মেদিনীপুরের মানুষ রতন, পর্ব -- ৫৮
ড. বিশ্বরঞ্জন ঘোড়ই (অধ্যাপক, সংগ্রাহক, লোকসংস্কৃতি গবেষক, মেদিনীপুর)
ভাস্করব্রত পতি
বিশ্বনাথপুর গ্রাম। গ্রামের প্রান্তে কেলেঘাই ও বাঘুই নদীর দূরন্ত পথচলা। বন্যা কবলিত গ্রাম। কৃষিজ ফসল দারুণ হয়। চারিদিকে সবুজের সমারোহ। কিন্তু এখানে বর্ষার সময় বন্যার ভ্রুকুটি যেমন ছিল, তেমনি নদীকেন্দ্রিক জীবনের মাধুর্য ছিল বেশ। মানুষজনের সারা বছরের পেশা ছিল চাষবাস, কৃষিকাজ।
তেমনই এক কৃষক পরিবারে ১৯৫৭ এর ১ লা ডিসেম্বর জন্মগ্রহণ করেন আজকের মেদিনীপুরের মানুষ রতন ড. বিশ্বরঞ্জন ঘোড়ই। বাড়ির এক বাল্য বিধবা দিদির স্নেহাচার্যতে বড় হয়েছিলেন লোকজীবনের ঘ্রাণ নিতে নিতে। ছোট থেকেই গ্রামীণ পরিবেশের ছত্রছায়ায় জারিত হয়েছে তাঁর মননশীল দিনগুলি।
ছোটবেলা থেকেই গাছের প্রতি, ফুলের প্রতি টান ছিল অসীম। গ্রামের বাড়িতে বড়দা লাগাতেন গাছ। উৎসাহ সেখান থেকেই। এরপর পাঁচমুড়া কলেজে (১৯৮৭-১৯৯৭) অধ্যাপনার সময় সেখানকার ল্যাটেরাইট মাটিতে সবুজায়ন করেছিলেন। ছাত্র ছাত্রীদের সাথে নিয়ে তাঁর সবুজ করার পথে কেউ বাধা হয়ে ওঠেনি। সেখানকার বট, অশ্বত্থ গাছের তলা বাঁধিয়ে সেখানে শান্তিনিকেতন স্টাইলে ক্লাস করতেন ছোটবেলায় শেখা প্রকৃতি প্রেমের বিদ্যা দিয়ে। আসলে প্রজন্মের কাছে সুস্থ থাকার বার্তা দিতে চেয়েছেন সবুজ গাছের হাত ধরেই।
গ্রামের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়াশোনা চুকিয়ে নৈপুর শান্তিসুধা ইন্সটিটিউশনে উচ্চ মাধ্যমিক সেরে সটান মেদিনীপুর কলেজ। এখানে সাম্মানিক স্নাতক হওয়ার পর সোজা বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়। স্নাতকোত্তর এবং ডক্টরেট ডিগ্রি অর্জন করেন এখানেই।
বিশ্বভারতীতে পড়ার সময় এখানকার রবীন্দ্র মিউজিয়াম দেখে পরিকল্পনা করেন নিজেই মিউজিয়াম বানানোর। সেই ইচ্ছে থেকে নিজের বাড়িতে বানিয়েছেন এক অনন্য সংগ্রহশালা। এর পাশাপাশি পাঁশকুড়া বনমালী কলেজের বাংলা বিভাগেও বানিয়েছেন লোকসংস্কৃতি মিউজিয়াম। এখানে যেমনি রয়েছে অসংখ্য হস্তশিল্প, তেমনি রয়েছে টেরাকোটার অজস্র সামগ্রী, পুঁথি পত্র, মডেল ইত্যাদি। পরিবেশ, প্রকৃতি এবং সমাজ থেকে হারিয়ে যাওয়া জিনিসগুলো সংগ্রহ করে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের অবলোকনের জন্য সাজিয়ে রেখেছেন নিজের ভাবনা মতো। একসময় এগুলিই হয়ে উঠবে একটা হারিয়ে যাওয়া প্রজন্মের দলিল।
স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভের পরেই বাংলা বিভাগের অধ্যাপক ড. সুখময় মুখোপাধ্যায়ের তত্বাবধানে Ministry Of Education এর প্রোজেক্টে জয়দেব কেন্দুলী নথি প্রকল্পের রিসার্চ স্কলার হিসেবে কাজ শুরু করেন। সেইসঙ্গে অ্যানথ্রোপলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়ার একটি প্রোজেক্টে Santal and Non Santal Behavior in Agriculture in Birbhum District এর কাজে যুক্ত হন অধ্যাপক অসীম অধিকারীর অধীনে। দেড় বছর করার পরেই ১৯৮৭ তে যুক্ত হন অধ্যাপনার কাজে। বাঁকুড়া জেলার পাঁচমুড়া কলেজে শুরু হয় অধ্যাপক হিসেবে কর্মজীবন।
দশ বছর পর পাঁচমুড়া কলেজ থেকে চলে আসেন পাঁশকুড়া বনমালী কলেজে। আর 'ঢেঁকি স্বর্গে গিয়েও ধান ভানে'। এখানে এসেও তাঁর পরিবেশপ্রীতি কমেনি। বরং বেড়ে গিয়েছিল। পুরো ক্যাম্পাস জুড়ে সবুজের চাঁদোয়া তৈরি করেন তিনি। আর পাঁচমুড়াতে থাকাকালীন বিখ্যাত টেরাকোটার কাজের প্রতি যে ভালোবাসা তৈরি করে ফেলেছিলেন, তা পরবর্তী জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে কাজে লাগিয়েছেন। পাঁশকুড়া কলেজে এসেও সেই টেরাকোটাকে কাজে লাগিয়ে বানিয়েছেন তোরণ। চারিদিকে করা হয়েছে সৌন্দর্যায়ন।
দু দুবার বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয়ে U. G. Council এর সদস্য হয়েছেন। ফলে বিভিন্ন ইন্সপেকশন টিমের হয়ে অবিভক্ত মেদিনীপুরের সমস্ত কলেজে গিয়েছেন। আর কলেজগুলির সাথে গড়ে তুলেছেন একটা আত্মিক সম্পর্ক। একসময় বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে পড়তে খুব ফুটবল খেলতেন। রেফারিং পরীক্ষাতেও উত্তীর্ণ হয়েছেন। ইন্টার ইউনিভার্সিটি ফুটবল দলের খেলা পরিচালনা করেছেন তিনি। N. S. S. করেছেন। বিশ্বভারতীতে থাকা কালীন ড. পঞ্চানন মণ্ডলের সঙ্গে গ্রামে গ্রামে ঘুরে সংগ্রহ করেছেন অসংখ্য পুঁথি। সেই অভিজ্ঞতা পরবর্তীতে কাজে লেগেছে তাঁর। বিশ্বভারতীতে 'জয়দেব কেন্দুলি নথি প্রকল্প'র কাজে এবং 'অ্যানথ্রোপোলজিক্যাল সোসাইটি অব ইণ্ডিয়া'র প্রোজেক্টের কাজ করার সঙ্গে সঙ্গে গবেষণার কাজও করতে থাকেন। ১৯৮৮ তে তা জমা দেন। ১৯৮৯ তে রাজীব গান্ধী আচার্য থাকাকালীন তাঁর কাছ থেকে ডিগ্রি লাভ করেন।
নিজের বাড়িতে গড়ে তুলেছেন টেরাকোটার অপূর্ব সম্ভার। শুধু আলমারির শোকেসে সাজানো নয়, বাড়ির আনাচেকানাচে ডেকোরেশন করেছেন টেরাকোটার সামগ্রী দিয়ে। একটা লৌকিক শিল্পকলাকে ভালোবাসা দিয়ে আত্মীকরণ করেছেন ঐ শিল্পকলার প্রতি নিবিড় ভালোবাসা এবং শিল্প ও শিল্পীর প্রতি দায়বদ্ধতা থেকে। সাধারণ মানুষের মনে টেরাকোটার প্রতি আগ্রহ, চাহিদা, পছন্দ, টান এবং ভালোবাসা জন্মানোর জন্য এই পন্থা নিয়েছেন লোকসংস্কৃতি গবেষক ড. বিশ্বরঞ্জন ঘোড়ই।
ড. বিশ্বরঞ্জন ঘোড়ইয়ের কাছে ছাত্রছাত্রীরা শেখে বাংলার সংস্কৃতির ব্যবহারিক পাঠ। বাংলা ভাষা সাহিত্যের অধ্যাপক হয়ে অগুনতি ছাত্র ছাত্রী তিনি সমাজের হাতে তুলে দিতে পেরেছেন যাঁরা এই সংস্কৃতি টিকিয়ে রাখতে বদ্ধপরিকর সমাজের কল্যাণে। মানুষ গড়ার কারিগর হয়ে নিজের দেশ, নিজের সংস্কৃতি নিজের পরিচয় টিকিয়ে রাখার অমূল্য পাঠদান করে গিয়েছেন কর্মজীবনের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত। অবসরের পরেও থমকে নেই মেদিনীপুর তথা বাংলার সংস্কৃতি বাঁচানোর নির্ভিক প্রয়াস।
1 Comments
বিরল মানুষ
ReplyDelete