জ্বলদর্চি

যেতে যেতে পথে-৭৬/রোশেনারা খান

বিদ্যাসাগর শিক্ষক শিক্ষন মহাবিদ্যালয়ের সুবর্ণজয়ন্তীতে।

যেতে যেতে পথে

রোশেনারা খান

পর্ব ৭৬  

আজ খান সাহেবকে কলকাতা নিয়ে গেছলাম চেকআপে। সঙ্গে সৌনক গেছল। এখন বিকেল পর্যন্ত রিপোর্টের জন্য অপেক্ষা করতে হয় না বলে ২ টোর সময় বাড়ি ফিরে গেছি। মাঝে কলকাতায় লাঞ্চও করেছি।

  আজ ২৮ এপ্রিল বিশ্ব নৃত্যদিবস। ভেবেছিলাম দেখা দিয়ে চলে আসব, কিন্তু ওরা দেখতে পেয়েই পদযাত্রার সামনে দাঁড় করিয়ে দিল। পরদিন আনন্দবাজারে সেই ছবি প্রকাশিত হওয়ার পর অনেকেই বললেন, ‘কাগজে আপনার ছবি দেখলাম’।  ছবি তো আজকাল প্রায়ই থাকে। ওতে আর কী হয়? 

   ৫ মে, মানে আজ বিদ্যাসাগর শিক্ষক শিক্ষণ মহাবিদ্যালয়ের সুবর্ণজয়ন্তীর অনুষ্ঠানে গেছলাম। যথাযোগ্য সম্মান দিয়ে ওরা বরণ করল, ছবি তুলল, ওখানেই আমাদের জন্য আলাদাভাবে লাঞ্চের ব্যবস্থা ছিল। আমি আর অন্নপূর্ণাদি একসঙ্গে বসেছিলাম, এক সঙ্গে  লাঞ্চ করলাম। মে মাস মানেই প্রচণ্ড গরম। লিখতে বসতেও পারছি না। এর মধ্যেই সকালে বাজার থেকে মাছ, আলু আর কিছু সবজি কিনে এনে রান্না করলাম। লেবার ডেকে এনে ছাদ বাগান আর নিচের রুমটা পরিস্কার করালাম। কত আর এসি চালানো যায়? প্রচুর বিল আসবে। রাতে আনন্দবাজার থেকে একটা বিষয়ে জানার জন্য ফোন করেছিল।

    আজ ১১ মে আনন্দবাজারের জেলার পাতায় আমার ইউক্যালিপটাস জঙ্গলের  ওপর লেখা আর্টিকেলটি প্রকাশিত হয়েছে। অনেকেই ফোনে প্রশংসা করছেন। কেউ  কেউ বলছেন, ‘আপনি এসব নিয়েও ভাবেন? অনেক না জানা বিষয় আপনার লেখা থেকে জানা গেল’।

   মেদিনীপুর কুইজকেন্দ্র আজ ১১ জ্যৈষ্ঠ রবীন্দ্র নজরুল সন্ধ্যার আয়োজন  করেছিল।   মৌসম মজুমদার, বিবেকানন্দ ভট্টাচার্য ও আমি কিছু বললাম, আমি দুটি   স্বরচিত কবিতা পাঠ করলাম। চদ্রিমা গিয়েছল, সমস্তটা ভিডিও করেছে। আমরা  তাড়াতাড়ি ফিরে এসেছিলাম।

       আজকাল নিয়মিত লেখা হয়ে ওঠে না। সব ভুলে যাই। তাছাড়া সময় পাইনা। আজ ওনার ডায়ালিসিস ছিল, দুপুরে ফিরেছি। রানী রান্না করে রেখে কলেজ গেছে রেজাল্ট আনতে। ওর বোন তানি এসেছে, ও আমাদের দরজা খুলে দিল।

   সুদিনদা ও ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট সুমন বিশ্বাসকে দুখানা বই কুরিয়ার করলাম। ফেরার পথে লন্ড্রি থেকে শাড়ি নিলাম, ওনার ওষুধ নিলাম। প্রচণ্ড রোদ, গরম। এর থেকেও বেশি কষ্ট হয় ওনার জন্য। ডায়ালিসিসের সুচটা যখন হাতে ঢোকায়,  ওনার খুব কষ্ট হয়, আমিই সহ্য করতে পারিনা।

    ডায়ালিসিসের সময় প্রা্য়দিন প্রেসার ফল করে, মাঝে মাঝে বমিও হয়।  আজও হয়েছে। ওরা কী সব করে সামাল দিল। ওরা বলল বেশি জল বের করা যাবেনা, ওয়েট বেড়েছ। ৪৫ কেজি ওয়েট বাদ দিয়ে জল বের করা হবে। জানিনা   কি হবে। সুদিনদা ও সুমন, দুজনেই বইয়ের প্রাপ্তিস্বীকার করেছেন।

      ১০ ডিসেম্বর, ‘মানবাধিকার দিবস’ তবে গতর খেটে খাওয়া মানুষেরা, বিশেষ করে এই শ্রেণীর মহিলারা অধিকার টধিকার বোঝে না। একটা সহজ কথা   ওরা বোঝে, ‘ভাত দেয় কি ভাতারে?/ভাত দেয় গতরে’। ওরা গতর খাটিয়ে খায়, স্বামীর হাতের মারও খায়। অধিকারের কথা বলতে গেলে, হয়ত মেরেই   ফেলবে। তারপর যা হবার হবে।

      বছরের শেষটা ঘরেবাইরে খুব ব্যাস্ততার মধ্যেই কাটছে। ১৫ ডিসেম্বর বিদ্যাসাগর ইউনিভারসিটির রাষ্ট্র বিজ্ঞানের অধ্যাপক মেদিনীপুর কলেজে গান্ধীজীর ওপর একটি সেমিনারের আয়োজন করেছিল। সুধীররঞ্জন বাগ, অমর সাহা, গার্গী সহ বেশ কিছু অধ্যাপক অংশগ্রহন করেছিলান। আমাকে অনুষ্ঠানের চেয়ারপার্সন  করা হয়েছিল। এত গুণী মানুষ থাকতে আমি কেন? আজই জানতে পারলাম এবছর চুনী  কোটাল স্মৃতি পুরস্কার দেওয়া হবে আমাকে।

     ২৯ ডিসেম্বর দুপুরে আমি চন্দ্রিমা আর বৃষ্টি কলকাতা রওনা দিলাম। কফি  হাউসের ‘বইচিত্র’ হলে অনুষ্ঠান হল। মেদিনীপুর থেকে বিবেকানন্দ ভট্টাচার্য গেছলেন, নিলীনি বেরা, রেহান কৌশিক, বেবি সাউ, মনোরঞ্জন ব্যপারি ও আরও অনেকে ছিলেন। বেবি সাউ, মনোরঞ্জন ব্যাপারি ও আমি চুনি কোটাল স্মৃতি পুরস্কার পেলাম। দোতলায় কফি হাউসের দরজার সামনে হঠাৎ করে সাংবাদিক ও কবি সাকিল আহামেদের সঙ্গে দেখা। উৎফুল্ল হয়ে কফি খাওয়াতে চেয়েছিল, আমার হাতে সময় ছিল না। অনেক ছবি তুলল। পরদিন সোশাল মিডিয়ায় পোস্টও করেছিল।  

   আজ ২০১৮ সালের শেষ দিন। যথারীতি এবারেও পিঠে মেলায় বিচারক ছিলাম। এবার খড়গপুর আই আই টির একজন অধ্যাপক আমার টেবিলে ছিলেন।  গতবছরের দম্পতিকে এবার বাদ দেওয়া হয়েছে। শিক্ষিত ভদ্রলোক, বোঝেন না এটা প্রতিযোগিতা! এক টেবিলে দুজনে বসেছেন, স্ত্রীর হয়ে তিনি নিজের ও স্ত্রীর  মার্কশিটে নাম্বার লিখছেন। এটা ঠিক নয়, তাই ওনাদের এবার ডাকা হয় নি।
🍂

    সময় আজ ২০১৯ এ পা রাখল। মাঝরাত থেকেই শুভেচ্ছাবার্তা আসতে শুরু করেছে। আমার ভাল না লাগতে পারে, মনখারাপ হতে পারে। তাই বলে অন্যের আনন্দ নষ্ট করতে পারি না। তাই সব ব্যথা বুকে লুকিয়ে রাখি। এটা আমার  কাছে একটা অভিশপ্ত মাস, সেসব কথা মনে করতে চাইনা। তবুও সারাক্ষণ মনে পড়ে। সব উৎসবের দিনগুলো আর পাঁচটা দিনের মত সাধারণ ভাবেই কাটে। এবার রানী সুহানা আছে, তাই ওদের জন্য পোলাও রান্না করেছি। বিকেলে চন্দ্রিমা কেক, মিষ্টি নিয়ে এসেছিল।

    রিটায়ার্ড ব্যাঙ্ক এমপ্লয়িদের পেনশনের ব্যপারে মিটিং ছিল, খান সাহেব যেতে  পারবেন না বলে আমি গেছলাম। শেষপর্যন্ত পেনশনটা হবে। আমাদের মত ফ্যামিলিগুলো বাঁচবে। এখানে অনেকের সঙ্গে দেখা হল, আলাপ হল। আমাকে মোটামুটি সবাই চেনেন। একটা ফর্ম দিয়েছে, সই করে দিলেই হবে, ওঁরা পূরণ করে নেবেন। আজ(৮জানুয়ারি)আর কাল বামফ্রন্ট ভারত বন্ধ ডেকেছে। এই বন্ধ ডেকে কার উপকার হয় জানিনা, দিন আনা খাওয়া মানুষগুলোর হয়রানি হয়,  কারো কারো হাড়ি চড়ে না। এখন বন্ধ ডাকলেই সফল হয়। ওদের সমর্থন করে নয়, ক্ষতির আশঙ্কায় দোকান বাজার খোলেনা কেউ। রাস্তায় প্রাইভেট বাস, গাড়ি বের হয় না। এর মধ্যেই মৃণালদা এসে পেনসনের ফর্ম পূরণ করে বলে গেলেন, বৃহস্পতি বার জমা দিতে হবে।

      আজ ডায়ালিসিস ছিল। ওনার পাওয়ার চেক করে চশমা করে দিলাম। দিন দিন উনি কর্ম ক্ষমতা হারাচ্ছেন, ব্রেন ঠিক কাজ করছে না। ভুলে যাচ্ছেন, ভুল বুঝছেন। কিন্তু কিছু করার নেই, আমাকে সহ্য করতেই হবে। কানে ঠিকমত শুনতে পাচ্ছেন না বলে, বেশি সমস্যা হচ্ছে। জোরে কথা বললে রেগে যাচ্ছেন। বৃহস্পতিবার ব্যাঙ্কে ফর্ম জমা দিয়ে এলাম, মৃণালদা ও তন্ময়দা খুব হেল্প করলেন।

     ওনার শরীরটা খুবই খারাপ, একদমই হাঁটতে পারছেন না। ভুল বকছেন। ডাক্তারকে ফোন করে জানালাম, পরশু শুক্রবার ওনাকে নিয়ে যাব। অপেক্ষা করা যাবে না। আজ সারাদিন খুব পরিশ্রম হল। সকালে বাজার করতে গিয়ে স্কুটির সঙ্গে জোর ধাক্কা খেতে গিয়ে বেঁচেছি। রান্না করে ওনাকে খাইয়ে নন্দিনীর অফিসে গেছলাম ইন্টারভিউ নিতে. ২টো ৩০শে সিপাইবাজার থেকে টোটো নিয়ে এসে ওনাকে নার্সিংহোম নিয়ে গেলাম। ডায়ালিসিস শেষ হল ৭ টায়। সাড়ে সাতটায়  বাড়ি ফিরে রান্না বসিয়ে কলকাতা যাওয়ার জন্য সবকিছু ব্যগে ভরলাম। জানিনা রিপোর্ট কী হবে? ডাক্তার কী বলবেন?
ওনাকে নিয়ে ১২টার সময় ডাক্তারের ক্লিনিকে পৌঁছালাম। ডাক্তার দেখে বললেন, নার্ভের সমস্যা। নিউরোলজিস্টকে দেখান। শুনে ভাবলাম আজকে দেখাতে পারলে ভাল হয়। বাড়ি নিয়ে গিয়ে আবার নিয়ে আসা অসম্ভব ব্যপার। অ্যাপলোতে আমি নিউরোলজিস্ট অমিতাভ ঘোষের চিকিৎসায় আছি অনেকদিন। ওনার কাছে  ফোনে অ্যাপয়েন্টমেন্ট করতে হয়। তবুও ওনার অ্যাসিসটেন্ট গীতাদিকে ফোন করলাম, প্রথমে না না করলেও, বুঝিয়ে বলতে রাজি হলেন। বললেন, ৪টের মধ্যে নিয়ে আসুন। আমরা আড়াইটাই পৌঁছাতেই গীতাদি বললেন, বসুন এখুনি দেখানো  হয়ে যাবে। অমিতাভবাবু ওনাকে দেখে বললেন MRI করতে হবে, তার আগে সিটিস্ক্যান করান, ওতে কিছু ধরা না পড়লে MRI করাতে হবে।

      হুইল চেয়ারে বসিয়ে নিয়ে ওপর নিচ করছি। আজ MRI হবেনা। সিটিস্ক্যান করিয়েছি, রিপোর্ট আজ পাওয়া যাবেনা। তাই প্লেটদুটো নিয়ে গিয়ে ডাক্তারকে দেখালাম, কিচ্ছু ধরা পড়েনি। অতএব এম আর আই করাতেই হবে। বাড়ি ফিরে ঠিক করলাম, কালই স্পন্দনে এম আর আই করিয়ে নেব। রিপোর্ট  কলকাতা নিয়ে গিয়ে দেখাতে হবে। কী ধরা পড়ে কে জানে? এম আর আই করাতে টেকনিশিয়ান বললেন, খারাপ কিছু দেখছি না। ই জি জি রিপোর্টও তাই। আজ একা একা হাঁটতে পারছে। কিন্তু আগামিকাল কেমন থাকবেন,বলা মুশকিল।                                         

                          ক্রমশ

Post a Comment

0 Comments