জ্বলদর্চি

আমাদের প্রভাত : মলয় রায়চৌধুরী

আমাদের প্রভাত : মলয় রায়চৌধুরী

.
আমি রিজার্ভ ব্যাঙ্কের বেশি মাইনের চাকরি ছেড়ে নতুন একটা চাকরি নিয়েছিলুম, শুধু ভারতবর্ষের গ্রামগুলোর মানুষের জীবনযাত্রা দেখার আর তাদের সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহের লোভে । সেসময়ে আমি লেখালিখি বন্ধ করে নানা বিষয়ে বই পড়ায় মন দিই । আরেকটা কারণ ডান হাতের আঙুলে আরথারাইটিস।   
.
পাটনায় তো থাকতুম ইমলিতলা নামে একটা বস্তিতে । পরে বাবা দরিয়াপুরে বাড়ি করলে সেখানে উঠে যাই । চাকরির জন্য ভারতের মানুষের, খেতখামারের, জীবজগতের, জলসেচের, চাষবাসের বৈচিত্র সম্পর্কে বই পড়া জরুরি হয়ে গিয়েছিল। 
.
ওই বৈচিত্র্যের সূত্রেই অনুন্নত দেশগুলো সম্পর্কে পড়া আরম্ভ করি আর জানতে পারি আধুনিকতাবাদ থেকে ভাবুকেরা কতোটা সরে গেছেন এবং অন্য এক ভাবকল্প খুঁজছেন নতুন অবস্হাটাকে সংজ্ঞায়ন করার জন্য । তখনই ফেদেরিকো দ্য ওনিস কথিত ‘পোস্টমডার্ন’ ভাবকল্পের সন্ধান পাই যা ইউরোপ-আমেরিকার পোস্টমডার্ন ভাবনা থেকে একেবারে আলাদা । দাদার অনুরোধে প্রবাল দাশগুপ্ত একটা প্রবন্ধে ব্যাপারটা খোলোশা করে আধুনিকতার পরের অবস্হানকে বলেন ‘অধুনান্তিক’ ।
.
দাদা কলকাতায় ফিরে ‘হাওয়া৪৯’ নামে একটা পত্রিকা প্রকাশের তোড়জোড় আরম্ভ করে বলেন যে ‘তুই কলকাতায় চলে আয়’ । বহুকাল কলকাতার বাইরে ছিলুম বলে কবি-সাহিত্যিকদের সঙ্গে নতুন করে পরিচয়ের প্রয়োজন অনুভব করলুম । কলকাতায় এসে বেশ কিছুদিন দাদার বাড়িতে ছিলুম, কেননা আমার নাকতলার ফ্ল্যাট চুনকাম করে রেডি করতে সময় লাগছিল ; মুম্বাই থেকে আসবাবপত্রও পৌঁছোয়নি । 
.
দাদার বাড়িতে অনেকে আসতেন, যাঁদের সঙ্গে আগে পরিচয় ছিল না । জহর সেনমজুমদার, কলিম খান, মুর্শিদ, নাসের হোসেন, শান্তি লাহিড়ী, রুদ্র কিংশুক,  প্রভাত চৌধুরী প্রমুখ । প্রভাত আর পবিত্রদের ধ্বংসকালীন আন্দোলন তখন ষাটের অন্যান্য আন্দোলনের মতন ফুরিয়ে গেছে । অধুনান্তিকতা নিয়ে আলোচনা হতো এবং ‘হাওয়া৪৯’-এর প্রতিটি সংখ্যায় বিষয়টির কোনো না কোনো দিক নিয়ে লিখতে বলা হতো আগ্রহীদের ।
.
দাদার বাড়ি থেকে আলোচনাচক্র প্রভাত চৌধুরীর বাড়িতে আরম্ভ হলে ছুটিছাটায় যেতুম সন্ধ্যাবেলা । প্রভাত চৌধুরী ‘কবিতা পাক্ষিক’ নামে কবিতার একটা পত্রিকা আরম্ভ করেছিল । কানাইলাল জানার আলিপুর জেলের কোয়ার্টারের ছাদে কবিতা পাঠের আয়োজন করত আর সেখানে গোষ্ঠী-নির্বিশেষে প্রায় সবাই আসতো । 
.
দেখলুম যে প্রভাত চৌধুরীর সম্পাদকীয় আগ্রহ তার আগের কবিতা পত্রিকা, যেমন বুদ্ধদেব বসুর ‘কবিতা’, সুশীল রায়ের ‘ধ্রুপদি’, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘কৃত্তিবাস’ থেকে একেবারে আলাদা । আগের সম্পাদকরা ছিলেন ছাঁটাই করার সম্পাদক, কাদের কবিতা ছাপা হবে না, তার নির্ণায়ক । প্রভাত চৌধুরী সবাইকে ‘কবিতা পাক্ষিক’-এর আশ্রয়ে আনার অবিরাম প্রয়াস করে গেছে, তা একজন যেমনই লিখুক, প্রভাত চৌধুরী গাইড করেছে, কিন্তু  প্রভাত নিজের ফর্মে তাদের লিখতে বলেনি। অর্থাৎ অধুনান্তিক কবিতার এলাকাকে সুস্পষ্টভাবে চিহ্ণিত করেছে । 
.
আমার কবিতার বই, গিন্সবার্গ আর ককতোর অনুবাদ, প্রবন্ধের বই নিজের আগ্রহে প্রকাশ করেছে প্রভাত ; দরকার হলে নতুন মুদ্রণ করেছে। আমার যখন হার্ট অ্যাটাক হলো, তখন চিকিৎসার জন্য প্রভাত গিয়ে ডেকে এনেছে ভূমেন্দ্র গুহকে । 
.
বয়স হয়ে গেলেও প্রভাত কাঁধে ঝোলা নিয়ে পৌঁছে গেছে পশ্চিমবাংলায় বিভিন্ন কবিদের জমায়েতে, কবিতা পাঠে, এমনকী কবিদের বাড়িতে । বুদ্ধদেব বসু, সুশীল রায়, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় কখনই কারোর বাড়িতে অমনভাবে যেতেন না, তাঁদের গজদন্ত মিনার থেকে তাঁরা নামেননি কখনও। 
.
আমি অবাক হয়ে যেতুম, কেননা আমার শরীরে কুলোতো না বলে আমি কোথাও যেতে পারতুম না । প্রভাত আমাকে সম্বর্ধনা দিতে চেয়েছিল, কিন্তু আমি নিজেকে এসবের অযোগ্য মনে করি বলে অনুরোধ ফিরিয়ে দিয়েছিলুম ।
প্রভাত চৌধুরী ছিল ছত্রপতি । নিজের ছাতার তলায় যেকোনো আগ্রহীকে স্হান দিতো । প্রতিষ্ঠানকে পরোয়া করেনি । প্রভাতের জায়গা নেবার মতন কেউ আর রইলো না ।
প্রভাতের জন্মদিন ২৪ জুন ।

🍂

Post a Comment

0 Comments