দূরদেশের লোকগল্প (উত্তর আমেরিকা)
ধূসর ঈগল ও তার পাঁচ ভাইবোন
চিন্ময় দাশ
ছ’ছটা বাচ্চা নিয়ে দুই ঈগলের সংসার। বড়টাই যা একটু বড়সড়। বাকি পাঁচটা বাচ্চা এখনও ওড়তে শেখেনি। হঠাৎই একদিন, বাবা মা দুটো পাখিই শিকারীর তীরে গাঁথা হয়ে, মারা গেল।
বাসায় হাঁ করে বসে আছে বাচ্চাগুলো। মা বাবা কখন ফিরবে বাসায়। খাবার নিয়ে আসবে তাদের জন্য। এদিকে সূজ্জি ডুবল একসময়। দেখতে দেখতে রাতও নামল আঁধার হয়ে। না পাওয়া গেল খাবার। না বাসায় ফিরল বাবা মা।
রাতটা ভারি কষ্টে কাটল বাচ্চাগুলোর। সকাল হলে, বড়বাচ্চাটা বেরুল বাসা ছেড়ে। ডানা মোটামুটি শক্ত হয়েছে কেবল তারই। বড় বুঝে গেল, যেহেতু আমিই বড়, সকলের দায়িত্ব এখন আমাকেই নিতে হবে। খাবার জোগাতে হবে ভাইবোনদের মুখে। আগলে রাখতে হবে বিপদ আপদ থেকে।
সকাল হলেই বেরিয়ে যায় বড় পাখিটা। ফিরতে ফিরতে সেই দুপুর গড়িয়ে বিকেল। পাঁচজনের খাবার তো আর কমটি নয়। বাবা মা যে কাজ দুজনে মিলে করত, এখন তাকে একাই করতে হয় কাজটা। এভাবেই গেল কয়েক মাস। ছোটগুলো ওড়াউড়ি শিখে ফেলেছে প্রায়। তবে, এখনও তাদের শিকারে পাঠায় না বড় ঈগল।
সে সময়েই বিপদের সঙ্কেত পাওয়া গেল। ঠাণ্ডা বাতাস বইতে শুরু করেছে। শীত আসছে, এটা তারই জানান। তার মানে হোল, শীত এসে পড়বার আগেই, চলে যেতে হবে এখান থেকে। বিপদ থেকে বাঁচতে হলে, আরও আরও দক্ষিণে সরে যেতে হবে সবাইকে।
এদিকে ঠিক তেমন সময়েই, একদিন বিপদ এসে হাজির হোল ঈগলদের সংসারে। বাসা থেকে তখন অনেক দূরে। হঠাৎই এক দুর্ঘটনা। একটা ডানাই ভেঙে গেলে বড় ঈগলটার। এক ডানায় তো আর ওড়া যায় না। কোন রকমে একটা পাহাড়ের মাথায় পড়ে থাকতে হোল বেচারাকে।
🍂
দক্ষিণে সরে যাওয়ার সময় হয়ে গিয়েছে। আর দেরি করা ঠিক নয়। কিন্তু বড় ভাইকে না নিয়ে, যাবেই বা কী করে? সবাই আলোচনা করে ঠিক হোল, এলাকা ছাড়বার আগে, বড়কে খুঁজতে বেরোবে সবাই। পাঁচজন তারা। তিনজন ভাই দু’জন বোন। দুটো দলে ভাগ হয়ে গেল তারা। এক দল উপর থেকে জরীপ করবে। এক দল খানিক নীচ থেকে।
সারাদিন উড়ে উড়ে, যখন হাল ছেড়ে দেওয়ার অবস্থা, হঠাৎই চোখে পড়ে গেল। একটা পাহাড়ের মাথায় পড়ে আছে বড়। একটা ডানা ভাঙা। ওড়বার সাধ্যি নাই তার।
ভাইবোনদের দেখতে পেয়ে ভারি নিশ্চিন্ত হোল বড়। বলল—শোন সবাই। শীত এসে পড়ছে। আমার নড়বার ক্ষমতাটুকুও নাই। চলে যাও তোমরা সকলে। যতটা পারো, দক্ষিণে চলে যেও।
ভাইবোনেরা তাতে রাজি নয়। বড় বলল—শীত ভারি ভয়াণক জিনিষ। প্রাণে বাঁচতে দেবে না কাউকে। আমার জন্য সবাই কেন খেসারত দেবে? মরতে হলে, একজন মরাই ভালো।
সবাই একসাথে চেঁচিয়ে উঠল—তা হতে পারে না। তোমাকে ফেলে, কোনমতেই যাব না আমরা। তাতে যা হয় হোক। তুমি কীভাবে বড় করে তুলেছ আমাদের, সে কথা ভুলে যাব কী করে? বাবা মা দুজনের মতো করে আগলে রেখেছিলে আমাদের। আজ বিপদের দিনে তোমাকে ফেলে, সরে পড়ব, তা হবে না। বাঁচলে সবাই একসাথে বাঁচব। মরলেও একসাথেই।
তিন ভাই চটপট নীচের দিকে নেমে গেল। অনেক খোঁজাখুঁজির পর পেয়েও গেল একটা উপায়। বড়সড় একটা বুড়ো পাইনগাছের ইয়াব্বড় একটা কোটর চোখে পড়ে গেল। আর ভাবনা কীসের। এখানেই কাটিয়ে দেওয়া যাবে শীতের দিনগুলো।
ধরাধরি করে বড়কে নীচে নামানো হোল। শীতের খাবার জমা করা শুরু হোল কোটরে। কিন্তু ঈগল তো আর কোটরে বাস করবার পাখি নয়। তাদের ঘরবাড়ি হোল পাহাড় জঙ্গলের সবচেয়ে উঁচু গাছের একেবারে মগডালে। আর এখন কি না একটা গাছের খোঁদলে।
তাও একটা কোটরে ছ’জনে গাদাগাদি করে থাকা! খুব একটা সহজ হবে না। অন্য কিছু খোঁজ করতেই হবে। হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকলে চলবে না।
তখন ঠিক হোল, বড় দুজন বেরোবে ভালো কিছুর সন্ধানে। তিন জন বাসায় থাকবে, বড়ভাইয়ের দেখভালের জন্য। বড় দুজন উড়ে গেল দক্ষিণের দিকে। দুটি বোন আর ছোট ভাইটি আছে এখানে।
কোটরের একেবারে প্রশস্ত জায়গাটিতে একটা বিছানা তৈরি করা হয়েছে। নীচে খড় বিছিয়ে, উপরে শুকনো শ্যাওলা পেতে দেওয়া হয়েছে পুরু করে। যাতে কষ্ট না হয় বড়র।
বাসার কাজকর্ম ভাগাভাগি করে নিয়েছে তিনজনে। মোদ্দা তিনটি কাজ। বড়র সেবা সুশ্রুষা করা। তার মুখে খাবার জোগানো। বাইরে বেরিয়ে জল এনে দেওয়া। মাঝে মাঝে পাশ ফিরিয়ে দেওয়া। এই সব।
দ্বিতীয় কাজ বড়র জন্য ঔষধপত্র জোগাড় করে আনা। শরীরের অবস্থা অনুযায়ী বনের বিভিন্ন ঘাস-পাতা তুলে এনে দেওয়া হয়। যাতে তাড়াতাড়ি সেরে উঠতে পারে।
তৃতীয় কাজ খাবারের বন্দোবস্ত করা। দিনের খাবারটুকু হলেই তো হবে না। ভয়াণক শীত আসছে সামনে। শীতের দিনগুলোর জন্য, বাসাতেই খাবার মজুদ করে রাখতে হবে।
পালা করে তিনটি কাজ শুরু করল তারা। তবে সমস্যা হোল ছোটটাকে নিয়ে। ছোট বলেই নয়। মাথায় বোধ হয় ঘিলু বলে কিছু নাই তার। কোন কাজই ঠিক মতো করতে পারে না সে। এখন তাই অন্য দুজন যে যেদিন বাইরে যায়, সাথে নিয়ে যায় ছোটকে। কাজকর্ম শেখায়।
ভাইবোনদের ঠিকমতো সেবাযত্ন পেয়ে, একদিন শরীর সেরে উঠল বড়র। দেখতে দেখতে শীত চলে যাচ্ছে। বসন্তের দিন আসবে এবার। দেখা গেল, ভাঁড়ারের অবস্থা ভালো নয়। খাবার দাবার ফুরিয়ে আছে। শিকারে না বেরুলে, বিপদে পড়তে হবে।
তিন ভাইবোনকে শিখিয়ে পড়িয়ে দিতে শুরু করল বড় ঈগল। ঈগলেরা হোল দুনিয়ার সবচেয়ে বড় শিকারী পাখি। সবচেয়ে শক্তিশালী। তাহলেও সতর্ক হয়ে কাজ করতে হয়। তাছাড়া, ভাইবোনগুলি এখনও ছোটই। কায়দা কসরত শিখিয়ে পড়িয়ে দিতে হবে ঠিকমতো। বাবা মা নেই। বড়ভাইই এখন তাদের বাবা মা শিক্ষক সবই। কীভাবে কোন কাজটা করতে হবে, তার রীতি নিয়ম বুঝিয়ে দিতে লাগল বড় ঈগল।
--এখনও তোমরা ছোট। এইটা মনে রাখতে হবে। বড় কোন শিকারকে নিশানা করবে না। তাতে কাজের কাজ তো হবেই না, উলটে বিপদও হতে পারে। এখন কাঠবেড়ালি, বুনো বেড়াল বা ধেড়ে ইঁদুর, নেউল, খরগোশ এসব দেখলে ঝাঁপাবে। বড়জোর বাঁদরছানা। এই পর্যন্ত।
সমস্যা হয়েছে ছোট ভাইটাকে নিয়ে। চেহারা ছোট, বুদ্ধিতেও বড় নয়। উদ্দেশ্যহীনভাবে ঘুরে বেড়ায় এদিক ওদিক। বাসায় ফেরে খালি হাতে। মানে, একটা ইঁদুরও আনে না শিকার করে। এদিকে তাকালেই দেখা যাবে, তার দুটো ডানারই পালক উস্কো খুস্কো।
একদিন কারণ জানতে চাওয়া হোল। সেদিন ছোট খুলে বলল ব্যাপারটা—আমি বয়সে ছোট, বা গায়ে শক্তি কম আমার—সেটা কিন্তু নয়। আমাকে খালি হাতে ফিরতে হয় অন্য কারণে।
সবাই তাকে ধরে পড়ল—তাহলে, কারণটা কী, সেটা শুনি।
ছোট বলল—বাইরে বেরোলেই এদিক ওদিক উড়ে বেড়াই আমি। বুনো হাঁস, বা অন্য কোন না কোনও পাখি শিকারও করি। কিন্তু বাসায় ফেরার পথে, যেই না বনের সীমানায় পৌঁছাবো, অমনি বড়সড় একটা পাখি এসে ঝাঁপিয়ে পড়ে। সব কেড়েকুড়ে নেয়ে আমার।
একটু দম নিয়ে, জোর গলায় বলল—আমি ভালো করে বুঝতে পারছি, আমার ফেরার সময় হলেই, ওত পেতে বসে থাকে শয়তানটা।
—একেবারে ঠিক কথা বলেছ তুমি। বড় বলল—চিনতেও পারছি শয়তানটাকে। ও হোল সাদা প্যাঁচা। এখন তো আমার শরীর ভালোমতোই সেরেছে। কাল তোমার সাথে যাবো আমি। কালই উচিত শিক্ষা দিয়ে দেব লোভি বুনো ডাকাতটাকে।
পরদিন। বড় আর ছোট একসাথে বেরিয়েছে দুই ভাই। বেশি দূর গেল না। বনের কাছেই, একটা হ্রদের পাড়ে এসে নামল দুজনে। বড় রইল একটা পাথরের আড়ালে। ছোট চলল শিকারে। বেশি সময় লাগল না। একটু বাদেই একটা বুনো হাঁস তুলে নিল ছোঁ মেরে। বড়ভাই তা দেখে বেশ খুশি। কাজ তো মন্দ শেখেনি ছোট!
তখনই ঘটে গেল ঘটনাটা। দু’পায়ে শিকার ধরা। ছোট ডাঙায় নামতে যাবে, একটা পেঁচা এসে ঝাঁপিয়ে পড়ল তার উপর। কাছেই একটা গাছের ডালে ওত পেতে বসে ছিল সে। এখন ছোটর কাছ থেকে হাঁস কেড়ে নিতে চাইছে প্যাঁচা।
আড়াল থেকে দেখছিল বড়। চিৎকার করে উঠল-- তবে রে, শয়তান! আজই তোর সব ধূর্তামি খতম করে দেব আমি।
চারটে করে নখ ঈগলদের পায়ে। বঁড়শির কাঁটার মতো বাঁকানো আর কুচকুচে কালো নখ। যেমন বড়, তেমনই শক্ত। ঝপাৎ করে পেঁচাটার উপর এসে পড়ল বড় ঈগল। আর, আটখানা সূচালো নখ গেঁথে গেল পেঁচার দু’দিকের পাঁজরে।
শত্রুকে বন্দী করে, বাসার দিকে উড়ে চলল বড় পাখিটা। পেছনে ছোট। আজ তার সাথে একটা হাঁস। এই প্রথম শিকার নিয়ে বাসায় ফিরছে সে। মনে ভারি পুলক ছোটর।
আজ ঘর সামলাবার দায় এক দিদির। তার কাছে হাঁসটাকে সঁপে দিয়ে, হাজির হোল বড়র কাছে। পেঁচার কী হাল করে বড়ভাই, দেখার ভারি কৌতুহল।
ছোটকে দেখে, বড় বলল—তোমার সাথেই বদমায়েসি করে, এ ডাকাতের সাজা তুমি নিজেই দাও।
আর যায় কোথায়? প্যাঁচাটার উপর মনে মনে ভীষণ রাগ ছিল ছোটর। হুকুম পেয়ে সে চেঁচিয়ে উঠল-- পাতার আড়ালে বসে বসে, নজর রাখো আর ডাকাতি করো, তাই না? চোখ দুটোই গেলে দেব আজ তোমার।
কথা শেষ না করেই, প্যাঁচার দুটো চোখেই নখ বসাতে লাগল ছোট। একবার নয় বারবার। খোঁচাখুঁচিতে রক্ত বেরোচ্ছে গলগল করে। অসহ্য যন্ত্রণায় চেঁচাছে প্যাঁচাটা। দুটো চোখই ছিঁড়েখুঁড়ে গেছে বেচারার। চোখের দুটো ডিমই বেরিয়ে এসেছে মাথার বাইরে।
বড় থামিয়ে দিল ভাইকে—ছেড়ে দাও এবার। এতো রাগ ভালো নয়। শ্ত্রুকেও ক্ষমা করতে হয়—এটা ভুলে যেও না কখনো।
বড় ঈগল প্যাঁচাকে বলল—এবার তুমি যেতে পারো। কিন্তু একটা কথা বলি তোমাকেও। তোমার চেয়ে দুর্বল, এমন কারও ওপর অত্যাচার কোর না কখনো। যাও এবার।
প্যাঁচা ককিয়ে উঠল—এভাবে যাবো কী করে? ভালো করে দেখতেই পাচ্ছি না। তার চেয়ে মেরে ফেলো তোমরা আমাকে। অন্ধ হয়ে বাঁচবো কী করে? কে খাওয়াবে আমাকে শিকার করে?
সে কী হাসি বড় ঈগলের! বলল—সেই ব্যবস্থাটাই করা হয়েছে তোমার। ঔষধ বলে দেব আমি। চোখ তোমার সেরে যাবে। তবে দিনের বেলা দেখতে পাবে না তুমি। ডাকাতিও আর করতে পারবে না কারও ওপর। রাতের বেলা শিকার কোর। আমাদের কোন আপত্তি নাই তাতে।
চোখের ঘা সারাবার বুনো লতাপাতার হদিস দিয়ে, প্যাঁচাকে বিদায় করে দিল বড়। ভাইবোনদের নিয়ে আহারে বসে গেল এবার।
কিছুদিন না যেতেই, আবহাওয়া বদলে যেতে লাগল। উত্তরের বাতাস ফিরে যাচ্ছে। বরফের পুরু চাদর সরে যাচ্ছে গাছের পাতা থেকে। নীল রঙ ফিরে আসছে নদীর জলে। আকাশ ঝকঝকে নীল। বাতাস ভরিয়ে দিচ্ছে পাখিদের কলকাকলি। বসন্ত এসে গেছে।
তেমনই এক দিন। সবে সকাল হয়েছে। দক্ষিণের দিকে উড়ে যাওয়া দুটো ঈগল ঘরে ফিরে এলো। সবার ভারি আনন্দ তাতে। ভারি একচোট নাচানাচি করে নিল সকলে মিলে।
দেখতে দেখতে এক একজন করে সঙ্গী জুটে গেল ছয় ভাইবোনেরই। সকলেরই নিজের সুংসার। আলাদা আলাদা বাসা গড়ে উঠল সকলের। বেশ আনন্দেই থাকে ছ’জন। তবে, মাঝেমধ্যে কোন একটা পাহাড়ের মাথায় এসে জোটে সকলে। একজোট হয়ে গল্পগুজব করে নিজেদের মধ্যে।
আর সেই প্যাঁচা? সেদিন থেকে প্যাঁচা আর দিনের বেলায় দেখতে পেতো না। বাইরে বেরোতও না ঈগলের ভয়ে।
সেই থেকে আজও কোন প্যাঁচাই দিনের আলোয় ভালো দেখতে পায় না। দিনের বেলা খুব একটা বেরোয় না বাইরে। তাদের যা কিছু কাজ কারবার, সবই রাতের বেলায়। সূজ্জিঠাকুর ঘুমোতে যাওয়ার পর।
0 Comments