জ্বলদর্চি

ভোলগা নদীর খোঁজে - ৫ /বিজন সাহা

ভজনেসেনস্কি ক্যাথেড্রাল

ভোলগা নদীর খোঁজে - ৫

বিজন সাহা 

আস্তাশকভ 

তরঝক থেকে আস্তাশকভের দুরত্ব ১২৭ কিলমিটার। নির্জন রাস্তা। কালেভদ্রে দু' একটা গাড়ি দেখা যায়। পথ প্রায় জনপদ শূন্য। বন অথবা খোলা মাঠ। সেই পথ ধরে আমরা এগুচ্ছি অনিশ্চিতের সন্ধানে। এতক্ষণে বুঝে গেছি ভোলগার উৎসে আজ আর যাওয়া হবে না। রাত কাটাতে হবে আস্তাশকভেই। কি আছে বা নেই সেখানে, কিছু জানা নেই। দেমিদ পথেই চেষ্টা করছে রাতে থাকার কোন ব্যবস্থা করতে। এদিকে সূর্যের রথ দ্রুত গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে দিগন্ত বলয়ের দিকে যাতে সে সময় মত ঘুমের কোলে ঢলে পড়তে পারে। এখন রাত ছোট, তাই দেরি করলে আর ঘুমানোর সময় পাওয়া যাবে না। দেমিদ নিজেও চলছে সূর্যের সাথে পাল্লা দিয়ে। ইতিমধ্যে এক ভদ্রলোকের সাথে কথা হয়েছে। একটা স্পোর্টস কমপ্লেক্সে আমাদের থাকার ব্যবস্থা হয়েছে। তিনি অনুরোধ করেছেন আমরা যেন খুব দেরি না করি। যখন আস্তাশকভ এসে পৌঁছুলাম সূর্য ডুবতে শুরু করেছে সেলিগের হ্রদে। এখন অবশ্য সূর্য ডোবার পরেও গোধূলির আলোয় অনেকক্ষণ পর্যন্ত সবকিছু স্পষ্ট দেখা যায়। সেই আধো আলো আধো ছায়ায় শহরকে মনে হল জেলেদের বস্তির মত। কেন এমন মনে হল বলতে পারব না। হয়তো ছোট ছোট নৌকার কারণে। তাছাড়া জলাশয়ের পাশে লোকজন মাছ ধরবে এমন মনে করাও অসম্ভব কিছু নয়। আস্তাশকভ ঢুকে আমার ঠিক এটাই মনে হয়েছিল। আমরা সোজা চলে গেলাম আস্তানায়। সেখানে লাগেজ রেখে বেরুবো শহর দেখতে আর রাতের খাবার খেতে। এটাই আমাদের প্রথম রাত। এখনও এমন দীর্ঘ জার্নিতে ঠিক অভ্যস্ত হয়ে উঠিনি। তাই রাতে ঘুমের খুবই দরকার ছিল। দেখা গেল সেই কমপ্লেক্স একেবারে ফাঁকা, ফলে অনেক কিছুই কাজ করে না। দিলীপের খুব একটা পছন্দ হয়নি থাকার ব্যবস্থা। ও চাইছিল কোন হোটেলে উঠতে। কিন্তু কথা হল এই রাতে যদি সেখানে সীট না পাওয়া যায় তখন কোথায় যাব? তাছাড়া কাটাবো তো একটা মাত্র রাত। তাই দিলীপকে বললাম কষ্ট করে হলেও রাতটা এখানেই কাটাতে। কমপ্লেক্সের ভদ্রলোকের কাছে জেনে নিলাম কিভাবে ভোলগার উৎসে যেতে হয়। সকালে তার হাতে চাবি দিয়ে অথবা ওনার দেখানো জায়গায় চাবি রেখে আমরা চলে যাব। 

সেলিগের হ্রদ

আস্তাশকভ শহরের প্রথম উল্লেখ পাওয়া যায় ১৩৭১ সালের দিনলিপিতে যখন মস্কোর রাজা এই লিথুনিয়ান জনপদ দখল করেন। সেলিগের জলাশয়ের এক দ্বীপে অবস্থিত এই জনপদ তখন ক্লিচেন নামে পরিচিত ছিল। ১৩৯৩ সালে নভগোরাদের রাজা ক্লিচেন দখল করে পুড়িয়ে দেন। স্থানীয় কিংবদন্তি অনুযায়ী এই অগ্নিকান্ডে ক্লিচেনের অধিবাসী এফস্তাসি বা অস্তাশকো নামে এক জেলে ভাগ্যক্রমে বেঁচে যায়। পরে সেই জেলে ক্লিচেনের দক্ষিণে অন্য এক দ্বীপে গিয়ে বসবাস শুরু করে আর তার নামানুসারে এই জায়গার নাম হয় অস্তাশকভ। পঞ্চদশ থেকে অষ্টাদশ শতাব্দী পর্যন্ত অস্তাশকভ ছিল রঝেভ রাজ্যের অংশ। বিভিন্ন সময়ে এই জনপদ আগুনে পুড়ে নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। ১৭১১ সালে আগুনে ধ্বংস হবার পরে তৃতীয় বারের মত একে নতুন করে গড়ে তোলা হয়। ১৭৭৫ সালে অস্তাশকভ তভেরের অন্তর্ভুক্ত হয়। উনবিংশ শতাব্দীতে অস্তাশকভ ছিল অগ্রগামী মফঃস্বল শহর। সেখানে এ সময় হাসপাতাল, পাবলিক ও ধর্মীয় শিক্ষালয়, লাইব্রেরি, থিয়েটার, বুলভার্ড, মেয়েদের বিদ্যালয়, উদ্যান, আধ্যাত্মিক ব্যান্ড, পাথরের রাস্তা, সামাজিক অগ্নি নির্বাপক দল এসব গড়ে ওঠে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জার্মান সেনারা এই শহর দখল করতে ব্যর্থ হয় যদিও এটা ফ্রন্ট লাইন থেকে খুব দূরে ছিল না। তাই অস্তাশকভ যুদ্ধের সময় সরবরাহ কেন্দ্র হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এই সময় শহরে বিদ্যুৎ কেন্দ্র, হাসপাতাল, রুটির মিল এসব কাজ করলেও চামড়ার কারখানা কাজাখস্তানে স্থানান্তরিত হয়। শহরে দর্শনীয় স্থানগুলোর মধ্যে স্থানীয় ইতিহাসের যাদুঘর, ঝিতেনস্কি মহিলা মনাস্তির, ভজনেসেনস্কি ও ভস্ক্রেসেনস্কি ক্যাথেড্রাল, ত্রইস্কি গির্জা, প্রিওব্রাঝেনস্কায়া বেল টাওয়ার, ফায়ার টাওয়ার ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। উল্লেখ করা যেতে পারে যে ১৯৮৯ সালে এখানে সর্বোচ্চ সাড়ে সাতাশ হাজার লোক বাস করত, বর্তমানে সেটা কমে সাড়ে ষোল হাজারে দাঁড়িয়েছে।

🍂
মফঃস্বল শহরের একটাই সমস্যা – খুব তাড়াতাড়ি এখানে রাত নামে। তাই সূর্যের শেষ আলোয় আমরা আস্তাশকভ এসে পৌঁছুলেও শহর এখন বাসায় ঢুকে পড়েছে। বড় শহরে যদি জীবন শুরু হয় সন্ধ্যার পরে এসব শহরে জীবন তখন ঘুমিয়ে পড়ে। তাই আজ যে খুব বেশি কিছু দেখা হবে না বা শহরের সাথে পরিচয় হবে না সেটা আগে থেকেই জানা ছিল। আমার আবার এক সমস্যা, কোথাও গেলে তা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে না দেখলে এক ধরণের অতৃপ্তি থেকে যায়। যাহোক সারাদিন জার্নির পর ক্লান্ত ছিলাম। আর ঘরে ফিরে স্নান না করলে কেমন যেন অস্বস্তি বোধ করি। তাই প্রথমেই যেটা করতে হবে – সেটা ফ্রেশ হওয়া। কিন্তু স্নান করতে গিয়ে দেখি গরম জল নেই। নিজেরা প্রথমে চেষ্টা করলাম। শেষ পর্যন্ত কেয়ার টেকার ভদ্রলোককে ফোন করলাম। ঠিক মনে নেই, উনি এসে ঠিক করেছিলেন নাকি দেমিদকে ফোনে বলে দিয়েছিলেন – শেষ পর্যন্ত গরম জল এলো। একে একে তিন জন স্নান করে একটু গা এলিয়ে দিলাম বিছানায়। তবে বেশিক্ষণ রেস্ট নেবার সময় ছিল না। রাতের খাবার এখনও বাকি।   

একটু রেস্ট নিয়ে আমরা বেরুলাম খাদ্যের সন্ধানে। বিভিন্ন রকম রেস্টুরেন্ট ছিল। আমরা ঢুকলাম এক আর্মেনিয়ান   রেস্টুরেন্টে। তার আগে সকালের জন্য কিছু খাবার কিনে নিলাম সুপার মার্কেট থেকে। খুব সকালে আমাদের বেরিয়ে যাওয়ার প্ল্যান। তখন কোন কিছু খোলা থাকবে কি থাকবে না কে জানে। তাই এই ব্যবস্থা। আমি জানতাম দেমিদ নিরামিষাশী। আমার ওখানে অনেক বার এসেছে সব্জি ভাত খেতে। কিন্তু ও যে এতটা কোর ভেজ সেটা জানা ছিল না। আসলে দুবনায় আমার বন্ধুদের অনেকেই নিরামিষাশী। ওরা বিভিন্ন স্পেশাল শপ থেকে জিনিসপত্র কেনে। এমনকি ওদের জন্য মাংসবিহীন সসেজ পর্যন্ত পাওয়া যায়। রাশিয়ায় আমিষের অভাব নেই কিন্তু যত্রতত্র নিরামিষ পাওয়া কঠিন। দিলীপ ওর স্বভাবসুলভ আন্তরিকতায় চেষ্টা করল দেমিদকে খাওয়াতে। আসলে দিলীপের সত্তর ছুঁই ছুঁই, দেমিদের ৩৫। তাই দেমিদ দিলীপের ছেলের মত। আরও একটা সমস্যা হল দেমিদকে নিয়ে – ও যোগীদের মত শক্ত বিছানায় ঘুমায়। যেহেতু অধিকাংশ বাসায় নরম বিছানা, ও ফ্লোরিং করে। এটাও দিলীপের পছন্দ নয়। আমি ওকে  বলি দেমিদের যেটা ভালো লাগে তাই করতে দাও, দিলীপ ভাবে হয়তো হোটেলে না ওঠার জন্যে দেমিদের সমস্যা হচ্ছে। আমি বলি, কেউ যদি বেশি দাম দিয়ে হোটেলে সীট নিয়ে ফ্লোরে ঘুমায় সেটা আর যাই হোক বুদ্ধিমানের কাজ নয়।

 মাগ্নিৎস্কি বা তেলিয়াশিন লিওন্তি ফিলিপভিচের স্মৃতি সৌধ

যেহেতু অস্তাশকভ সেলিগের হ্রদের তীরে অবস্থিত তাই এ হ্রদ সম্পর্কে দু' কথা না বললেই হয় না। সেলিগের হ্রদের উৎস হিমবাহ। ২৬০ বর্গ কিলোমিটার আয়তনের এই হ্রদের গড় গভীরতা ৫.৮ মিটার আর সর্বোচ্চ গভীরতা ২৪ মিটার। তভের ও নভগোরাদ রিজিওনে অবস্থিত এই হ্রদকে অস্তাশকভ নামেও ডাকা হয়। মোট ১১০ টি নদী এই হ্রদে জল বয়ে আনছে আর একমাত্র নদী সেলিঝারভকা এখান থেকে জলে নিয়ে চলে যাচ্ছে ঠিক যেমনটা বৈকাল হ্রদে শত শত নদী জল বয়ে আনে আর একমাত্র আঙ্গারা সেই জল বয়ে নিয়ে ইনেসেই নদে পড়ে। স্থানীয় রুপকথা বলে বৈকাল কন্যা আঙ্গারা ইনেসেই নদের প্রেমে পড়লে বৈকাল প্রচণ্ড রেগে যায়। বাবার অগ্নিমূর্তি দেখে আঙ্গারা পালিয়ে যায় আর বৈকাল সেখানে একটা পাথর ফেলে মেয়ের ফেরার পথ বন্ধ করে দেয়। অনেক পরে স্থানীয় জেলেরা তাদের বউদের সতীত্বে সন্দেহ করলে সেই পাথরের উপর রেখে আসত। ধারণা করা হত বউ সতী হলে বেঁচে থাকবে, না হলে ভেসে যাবে আঙ্গারার জলে। পরের দিন মানে ২৫ আগস্ট ভোরে আমরা গেলাম সেলিগের হ্রদের তীরে। সেটা বাসার থেকে হাঁটা পথ। এখন ভোর সাড়ে পাঁচটায় সূর্য উঠলেও কুয়াশায় সকাল দুপুর সব মিলেমশে একাকার হয়ে গেছে। সেখান থেকে ফিরে স্নান সেরে ব্রেকফাস্ট করে আমরা আমরা রওনা হলাম ভোলগার উৎসের সন্ধানে। সেখান থেকেই আমাদের যাত্রা শুরু করব হবে।   

Post a Comment

1 Comments

  1. অস্তাশকভের উপর ছবি দেখা যাবে

    http://bijansaha.ru/albshow.html?tag=239


    আর ভিডিও

    https://www.youtube.com/watch?v=8A_qyAJIbn4

    ReplyDelete