জ্বলদর্চি

লোকমাতা রানি রাসমণি —১/ সুমিত্রা ঘোষ

লোকমাতা রানি রাসমণি —১

সুমিত্রা ঘোষ

ভারতবর্ষ শিক্ষা-সংস্কৃতি - প্রাচীন ঐতিহ্য ও আধ্যাত্মিকতাপূর্ণ এমনই এক দেশ যে দেশ বিশ্বের দরবারে মাথা উঁচু করে আপন মহিমা ঘোষণা করতে পারে। ভারতবর্ষ প্রাচীন শিক্ষা-সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের ধারক ও বাহক হয়ে যুগ যুগ ধরে চলে আসছে। যুগে যুগে কত মহামানব, যাঁদের অবতারও বলা হয়, এই পুণ্যভূমি ভারতের মাটিতে অবতীর্ণ হয়ে ভারতবর্ষকে গৌরবান্বিত করেছেন সে ইতিহাস বলে বা লিখে শেষ করা যায় না। এঁদের মধ্যে নারী পুরুষ উভয় মিলেমিশে আছেন। তাঁরা ভারতের মাটিতে অবতীর্ণ হয়ে মানুষকে শিক্ষা দিয়ে পাপী-তাপী উদ্ধার করেছেন।

কালের ইতিহাস কালই রচনা করে। কালই টেনে নিয়ে আসে ঠিকঠিক মানুষকে তার প্রয়োজনে। যাঁর যা ভূমিকা তাঁকে সেইখানে বসিয়ে দেয়। এইভাবে তৈরি হয়েছিল মহাভারত। অজস্র চরিত্র, ঘটনা, যুদ্ধবিগ্রহের কাহিনি দিয়ে শেষ হয়েছিল মহাভারত। সেই সময় শ্রীকৃষ্ণ বর্তমান ছিলেন। তাই মহাভারতের কালকে দ্বাপর বলা হয়। তারপর শুরু হয়েছে কলিকাল। কলিকালে শ্রীকৃষ্ণ না থাকলেও দুষ্টের দমন ও শিষ্টের পালনের জন্য গৌতম বুদ্ধ থেকে শুরু করে
মহাপ্রভু,শঙ্করাচার্য, তৈলঙ্গস্বামী, সাধক রামপ্রসাদ, কমলাকান্ত, শ্রীরামকৃষ্ণদেব এবং তাঁর লীলাসঙ্গিনী সারদা মা, সাধক বামাক্ষ্যাপা প্রমুখেরা ধরাধামে আবির্ভূত হয়ে ভারতবর্ষকে আধ্যাত্মিক চেতনায় উদ্বদ্ধু করে আপামর জনসাধারণকে সঠিক পথের নিশানা দিয়েছেন। গৌতম বুদ্ধ ও মহাপ্রভু ছাড়া এই সমস্ত মহাপুরুষরা হলেন ঊনবিংশ শতকের বিস্ময়। এঁনারা সমাজ সংস্কারও ছিলেন। এঁনারাই ভারতের মাটিতে লোকচক্ষুর অন্তরালে আধ্যাত্মিকতার প্রদীপ জ্বালিয়ে ছিলেন। সেই প্রদীপের আলো যাতে দীর্ঘস্থায়ী হয় সেজন্য অনেকের সঙ্গে বাংলার এক ছোট্ট দরিদ্র কুটিরে প্রণম্য অগ্রজদের প্রদীপে তেল জোগান দিয়েছিলেন বাংলার অখ্যাত গ্রামের বালিকা রাসমণি।

 রাসমণির মাতা রামপ্রিয়া তাঁর টুকটুকে ফর্সা মেয়েটির নাম রেখেছিলেন রানি। রানি শব্দের সঙ্গে জড়িয়ে থাকে অর্থ ও প্রতিপত্তি। রানি রাসমণির রানি শব্দের মধ্যে অর্থ ও প্রতিপত্তি জড়িয়ে না থাকলেও তিনি এমন একটি পরশমণির সন্ধান পেয়েছিলেন যার স্পর্শে সবই সোনা হয়ে যায়। পরশমণির ছোঁয়ায় তিনি হলেন মা ভবতারিণীর লীলাসহায়িকা, সমাজ সেবিকা, দীন-দুঃখী-আতুরজনের অতি আপনজন — রানিমা।

অশেষ পুণ্যবর্তী এবং অসীম প্রতিভাময়ী রানি রাসমণিকে স্মরণ করতে গেলে স্বাভাবিক কারণে তখনকার দিনের সামাজিক পেক্ষাপট চোখের সামনে ভেসে ওঠে। পলাশীর যুদ্ধে (১৭৫৭) অস্তমিত হয়েছে বাংলার স্বাধীনতা সূর্য, প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানীর রাজত্ব। ইতিপূর্বে ১৭৪২খ্রীঃ থেকে ১৭৫১ খ্রীষ্ট পর্যন্ত প্রায় ৯/১০ বছর কালে মারাঠা বর্গীরা পুনঃপুনঃ এই বাংলা আক্রমণ করে ধন-সম্পদ সহ সমস্ত মূল্যবান জিনিস লুঠ করে নিয়ে যায়, নারী ধর্ষণ ও নারীর উপর ঘৃণ্য অত্যাচার চালায়। মারাঠা নেতা সাহুর অনুচর ভাস্কর পণ্ডিত বার তিনেক বাংলাদেশ (অবিভক্ত) বিশেষতঃ পশ্চিমবঙ্গে হানা দিয়েছিলেন। সেই অমানুষিক অত্যাচারের নির্মম বর্ণনা যে কাব্যে পাওয়া যায় সেই ঐতিহাসিক কাব্যের নাম গঙ্গারামের 'মহারাষ্ট্র পুরাণ'। গঙ্গারাম বর্তমান ওপার বাংলার (ময়মনসিংহ) কবি ছিলেন।

অত্যাচারী বর্গীরা বাংলা ছেড়ে চলে যাওয়ার পরেও বাংলায় শান্তি ফিরে আসেনি। পলাশীর যুদ্ধে নবাব সিরাজদৌল্লার মৃত্যুর পর মিরকাশিম বাংলার নবাব হলেন ( ১৭৬০ )। তারপর মিরজাফর, তার ছেলে নজমউদ্দৌলা নবাব হলেন। এদের মত অপদার্থ এবং লোভ লালসা-সর্বস্ব নবারের প্রভাব এবং তৎকালীন ইংরেজ বণিকের শোষণের ফলে বাঙালীর অবস্থা হয়েছিল শোচনীয়।
(ক্রমশ)

দীর্ঘ তিরিশ বছর ধরে নিয়মিত : জ্বলদর্চি। 
জ্বলদর্চি অ্যাপ ডাউনলোড করে নিন।👇
🍂

Post a Comment

0 Comments