দূরদেশের লোকগল্প—গুয়াতেমালা (উত্তর আমেরিকা)
বেড়ালের বিচারধারা
চিন্ময় দাশ
কুঠার নিয়ে শিকারে বেরিয়েছে একটা লোক। দুপুর হয়ে এলো যখন, শরীর ভারি। সামনে বড় বড় ঘাসের ঘন বন। এগিয়ে লাভ নাই।
শিকারী ভাবলো, একটু জিরিয়ে নেওয়া যাক। একটা গাছের তলায় বসতেই, খিদেটা চাগাড় দিয়ে উঠলো। শিকারের থলে থেকে একটা খরগোশ বের করে, ঝলসে নিতে লাগলো লোকটা।
এমনিতে খিদে পেটে সব খাবারই সুস্বাদু মনে হয়। খরগোশের মাংস তো ভালো লাগবেই। মনের আনন্দে খাচ্ছে লোকটা। হঠাতই দেখলো, ঘাসের ভিতর থেকে দুটো ড্যাবডেবে চোখে কেউ চেয়ে আছে তার দিকে।
ধারালো ছুরিটা হাতে তুলে নিয়ে, শিকারী চেঁচিয়ে উঠলো--কেরে, ওখানে?
একটা বুনো বেড়াল বেরিয়ে এলো ঝোপ থেকে—পেটে কিছুই পড়েনি সেই সকাল থেকে। এক্টু খাবার দেবে আমাকে?
একটা বেড়ালের তো পেট! কতোটুকু আর খাবে? খানিকটা মাংস তাকে দিলো লোকটা। চেটেপুটে খেয়ে, আগুনের পাশে একটু গড়িয়েও নিলো বেড়াল।
যাওয়ার সময় বেড়াল বললো—তুমি বাপু ভারি ভালোমানুষ। নইলে, ঝলসানো মাংস জোটে বেড়ালের কপালে? আসি, বন্ধু! বলা যায় না, কখনও হয়তো তোমার কোন উপকারে আসতে পারি। দরকারে পড়লে, ডাকতে পারো আমাকে।
লম্বা একটা কুর্ণিশ ঠুকে বেড়াল চলে গেল।
দিন কয়েক বাদে। আবার সেই গাছটার তলায় এসেছে শিকারী। ঘাস জঙ্গলের মুখেই বড়সড় একটা কুমীর। লোকটা বলল—আরে, তুমি এখানে কেন? তোমার তো জলে থাকবার কথা।
কুমীর তার গল্প শোনাতে শুরু করে দিল। গতরাতে ডাঙ্গায় উঠেছিল। এদিক ওদিক ঘোরাঘুরি করে, পথ হারিয়ে ফেলেছে। এখন আর নদীতে ফিরতে পারছে না।
--কষ্ট করে আমাকে একটু নদীতে পৌঁছে দেবে তুমি? তবে, তার বদলে পাঁচ ঝুড়ি মাছ দেবো আমি তোমাকে।
এ হতভাগা তো দেখছি আস্ত গবেট একটা। বোকার বেহদ্দ! নিগার নদীটা তো এই ঘাসের পেছনেই। সরু একফালি মাঠ। তাতেই রাস্তা গুলিয়ে গেল!
শিকারী লোকটা ভালোমানুষ। ভাবল, পৌঁছেই দিয়ে আসি কুমীরটাকে। তবে, একটু সন্দেহও হোল মনে। নদীর পাড়ে গিয়ে, আমাকেই গিলে খাবে না তো?
যাইহোক, কুমীরের পিছনের একটা পায়ে দড়ি বেঁধে, তাকে নিয়ে নদীতে গিয়ে হাজির হোল শিকারী। জলে নেমে, কুমীর বলল—ভারি ভালো মানুষ গো তুমি। একটু দাঁড়াও। মাছ নিয়ে আসি তোমার।
পাড়ের উপর দাঁড়িয়ে রইল শিকারী। প্রথম বার বিশাল একটা মাছ নিয়ে হাজির হোল কুমীর। পরের বারের মাছগুলো একটু ছোট বটে, দেখে বেশ পছন্দ হোল শিকারীর। কুমীর এবার মাছগুলো নিয়ে ওপরে ওঠেনি। ডাঙ্গায় একটু ওপরে তুলে দিয়ে চলে গেল। তৃতীয় বারে মাছ আনলো অনেক। বলল—বেদম ভারি, আমি আর পারছি না। একটু হাত লাগাও তুমি। জলের একেবারে কিনারে নামিয়ে দিল বোঝাটা।
শিকারী পাড়ের উপরে নিয়ে গেল মাছগুলোকে। পরের বোঝাটা নামালো হাঁটুখানিক জলে। বলল—আর পারছি না গো। একটু কষ্ট করে তুলে নাও ওপরে।
শেষ বারে কোমর জলে থেমে গিয়ে কুমীর বলল—আর পারছি না, বন্ধু। হাত লাগাতেই হবে তোমাকে।
সরল মনে জলে নেমে পড়ল শিকারী। অমনি একটা ঝাপটা। কপাক করে শিকারীর একটা পা কামড়ে ধরল ধূর্ত কুমীরটা। ভয়ানক চমকে গেল শিকারী। ভয়ও পেল খুব।
কুমীর টানতে টানতে মাঝ নদীতে এনে হাজির করল শিকারীকে। অন্য কুমীরদের হাঁক পেড়ে বলল—আজ মানুষ পেয়েছি শিকারে। চলে এসো সবাই।
দেখতে না দেখতে এক ঝাঁক কুমীর এসে ঘিরে ধরল মানুষটাকে। শিকারী চেঁচিয়ে বলল—তোমাদের বন্ধুকে বাঁচিয়েছি আমি। পথ দেখিয়ে এনেছি তাকে নদীতে? তার এই ব্যবহার কি সঠিক?
--রাখো তোমার সঠিক বেঠিক বিচার। আগে ভোজ খাওয়া যাক। মাছ খেয়ে খেয়ে মুখ ধরে গেছে আমাদের। সব কুমীরেরই এক রা।
সেসময়ই একটা ছেঁড়া চাঁটাই ভেসে যাচ্ছিল নদীর জলে। শিকারী তাকে দাঁড় করিয়ে সব কথা খুলে, বলে জানতে চাইল—কাজটা কি কুমীরের ঠিক হচ্ছে।
চাঁটাই বলল—হচ্ছে না, সেটা বলি কী করে? আমার দশাই দেখো না। যখন নতুন ছিলাম, ইচ্ছা মত ব্যবহার করেছে আমার মালিক। পুরাতন হতেই, দূর-ছাই করে ছুঁড়ে ফেলে দিল। তোমার মত মানুষরাই করেছে কাজটা।
চাঁটাইটা চলে গেল ভাসতে ভাসতে। একটু পরেই এলো একটা ফুটোফাটা কোট। তাকে দাঁড় করিয়ে সব কথা খুলে বলল শিকারী। দুঃখের ব্যাপার, একই কথাই বলে গেল কোটটাও।
কুমীর বলল—এবার হোল তো? নিজের কানেই শুনলে, মানুষের সাথে সুবিচার করবার কোন দরকারই নাই।
এবার একটা বুড়ো ঘোড়া এল নদীতে জল খেতে। শিকারী তাকে ডেকে সব কথা বলল। ঘোড়া তো হেসেই বাঁচে না। মানুষ হয়ে সুবিচার আশা করছ কোন মুখে? সারা জীবন গায়ের ঘাম ঝরিয়ে সেবা করেছি মানুষের। বুড়ো হতেই দূর-দুর করে তাড়িয়ে দিয়েছে। মানুষের কথা আর বোল না।
পেট ভরে জল খেয়ে, চলে গেল ঘোড়াটা।
ঘোড়াটা যেতে না যেতে, যে এলো, তাকে দেখে, মনে ভারি আশা জাগলো শিকারীর। এটা সেই বুনো বেড়াল।
খুব আশা নিয়ে শিকারী তাকে বলল—একটা বিচার করে দেবে আমার?
বিড়াল চিনতে পেরেছে, এই সেই লোক। যে তাকে মাংসের ভাগ দিয়েছিল ক’দিন আগে। খুব বড় বিপদে পড়েছে আজ, বুঝতে অসুবিধা হোল না।
কিন্তু মুখে কিছু বলল না। জানতে চাইল—হয়েছে কী, সেটা তো আগে শুনি। বিচার তো পরের কথা।
শিকারী আবার সব কথা খুলে বলল তাকে। বেড়াল গম্ভীর হয়ে বলল—বিচার আমি করি। বনজঙ্গলে বিচারক হিসাবে নামও আছে আমার। কিন্তু ...
শিকারী বলল—তাহলে করে দাও বিচারটা। এর আবার কিন্তু কিসের?
কিন্তু হোল, তুমি তো আর বনের জীব নয়। তুমি হলে একজন মানুষ। তোমাদের ধরণ-ধারণই আলাদা। আমি বা এই কুমীররা, আমরা জল-জঙ্গলের জীব। আমাদের বিচারের ধারা আলাদা। কিগো, কুমীর ভায়ারা, ঠিক বলছি তো?
সবাই হাঁ-হাঁ করে উঠল—একদম ঠিক বলেছ। আলাদা ধারার বিচার আমাদের।
আসলে তাদের আর দেরি সইছে না। তখন থেকে জলজ্যান্ত একটা মানুষ একেবারে ঘেরাটোপের মধ্যে। কিন্তু একটা কামড়ও বসানো হয়নি। বিচার পর্বটা তাড়াতাড়ি শেষ হয়ে যাক, এটাই সবার চাহিদা।
বেড়াল বলল—কানে শুনে বিচার করি না আমি। নিজের চোখে পুরোটা দেখব। তবে না সিদ্ধান্ত। দুজনে এসো আমার সাথে। চটপট গোড়া থেকে দেখিয়ে দাও পুরো ঘটনাটা।
শিকারী আর কুমীরকে নিয়ে নদীর পাড়ে উঠে এলো বেড়াল। শিকারীকে জিজ্ঞেস করল—ঘাসের বনে পথ হারিয়ে বসেছিল কুমীর। তা, তুমি তাকে এখানে পথ দেখিয়ে আনলে কী করে?
একটা পায়ে দড়ি বেঁধে এনেছিলাম। যাতে ঘাসের ঝোপে হারিয়ে না যায়।
--কীভাবে বেঁধেছিলে, ঠিকঠাক দেখাও দেখি আমাকে।
শিকারী আবার কুমীরের পায়ে দড়ি বাঁধল শক্ত করে। ঘাসের জঙ্গল দিয়ে নিয়ে চলল তাকে, যেখানে প্রথম দেখেছিল।
বেড়াল জানতে চাইল—ঠিক এভাবেই হয়েছিল ব্যাপারটা?
কুমীর বলল—একেবারেই ঠিক।
বেড়াল বলল—তাহলে তো মিটেই গেল গো। সে তোমাকে টেনে নিয়ে গিয়েছিল। তুমিও তাকে টেনে মাঝ নদীতে নিয়ে গিয়েছিলে। চুকে বুকে গেল সব। দোষটা কী করেছে?
লেজের প্রকাণ্ড একটা ঝাপটা মারল কুমির। ঘাসের জঙ্গল লণ্ডভণ্ড হয়ে গেল সে আঘাতে। চিৎকার করে উঠল কুমীর—এটা কেমন বিচার হোল?
কুমীরের মাথা খারাপের জোগাড়। মুখের গ্রাস চলে যাচ্ছে তার। রেগে কাঁই হয়ে গেছে সে।
বেড়ালের ভারি রাগ হোল দেখে। মানুষটাকে বোকা বানাবার জন্য পাঁচ বার মাছ দেবার নাম করে জলে নামিয়েছিল হতভাগা। এবার একটা ফন্দি এল তার মাথায়।
🍂বিড়াল বলল—তোমার যদি আরও কিছু বলবার থাকে, বলতে পারো। তবে, চলো ঐ গাছটার তলায় বসি গিয়ে। ঠাণ্ডা মাথায় সব শোনা যাবে।
একটা গাছের তলায় পৌঁছে, বেড়াল শিকারীকে বলল—দড়িটা ধরে থেকে লাভ নাই। এই গাছের ডালটায় বাঁধো ওপর দিকে তুলে।
শিকারী মোটেই দেরি করল না। ঝটপট বেঁধে ফেলল দড়িটা। কুমীরের পেছনের পা থেকে সোজা উপরে উঠে রইল দড়ি। যাতে কোনমতেই কুমীরের চোয়াল নাগাল না পায়। কেটে পালিয়ে যেতে না পারে।
বেড়াল শিকারীকে বলল—বিচার শেষ। চলো, এবার সরে পড়া যাক এখান থেকে।
কুমীর আঁতকে উঠে বলল—চলে যাবে মানে?
বেড়ালের গলায় হাসি—ভেবো না। আবার যখন এদিকে আসব, দেখা করে যাব তোমার সাথে।
শিকারী লোকটা আদতে ভারি ভালো মানুষ। সে একটু কিন্তু-কিন্তু করতে লাগল। ভালোই বুঝতে পেরেছে, এখানে শুকিয়ে শুকিয়ে মরবে কুমীরটা। অন্য কোনও গতি নাই তার।
বেড়াল বলল—ভালো মানুষি ভালো জিনিষ। কিন্তু যে যেমন ব্যবহার করবে, তার সাথে ঠিক তেমনটা করাই আরও ভালো। সব কথা আমি বুঝিয়ে বলব তোমাকে। এখন চলো এখান থেকে।
শিকারীকে নিয়ে চলে গেল বেড়াল।
1 Comments
গল্পটা সুন্দর কিন্তু এই গ্রুপের নিয়ম হচ্ছে সরাসরি পোস্ট করা। কোন শেয়ার তা লিঙ্ক গ্রহণ যোগ্য নয়।
ReplyDelete