জ্বলদর্চি

মেদিনীপুর জেলাশাসক 'বার্জ' হত্যা /সূর্যকান্ত মাহাতো

জঙ্গলমহলের জীবন ও প্রকৃতি
পর্ব - ৭৪

মেদিনীপুর জেলাশাসক 'বার্জ' হত্যা

সূর্যকান্ত মাহাতো


'এপ্রিল' মাসকে 'বেঙ্গল ভলেন্টিয়ার্স' এর সদস্যরা ম্যাজিস্ট্রেট নিধনের 'এনিভার্সারি ডে' রূপে উল্লেখ করেছিলেন।(শ্রী নিরঞ্জীব রায় কথিত, সূত্র: রক্তের অক্ষরে/ শৈলেশ দে, পৃষ্ঠা- ১৯৯) কারণ এই এপ্রিল মাসেই ঘটে গিয়েছিল পরপর কয়েকটা ঘটনা। ১৯৩০ এর এপ্রিলে চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুন্ঠন, ১৯৩১ সালের এপ্রিলে মেদিনীপুর জেলা শাসক পেডিকে নিধন, পরের বছরই আবার ১৯৩২ সালের এপ্রিলে জেলা শাসক ডগলাসকে নিধন করা হয়েছিল। তাই ১৯৩৩ এর এপ্রিল মাসকেও পরবর্তী জেলাশাসক 'বার্জ'কে হত্যার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছিল। এখানে একটু বলে রাখা দরকার ডগলাস হত্যার পরে পরেই কিন্তু বার্জ হত্যা একরকম নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিল। কারণ ডগলাস হত্যাকারী প্রদ্যোতের ফাঁসির সময় জেলাশাসক 'বার্জ' সেখানে যখন উপস্থিত ছিলেন। তিনি ফাঁসির পূর্বে প্রদ্যোতকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, সে প্রস্তুত কিনা। জবাবে প্রদ্যোত বলেছিলেন, "One minute please, Mr. Burdge, I want to say something. We are determined Mr. Burdge. British rulers will not remain in Midnapore, you are the next. Get ready." সেই সঙ্গে বলেছিলেন, "I am not afraid of death each drop of my blood will give birth to hundreds of Protita in homes of Bengal--- Now you do your work." (Durba Ghosh/ Gentlemanly terrorist political violence and the colonial state in India 1919-1947 Cambridge University press- 2017, page- 152)
প্রদ্যোতের সেই চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করেছিল ইংরেজরা। কারণ বাংলার গভর্নর 'জন এন্ডারসন' মেদিনীপুরে এসে বলেছিলেন, "মেদিনীপুরের নৈরাজ্যবাদী শক্তিধররা আমাদের সামনে একটা চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়েছে তারা একজন ব্রিটিশ ম্যাজিস্ট্রেটকেও জীবিত রাখবে না। সরকার সেই চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করেছে। শহরে সৈন্য মোতায়েন করা হয়েছে। এবং পরে মেদিনীপুরে কোন নৈরাজ্য সৃষ্টিকারী আন্দোলনকে মিলিটারি নামিয়ে কঠোরভাবে মোকাবিলা করা হবে। (জিলা মেদিনীপুর: স্বাধীনতার আন্দোলন/ কমল কুমার কুন্ড, পৃষ্ঠা- ১৯)
ওই সময়ে মেদিনীপুরের পরিস্থিতি কেমন ছিল?

পূর্ববঙ্গের 'চট্টগ্রাম' এবং আমাদের 'মেদিনীপুর' ব্রিটিশদের কাছে তখন এতটাই আতঙ্কের হয়ে উঠেছিল যে ১৯৩২ সালে দুটি বিশেষ আইন জারি করতে ব্রিটিশরা বাধ্য হয়েছিল। একটি হল, 'দ্য বেঙ্গল সাপ্রেশন অফ টেররিস্ট আউটরেজস অ্যাক্ট' এবং অন্যটি হল, 'দ্য এমার্জেন্সি পাওয়ারস অর্ডিন্যান্স' (বেঙ্গল ভলেন্টিয়ার্স/ মধুমন্তী সেনগুপ্ত, পৃষ্ঠা-২৩১) বাংলার মায়েরা যেমন করে বর্গীদের ভয় দেখিয়ে শিশুদের ঘুম পাড়াতেন, তেমনি ইংরেজ রমণীরাও 'এপ্রিল' মাসের ভয় দেখিয়ে শিশুদের ঘুম পাড়াতেন। ওই মাসটা ইংরেজদের কাছে ঠিক কতটা আতঙ্কের ছিল সেটাই তা প্রমাণ করে। মায়েরা বলতেন, baby sleep on April is coming(ভুপেন্দ্রকিশোর রক্ষিত রায় /সবার অলক্ষ্যে, দ্বিতীয় পর্ব, পৃষ্ঠা- ১০৯)

ত্রিশের দশকের ওই সময়কালটা এমনই ছিল যে মেদিনীপুরে যেকোন যুবককেই সন্দেহের চোখে দেখা হত। তৎকালীন ঘাটালের মহকুমা ম্যাজিস্ট্রেট 'রেবতীরমন দত্ত' জানিয়েছিলেন, 'যেকোনো যুবককে দেখলেই আঁতকে উঠতাম। অচেনা কোন কিশোর বা তরুন ধারে কাছে এলেই মনে হতো যেন বাঘ দেখছি।' (বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্স/ মধুমন্তি সেনগুপ্ত, পৃষ্ঠা- ২৩২) ঠিক এই কথাগুলো বিপ্লবী নিরঞ্জীব রায়ও বলেছেন। তিনি বলেছেন, 'তখনকার দিনে কোন তরুণের পক্ষে মেদিনীপুর যাওয়া বিপদের মুখে পা বাড়ানো।' (রক্তের অক্ষরে/ শৈলেশ দে, পৃষ্ঠা- ২১৩) কারণ পুরো শহরটা নাকি আই. বি. পুলিশের নজরে ছিল। ইংরেজরা কতটা ভয় পেলে একটা শহরকে সৈন্য দিয়ে মুড়ে ফেলতে পারে এটাই তার প্রমাণ।
জ্বলদর্চি অ্যাপ ডাউনলোড করে নিন।👇
বার্জকে যে হত্যা করা হবে তা তো পূর্বনির্ধারিত ছিলই। এবার সিদ্ধান্ত নেয়ার পালা ছিল কারা সেই গুরু দায়িত্ব পালন করবে। প্রথমে নির্বাচিত করা হয়েছিল মৃগেন দত্ত ও ব্রজকিশোর চক্রবর্তীকে। কিন্তু অনাথ পাঁজা ব্যক্তিগতভাবে ব্রজকিশোরকে অনুরোধ করে বলেন যে, তৃতীয় এনিভার্সারির জন্য তাকে সুযোগ দেওয়া হোক। (রক্তের অক্ষরে/ শৈলেস দে, পৃষ্ঠা- ২২১) তাই ব্রজকিশোর নিজে সরে গিয়ে অনাথকে সেই সুযোগ করে দিয়েছিলেন।

বি.ভি.-র সদস্যরা বার্জকে হত্যা করার জন্য এপ্রিল মাসকেই প্রথমে বেছে নিয়েছিলেন। কিন্তু ওই মাসে কোন রকম সুযোগ তারা পাননি। এরপর একাধিক সুযোগের অপেক্ষায় তারা দিন গুণতে লাগলেন। কিন্তু সেরকম কোন সুযোগ তারা পাচ্ছিলেন না। কর্মীরাও একরকম হতাশ হতে শুরু করেছিলেন। অবশেষে এলো সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। ১৯৩৩ সালের ২রা সেপ্টেম্বর। বার্জ সাহেব ছিলেন খুবই ক্রীড়া প্রেমী মানুষ। কলকাতায় ক্রিকেট খেলে তার সুনামও হয়েছিল। মেদিনীপুরে এসে দেখেন এখানে খেলাধুলার সেরকম কোনো সুযোগ নেই। তাই তিনি ভাবলেন, তরুণদেরকে খেলায় উৎসাহিত ও আকৃষ্ট করতে পারলে হয়তো তারা বিপ্লব থেকে সরে আসতে পারে।(বেঙ্গল ভলেন্টিয়ার্স/ মধুমন্তী সেনগুপ্ত, পৃষ্ঠা- ২৩৬) তাই খেলার বয়স পেরিয়ে গেলেও ফুটবল খেলা তিনি আবার শুরু করেছিলেন। সেইসঙ্গে অন্যদেরকেও উৎসাহিত করতে শুরু করেছিলেন।

২রা সেপ্টেম্বর পুলিশ গ্রাউন্ডে একটি ফুটবল ম্যাচের আয়োজন করা হয়েছিল। দুই প্রতিপক্ষ দল ছিল, 'টাউন ক্লাব' ও 'মহামেডান স্পোর্টিং'। সেই মাঠে মহামেডানের কালো জার্সি পড়ে ঢুকে পড়েছিল দুই বিপ্লবী অনাথ পাঁজা ও মৃগেন দত্ত। মিস্টার বার্জ গাড়ি থেকে নেমে এগিয়ে আসতেই মাত্র পাঁচ হাত দূর থেকে তাদের দুটি বন্দুক গর্জে উঠেছিল। শুধু গুলি করেই ক্ষান্ত হননি অনাথ পাঁজা। 'সবার অলক্ষ্যে' গ্রন্থের দ্বিতীয় পর্বে উল্লিখিত সেই বর্ণনাকে মধুমন্তী সেনগুপ্ত এইভাবে বর্ণনা করেছেন, 'বার্জের দেহ মাটিতে লুটিয়ে পড়তেই অনাথ দুর্বার গতিতে বার্জের বুকের উপর লাফিয়ে পড়ল। রিভলবারের সব কটি গুলি নিঃশেষ করেও যেন তার শান্তি নেই। অনাথ বার্জকে বজ্র আঁটুনিতে জড়িয়ে ধরেছে যেন কোন মতে শিকারটি হাতছাড়া না হয়।' (বেঙ্গল ভলেন্টিয়ার্স/মধুমন্তী সেনগুপ্ত, পৃষ্ঠা- ২৪১) কিছুক্ষণ পরেই দেহরক্ষীদের  গুলিতে অনাথ পাঁজাও মৃত্যুমুখে পতিত হয়। মৃগেন দত্ত গুলি খেয়ে মুমূর্ষু হয়ে পড়েন। তাকে উদ্ধার করে নিয়ে যাওয়ার সময় তিনি কেবল, 'আমাকে মেরে ফেলো' 'আমাকে মেরে ফেলো' বলে চিৎকার করছিলেন। তারপর দিন হাসপাতালে তিনি মারা গিয়েছিলেন। তবে মারা যাওয়ার আগেই কেন গুলি করেছিলেন তার উত্তরও দিয়ে গেছেন। তিনি বলেছিলেন, 'এই হত্যা হল কেশপুরের মানুষের উপর অত্যাচারের প্রতিবাদ।'(প্রণব কুমার চ্যাটার্জী/ মিডনাপুর ট্রিস্ট উইথ স্ট্রাগেল, দ্য স্টেট আর্কাইভস অফ ওয়েস্ট বেঙ্গল পাবলিকেশন, পৃষ্ঠা- ২৪৫)

এই ঘটনার তিন মাসের মধ্যেই শুরু হয়েছিল বার্জ হত্যা মামলা। প্রচন্ড রকমের ধর পাকড় শুরু হয়েছিল। এত মৃত্যুর ঘটনা এর আগে কখনো ঘটেনি।

এত মৃত্যু বলতে?

ঘটনাস্থলেই বার্জ সাহেব ও অনাথ পাঁজার মৃত্যু ঘটেছিল। পরদিন মারা গিয়েছিলেন আর এক বিপ্লবী মৃগেন দত্ত। পরে একে একে বিপ্লবী কর্মীরা গ্রেফতার হতে শুরু করল। পুলিশি অত্যাচারে মারা গিয়েছিলেন 'সন্তোষ বেরা' ও 'নবজীবন ঘোষ'। (আমি সুভাষ বলছি/ শৈলেশ দে, পৃষ্ঠা- ২৪০) ব্রজকিশোর চক্রবর্তী, রামকৃষ্ণ রায় ও নির্মলজীবন ঘোষের ফাঁসি হয়েছিল। অনেকেই যাবজ্জীবন দ্বীপান্তরিত হয়েছিলেন।

১১. ০২. ১৯৩৪ এর আনন্দবাজার পত্রিকায় বার্জ হত্যা মামলার রায় প্রকাশিত হয়েছিল। শিরোনাম--- 'তিন জনের প্রাণদণ্ড; চারিজনের যাবজ্জীবন দ্বীপান্তর, বার্জ হত্যার মামলার রায়।' সেখানে লেখা হয়েছিল--- 'মেদিনীপুর ১০ ফেব্রুয়ারি, অদ্য স্পেশাল ট্রাইব্যুনালের কমিশনারগণ বার্জ হত্যা ষড়যন্ত্র মামলার রায় প্রকাশ করিয়াছেন। আসামি (১) নির্মল জীবন ঘোষ,(২) ব্রজ কিশোর চক্রবর্তী,( ৩) রামকৃষ্ণ রায়- এই তিনজনের প্রতি প্রাণদণ্ডের আদেশ হইয়াছে। (১) কামাখ্যা ঘোষ, (২) নন্দ দুলাল সিংহ, (৩) সনাতন রায় (৪) সুকুমার সেন- এই চারিজনের প্রতি যাবজ্জীবন দ্বীপান্তর দন্ড হইয়াছে।... মিস্টার এইচ জি ওয়েট (প্রেসিডেন্ট) মিস্টার টি. এন বসু ও রায়বাহাদুর এস পি ঘোষকে লইয়া স্পেশাল ট্রাইব্যুনাল গঠিত হইয়াছিল।'(আনন্দবাজার পত্রিকা- ১১.০২.১৯৩৪)
এই রায় হয় তো অন্যরকম কিছু হতে পারত, কিন্তু এক দুর্বল চিত্তের বিপ্লবী মীরজাফরের ভূমিকা গ্রহণ করাই সেটা আর সম্ভব হয়নি। 

সে কি! এরকম ঘটনাও ঘটেছিল? কে ছিলেন সেই বিপ্লবী?

শৈলেশচন্দ্র ঘোষ। তিনি রাজসাক্ষী  হয়েছিলেন। বন্ধুদের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করলেও ইংরেজরা তাকে পুরস্কার হিসেবে মুক্তি দিয়েছিল। ১১.০২.১৯৩৪ এর আনন্দবাজার পত্রিকায় মামলার রায়ে সেই খবর প্রকাশিত হয়েছিল--- "রাজসাক্ষী শৈলেশচন্দ্র ঘোষকে অব্যাহতি দেওয়া হইয়াছে।"

তথ্যসূত্র: পর্ব ৭০-৭৪
১) পুরুলিয়া/ তরুণদেব ভট্টাচার্য
২) আমি সুভাষ বলছি/ শৈলেশ দে
৩) জিলা মেদিনীপুর: স্বাধীনতার সংগ্রাম/ কমলকুমার কুন্ডু
৪) স্বাধীনতার রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম(দ্বিতীয় খন্ড)/ গোকুলেশ্বর ভট্টাচার্য
৫) মুক্তিসংগ্রাম/ মাখন গুপ্ত
৬) বাংলার বিপ্লব সাধনা/ পুলকেশ দে
৭) অগ্নিযুগ/ শৈলেশ দে
৮) রক্তের অক্ষরে/ শৈলেশ দে
৯) বেঙ্গল ভলেন্টিয়ার্স/ মধুমন্তী সেনগুপ্ত
১০) সবার অলক্ষ্যে, দ্বিতীয় পর্ব/ ভূপেন্দ্রকিশোর রক্ষিত রায়

Post a Comment

1 Comments

  1. ভালো হয়েছে লেখাটি।

    ReplyDelete