দেশান্তরী -২২
হিল্লোল রায়
ফিলাডেলফিয়া ত্যাগ -নর্থ ডাকোটা অভিমুখে
প্লেনের মধ্যে বসে যাত্রা -পথের বর্ণনা
ফিলাডেলফিয়া ত্যাগের প্রস্তুতি
সেপ্টেম্বর ২, ১৯৭৫
মঙ্গলবার সকাল ৭-৪০ মিনিট
নর্থ ওয়েস্ট এয়ারলাইন্সের বিমানে বসে...
আজকের দিনটা আমার জীবনে উল্লেখ করার মত। কারণ ফিলাডেলফিয়া শহর ত্যাগ করে আবার আকাশপথে পাড়ি জমাচ্ছি। আমার এই ডাইরী লিখছি অনেক উঁচুতে বসে, প্লেনের মধ্যে। নর্থ ওয়েস্ট এয়ার লাইন্স-এ করে ফিলাডেলফিয়া বিমানবন্দর ত্যাগ করছি। গন্তব্যস্থল নর্থ-ডাকোটা স্টেটের ফার্গো "হেক্টর” বিমানবন্দর। ঘুম থেকে উঠেছি খুব সকালে, প্রায় ৬টায়। গতকাল রাত বারোটা পর্য্যন্ত জিনিষপত্র গুছিয়েছি, মেজমামা, সেজমামার সংগে নর্থ ডাকোটার জীবনযাত্রার ধরণ সম্পর্কে আভাস নিয়েছি। টুকিটাকি জিনিষপত্র গতকালই কিনে নিয়েছি। সেজমামা একটা ঘড়ি উপহার দিয়েছেন, চেকে দুশো ডলার। আর মেজমামা টাই, আনুসঙ্গিক জিনিষপত্র অনেক কিছুই এবং দুশো ডলার নগদ। আমার মন আজ ভারাক্রান্ত কবে ফিলাডেলফিয়া ফিরব জানি না। মনটা আরও বেশী খারাপ লাগছে মেজমামার মেয়ে কাকলীকে অসুস্থ দেখে। কাকলী তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে উঠুক ভগবানের কাছে এই প্রার্থনাই জানাচ্ছি। আমাদের এ্যাপার্টমেন্ট , পার্ক লেন ঈস্ট, E 102, আপার ডার্বি, পেনসিলভ্যানিয়া ১৯০৮২ থেকে জিনিষপত্র নিয়ে বেরিয়েছি ঠিক সাততায়। ঘুম থেকে উঠে হাত মুখ ধুয়ে বেরুতেই ৬-২০।
তাড়াতাড়ি করে জামাকাপড় পরে নিলাম। টাই এর নট(KNOT) টা ঠিকমত হচ্ছিল না। মেজমামা আমায় টাই-এর 'নট' দিয়ে দিলেন। চা এবং ৩/৪ অংশ ডোনাট (আমেরিকান খাবার, মিষ্টি লাগে খেতে) দিয়েই ব্রেকফাস্ট সারলাম। কিছুই খেতে ইচ্ছা করছিল না। গতরাত্রে একটুও ঘুম হয় নি আজকের যাত্রাপথের কথা চিন্তা করে। মেজমামিমাকে সাশ্রুনয়নে প্রনাম করে কাকলীর মুখে স্নেহচুম্বন জানিয়ে এ্যাপার্টমেন্ট থেকে বেরিয়েছি সকাল সাতটায়। সেজমামা তাড়াতাড়ি করে নতুন 'ফিল্ম দিয়ে 'মিনোল্টা' ক্যামেরা লোড করে নিলেন। আমাদের এ্যাপার্টমেন্টের সামনে এবং গাড়িকে সামনে রেখে দুটো ছবি তুললেন। রুমাল দিয়ে চোখ মুছছি তখনও। জানি না, ছবিগুলো কেমন হবে।
দৌড়ে এসে প্লেনের মধ্যে ঢুকেছি। আমার সীট নম্বর 32H Right Window. একেবারে জানলার সীট পেয়েছি। বাইরের দৃশ্যাবলী দেখছি।
প্লেন রানওয়ের উপর চলতে শুরু করেছে। ফিলাডেলফিয়া এয়ারপোর্টে ঢোকার পর চোখের জল মুছে ফেলেছি। মনটাকে শক্ত করে নিয়েছি, নিজেকে ভবিষ্যৎ জীবন গড়ে তুলতে হবে। আমার মন খারাপ লাগছে তাই ডাইরীর পাতায় যা মনে আসছে লিখছি। বানান ভুল কিংবা ভাষার দুর্বলতা থেকে যেতে পারে।
যাই হোক আঙুলগুলো লাল হয়ে গিয়েছে, কলম ধরে লিখতে অসুবিধা হচ্ছে। তার উপর প্লেনের মধ্যে বসে লিখছি। কিছুক্ষণ চলার পর আমার প্লেন ফিলাডেলফিয়ার মাটি ছেড়ে আকাশে উঠল ৭-৫৫ নাগাদ। সীট বেল্ট বেঁধে নিয়েছি। সত্যি সত্যিই ফিলাডেলফিয়া ত্যাগ করলাম। প্লেনের গতিবেগ বাড়ছে, ক্রমশই উপরে উঠছে। কাঁপছে প্লেনের ডানাগুলো। এখন ঘড়িতে ৮-১০। আর মন খারাপ লাগছে না। এই মাত্র এ্যানাউন্স করলো প্লেনের কেবিন থেকে; আমরা ৩৩ হাজার ফুট উঁচু দিয়ে যাচ্ছি, ঠিক আমার জীবনের সব বাধার বেড়া জাল ডিঙিয়ে ওপরে আকাশ ছোঁয়ার প্রচেষ্টা। বাইরের তাপমাত্রা ৭৮ ডিগ্রী ফারেনহাইট, আর আমার মনের তাপমাত্রা ১১০ ডিগ্রী ফারেনহাইট। প্লেনে বসে বাইরের দৃশ্য দেখার সখ আমার অনেক দিনের। আজ জানলার পাশে সীট পেয়েছি। মনের মত করে সখ মিটিয়ে নিচ্ছি।
প্লেন এখন বেশ উঁচুতে । ঘড়িতে ৮-৪০ মিনিট ফিলাডেলফিয়ার অবস্থান আমেরিকার ম্যাপে পূর্বদিকে আর নর্থ ডাকোটা একেবারে উত্তরে। সময়ের পার্থক্য এক ঘন্টা। যতই উত্তরে যাচ্ছি ঠান্ডার আধিক্য। প্লেন যখন প্রথম ফিলাডেলফিয়া ত্যাগ করল তখন নীচের দৃশ্যাবলী বেশ ভালোই লাগছিল। বাড়ীঘরগুলো খুব ছোটছোট, আর আমার স্মৃতিগুলো বেশ বড় আকারে মনে ঘুরপাক খাচ্ছে, নদীকে ক্ষীণতর লাগছিল। প্লেনের মধ্যে বসে তাপমাত্রার পার্থক্য কিছুই বোঝা যায় না। তবে ঘোষণা অনু্যায়ী বুঝলাম তাপমাত্রা কমতে শুরু করেছে একটূ আগে ৭৮ ডিগ্রী ফারেনহাইট ছিল আর এখন ৬৫ ডিগ্রী ফারেনহাইট । প্লেন এখন বেশ উঁচুনীচু হচ্ছে। কানগুলো কটকট করছে।
এখন চলেছি মেঘের মধ্যে দিয়ে, সময় ৮-৫৫ মিনিট। যতই উত্তরে যাচ্ছি, সময় পার্থক্য বাড়ছে।
কাজেই আমার 'ডাইরী' লিখবার সমস্তই নির্দেশিত হচ্ছে ফিলাডেলফিয়ার সময় অনুযায়ী। যাই হোক, সূর্য্যের আলো আমার জানলা দিয়ে এসে পড়ছিল। পাশের সিটটি ফাঁকা । জানলার সাটার টা একটু বন্ধ করে দিলাম।
ব্রেক ফাস্টের কথা লিখতেই ভুলে গিয়েছি। কন্টিনেণ্টাল ওমলেট, অরেঞ্জ জুস, কফি, বীফ রোল এবং স্ন্যাক্স দিয়ে প্রাতঃরাশ সারলাম। অনেক দূরে চলে এসেছি। এতক্ষণ মেঘের মধ্যে দিয়ে প্লেন আসছিল। বাইরের দৃশ্য কিছুক্ষণের জন্য দেখা যাচ্ছিল না। এখন আবার দেখতে পাচ্ছি।
সীট বেল্ট বেঁধে নিয়েছি। নীচের বাড়ীঘর গুলো খুব ছোট ছোট লাগছে। আকাশকে মনে হচ্ছিল পেঁজা তূলো। কোন ধুনুরী যেন তূলো ধুনে চারিদিকে ছড়িয়ে দিয়েছে। লেপ-তোষক তৈরী করবার মতলব আছে হয়তো। জানি না, শীতের শহর ফার্গোর দিকে যাচ্ছি তো। তাই আগে থেকেই আমাকে জানিয়ে দিচ্ছে, “শীতপ্রধান শহরে যাচ্ছো যাও, ক্ষতি নেই। ঠান্ডাকে ভয় পেও না। প্রস্তুতি নাও।”
এখন আর মন খারাপ লাগছে না। ডেট্রয়েট (মিশিগান) বিমানবন্দরে আমার প্লেন নামবে বিশ্রাম নেবার জন্য। প্লেনের ডানাগুলো কাঁপতে শুরু করেছে। গতিমুখ নীচের দিকে। ফিলাডেলফিয়ার সময় অনুযায়ী ঘড়িতে ৯টা(সকাল)। প্লেন বেশ নীচুতে নেমে আসছে। এইমাত্র রানওয়ে স্পর্শ করল। ছুটছে বেশ, গতিবেগ ক্রমশ:ই কমছে। একেবারে সুস্থির হল সকাল ৯-০৫ মিনিটে। যাত্রীরা অনেকেই নামতে শুরু করেছে। এখন প্লেনটা বেশ ফাঁকাই লাগছে। ফিলাডেলফিয়া এয়ারপোর্টে যত জন যাত্রী ছিল, এখন আর অত যাত্রী নেই। আমার প্লেন ডেট্রয়েট বিমানবন্দরে দাঁড়িয়ে।
জানলা দিয়ে বাইরের রানওয়ের দৃশ্য দেখছি। বেশ ভালই লাগছে। সূর্য্যের কিরণ ঠিকরে পড়ছে, মেঘের মধ্যে দিয়ে। ডেট্রয়েট বিমান বন্দর খুব বড় নয়। চারিদিকে সবুজ গাছ। দূরে মেঘ জমে আছে । প্লেনের মধ্যে বসেই দেখলাম। একের পর এক প্লেন ডেট্রয়েট বিমান বন্দরের রানওয়ের উপর দৌড়ে আসছে বিশ্রামের জন্য।
যাত্রীরা অনেকেই মার্কেটিং -এ বেরিয়েছেন প্লেন থেকে। জনৈকা এয়ার হোস্টেসকে প্রশ্ন করলাম,
-হোয়াটস দি টাইম এ্যাট দিস এয়ারপোর্ট ?
-মাই ওয়াচ হ্যাজ স্টপড -উত্তর দিয়ে নিজেই একটু লজ্জিত হল, দেখে তাই তো মনে হল আমার।
-ডোন্ট মাইন্ড , বল্লাম।
মুচকি হেসে চলে গেল। এরপর একটু রেস্ট রুমে গেলাম। টাই এর নট ঠিক করলাম। হাতমুখ ধুলাম, জল খেলাম। পেটটা বেশ ভরা ভরা লাগছে। জল খেয়ে শরীরটা একটু সুস্থ লাগছে। গতরাত্রে ঘুম না হওয়ার জন্য চোখটা জ্বালা জ্বালা করছে। যাই হোক মন খারাপ লাগছে না। ডেট্রয়েট বিমান বন্দরে বিশ্রাম নেবার পর আমার প্লেন আবার রানওয়ের উপরে গতি নিতে শুরু করেছে। ঘড়িতে ৯-৫৫ মিনিট।
ডেট্রয়েট বিমানবন্দরের পারিপার্শ্বিক পরিবেশ দেখার জন্য বেড়িয়েছিলাম ৯-৩৫ নাগাদ। মিনিট পাঁচ ঘুরে আসার পর আবার চলে এলাম প্লেনের দিকে। ভালই লাগলো। ডেট্রয়েট বিমানবন্দর থেকে যাত্রী ওঠানামা অনেক আগেই শেষ হয়ে গিয়েছে। আবার রোদ উঠেছে। ডেট্রয়েটে এখন বেশ গরম লাগলো। ফিলাডেলফিয়ার সংগে ডেট্রয়েটের তাপমাত্রার পার্থক্য বোঝা গেল না।
আমার প্লেনটা হচ্ছে DC 10. ডেট্রয়েটের রানওয়ের উপর দিয়ে প্লেন এখনও ছুটছে, গতিবেগ নিচ্ছে মিনিয়াপোলিশ/সেন্টপলস যাওয়ার জন্য। এখন সকাল ১০-০২ মিনিট।
ডেট্রয়েট বিমানবন্দর ত্যাগ, মিনিয়াপোলিশের পথে
আমার ডিসি-১০ পাখা নাচাচ্ছে, প্রস্তুতি নিচ্ছে ডেট্রয়েট বিমানবন্দরকে 'টা টা' জানাবার জন্য। চারিদিকে সবুজ ঘাস, সুন্দরভাবে সাজানো। রানওয়ের উপর প্লেনটা দৌড়াদৌড়ি করে স্থির হয়ে দাঁড়িয়েছে। দাঁড়িয়ে গতিবেগ নিচ্ছে আকাশে উড়বার পথে। জানলা দিয়ে সূর্য্যের আলো ঠিকরে পড়ছে। প্লেন কাঁপছে। ঠিক ১০-০৫ মিনিটে আকাশে উড়ল।
এবার হল শুরু যাত্রা মিনিয়াপোলিশ(মিন্নেসোটা) অভিমুখে। ডেট্রয়েটকে টা-টা জানালাম। "পরে তোমাকে ভাল করে দেখতে আসবো" - “মনে মনে বল্লাম। জানলায় আমার সীট নম্বর ৩২-এইচ(32H)। পেছনের এবং সামনের যাত্রীরা কেউ কেউ তন্দ্রাচ্ছন্ন। আবার কেউ বা 'ওয়াশিংটন পোস্ট', 'টাইমস' ইত্যাদিতে চোখ বোলাচ্ছেন।
আবার অনেক উঁচুতে উঠে পড়েছি। এখন সময় দশটা-দশ, মেঘের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছি। সীট বেল্ট এখনও বাঁধা। সাদা-সাদা পূঞ্জীভূত মেঘে সূর্য্যের আলো এক মনোরম দৃশ্য সূচনা করেছে। কিছুক্ষণ আগেও ডেট্রয়েট শহরের ঘরবাড়ি দেখা যাচ্ছিল। এখন ওগুলো দেখতে পাচ্ছি না। সীট বেল্ট বাঁধা রয়েছে কারণ খুলবার নির্দেশ হয়নি।
মিনিয়াপোলিশের পথে উড়ে চলেছি। সোয়া দশটা নাগাদ সীট বেল্ট খুলে ফেলার নির্দেশ । সীটটাকে কাতকরে আরাম করে বসে বাইরের দৃশ্য দেখছি। ডাইরী লিখছি। ভীষণ ভাল লাগছে। প্রকৃ্তিলোকের সৌন্দর্য্য অবলোকন করার গর্বে আমার বুকটা বেশ স্ফীত হচ্ছে। প্লেনের মধ্যে বসে জানলার ফাঁক দিয়ে দেখা প্রাকৃ্তিক দৃশ্যাবলীর বর্ণনা দেওয়া আমার পক্ষে সম্ভব নয়। কারণ সে্টা আরো অনেক বড় লেখকের পক্ষেই সম্ভবপর। তবে আমার আজকের এই ডাইরীর পাতায় সেপ্টেম্বর ২, ১৯৭৫ তারিখটা বেশ উজ্জ্বল হয়েই থাকবে।
ক্রমশ
0 Comments