পর্ব ৮০
শ্রীরামকৃষ্ণের সন্ন্যাসী সন্তানেরা
প্রীতম সেনগুপ্ত
আর কারোর না হোক, নরেন্দ্রর কথা ঠাকুর খুব মানতেন, শুনতেন। আবার এই ব্যাপারে অনেকক্ষেত্রে হাস্যরসের উদ্রেকও হত। এমন একটি ঘটনার উল্লেখ স্বামী গম্ভীরানন্দ প্রণীত ‘যুগনায়ক বিবেকানন্দ’ গ্রন্থে এইরকম -- “... একদিন ঠাকুর ভক্তের স্বভাবের সহিত চাতকের দৃষ্টান্ত দিয়া বুঝাইতেছিলেন, ‘চাতক যেমন নিজ পিপাসাশান্তির জন্য সর্বদা মেঘের দিকে তাকাইয়া থাকে এবং উহার উপর সর্বতোভাবে নির্ভর করে, ভক্তও তদ্রূপ নিজ প্রাণের পিপাসা ও সর্বপ্রকার অভাব মিটাইবার জন্য একমাত্র ঈশ্বরের উপর নির্ভর করে’-- ইত্যাদি। অমনি নরেন্দ্রনাথ সহসা বলিয়া উঠিলেন, ‘চাতক বৃষ্টির জল ভিন্ন অন্য কিছু পান করে না ঐরূপ প্রসিদ্ধি থাকিলেও ঐ কথা সত্য নহে; অন্য পক্ষীসকলের ন্যায় নদী প্রভৃতি জলাশয়েও পিপাসা-শান্তি করিয়া থাকে। আমি চাতক পক্ষীকে ঐরূপ জলপান করিতে দেখিয়াছি।’ ঠাকুর বলিলেন, ‘সে কি রে? চাতক অন্য পক্ষীর ন্যায় জলপান করে? তবে তো আমার এতকালের ধারণা মিথ্যা হল, তুই যখন দেখিয়াছিস, তখন তো ঐ বিষয়ে আর সন্দেহ করতে পারি না।’ ঐরূপ বলিয়াও ঠাকুর শান্ত হইতে পারিলেন না। তাই তো, একটা ধারণা যদি এইভাবে মিথ্যা প্রমাণিত হয়, তবে অন্য ধারণাগুলিরই বা কি হইবে? ইহার কয়েকদিন পরেই নরেন্দ্রনাথ ঠাকুরকে ডাকিয়া বলিলেন, ‘ঐ দেখুন মহাশয়, চাতক গঙ্গার জল পান করিতেছে।’ ঠাকুর ব্যস্তভাবে আসিয়া বলিলেন, ‘কই রে?’ নরেন্দ্র দেখাইয়া দিলে তাঁহার চোখে পড়িল একটি চামচিকা জলপান করিতেছে। তখন তিনি সহাস্যে বলিলেন, ‘ওটা চামচিকা যে? ওরে শালা, তুই চামচিকাকে চাতক জ্ঞান করিয়া এতটা ভাবাইয়াছিস্? তোর সকল কথায় আর বিশ্বাস করব না।”
নরেন্দ্রর জীবনজুড়ে ছিল অদ্ভুত হাস্যরসের প্রবাহ। এই বিষয়ে বিশিষ্ট বিবেকানন্দ গবেষক শঙ্করীপ্রসাদ বসু ‘সহাস্য বিবেকানন্দ’ গ্রন্থটিতে এক স্থানে নরেন্দ্রর ধূমপান অভ্যাস বিষয়ে পিতা বিশ্বনাথ দত্তের প্রতিক্রিয়া নিয়ে লিখছেন --“...বিশ্বনাথ দত্ত অবশ্য কিছুদিনের মধ্যেই চমৎকৃত হয়ে দেখবেন -- তাঁর পুত্র ধূমপান সম্বন্ধে পরীক্ষা-নিরীক্ষার স্তর পার হয়ে গেছেন। মেট্রোপলিটান স্কুল- পড়াকালেই নরেন্দ্রের ধূমপানের অভ্যাসের সূচনা। পুত্রের অকাল ধর্মের প্রতি আসক্তির কথা পিতা ইতিমধ্যেই জেনেছেন। এখন এই আর একটি অকাল-আসক্তির কথা জানলেন। না, পুত্রের মাথায় পিতা মোহমুদ্গর বসালেন না, তিনি হাসলেন। তাঁর হাসির দৌত্য পুত্রের দুই আসক্তিকে চিরবন্ধনে বেঁধে দিল। পড়ার ঘর বন্ধ করে পুত্র ধূমপান করে থাকেন। পিতা বললেন, ‘বাবাজি ঠাকুরকে ধূপ-ধূনা দিচ্ছেন, তাই বন্ধ’।” শঙ্করীপ্রসাদ আরেকটি ঘটনার বর্ণনায় জন্ম-নেতা নরেন্দ্রনাথকে তুলে ধরেছেন। সেটি এইরকম-- “কথাসাহিত্যিক কেদারনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় নরেন্দ্রনাথের সঙ্গে একদিনের আলাপের মনোহারী বিবরণ দিয়েছেন। কেদারনাথের বাড়ি দক্ষিণেশ্বরে। তাঁর বন্ধু হরিদাস চট্টোপাধ্যায় বি-এ পড়েন, তিনি কেদারনাথকে একদিন নিজের বাড়িতে টেনে নিয়ে চললেন তাঁর এক সহপাঠী-বন্ধুর সঙ্গে আলাপ করিয়ে দেবার জন্য। হরিদাসকে এ ব্যাপারে বেশি উদগ্রীব দেখে কেদারনাথ কারণ জিজ্ঞাসা করলেন। হরিদাস বললেন, ‘বিশেষ কিছু নয়; এই তুমি যেমন আমাদের দলের প্রধান বক্তা ও রহস্যপটু আনন্দদাতা, তিনিও তেমনি কলেজে আমাদের গল্পে ও কথায় রসমুগ্ধ করে রাখেন। তাঁর সঙ্গ সকলেই খোঁজে। তাঁর মতো রসমধুর বক্তা বিরল।’
হরিদাস তাঁর কলেজী বন্ধু নরেন্দ্র দত্তকে মুড়ির থালা ধরিয়ে দিয়ে এসেছিলেন। কেদারনাথকে সঙ্গে করে বাড়িতে পৌঁছতেই নরেন্দ্রনাথ মুড়ির থালা এগিয়ে দিয়ে বললেন, ‘লেগে যান।’ কেদারনাথ --‘কি মাজতে নাকি? সে-কাজ এই সদরঘরে কেন? হরিদাস বড় সৌখিন লোক।’
নরেন্দ্রনাথ --‘কেন, হরিদাসের মুড়ি ফুরিয়ে গেছে নাকি? Haridas a damn thrift.’
হাসির মধ্যে আলাপের সূচনা হয়ে গেল।
হরিদাস পরিচয় করিয়ে দিলেন, ‘ইনি কলিকাতার সিমলা-নিবাসী শ্রীনরেন্দ্রনাথ দত্ত। আমাদের সহপাঠী হলেও দুনিয়ার কি, বা কোন্ বিষয় যে জানেন না, সেইটিই জানিনা।’
নরেন্দ্রনাথ -- ‘কেন ম্যাথামেটিক্স! বিদ্যাসাগর মশাই এখনো বেঁচে আছেন -- সদা সত্য কথা কহিবে।’ খানিক কথাবার্তার পর কেদারনাথ দেখলেন, ‘যেমন সুপরুষ, তেমনি সুবক্তা। তাঁকে দেখলে বা তাঁর কথা শুনলে মুগ্ধ না হয়ে কেউ থাকতে পারবে না। তাঁর রহস্য-মাখা ভাষা ছিল শোনবার জিনিস, কিন্তু বস্তু থাকত ভাবে। শ্রোতা অবাক হয়ে ভাবত বয়সের অনুপাতে এতখানি জ্ঞান হয় কি করে? এ যে বড় বড় শাস্ত্রজ্ঞ পণ্ডিতের কাছেও চমকপ্রদ। কিন্তু তাঁর মুখে সে-সব হাসি রহস্যচ্ছলেই প্রকাশ পেত। এমন অদ্ভুত যুবা দেখিনি।’
এই দিনই নরেন্দ্রনাথ দক্ষিণেশ্বর কালীবাড়িতে শ্রীরামকৃষ্ণকে দেখতে যান।
নরেন্দ্রনাথ --‘না হয় ঠকাই যাবে। শুনেছি ( পরমহংস ) নিরক্ষর ব্রাহ্মণ, ইতিপূর্বে মা-কালীর পূজারী ছিলেন, এখন সহসা সিদ্ধপুরুষ, আমাদের দেশে যা সহজেই হওয়া যায়। তাঁকে দেখা হবে। আমাদের দেশে লোক পয়সা দিয়েও ভেলকি দেখে। শুনেছি এখানে পয়সাও লাগে না।’
শ্রীরামকৃষ্ণের সঙ্গে নরেন্দ্রনাথ এমন চোটপাট কথাবার্তা বললেন যে, কেদারনাথের ভাল লাগল না।
‘বাইরে বেরিয়ে নরেন্দ্রনাথ বললেন, আমার কথাগুলো বড় বিশ্রী লাগছিল, না বাঁড়ুজ্জে?’ বললুম, সেটা নিজেই বুঝতে পারছেন। ‘না, আমি ভাল বুঝতে পারিনি। ( শ্রীরামকৃষ্ণের সমাধি নরেন্দ্রনাথ দেখেছিলেন )। তাই দ্বিতীয়বারের জন্য একটু কড়া ভূমিকা ছেড়ে চললুম। এর পরের সাক্ষাতে খোলসা হতে পারে। সেবার আর হরিদাসের মুড়ি নষ্ট করব না, সোজা একাই চলে আসব।’ আর দাঁড়ালেন না।
কেদারনাথের মনে হল --‘সমবয়সী হলেও এরূপ ছেলে পূর্বে দেখিনি -- যেমন নির্ভীক, কথাবার্তাতেও তেমনি বহুদর্শী জ্ঞানীর মতো। এ ছেলে কারো মুখ চেয়ে কথা কবার নয়, লীডার হবার জন্যই জন্মেছে। দেখলুম, ঠাকুর এঁকে চান। এ ছেলে কম্যাণ্ডার-ইন-চীফ -- সোলজার নয়।”
🍂 এই প্রসঙ্গে বরানগর মঠের দিনগুলি স্মরণ করা যায়। লাটু মহারাজ ( স্বামী অদ্ভুতানন্দ ) সেই দিনগুলি নিয়ে বলছেন --“... মঠে দেখতুম কালীভাই কোন কুছু ঝঞ্ঝাটের মধ্যে যেতে চাইতো না। রাতদিন কেবল পড়াশুনো করতো। ফুরসৎ পেলে লোরেনভায়ের সাথে তর্ক জুড়ে দিতো। লোরেনভাই তার তর্কগুলো কুচকুচ করে কেটে দিতো। বাকী একদিন লোরেনভাইকে সে এমন কোণঠেসা করলে যে কুছুতেই আর লোরেনভাই তার উত্তর দিতে পারলে না। তখন লোরেনভাই বললে -- ‘আজ এই পর্য্যন্ত, কাল আবার এইখান থেকে শুরু করবো।’ কালীভায়ের সেদিন ভারী ফূর্ত্তি হোলো। বাকী পরের দিনে লোরেনভাই এমন সব যুক্তি দিতে লাগলো যে, কালীভাইয়ের সব কথা কেটে গেলো। তখন কালীভাই দুঃখু করে বললে -- ‘লোরেনকে একদিনও যুক্তি দিয়ে হারাতে পারলাম না।’ কালীভায়ের কথা শুনে হামনে বললুম -- ‘এ ত হোবেই; লোরেনভাই হামাদের লিডর ( নেতা ), তাকে ছাপিয়ে তুমি যেতে পারবে কেনো?” ( শ্রীশ্রীলাটু মহারাজের স্মৃতিকথা, শ্রীচন্দ্রশেখর চট্টোপাধ্যায় )
‘লোরেনভাই’ অর্থাৎ নরেন্দ্রনাথ -- উত্তরকালে স্বামী বিবেকানন্দ, হয়ে উঠলেন জাতির নেতা, বিশ্বনেতা।
0 Comments