জ্বলদর্চি

দূর দেশের লোকগল্প—এশিয়া (জাপান) /কণের মাথায় কাঠের টোপর /চিন্ময় দাশ

দূরদেশের লোকগল্প—এশিয়া (জাপান) 
কণের মাথায় কাঠের টোপর
চিন্ময় দাশ


অনেক অনেক দিন আগের কথা। বউ আর মেয়েকে নিয়ে, জাপানের এক গ্রামে বাস করত একটা লোক। ভালোভাবেই দিন কেটে যেত তাদের। কিন্তু চিরকাল তো আর সবার সমান যায় না। পায়ে পায়ে লোকটার দুঃসময় ঘনিয়ে এল এক দিন। ছোট্ট মেয়েটি ছাড়া আর কিছুই রইল না তাদের। 
ফুটফুটে বাচ্চা। দেখতে শুনতেও মন্দ নয়। ভালো করে দিন চলে না এখন। পাড়াপড়শিরাই এখন সাহায্য করে তাদের, যে যতটা পারে। 
কিন্তু এভাবে অন্যের দয়ার দানে আর কতো দিন চালানো যায়? না কি, চলতে দেওয়া যায়? একদিন বউ আর মেয়েকে নিয়ে, গ্রাম ছেড়ে চলেই গেল লোকটা।
বেশ বড়মতন একটা গঞ্জ এলাকায় থাকতে লাগলো তারা। সারা দিন ঘরকন্নার কাজ, বাগান করা এসব নিয়ে সময় কেটে যায় মা আর মেয়ের। লোকটার কিছুই ভালো লাগে না। উদাস দুটো চোখ মেলে বসে থাকে সারা দিন। পুরাণো দিনগুলোর কথা ভেসে বেড়াতে থাকে চোখের সামনে। এইভাবে বসে থাকতে থাকতে, একদিন মরেই গেল লোকটা।
কাঁদতে কাঁদতে দিন গেল মা মেয়ের। মাসের পর মাসও গেল দেখতে দেখতে। কোন কাজেই যেন মন বসে বা তাদের। একদিন হঠাৎই মেয়েটার দিকে চোখ গেল মায়ের। যেন এই প্রথম দেখছে নিজের মেয়েকে। যেন নতুন করে দেখছে তাকে। কী সুন্দরটাই না হয়ে উঠেছে মেয়েটা। এমন অপরূপ সুন্দরী তো চোখে পড়ে না বড় একটা! এতো সুন্দরটি হয়েছে তাদের মেয়ে! 
আনন্দে মন ভরে যাওয়ার কথা মায়ের। তা কিন্তু হোলই না। ভয়ে কেঁপে উঠল মায়ের মন। এই এতবড় দুনিয়ায় তারা দুজন ছাড়া, তৃতীয় কেউ নাই তাদের। আপদে বিপদে কে এসে দাঁড়াবে তাদের পাশে? 
একজন সতর্ক মায়ের যা কাজ, তাই শুরু হোল এবার। দুনিয়ার কোনটা ভালো কোনটা মন্দ, কোনটা উচিত আর কোনটা উচিত নয়—এসব নানা বিষয়ে নানা কথা পাখি পড়া করে বোঝাতে লাগল মেয়েকে। সারাদিন হাজারো কাজে ব্যস্ত রাখে মেয়েটাকে। যাতে অন্য কোন দিকে মন না দিতে পারে। উল্টো-পাল্টা ভাবনা এসে মাথায় বাসা না বাঁধে। মেয়েটিও তাদের ভারি লক্ষ্মী। মন দিয়ে সব শোনে। মেনেও চলে মায়ের কথাগুলো।
এইভাবে কয়েকটা বছরও কেটে গেল। মেয়েটা আরও সুন্দরী হয়ে উঠেছে। চোখ ফিরিয়ে নেওয়া যায় না তার থেকে, এতটাই সুন্দরী। হঠাৎই একদিন বেদম ঠাণ্ডা লেগে, মা পড়ল বিছানায়। সেই যে পড়ল, আর উঠল না।
যেদিন মা বুঝল, তার আর সেরে উঠবার উপায় নাই, মেয়েকে ডেকে বলল-- আমার দিন তো ফুরিয়ে এলো, মা। এই এতবড় দুনিয়ায় আপন বলতে কেউ রইল না তোর। সাবধানে থাকিস। নিজের যত্ন নিস। মনে রাখিস, সুন্দরী মেয়েদের পায়ে পায়ে বিপদ ঘোরে। একটু বেখেয়াল হলেই, সর্বনাশ!
--আমি সাবধানেই থাকব, মা তুমি চিন্তা কোর না। বরং তাড়াতাড়ি সেরে ওঠো তুমি। 
মেয়ের কথা শুনল মা। কিন্তু তাতে কী আর মায়ের মন মানে? ঘর থেকে একটা কাঠের হেলমেট বের করে আনল মা। মেয়ের মাথায় পরিয়ে দিল সেটা। দুটো কান ঢাকা পড়ে গেল হেলমেটের তলায়। পিছনের দিকে তো একেবারে কাঁধ ছুঁই-ছুঁই। আর সামনে? ভুরু দুটোও আড়াল হয়ে গেছে হেলমেটের নীচে। এই হেলমেট মাথায় থাকলে, অতি ভীড়ের ভিতর দিয়ে অনায়াসেই চলে যেতে পারবে সে। কেউ ফিরেও তাকাতে যাবে না। 
হাত বুলিয়ে বুলিয়ে জিনিষটা পরখ করতে লাগল মেয়েটা। মা বলল—কোন দিন খুলবি না এটাকে। কারও কথাতেই না। তাতে অনেক বিপদ এড়িয়ে থাকতে পারবি। বলেই মা মারা গেল।
মেয়েটা বলল—তোমার কথা মনে থাকবে মা। কোনদিন আমি খুলব না এটাকে মাথা থেকে।
কাঁদতে কাঁদতে দিন চলে যায় মেয়ের। কিন্তু এমন একলাটি একটা মেয়ে থাকবে কী করে। পেটেই বা দেবে কী? যা দু-চারটে কাপড়-চোপড় ছিল, পুঁটলি বেঁধে নিয়ে, একদিন মেয়েটা বেরিয়ে পড়ল ঘর ছেড়ে। বন পেরিয়ে, পাহাড় ডিঙিয়ে, কত সময় বাদে একটা গ্রামে এসে থামল মেয়েটা। 
গ্রামের মোড়লের জমিজমা খেতখামার অনেক। সে বাড়িতে কাজ জুটে গেলে মেয়েটার। সেই কোন সকালে বেরিয়ে যায়। সূর্য ডুবে যায় কাজ সেরে ফিরতে। তারপর বিছানায় পড়লেই ঘুম নেমে আসে দু’চোখে। এদিকে মাকে কথা দিয়েছিল, কাঠের হেলমেট খুলবে না মাথা থেকে। সে কথা ভোলেনি মেয়েটা। রোদের তাত যতই হোক না কেন, মাথা আলগা করে না কোন মতেই। গোটা গ্রামের লোকজন জেনে গেছে ব্যাপারটা। একটা নামকরণও করে ফেলেছে তারা—রানির মাথায় কাঠের মুকুট।
যতই কাঠের টুপি পরে থাকুক, যতই আড়াল করে রাখার চেষ্টা করুক নিজেকে, গোটা গ্রাম জেনে গেছে, মেয়েটা কতো সুন্দরী। এমন সুন্দরী গোটা গ্রামে কেউ নাই। আশপাশের কোন গ্রামে নাই। এমনকি সারা জাপানেও কেউ নাই বোধকরি। 
ভিড় হচ্ছে। খুব ভীড় হচ্ছে ছেলেদের। মোড়লের বাড়িতে এলাকার যত উঠতি ছেলেরা এসে হাজির হচ্ছে। সবাই বিয়ে করতে চায় মেয়েটাকে। মেয়েটা যখন খেতে কাজ করতে যায়, সেখানেও হাজির হয় কেউ কেউ। তাকে জ্বালাতন করে। কাঠের টুপি খুলে দিতে চায় তার। টুপির আড়ালের রূপ দেখতে চায় ভালো করে। কতোটা সুন্দরী এই মেয়ে! 
কাউকে পাত্তা দেয় না মেয়েটা। রাগও করে না কারও ওপর। সে শুধু মাকে দেওয়া কথাটা মেনে চলতে চেষ্টা করে মাত্র। নিজেকে আড়াল করে রাখে সবার থেকে।
একটাই কাজ তার। সারাদিন খেতে কাজ করে সময় কাটানো। সেই সকালে উঠে কাজে যায়। ফেরে সেই সূর্য ডোবার পর। শুধু কাজই করে সে। মাইনে পত্তর বলে কিছু নাই। দু’বেলা পেট ভরে দুটো খেতে পায় কেবল। আসলে, বেতনের কিছু দরকারই নাই এ মেয়ের। খেয়ে পরে বেঁচে থাকতে পারছে, এ-ই তার কাছে অনেক। মোড়লের বাড়ি বলে, বেশ নিশ্চিন্তে থাকতে পারা যাচ্ছে, কম কথা নয়।
একদিন মোড়ল বাজারে যাচ্ছিল। খেতের পাশ দিয়েই রাস্তা। তার চোখ গেল, কী যত্নে কাজ করছে মেয়েটা। একটু সময় দাঁড়িয়ে দেখল খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে। 
সেদিন সন্ধ্যায় মেয়েটা কাজ থেকে ফিরে এলে, তাকে ডেকে পাঠাল মোড়ল। দু’একটা প্রশ্ন করে জেনে নিল তার বাড়ির কথা। মোড়ল বলল—তুমি হয়তো জানো না, এ বাড়ির গিন্নিমা, মানে আমার স্ত্রীর, শরীর ভালো না। কাল থেকে তুমি গিন্নিমার দেখভাল করবে। খেতে কাজ করতে যেতে হবে না আর। 
মেয়েটা বেশ খুশি। পরিশ্রম তো কমলই। ছেলেছোকরাদের উৎপাত থেকেও বাঁচা গেল। কিন্তু মানুষ যা ভাবে, সব কি আর ঘটে ঠিকঠাক? 
সবে দিন কয়েক গিন্নিমার কাজে লেগেছে মেয়েটা। মোড়লের ছেলে ফিরল শহর থেকে। কিয়োটো শহরে থেকে পড়াশুনো করত এতদিন। সেসব শেষ করে, এবার বাড়ি ফিরেছে ছেলেটি। 
ঘরে ফিরেই মাকে জানতে চাইল—মেয়েটি কে মা? কোথা থেকে এলো এখানে? সব সময় এমন একটা বিদ্ঘুটে কাঠের টুপি মাথায় চাপিয়ে রাখে কেন?
--আর বলিস না, বাবা। ভারি জেদি মেয়ে। কারও কথায় কান দেয় না। টুপি সে খুলবে না কোন মতেই। হাসিহাসি মুখ করে, চুপচাপ মায়ের কথা শুনল ছেলেটি। মনের কথা কিছু খুলে বলল না। 
একদিন ঝরণায় জল আনতে গিয়েছে মেয়েটি। কাঠের হেলমেট খুলে পাশে রেখেছে। আঁজলা ভরে জল তুলে চোখে মুখে ছিটাচ্ছে। ভারি ঠান্ডা জল। সারা শরীর জুড়িয়ে যাচ্ছে তাতে। 
জ্বলদর্চি অ্যাপ ডাউনলোড করে নিন।👇
কতো দিন বাদে শহর থেকে বাড়ি ফিরেছে ছেলেটি। শহরে ইটকাঠের জঙ্গল। এখানে সবুজ মাঠ, সবুজ বন। চারদিকে সবুজ আর সবুজ। বেড়াতে বেরিয়েছিল সে। ঝরণায় মেয়েটিকে দেখতে পেয়ে গেল ছেলে। বিদ্ঘুটে টুপিটা নাই এখন মাথায়। চোখ ভরে দেখবার মত রূপ! এতো দিন শহরে থেকেছে। এমন একজনকেও চোখে দেখেনি সেখানে।
সাথে সাথেই সে ছেলের মনে হোল, একে ছাড়া আর কাউকেই বিয়ে করবে না সে। কিন্তু বাড়ির লোকজন রাজি হবে কেন? মোড়লের ছেলে বলে কথা! তার বিয়ে হবে কি না একজন কাজের মেয়ের সাথে। মা-বাবার পরিচয়টুকুও জানা নাই যে মেয়ের! 
মোড়লের বউ মেয়েটার নামে নানারকম উল্টো-পাল্টা কথা বানিয়ে বানিয়ে শোনাতে লাগল ছেলেকে। কিন্তু ছেলে শোনবার পাত্র নয়। সে জেদ ধরে বসে রইল-- এই মেয়ে ছাড়া আর কাউকেই বিয়ে করব না আমি। 
এদিকে মেয়েটাও পড়ে গেছে দুশ্চিন্তায়। এত বড়লোকের বাড়িতে বিয়ে! দোনামনা করতে লাগল সে। একদিন রাতে মাকে স্বপ্ন দেখল সে। মা বলছে, ভাবনার কিছু নাই এতে। অনেক সুখে থাকবি এখানে। অভাবী মানুষ ছিল তোর বাবা-মা। আমরা তোকে যা দিতে পারিনি, সব পাবি এখানে। আপদ বিপদের কোন ভয়ই আর রইল না তোর। 
এদিকে মোড়লই বা কী আর করে? কত দিন রাগ করে থাকা যায়? এড়িয়েই বা থাকা যায় কতদিন? রাজি হতেই হোল।
বিয়ের তোড়জোড় শুরু হয়েছে। দামি দামি পোষাক-আসাক এসেছে। গয়নাপত্তর এসেছে কাঁড়ি কাঁড়ি। কিন্তু মেয়ের মাথা থেকে বিদ্ঘুটে কাঠের টুপি খোলানো যাচ্ছে না কিছুতেই।
সেদিন বিয়ে। দামি ঝলমলে পোশাক পরানো হয়েছে মেয়েকে। এবার মাথার চুলে চিরুণি দেওয়া দরকার। চাকরানির দল টুপিটা খুলতে গেল। এবার অবাক ব্যাপার! কিছুতেই খুলছে না সেই টুপি। যত জোর লাগায়, ততই যেন আরও চেপে বসে টুপিটা। যন্ত্রণায় চোখ দিয়ে জল গড়াতে লাগল মেয়ের।
কনের কান্না শুনে, বর দৌড়ে এল। গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে, মেয়েকে শান্ত করে, ঘোষণা করে দিল—বিয়ে যদি হয়, এই কাঠের টুপি পরেই বিয়ে হবে।
অগত্যা সেটাই বহাল হোল। বিয়ের অনুষ্ঠান শুরু হোল। ভীড়ে গিজগিজ করছে হলঘর। আনন্দ কোলাহলে ঘরটা গমগম করছে। সে দেশের নিয়ম—বিয়ের শুরুতেই একটা গ্লাশ থেকে জল খেতে হবে বর-কণে দুজনকে। প্রথমে কণে খেলো এক ঢোঁক জল। তখন গ্লাস দেওয়া হোল বরের হাতে। যেই বরের জল খাওয়া হয়েছে, অমনি এক কাণ্ড! জোর শব্দ করে টুকরো টুকরো হয়ে ভেঙে পড়ল কাঠের টুপিটা। আর, দানা দানা মণি মুক্তো ছড়িয়ে পড়ল মেঝেতে। অবাক কাণ্ড একেবারে!
ঘর ভর্তি লোকজন। তারা মণি-মুক্তো ছড়িয়ে পড়তে দেখে যত না অবাক হোল, তারও বেশি আশ্চর্য হয়ে গেলে মেয়েটির রূপ দেখে। এখন কোন আড়াল নাই মেয়ের মুখে। পূর্ণিমার চাঁদের মত ফুটে উঠ্রছে মুখখানি! এমন রূপ দেখেনি কেউ কোন দিন। শোনেনিও কোন দিন কারও মুখে। সারা জাপানেও যেন এতো সুন্দরী কোন মেয়ে নাই। রূপ যেন ফেটে পড়ছে সে মেয়ের!
নাচে-গানে খানা-পিনায় আনন্দে-কোলাহলে, কখন যে রাত কেটে গেল, খেয়াল থাকল না কারও। 
মোড়লের ছেলের সেই বিয়েবাড়ি, আজও মনে আছে জাপানীদের। সেই থেকে জাপানের কিছু কিছু মেয়ে অনেক সুন্দরী। জাপানীরা আজও বলে—সেদেশের সুন্দরী মেয়েরা হোল, কাঠের টোপর পরা সেই মেয়েরই বংশধর।

Post a Comment

0 Comments