সবুজ দ্বীপ আন্দামান
অষ্টম পর্ব
দেবীপ্রসাদ ত্রিপাঠী
পূর্ব প্রকাশিতের পরবর্তী অংশ
১৮৫৮ সালের পরে শত শত বিদ্রোহী সিপাহীদের নিয়ে এসে কড়া নিরাপত্তার মধ্যে তাদেরকে দিয়ে জঙ্গল পরিষ্কার করে বসবাসের উপযোগী করা হয়। সেই সময়ের আন্দামান ছিল ঘন জঙ্গলে পূর্ণ এবং সারা বৎসর ধরে বৃষ্টিপাত হওয়ার দরুন মশা ও অন্যান্য কীট পতঙ্গ, সরীসৃপের আবাসস্থল। সমুদ্রের খাঁড়ি গুলি ছিল কুমীরের আবাসস্থল। মূল ভূখণ্ডে আত্মীয়-পরিজন থেকে বিভাজিত হয়ে নিজেদের জাত, ধর্ম বিসর্জন দিয়ে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে অমানুষিক কায়িক পরিশ্রমে বীতশ্রদ্ধ হয়ে বন্দী বিদ্রোহীরা ভুল ধারণার বশবর্তী হয়ে ভাবলেন আন্দামান থেকে ক্রমাগত উত্তর দিকে পথ চলা শুরু করলে তারা হয়তো বা ব্রম্ভদেশে পৌঁছে যাবেন এবং সেখানে তারা ব্রম্ভদেশের রাজার নিকট সৈনিক হিসেবে কাজ করবেন। কিন্তু তাদের ধারণা ছিল না যে আন্দামান সমুদ্রবেষ্টিত এলাকা। রস আইল্যান্ড থেকে সাঁতার দিয়ে সমুদ্র পার হয়ে বিপরীত দিকের গভীর জঙ্গলে এক মাস ধরে হাঁটার সময়ে আদিম জনজাতিদের হাতে তীর বিদ্ধ হয়ে কিছু সিপাহী প্রাণ হারায় এবং অবশিষ্টেরা ইংরেজের অনুসন্ধান দলের হাতে ধরা পড়ে। যারা ধরা পড়েছিল তাদেরকে বন্দী উপনিবেশে ফেরত এনে গাছের ডালে দড়ি টাঙ্গিয়ে প্রকাশ্যে ফাঁসি দেওয়া হয়। এইভাবে স্বাধীনতাকামী সিপাহীদের মুক্তির স্বপ্ন শেষ হয়ে জীবনদীপ নির্বাপিত হয়। প্রথম বৎসরে যে বন্দীরা এসেছিল তার মধ্যে ১৯১ জন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যায় এবং ১৭৫ জন বন্দী যারা পালিয়ে গিয়েছিল তাদের মধ্যে কিছু বন্দী আদিম জনজাতির শরাঘাতে মারা যায় এবং অবশিষ্টরা হয় সমুদ্রে ডুবে মারা যায় অথবা ফাঁসিকাষ্ঠে প্রদান দেয়। বন্দীদের দিয়ে গভীর জঙ্গল কেটে উপনিবেশ স্থাপনের উপযোগী করা হয়। পরবর্তীকালে ইংরেজ প্রশাসন ১৮৯৭ সালের Reformatory schools Act, 1897 আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে ১৫ থেকে ১৭ বৎসরের পাঁচজন কিশোরকে এখানে কারারুদ্ধ করে। সর্বনিম্ন বয়সী বন্দী হরিপদ ভট্টাচার্যের বয়স ছিল মাত্র ১৫ বৎসর। যে সকল বন্দীদের আচরণ জেল কর্তৃপক্ষের মতে সন্তোষজনক ছিল তাদের চিঠিপত্র লেখার ও পাওয়ার অধিকার থাকতো, তবে বন্দীদের যে চিঠি গুলি কারা অভ্যন্তর থেকে বাইরে যেত বা বাইরে থেকে আসতো সেগুলি জেল কর্তৃপক্ষ পরীক্ষা করতেন। তদানীন্তন ভারতবাসী এমনকি আজও সবার কাছে দ্বীপান্তর ও কালাপানির জীবন কাহিনী এক বিবর্ণ জীবনের দিনলিপি। সিপাহী মহাবিদ্রোহের সিপাহীদের দ্বীপান্তরের পরেই বৃহত্তর ভারতবর্ষে সংগঠিত অন্যান্য বিদ্রোহীদের দ্বীপান্তরের পালা শুরু হয়।
🍂 ওয়াহেবি বিদ্রোহ - উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত অঞ্চলে আঠারোশো সাতান্ন সালের কিছু পরেই ওয়াহেবি সম্প্রদায়ের বিদ্রোহ উল্লেখযোগ্য। ভারতের ব্রিটিশ সরকার ওয়াহেবি বিদ্রোহীদের আন্দামানে দ্বীপান্তরিত করে এবং ওয়াহেবিরা আন্দামানের কয়েদী উপনিবেশের দুঃস্বপ্নময় জীবনে প্রবেশ করে। ওয়াহেবি বিদ্রোহী এবং আফ্রিদি পাঠান কয়েদী শের আলি খান একজন ব্রিটিশ অফিসার কর্তৃক দ্বীপান্তরে দণ্ডিত হয়ে আন্দামানে আসেন। এই শের আলি খান ওয়াহেদি বন্দীদের কাছ থেকে অনুপ্রেরণা পেয়ে ভারতের গভর্নর জেনারেল লর্ড মেয়ো ১৮৭২ সালে যখন আন্দামানের চাত্থাম দ্বীপের বিপরীতে ব্যাম্বুফ্ল্যাটের জনবসতি থেকে কিছুটা দূরে মাউন্ট হ্যারিয়েট পাহাড়ের পাদদেশে হোপটাউন জেটিতে এসেছিলেন তখন কাছাকাছি লুকিয়ে থাকা শের আলি খান নিরাপত্তাকর্মীদের বেষ্টনীর মধ্যেই লর্ড মেয়োকে ছুরিকাঘাতে আহত করেন এবং সেখানেই তিনি মৃত্যুমুখে পতিত হন। উপনিবেশ কর্তৃপক্ষের লোকজন অনেক চেষ্টায় পলাতক শের আলিকে নিকটবর্তী জঙ্গল থেকে ধরে আনে এবং তাকে রস আইল্যান্ডের ফাঁসির মঞ্চে ফাঁসি দেওয়া হয়।
মহারাষ্ট্র বিদ্রোহ- বাসুদেব বলবন্ত ফাড়কে মহারাষ্ট্রে ব্রিটিশবিরোধী বিপ্লবের সূচনা করেন। তার বহু অনুগামীকে ব্রিটিশ সরকার আন্দামানে দ্বীপান্তরিত করে। পরবর্তীকালে স্বাধীনতা সংগ্রামী বিনায়ক দামোদর সাভারকর বিপ্লবের উত্তরসূরি নেতা হিসেবে বিদ্রোহকে এগিয়ে নিয়ে যান। ব্রিটিশ কর্তৃক বীর সাভারকার ও তার কিছু সহযোগীকে আন্দামানে দ্বীপান্তরিত করা হয়।
মনিপুরী বিদ্রোহ - ১৮৯১ সালে মনিপুরী বিদ্রোহে বহু ব্রিটিশ অফিসার মণিপুরীদের হাতে প্রকাশ্যে নিহত হন। বিদ্রোহ দমনের পরে বিচারে ব্রিটিশ অফিসারদের হত্যার দায়ে অনেক মনিপুরী বিদ্রোহীর মৃত্যুদণ্ড হয় এবং বহু বিদ্রোহীকে দ্বীপান্তরিত করে আন্দামানে কয়েদী উপনিবেশে নিয়ে আসা হয়।
গদ্দার বিদ্রোহ - প্রতিষ্ঠিত পাঞ্জাবীরা কানাডা, আমেরিকা, চীন ও জাপান থেকে যে বিদ্রোহের সূচনা করেন সেই বিদ্রোহের নাম গদ্দার বিদ্রোহ। বিদ্রোহ দমন করার জন্য ব্রিটিশ বহু গদ্দার বিদ্রোহীকে গ্রেফতার করে এবং প্রথম লাহোর ষড়যন্ত্র মামলায় অভিযুক্ত করে আন্দামানে দ্বীপান্তরিত করে।
রুম্পা কৃষক বিদ্রোহ- ১৮৭৮-৭৯ সালে দক্ষিণ ভারতের গোদাবরী জেলার কৃষকরা ব্রিটিশ বিরোধী বিদ্রোহের সূচনা করেন এবং তার ফলে কৃষকেরা নিজেদের শাসন ব্যবস্থা চালু করেন। এই বিদ্রোহ ব্রিটিশরা দমনমূলক ব্যবস্থা নিয়ে বহু কৃষককে শাস্তি স্বরূপ দ্বীপান্তরিত করে। এরপরে ১৯২৪ সালে দ্বিতীয় রুম্পা কৃষক বিদ্রোহ হয় সিতারামা রাজ্জুর নেতৃত্বে। পশ্চিম গোদাবরী জেলা ও বিশাখাপত্তনম জেলায় বিদ্রোহ প্রবলভাবে বিস্তৃত হয়ে ওঠে। ১৯২৪ সালে সিতারামা রাজ্জু ও তার বেশ কিছু অনুগামী ব্রিটিশের সাথে বীরত্ব সহকারে লড়াই করে শহীদের মর্যাদা লাভ করেন। বহু কৃষক যোদ্ধা গ্রেফতার হন এবং বিচারে তাদেরকে যাবজ্জীবন দ্বীপান্তরে দণ্ডিত করে ব্রিটিশ সরকার আন্দামানে নিয়ে আসেন।
বার্মা কৃষক বিদ্রোহ - এই বিদ্রোহ থারাওয়াদি কৃষক বিদ্রোহ নামে পরিচিত। ১৯২৮ সালে ডাক্তার সয়া সেনের নেতৃত্বে General council of Burmese Association ব্রিটিশের সঙ্গে সবরকম সম্পর্ক ছিন্ন করে পূর্ণ স্বাধীনতার দাবি করে। ১৯৩০ সালে ডিসেম্বর মাসে ডাক্তার সয়া সেন সমগ্র ব্রম্ভদেশে বিদ্রোহের পতাকা উত্তোলন করেন। পরে ডাক্তার সয়া সেন ব্রিটিশ কর্তৃক বন্দি হন এবং ব্রিটিশরা তাকে ফাঁসি দেয়। এরপরে বহু সংগ্রামী কৃষককে ব্রিটিশরা যাবজ্জীবন কারাদণ্ডাদেশ দিয়ে আন্দামানে পাঠিয়ে দেয়।
মোটা বিদ্রোহ - দক্ষিণ ভারতের মালাবার উপকূলে মোপলা জনজাতিরা খিলাফত আন্দোলনে অনুপ্রাণিত হয়ে প্রকাশ্যে বৃটিশের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেন। মোপলাদের মধ্যে সাম্প্রদায়িক শক্তি চাড়া দিয়ে ওঠার পরে তাকে হাতিয়ার করে ব্রিটিশরা তাদেরকে দণ্ডিত করে শর্তসাপেক্ষে আন্দামানে দ্বীপান্তরিত করে।
সবার শেষে আন্দামানে দণ্ডিত হয়ে ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামীরা সেলুলার জেলে আসেন। স্বাধীনতা সংগ্রামীদের কতজন এখানে এসেছিলেন তাদের সংখ্যা বাদ দিলে সিপাহী বিদ্রোহ ও বৃটিশ বিরোধী অন্যান্য বিদ্রোহে অংশগ্রহণকারী কতজন আন্দামানে এসেছিলেন তার কোনো নির্ভরযোগ্য তথ্য নেই। কিন্তু বন্দির সংখ্যা দিন দিন বেড়েই যায়। যার জন্য কয়েদী উপনিবেশ স্থাপনের পরে যেখানে ১৮৫৭ সালে কয়েদীর সংখ্যা ছিল ৭৭৩ জন পরবর্তী চার দশকের মধ্যে সেই সংখ্যা এসে দাঁড়ায় ১৬১০৬ জন। অর্থাৎ বিচারের নামে প্রহসন করে যত সংখ্যক বিদ্রোহী স্বাধীনতা সংগ্রামীদের দ্বীপান্তরিত করা যায় ততই ব্রিটিশের পক্ষে মঙ্গল।
পরবর্তী অংশ নবম পর্বে
0 Comments