জ্বলদর্চি

গোছল বোনা /ভাস্করব্রত পতি

পশ্চিমবঙ্গের লৌকিক উৎসব, পর্ব -- ৭৭

গোছল বোনা

ভাস্করব্রত পতি

দক্ষিণ দিনাজপুর জেলার বিভিন্ন এলাকায় এখনও কোনওমতে টিকে রয়েছে লৌকিক উৎসব ‘গোছল বোনা’। সম্পূর্ণ গ্রামীণ এই উৎসবটি আজ অনেকটাই ম্রিয়মান। গ্রামজীবনের সাথে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত এটি। মূলতঃ কৃষি জমিতে আমন ধান রোপণ করার সময়কার একটি পালনীয় উৎসব এই 'গোছল বোনা'। 

গোছ পোঁতার উপচার হিসেবে প্রথম গোছটি পোঁতা হয় কৃষিজমির আলের ধারে। এই চিরায়ত আচারেই লুকিয়ে আছে উৎসবের নামকরণের তাৎপর্য। 'গোছ' এবং 'আল' মিলে হয়েছে 'গোছল' (গোছ + আল = গোছল)। এর সাথে 'বোনা' যুক্ত হয়ে সৃষ্টি হয়েছে 'গোছল বোনা'। 
সংস্কৃত শব্দ 'গুচ্ছ' থেকে 'গোছ' কথার উৎপত্তি। 
সংস্কৃত গুচ্ছ  > প্রাকৃত গোচ্ছ > বাংলা গোছ
'গোছ'কে গুজরাটীতে গুচ্ছ, ওড়িয়াতে  গোছ, মারাঠীতে ঘোংস, পাঞ্জাবীতে গুচ্ছা, সিন্ধীতে গোশ বলা হয়। 
গোচ্ছা অর্থে গুচ্ছ বা আঁটি বোঝায়। বলাইচাঁদ গোস্বামী সম্পাদিত 'ভক্তমালগ্রন্থ'তে পাই "দুই গোচ্ছা তৃণ করে, এক গোচ্ছা দন্তে ধরে"। হুতোম প্যাঁচার নকশাতেও আছে "পইতে গোচ্ছা করে গলায়"। 

দক্ষিণ দিনাজপুর জেলা রাজ্যের মধ্যে অনেকটাই পিছিয়ে পড়া জেলা। এখানকার মানুষের মূল জীবিকা কৃষিকাজ। কৃষিপ্রধান জেলায় তাই কৃষিজীবী মানুষের অন্যতম রক্ষাকর্তা আমন ধান। সারা বছরের গ্রাসাচ্ছাদনের জন্য আমন ধানই যুগিয়ে চলে অন্যতম নির্ভরতা। বর্ষার জলে পরিপুষ্ট এই ধান এলাকার মানুষের মুখে অবশ্য 'হেমুদ ধান' বা 'হোমাইদ ধান' নামেও পরিচিত। মেদিনীপুরের চাষীরা বলে 'হেমত ধান'। আসলে এই ধানের চাষে খরচ খুব কম হয়। চাষীদের লাভ বেশি এই চাষে। 

'গোছল বোনা' উৎসবটি পালিত হয় কাদা করা জমিতে (কাদা বাড়ি) যেদিন চারা রোপণ করা হয়, সেইদিন। প্রথমে কৃষকরা বীজতলা বা 'বিচন কাঁচেলা' থেকে পরিনত ধানের চারা বা 'বিচন' বা 'ব্যানতলা' তোলে লাগানোর উপযুক্ত হয়ে গেলে। সেগুলি যেদিন রোপণ করা হয়, সেদিনেই উৎসবটি পালিত হয়। পঞ্জিকা অনুযায়ী যে দিনটি ধান্যাদি রোপণের উপযুক্ত বলে চিহ্নিত হয়, সেদিনেই রোপণ করা হয়। সেই মোতাবেক জমিতে কাদা করা হয় চাষের জন্য। 'গোছল বোনা' লৌকিক উৎসবে প্রয়োজন হয় একটি পাটগাছের চারা, একটি কালো কচুর চারা, একটি কলাগাছের চারা, এক আঁটি ধানের চারা, ধূপ, সিঁদুর এবং মিষ্টান্ন বা বাতাসা। 

‘গোছল বোনা'র কাজটি শুরু করে গৃহস্থের যে কোনও পুরুষ। তবে পরিবারের ছোট ছেলে বা শিশুয়া ব্যাটা বা কচ্যা টকা করলে সবচেয়ে ফলপ্রসূ হয় বলে বিশ্বাস। যেদিন ধান বোনা শুরু হবে সেদিন সকালে সেই বাড়ির ছোট ছেলে কাদা জমির পূবদিকের আলের ওপর ধূপ জ্বালায়। সেখানে কাদার তাল দিয়ে বানায় একটি ছোটো বেদি। সেই বেদিতে সিঁদুরের পাঁচটি বা সাতটি ফোঁটা দিয়ে সেখানে কলাগাছের চারা, কচুগাছের চারা এবং পাটগাছের চারা পুঁতে দেওয়া হয়। এরপর সেই গাছগুলির সাথে ধানের চারার আঁটিতেও সিঁদুরের ফোঁটা দিয়ে মিষ্টান্ন বা বাতাসার নৈবেদ্য নিবেদন করে হাঁটু মুড়ে প্রণাম করেন। এবার ঐ ফোঁটা দেওয়া ধানের আঁটি থেকে বিজোড় সংখ্যায় তিনটি বা পাঁচটি বা সাতটি গোছ নিয়ে তা বাম হাতে পুঁতে দেওয়া হয় কাদা জমিতে। এই প্রক্রিয়া শেষ হলে বাড়ির বাকিরা অথবা জন মজুর দিয়ে পুরো জমিতে আমন ধানের চারা রোপণ শুরু হয়। 
কিন্তু গোছল বোনার দিন বাড়ির মহিলারা কোনও ভাবেই হাত লাগাননা জমিতে। বরং তাঁরা সেদিন ব্যস্ত থাকে বাড়ির হেঁসেলে। নানা ধরনের উপাদেয় পদ রান্না করতে তাঁরা তখন ব্যস্ত থাকে সেখানে। তাঁদের হাতে তৈরি পঞ্চব্যঞ্জনের তালিকায় অবশ্যই সেদিন থাকবে কচুশাকের যেকোনো একটি পদ। সেইসাথে বিগত বছরে তুলে বিশেষ ভাবে শুকনো করা পাটশাক দিয়ে সুস্বাদু রান্না 'শুকতি'ও হেঁসেল আলো করে এই দিন। 

গবেষক নীরেনচন্দ্র রায় লিখেছেন, "দিনাজপুর নামটির সঙ্গে দীন বা দরিদ্র ব্যাপারটি জড়িয়ে আছে। এই এলাকাটি দীনদের রাজা কালীকানন্দজী মহারাজ শাসন করতেন। তিনি এই অঞ্চলের অলস প্রকৃতির দরিদ্র প্রজাদের পালন পোষণ করতে করতে নিজেও দীন হয়ে পড়েন। দীনদের রাজ্যশাসিত এই অঞ্চলকে তাই বলা হত 'দীনরাজপুর'। 'র'-কে এই অঞ্চলের মানুষ 'অ' উচ্চারণ করেন। তাই ‘দীনরাজপুর' উচ্চারণ বিকৃতিতে হয়ে গেছে 'দিনাজপুর'। এই জন্য প্রধান ফসল হোমোইদ ধান অর্থাৎ 'আমন' ধানের কল্যাণ কামনায় 'গোছল বুনা' লোকাচারটি যত্ন করে হৃদয় দিয়ে পালন করা হয়"।
🍂

Post a Comment

0 Comments