জ্বলদর্চি

ভোলগা নদীর খোঁজে - ৬ /বিজন সাহা


ভোলগা নদীর খোঁজে - ৬

বিজন সাহা 

ভোলগার উৎসে 

আমাদের যাত্রা শুরু হল ভোলগার উৎসের সন্ধানে। আস্তাশকভ থেকে কিছু দূর গিয়ে রাস্তা হারিয়ে গেল বুনো পথে। এখন আর এখানে হাইওয়ে নেই – সাধারণ পিচ ঢালা পথ। মাঝেমধ্যে সেটা চলে গেছে সেলিগের হ্রদের পাশ দিয়ে। এক সময় হ্রদও শেষ হয়ে যায়। আমরা এগিয়ে চলি সামনের দিকে। আমাদের যেতে হবে ভালদাই মালভূমিতে যেখানে জন্ম নিয়েছে স্রোতস্বিনী ভোলগা – ইউরোপের দীর্ঘতম নদী, এক সময় রাশিয়ার ধমনী। হয়তো এ কারণেই ভোলগাকে এরা বলে “মাতুশকা ভোলগা” বা মা ভোলগা – ঠিক যেন ভারতবর্ষের মা গঙ্গা। গঙ্গা যেমন ভারতের জন্য – ভোলগা তেমনি রাশিয়ার জন্য জীবন সুধা বয়ে নিয়ে যাচ্ছে। দুই দেশে এই দুই নদীর উপত্যকায় গড়ে উঠেছে বড় বড় শহর, বন্দর, বানিজ্য কেন্দ্র। গড়ে উঠেছে সভ্যতা। আর এ কারণেই দিলীপ এসেছে গঙ্গার সাথে ভোলগার আত্মীয়তার সূত্র খুঁজে বের করতে। 

আস্তাশকভ থেকে ৪২ কিমি উত্তর-পশ্চিমে ভোলগোভেরখভিয়ে গ্রামে সমুদ্র পৃষ্ঠ থেকে ২২৮ মিটার উঁচুতে ভোলগার উৎস অবস্থিত। উৎস ছাড়াও এখানে আছে ওলগিনস্কি মহিলা মনাস্তির আর উনবিংশ শতকের স্পাস-প্রিওব্রাঝেনস্কি গির্জা। আছে ২০০১ সালে স্থাপিত অলৌকিক ঘটনা ঘটনপটীয়সী নিকোলাইয়ের স্ট্যাচু।  কিয়েভের রানী¸ ভেশি ওলেগের পুত্রবধূ আর রাজা ভ্লাদিমির লাল সূর্যের মা, যার উদ্যোগে রুশ দেশে খ্রিস্টান ধর্ম প্রচলিত হয়, সেই ওলগার নামানুসারেই মহিলা মনাস্তিরের নামকরণ। মনাস্তির তৈরির কাজ শুরু হয় ১৯০২ সালে। শেষ হবার আগেই বিপ্লবের কারণে কাজ আর এগোয়নি। নতুন রাশিয়ায় সে কাজ শেষ হয়। সেখানে একটা মেমোরিয়ালে পাথরের গায়ে লেখা আছে 

«এখানে, ভোলগোভেরখভিয়ে গ্রামে ঝর্ণা থেকে মহান রুশ নদী ভোলগার পথচলা শুরু। ভোলগার প্রথম উপনদী ঝর্ণা পেরসিয়ানকা। এরপর আরও ৯১ কিলোমিটার ভেরখিত, স্তেরঝ, ভসেলুগ, পেনো ও ভলগো নামক কতগুলো ক্ষুদ্র ও বৃহৎ  হ্রদের ভেতর দিয়ে তার পথচলা। উৎস থেকে মোহনা পর্যন্ত ভোলগার দৈর্ঘ্য ৩৬৯০ কিলোমিটার।» 

উৎসের পাশেই   ভোলগোভেরখভিয়ে নামে যে গ্রামটি সেটা খুব বেশি বড় গ্রাম নয়। মনে হয় এখানকার মনাস্তিরের যারা দেখাশোনা করে তারাই এখানে থাকে। এ ছাড়াও আছে কিছু স্যুভেনিরের দোকান। তবে স্থানীয় তেমন কিছু নেই। মূলত চাইনিজ বা আলি এক্সপ্রেসের বিভিন্ন পণ্য দিয়ে দোকান ভরা।  

ভোলগার উৎসে একটা ঘর, সেখানে একটা কুপের মত। ঘরটা দেখতে অনেকটা একটা চার্চের মত, অন্তত ওর উপরে একটা ক্রস আছে। সেই ঘর থেকেই ভোলগা তার যাত্রা শুরু করেছে, যেন এক ছোট্ট মেয়ে ঘর থেকে পালিয়ে যাচ্ছে। ওটা দেখেই আমার মনে পড়ে গেল একটা সোভিয়েত কার্টুনের কথা যেখানে একটা ঝর্ণা পাহাড়ি পথ বেয়ে নীচে নেমে আসে আর পথে বিভিন্ন জনের সাথে বন্ধুত্ব করে সাগরের দিকে ধাবিত হয়। এখন মনে হল ভোলগাকে নিয়েই এই কার্টুন। সেখানে ভোলগার উপর ছোট্ট একটা কাঠের সেতু যদিও ঝর্ণা বড়জোর এক মিটার  প্রশস্থ। কিছুতেই লোভ সামলাতে পারলাম না। লাফিয়ে ভোলগা পার হলাম। ইস, যদি কিছু মাটি হাতে নিয়ে লাফাতাম, নিজেকে অন্তত হনূমানের গন্ধমাদন পর্বত নিয়ে সাগর পাড়ি দেবার সাথী বলে ভাবতে পারতাম। এখনও বন্ধুদের বলি আমি লাফিয়ে ভোলগা পার হয়েছি। অনেকেই ভাবে হয়তো শীতে যখন ভোলগা জমে যায় তখন আমি হেঁটে ভোলগা পার হয়েছি। ওখানে অবশ্য ভালুক থেকে সাবধান লেখা কিছু পোস্টার আছে। কে জানে মাঝে মধ্যে ওরা এখানে আসে কিনা মানুষের সন্ধানে। আর আছে বেশ কিছু বেঞ্চ। মনে হয় কখনও সখনও এখানে কোন অনুষ্ঠান হয় আর দর্শকগণ এই বেঞ্চিতে বসে এসব অনুষ্ঠান দেখেন। পাশেই একটা বড় পাথর যাতে লেখা আছে
“তোমার দৃষ্টি ভোলগার উৎসের দিকে ফেরাও। রুশ দেশের পবিত্রতা ও মাহাত্ম্য প্রকাশ করছে যে নদী তার জন্ম এখানেই। এ শুধু নদী নয় এটা রুশদের আত্মার উৎস।” এই পাথরটি স্থাপন করা হয়েছে ১৯৮৯ সালের ২২ জুন  যেসব শিশু এখন রাশিয়ায় বাস করছে আর যারা ভবিষ্যতে জন্ম নেবে তাদের উদ্দেশ্য। 

🍂
হাঁটতে হাঁটতে আমরা এক সময় মনাস্তিরের পাশে চলে আসি। এক মহিলা আমাদের জন্য দরজা খুলে দেন। দিলীপ স্বভাব সুলভ ভাবে জুতা খুলে সেখানে ঢুকে। আমি অবশ্য আগেই  ঢুকে গেছি। সেই মহিলা আমাকে এসে বললেন ওকে জুতা পায় দিতে বল, নয়তো ঠাণ্ডা লাগবে। মহিলার চোখেমুখে ক্লান্তির চিহ্ন। ঈশ্বরের সেবা তাঁকে আনন্দ দেয় বলে আমার মনে হল না।


সব মিলিয়ে ভোলগার উৎস আমাকে তেমন একটা বিমোহিত করতে পারেনি। আমার অনেক ফটোগ্রাফার বন্ধু এখানে এসেছে। ওদের ছবি দেখে আর গল্প শুনে অন্য রকম এক আশা নিয়ে এখানে এসেছিলাম। স্বাভাবিক ভাবে ভোলগা মানেই বিশাল কিছু একটা। এমনকি দুবনায় সে প্রায় ৪০০ মিটার প্রশস্ত। তাই এখানে ভোলগাকে এমন অসহায় ভাবে পড়ে থাকতে দেখে মায়াই হল। এ যেন এক অভুক্ত বা অর্ধভুক্ত কঙ্কালসার শিশু। তবে এটা ঠিক যে না এলেও মনে আফসোস থেকে যেত। ভোলগাকে বিদায় জানিয়ে স্যুভেনিরের দোকানের মেয়েদের সাথে একটু হাসিঠাট্টা করে আমরা আবার পথে নামলাম। এবার চেনা পথ। তাই মনে হল বেশ দ্রুতই আস্তাশকভ চলে এলাম।                  

আস্তাশকভ আমরা ফিরি দুপুর একটার দিকে। দুপুরের খাবার এবার আমরা সারলাম একটা ক্যাফেতে। এখন আর শহরকে মৃত বা জনশূন্য মনে হল না। প্রচুর লোকের ভিড়। ক্যাফেটা গত রাতের রেস্টুরেন্টের মত এত বড় না হলেও অনেক বেশি প্রানবন্ত। মনে হয় এটা শহরের কেন্দ্রে কোথাও হবে। তারপর যাই শহর দর্শনে। সেলিগের হ্রদের পাশে অবস্থিত এই শহর অন্য দশটা উপকূলবর্তী শহরের মতই। একটা জায়গায় গাড়ি পার্ক করে আমরা হাঁটতে হাঁটতে গেলাম হ্রদের তীরে। মেঘলা আকাশ, কিছুটা কুয়াশাচ্ছন্ন। তাই খুব বেশি দূরে কিছু দেখা যাচ্ছিল না। তবে এর মধ্যেই মালবাহী জাহাজ দেখা যাচ্ছিল। দেখা যাচ্ছিল দূরে গির্জা – নিলোভা পুস্তিন। দু একজনের সাথে কথা বলে মনে হল নিলোভা পুস্তিনের বর্তমান জৌলুষে এরা কিছুটা হলেও ঈর্ষান্বিত। ওখানে মস্কো থেকে গুরুত্বপূর্ণ লোকজন আসে অথচ তাদের শহরে আসে না সেটা এদের কষ্ট দেয়। একটু হেঁটে দেখতে পেলাম বিশাল এক গির্জা। দেখে মনে হল দীর্ঘ দিন অবহেলার পরে আবার নতুন করে নির্মাণ কাজ শুরু হয়েছে। ধারণা করা যায় কোন এক সময় এটা ছিল এই এলাকার অন্যতম প্রধান গির্জা। এটা আসলে ভজনেসেনস্কি ক্যাথেড্রাল। ভজনেসেনস্কি ক্যাথেড্রাল তৈরি হয় ১৭৪০ সালে। অক্টোবর বিপ্লবের পর ১৯২০ সালে এটা বন্ধ করে দেয়া হলেও ১৯৪০ সালে আবার খুলে দেওয়া হয়। বর্তমানে এর রিকনস্ট্রাকশন চলছে। সোভিয়েত আমলে সমস্ত গির্জা সরকারের অধীনে চলে গেলেও নতুন রাশিয়ায় সেসব আবার রাশিয়ান অর্থডক্স চার্চের কাছে হস্তান্তর করা হয়। ফলে এখন সারা দেশে প্রচুর চার্চ পুনর্নির্মাণ করা হচ্ছে। তবে নির্মাণ কাজ চল্লেও ঈশ্বরের উপাসনা বন্ধ হয় নি। এক কোণে উপাসনা চলছে। ক্যাথেড্রালের বাউন্ডারির ভেতরে আছে শ্রমিকদের আবাসন। আসলে বিপ্লবের পর ঈশ্বরকে ঘরছাড়া করে শ্রমিকরা তার সম্পত্তি দখল করে নেয়। বর্তমানে ঈশ্বর ফিরে এলেও দখলকৃত জমিজমা  এখনও ফিরে পায়নি আর কখনও ফিরে পাবে কিনা সে ব্যাপারে সন্দেহ আছে। অন্তত আমার সেটাই মনে হয়। 

ভজনেসেনস্কি ক্যাথেড্রালের ঠিক পাশেই রয়েছে কম্পাসের স্ট্যাচু। কম্পাসটা আসলে মাগ্নিৎস্কি বা তেলিয়াশিন লিওন্তি ফিলিপভিচের (১৬৬৯ -১৭৩৯) স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে তৈরি করা হয়েছে। তিনি এই অস্তাশকভেই জন্মগ্রহণ করেন। তিনিই প্রথম রুশ ভাষায় সেট, বিভাজ্য, গুনক এসব গাণিতিক পরিভাষা ব্যবহার করেন। মাগ্নিৎস্কি ছিলেন সেই সময়ের এক বিখ্যাত গণিতবিদ। তাঁর স্মৃতিতে এই কম্পাস। এক ধরণের মিশ্র অনুভূতি হল এটা দেখে। আসলে নিজেদের হিরোদের সম্মান দিতে না জানলে কোন জাতিই বড় হতে পারে না। আমাদের দেশে মূলত রাজনৈতিক নেতারা আর ধর্মগুরুরা এমন সম্মান পান। এখানে প্রায় প্রতিটি প্রতিভাবান মানুষকেই কোন না কোন ভাবে স্মরণীয় করে রাখা হয়।

সময় ফুরিয়ে আসে। আমাদের যেতে হবে তভের। আজ রাত সেখানেই থাকব। আমার খুব ইচ্ছে পথে নিলোভা পুস্তিন ঘুরে যাবার। দেমিদকে সেভাবেই বলেছি। দিলীপ রুশ না জানায় এই এক সুবিধা, নিজের ইচ্ছেগুলো কমবেশি বাস্তবে রূপ দেয়া যাচ্ছে। রুশরা বলে যে বিল পরিশোধ করে সেই মিউজিকের অর্ডার দেয়। তবে ক্ষেত্র বিশেষে সেই অর্ডার দেয় যে স্থানীয় ভাষা জানে।   

ভোলগার উৎসের কিছু ছবি দেখা যাবে এখানে
http://bijansaha.ru/albshow.html?tag=240

আর ভিডিও এখানে
https://www.youtube.com/watch?v=gxtuyxnaf3s   




Post a Comment

0 Comments