জ্বলদর্চি

শব্দে গাঁথা মণি-মালা : ৭ /সালেহা খাতুন

এই হাসপাতালেই মায়ের অপারেশান হয়।

শব্দে গাঁথা মণি-মালা : ৭ 

সালেহা খাতুন 

তবুও জীবন থেমে থাকে না। বহতা নদীর মতোই বয়ে চলে। দামোদর অধ্যুষিত এলাকায় মায়ের পৈতৃক ভিটেতে যে জীবন উপহার পেয়েছি গঙ্গার কিনারা বরাবর উঠেছি বেড়ে, সে জীবন আমার কাছে বার বার তার সুধাপাত্র নিয়ে হাজির হয়েছে। বিভিন্ন শিক্ষালয়ের দ্বার আমার জন্য সে উন্মুক্ত করে সমগ্র জগতকে এনে দিয়েছে নাগালের মধ্যে। 

১৯৮৩-র একেবারে শুরুর দিকে একটি রেখাচিত্র আমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বাবা বললেন হাইস্কুলে চলে যাও। আশ্চর্য বাবা তো ঐ স্কুলেই পড়ান! অথচ সঙ্গে করে না নিয়ে গিয়ে আমাকে একা একা পাঠিয়ে দিলেন! হাঁটা পথ। পাক্কা ৪৫ মিনিট লাগতো। প্রতিকূল সে পথ। বাঁকের পর বাঁক ঘুরে অবশেষে স্কুলে পৌঁছলাম। প্রথম দিন একা গেলেও পরে বন্ধুদের পেয়ে যাই।

প্রাইমারির দুই সহপাঠী মিরুজা ও মাসুমা বেলডুবি হাইস্কুলেই ভর্তি হয়। ফলে খুব কম দিনই একা একা যেতাম। পরে যাত্রাপথে বন্ধুর সংখ্যা বাড়তে থাকে। লুৎফন, মনীষা মনিরা,তৌহিদা আরো অনেকে যুক্ত হয়।

 বাবার সহকর্মীদের অনেককেই আগে থেকে  চিনতাম। কেননা দাদিমার মৃত্যুতে বাবাকে সমবেদনা জানাতে অনেকেই এসেছিলেন। তাঁদের হাত ধরে বাবাকে কাঁদতে দেখেছি। দাদিমার মৃত্যু বাবাকে অনেক বদলে দেয়। তুখোড় রাজনীতিবিদ হয়ে উঠেন ধার্মিক। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়তে শুরু করেন।
🍂

ক্লাস ফাইভে যখন পড়ছি নানান ঘটনায় অভিজ্ঞতার ঝুলি পূর্ণ হতে থাকে।দাদিমার অপূর্ণ কাজ ছোটোকাকার বিয়ে দেওয়া সেটি সংঘটিত হয় ১৯৮৩ এর ২৬ সেপ্টেম্বর। বাবা এবং সেজোকাকা পাত্রী অনুসন্ধান থেকে শুরু করে বিবাহের খুঁটিনাটি সবকিছু সম্পন্ন করেন।

 এদিকে মা ঘোরতরভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েন। অসহ্য পেটের যন্ত্রণায় কাতর হয়ে পড়েন। ডাক্তার দেখানো হয়। বিয়ের অনুষ্ঠানের জন্য যন্ত্রণা চেপে রাখেন। আমাদের তিন ভাইবোনকে সাজিয়ে গুজিয়ে বরযাত্রী পাঠিয়ে দেন। সন্ধ্যায় বরকনে ঘরে এলো। মায়ের ঘর অন্ধকার। দাঁতে দাঁত চেপে যন্ত্রণা সহ্য করতে থাকেন। 


পরের দিন বৌভাত। মুসলিম পরিবারে সাধারণত দিনের বেলায় সব অনুষ্ঠান হয়। আত্মীয় স্বজনের আগমনে ঘর গমগম করছে। কনেযাত্রীরা এসে গেছে। ছোটোকাকার কাছে মায়ের অসুস্থতা গোপন রাখা হয়েছিল কিন্তু যে মুহূর্তে এ কথা তিনি জানতে পেরেছেন সঙ্গে সঙ্গে মাকে নিয়ে কলকাতায় চলে গেছেন। 

শ্রী বিশুদ্ধানন্দ নামের এক মারোয়াড়ি হাসপাতালে মাকে ভর্তি করে দেন। প্রায় একমাস মা ঐ হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন। 
পনেরো দিন শুধু হরলিক্স খাইয়ে রাখা হয় মাকে।  তারপর পেটের অপারেশান করেন ডক্টর টিবরল। ডিওডিনাম আলসার, নাড়ির সঙ্গে নাড়ির জড়িয়ে যাওয়া এবং অ্যাপেনডিসাইটিস এতোকিছু মিলে এক বৃহৎ অপারেশান। মাকে এমনভাবে অজ্ঞান করা হয় অপারেশানের জন্য যে মায়ের তিনদিন জ্ঞান ফেরেনি। ছোটোকাকা ঠায় বসে ছিলেন অপারেশান থিয়েটারের বাইরে। মায়ের জ্ঞান ফিরলে এক নার্স মাকে বলেছিলেন “লক্ষ্মণের মতো দেবর পেয়েছেন জীবনে এঁকে ভুলবেন না যেন”। 


বাকি আত্মীয়স্বজনরা মাকে হাসপাতালে দেখতে গেছেন। বড়োমেসো বড়োমাসি সপরিবার বাংলাদেশ ভ্রমণ ক্যানসেল করেছেন মায়ের জন্য। বাবা এক দুবার দেখতে গেছেন। আমিও মাকে দেখার জন্য আকুল হওয়ায় খোকাদাদা(আমার পিসতুতো দাদা) আমাকে কলকাতায় মায়ের কাছে নিয়ে গেছেন একবার। হাওড়াব্রিজের উপর সেই প্রথমবার হাঁটি। ছোটোকাকা সেদিনই কলকাতা থেকে সুন্দর একটা ফ্রক কিনে দেন। খোকাদাদা কিনে দেন পাথর সেট করা চুলের ক্লিপ। যাতে মাকে ছেড়ে থাকার কষ্ট কিছুটা ভুলে থাকতে পারি।


এসময়েই শিখি আত্মত্যাগ কী জিনিস। এ ত্যাগ ছিল আমার ছোটোকাকার। বিয়ের পরের দিন ছোটোকাকার জোড়ে যাওয়ার কথা। অথচ তিনি পণ করলেন আমার মাকে সুস্থ না করে তিনি কোথাও এক পা নড়বেন না। বিয়ের অনুষ্ঠানের একমাস পর ছোটোকাকিমার সঙ্গে তাঁর প্রকৃত আলাপ হয়। আমার মাকে সুস্থ করে বাড়ি ফিরিয়ে এনে দিয়ে তবে শ্বশুরবাড়ি যান।


মা যখন হাসপাতালে আমাদের তিন ভাইবোনকে দেখাশোনার জন্য দিদাকে আমাদের বাড়ি আসতে অনুরোধ করা হয় কিন্তু তিনি দাদুকে পাঠিয়ে দেন। ভাই তখন খুবই ছোটো। তার সব কাজ করে দিতে হয়। দাদু প্রচণ্ড পিটপিটে মানুষ। তবুও অসাধ্য সাধন করেন। আর রান্নাবান্নার দায়িত্ব নেন আমার সেজোমা। এখানেও একটা ব্যাপার আমাকে অবাক করেছিল, সেজোমা সেসময় কোনোদিন কোনো কাজ করতে দেননি আমাকে। যদিও ছোটোদের ফাইফরমাশ খাটানো সব সংসারেই প্রায় দস্তুর।
ছোটোকাকার বিয়েতে আমি ও ভাই।

মা ঈশ্বরের কাছে নিজের আয়ু ভিক্ষা করেছিলেন শুধুমাত্র ভাইকে সাবালক করে তোলার জন্য। পরম করুণাময় সে প্রার্থনা শুনেছেন। সংসারে ফিরে বিশ্রাম পেলেন না। আবার কর্মযজ্ঞে ঝাঁপিয়ে পড়লেন। আমাদের পড়াশোনার দায়িত্বও নিলেন পুরোপুরি। মা-ই তো আমাদের পড়াতেন। কিছুদিন বাবার হাতে পড়লাম। অঙ্কের জন্য আমার পিঠে কঞ্চি ভাঙলেন। ডাজ বানানকে ডোজ করার জন্য দিলেন থাপ্পড়। রুপিজকে রেস উচ্চারণ করায় কানমলা। আসলে অভিভাবকরা ঠিকঠাক নজর রাখলে ভবিষ্যতে পথ চলা অনেকটা মসৃণ হয়। ক্লাস ফাইভে প্রায় সাড়ে তিনশো ছাত্রছাত্রীর মধ্যে ফার্স্ট হলাম। ছোটোকাকার কিনে দেওয়া সুন্দর জামাটা পরে রেজাল্ট আনতে গেলাম। 
(ক্রমশ)

Post a Comment

0 Comments