক হতে হয়। পড়াশুনোর চাপে অস্থির ছেলেমেয়েদের সাহিত্য চর্চার মানসিকতা দেখলে বিস্মিত হতে হয়। চতুর্থ শ্রেণীর অভ্ররাজ 'সুজয়ের ইতিহাস' গল্পে সুজয়ের রোবট বানানোর কাহিনী রীতিমতো বিস্ময়কর। যারা এখনও পড়ো নি, তাদের অবশ্যই পড়বে, ভাল লাগবে।

আমরা কেবলই যে যান্ত্রিক হয়ে পড়ছি, তা আবার প্রমাণিত তারাপ্রসাদ সাঁতরার 'মুঠোফোন' কবিতায়। কলম আর কালির ইতিহাস পড়তে গিয়ে আমি নাকাল হয়েছিলাম কেন জানেন! কারণ আমরা এখন এতই উন্নতির শিখরে পৌঁছে গেছি আর এতটাই কর্মব্যস্ত যে কলম দিয়ে লিখতেই ভুলতে বসেছি। হাতের মুঠোয় ধরে একটা যন্ত্রের দিকে ঘাড় গুঁজে বসে একটা কি দুটো আঙ্গুল দিয়ে শুধু ঠাস ঠাস করে টিপেই চলেছি যন্ত্রটিকে। এভাবেই মৃত্যুপথযাত্রী হয়ে চলেছে আমাদের নিখাদ প্রকৃতিপ্রেম। আগের মতো বাড়ি ফেরার পথে সন্ধ্যামালতীর ঘ্রাণ আমাদের নাকে ধরা দেয় না, চোখ খোঁজে না নীল আকাশে হঠাৎ ভেসে বেরানো মেঘেদের রাশি, বিকেল হলেই সবুজ মাঠে ছুট্টে যাওয়া ছেলেপুলেদের উল্লাস পড়ে না ধরা। এর জন্য সবার হাতে আদর খেতে থাকা সেই একটি বস্তু, যার কোন প্রাণ নেই, সচলতা নেই, অথচ তার আকর্ষণক্ষমতার কাছে আমরা সবাই ধরাশায়ী, কুপোকাৎ। কবির লেখায় তাই শেষের দিকে চরম হতাশা চোখে পড়লো।

তিনটে মিষ্টি ছবি দেখলাম এই সংখ্যায় অষ্টম শ্রেণীর সৌনকশৌর্য, চতুর্থ শ্রেণীর শ্রেয়সী এবং নার্সারীর আয়ুস্মিতার। আমার ভাল লাগে যখন আয়ুস্মিতার মতো ছোটরা তাঁদের দাদু, ঠাকুমার ছবি নিয়ে আঁকা দেয়। মনে হয় সংসারটা যেন আজও সেই একটি একান্নবর্তী পরিবার বেঁচে; যেখানে বাবা, কাকা, জ্যেঠা, দাদু, দিদারা আছেন। আছে দু চারটে আয়ুস্মিতাদের মতো ছানারা। মনে পড়ে গেল রতনতনু ঘাঁটির সেই গল্পটির কথা, জ্বলদর্চির পাতায় আছে পুরানো সংখ্যায়। আবার যখন পাখির বাসায় মা পাখি খাবার নিয়ে এসে দুটো ছানাদের কাছে আসে, মনে হয়, আহা! এই ছবি তো একটি সুপরিবারের উদাহরণ। বাবা পাখিও হয়তো কাজের সন্ধানে কোথাও গেছে। পরিবেশের সাথে এদের বন্ধন তো একটি সূত্রেই গাঁথা। পরিবেশের অপরিহার্য জীবকুল ছাড়া তো পরিবেশ পূর্ণতা পায় না। শ্রেয়সীকে অনেক আদর দিলাম। সৌনকশৌর্য যে ধীরে ধীরে বড়ো হচ্ছে, ঘড়ির মেকানিকের ছবিটি তার উদাহরণ। সত্যি, আমাদের ঘরে বহু জিনিসপত্র রক্ষণাবেক্ষণের কাজে খুব প্রয়োজন সেগুলো সারাইয়ের। আর সেই কাজে একজন পাকা দক্ষ মেকানিক খুব প্রয়োজন। খুবই প্রাসঙ্গিক ছবি এখনকার সমাজে। তোমাদের তিনজনকেই অন্তর থেকে অনেক অভিনন্দন এবং আশীর্বাদ রইলো। আর শেষে এসবের মূলে যিনি প্রায় দু বছর ধরে অতি যত্নে এবং শ্রমদান করে এতকিছু লেখা উপহার দিয়ে চলেছেন, সম্পাদিকা শ্রীমতী মৌসুমী ঘোষ দিদিকেও আন্তরিক শুভকামনা জানাই এই ওয়েব ম্যাগাজিনকে এত ভালবেসে সাজিয়ে তুলতে। এর বিনিময়ে যেকোন মূল্যই বড় ম্লান মনে হয়। এমনই চলুক তাঁর ক্রিয়াকর্ম, পাঠক এবং লেখক কবিদের সান্নিধ্যে এটি এভাবেই হৃদয়ে বেঁচে থাকুক অনন্তকাল, প্রার্থনা তেমনটাই।


Post a Comment

0 Comments