জ্বলদর্চি

দণ্ডীকাটা /ভাস্করব্রত পতি

পশ্চিমবঙ্গের লৌকিক উৎসব, পর্ব -- ৭৮

দণ্ডীকাটা

ভাস্করব্রত পতি

'দণ্ডবৎ' সম্পর্কে হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় লিখেছেন, 'কোনো বিষয়ে বিরক্তিপূর্ব্বক বিদায়গ্রহণে বা পরিহারে প্রণাম'। 'দণ্ডবৎ' শব্দের অর্থ হল দণ্ডতুল্য সাষ্টাঙ্গপাতপূর্ব্বক প্রণিপাত অর্থাৎ সাষ্টাঙ্গ প্রণাম। আর দণ্ডবৎ হয়ে লগুড় বা দণ্ড দিয়ে দাগ কাটাই হল 'দণ্ডীকাটা'। এই দণ্ডীকাটার মাধ্যমে দেবতাকে সামনে রেখে প্রনাম করতে করতে মন্দির প্রদক্ষিণ করেন হিন্দু ভক্তকূল। 

অমূল্যরতন বন্দ্যোপাধ্যায় প্রকাশিত 'বাইশ কবি মনসা' তে রয়েছে 'দণ্ডবত করে যদুবর'। কৃত্তিবাসী রামায়ণে আছে 'দণ্ডবৎ করিয়া'। আবার মানিক গাঙ্গুলীর ধর্মমঙ্গলে আছে 'অসংখ্য দণ্ডবত' কথাগুলি। ঘনরাম চক্রবর্তীর 'ধর্মমঙ্গল' কাব্যে পাই 'বেঁচে গেলে এবার বিষয়ে দণ্ডবত'। 'চৈতন্যচরিতামৃত'তে পাই 'দণ্ডবৎ করেন' এবং 'চৈতন্যমঙ্গল'তে পাই 'দণ্ডবৎ করে'। এককথায় সাষ্টাঙ্গপাত পূর্ব্বক প্রণত নমস্কারই হল 'দণ্ডবৎ'। রায়গুণাকর ভারতচন্দ্র রায় লিখেছেন, 'দণ্ডবৎ হৈল'। কবিকঙ্কণ চণ্ডীতে আছে 'রাজরাজেশ্বরে শত দণ্ডবৎ হয়্যা'। তেমনি অতুলকৃষ্ণ নন্দীর 'চৈতন্য ভাগবত'তে পাই, 'সৰ্ব্বলোক দণ্ডবত হয়'। 'শিবায়ন'তেও লেখা হয়েছে 'পায়ে দণ্ডবৎ হই'। 
দেবতাকে সন্তুষ্ট করার জন্য লম্বা হয়ে শুয়ে প্রনাম করার উপচার হল দণ্ডবৎ। আর এভাবে শুয়ে শুয়ে দুই হাত সামনের দিকে প্রসারিত করে একটি ছোটো দণ্ড (কাঁঠি বা খোলামকুচি) দিয়ে দাগ করে ফের সেই দাগে দাঁড়িয়ে পুনরায় দণ্ডবৎ হয়ে শুয়ে প্রনাম করতে করতে এগিয়ে চলাকেই বলা হয় 'দণ্ডীকাটা'। এটি গ্রামীণ মানুষ জনের কাছে লৌকিক প্রথা বা আচার বা উৎসব। এই উপচারের কোনো নির্দিষ্ট সময় নেই। কোনো নির্দিষ্ট দেবতার কাছেও  তা প্রদর্শন করা হয়না। বছরের যেকোনো সময়ে এটা করা হয়। 

কোনো দেব দেবীর মন্দিরে কোনো ভক্ত নিজের মনোবাসনা পূরণ হলে দণ্ডীকাটা করে দেবতাকে সন্তুষ্ট করার ইচ্ছে প্রকাশ করে। মানসিক করে। সেই মানসিক প্রার্থনা পূরণের জন্য এহেন উৎসবে সামিল হয়। মূলতঃ মহিলাদের দেখা যায় এক্ষেত্রে। তবে অনেক সময় পুরুষদেরও করতে দেখা যায়। কতবার মন্দির প্রদক্ষিণ করা হবে তা সিদ্ধান্ত নেন ভক্ত নিজেই। শরীরের সামনের অংশ মাটিতে ঘসা লেগে ছিঁড়ে যায় অনেক সময়। তবুও হাসিমুখে এবং ভক্তি গদগদ চিত্তে নিজের মানসিক প্রার্থনা পূরণে দণ্ডীকেটে দেবতাকে উৎসর্গ করেন। 
যে মন্দিরের দেবতাকে এই কঠিন কৃচ্ছ্রসাধনের মাধ্যমে নিজেকে বিলিয়ে দিতে ভক্ত তৎপর হয়, সেই মন্দিরের নিকটবর্তী কোনো পুকুরে গিয়ে প্রথমে স্নান করতে হয়। এরপর ঐ ভেজা কাপড়েই দেবতাকে প্রনাম করে শুরু হয় দণ্ডীকাটা। গোটা মন্দির প্রদক্ষিণ করে দণ্ডী কেটে কেটে। যথেষ্ট কষ্টের কাজ। বারংবার শোয়া এবং উঠে দাঁড়িয়ে দুহাত জড়ো করে প্রনাম করে ফের ভেজা গায়ে জলকাদায় ভরা বন্ধুর জমিতে দণ্ডীকাটা -- নিদারুণ ভক্তির পরিচয়বাহী। 

মূলতঃ ফলহারিণী কালীপূজা, চড়ক গাজন, শীতলাপূজার সময় মন্দিরে এই উৎসব পালন করেন হিন্দু ভক্তগণ। এতে কোনো ফুল বেলপাতা লাগে না। কেবল আগের দিন নিরামিষভোজী হয়ে সম্পূর্ণ অনশনে থেকে দেবতার উদ্দেশ্যে নিজেকে মাটির সাথে মিশিয়ে দণ্ডবৎ শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করা। জল কাদায় শরীর মাখামাখি হয়ে ঘর্মাক্তকলেবরে শারীরিক কষ্টসাধনের মাধ্যমে দেবতার চরণে নিজেকে বিলিয়ে দিতে হয় এই দণ্ডীকাটার মাধ্যমে।
🍂


Post a Comment

0 Comments