জ্বলদর্চি

যেতে যেতে পথে -৭৫/রোশেনারা খান

যেতে যেতে পথে
রোশেনারা খান

পর্ব ৭৫

আজ আন্তর্জাতিক নারীদিবস। নারীদিবস উপলক্ষ্যে মেদিনীপুররের ডি সি সি আই,   খড়গপুরের রিপোর্টার ক্লাবও তথ্যসংস্কৃতি দপ্তর, যৌথ উদ্যোগে আয়োজিত  অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ পেয়েছি। দুটি জায়গাতেই সন্ধ্যায় অনুষ্ঠান। খড়গপুর যাওয়া  বাতিল করলাম। ‘ডি সি সি আই’ এর অনুষ্ঠানেই গেলাম। আমার কথা নাকি   সবার খুব ভাল লাগে। ‘ডি সি সি আই’ আগে একটি শিল্পমেলায় আমাকে সম্বর্ধনা দিয়েছে। খরগপুরের রিপোর্টার ক্লাব ও তথ্য সংস্কৃতি দপ্তর ২০১৫তে ‘বর্ষসেরা অনন্য পুরস্কার দিয়েছে। যাইহোক, এবারেও আমার বক্তব্য সবার ভাল লেগেছে বলেই বলছেন সবাই।  

    আমার শরীরেও একাধিক রোগ বাসা বেঁধেছে। এমাসেই চন্দ্রিমাকে সঙ্গে নিয়ে অ্যাপোলো গেছলাম চেকআপে। মোটামুটি সবই থেমে আছে। ডাক্তারই বলেছেন,  ‘শরীরের ভিতরের অসুখ কখনো সারানো যায় না, মেডিসিনের সাহায্যে থামিয়ে   রাখা হয়’,তাই হবে। সেদিন কলকাতায় ছিলাম। সন্ধ্যাবেলা ওসমানের টাকাটা দিতে    গেছলাম। বাবলি কিছু গিফট নিয়ে এসেছিল, সেগুলোও দিয়ে এসেছি। পরদিন ধর্মতলায় কিছু শপিং করে বাড়ির পথ ধরি। কোলাঘাটে লাঞ্চ করে প্রায় বিকেল  হয়ে গেছল বাড়ি পৌঁছাতে।

     আজ ওনার ডায়ালিসিস  ছিল, কিন্তু লুজ মোশনের জন্য হল না। আমি নিয়ে যাব না বলেছিলাম, ওরাই জোর করে বাধ্য করল। নিতে পারল না। ১ ঘণ্টার মধ্যে বাড়ি ফিরে আসতে হল।
   আজ(২১ মার্চ) বিশ্ব কবিতা উৎসব। ২ জায়গায় আমন্ত্রণ থাকলেও ওনার শরীর খারাপের জন্য যেতে পারলাম না। সম্ভবত গতবছর ৩০ জুন হুলদিবসে   বিনোদের (বিনোদ মণ্ডল, প্রধান শিক্ষক) ডাকে ওর স্কুল ‘রঘুনাথ মুরমু  আবাসিক বিদ্যালয়’এ গেছলাম। হুল দিবসকে, হুল উৎসব বলার প্রতিবাদে ও  আরও কিছু দাবিতে আদিবাসীরা ‘চাক্কা জ্যাম’ এর ডাক দিয়েছিল ওইদিন। যার  ফলে বাস চলাচল দূরে থাক, প্রাইভেট কারও যেতে দিচ্ছিল না। কলকাতা থেকে অরিজিত (কবি)পল্লব কীর্তনিয়াকে নিয়ে এসেছে। আমাদের গাড়ি মেদিনীপুর থেকে সোজা না গিয়ে আমড়াকুচি দিয়ে আনন্দপুর হয়ে, রোড চন্দ্রকোনা ক্রস করে নয়াবসত পৌঁছাল। নয়াবসত এ বিশাল এলাকা জুড়ে ওর স্কুল। বেশ বাগানও রয়েছে। আমরা পৌঁছানোর আগে অনুষ্ঠান শুরু হয়ে গেছে। এদিকে পল্লবকে যে নিয়ে এসেছে, সে বিনোদকে খুব হম্বিতম্বি দেখাচ্ছে। হ্যাঁ, এভাবে আসতে পল্লবদার কত কষ্ট হল, এরকম রাস্তা দিয়ে আসতে হবে জানলে খড়গপুর থেকে ফিরে যেতাম। কথাগুলো শুনে ভাল লাগল না।  

   আমাদের একে একে মঞ্চে ডেকে বসিয়ে বরণ করা হল। তারপর শুরু হল  বক্তব্য। আমি আজকের পরিস্থিতির প্রসঙ্গে বললাম, চাক্কা জ্যাম ও অবরোধের কারণে আমাদের পৌঁছাতে দেরি হয়েছে, গরমে কষ্টও হয়েছে। কিন্তু যদি আমরা ভাবি এই অবরোধের জন্য কোনও আসন্নপ্রসবা মা ব্যথায় কাৎরাচ্ছে, কোনও অসুস্থ শিশু বা বৃদ্ধ রোগ যন্ত্রণায় ছটফট করছে, তাদের ভ্যান রিক্সায় শুইয়ে এই রোদ্দুরে, গরমে হাসপাতাল নিয়ে যেতে হচ্ছে, তাহলে নিজেদের কষ্টটা তুচ্ছ মনে হবে।

       অনুষ্ঠান শেষে পল্লবের সঙ্গে সামান্য কথা হয়েছিল। একই গাড়িতে যখন বিনোদ আমি ও দুজন শিক্ষিকা বাড়ি ফিরছিলাম, তখন বিনোদ বলল, দিদি তুমি যখন ওই কথাগুলো বলছিলে, তখন আমি পল্লবদাকে বললাম, দিদি এগুলো তোমাকে দিল। পরেরদিন দেখি পল্লব ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠিয়েছে। লিখেছে, তোমার সাহসী বক্তব্য আমার খুব ভাল লেগেছে।
জ্বলদর্চি অ্যাপ ডাউনলোড করে নিন।👇
আজ এই স্কুলে আলোচনার বিষয় ‘আদিবাসিদের নৈতিক অধিকার’। এবিষয়ে   বলবেন মেদিনীপুরের প্রথিতযশা আইনজীবী তীর্থঙ্কর ভকত, একজন অধ্যাপিকা ও আরও কয়েকজনসহ এই অধমা। আমাদের দেশে এখনও জাতিবৈষম্য, বর্ণবৈষম্য দূর করা সম্ভব হয়নি। খাবার জলটুকু পেতে তাদের অনেক বাধা অতিক্রম করতে হয়। ওদের খেলার মাঠ দখল হয়ে যাচ্ছে, ওরা মাঠের ধারে বসে খেলা দেখে, অদের খেলতে নেওয়া হয় না। তীর্থঙ্কর বাবু এঁদের অধিকারের কথা বোঝালেন, সেইসঙ্গে  আরও বললেন এঁদের অধিকার থেকে বঞ্চিত করলে আইন কী শাস্তি দিতে পারে। সংবিধান অনুযায়ী এঁরাও সমানাধিকারের দাবিদার। আদতে দেশটা কিন্তু এদেরই।  অথচ আজ এদের জঙ্গলের অধিকারও নেই। এরা তো কোনদিন আলো ঝলমলে শহর দাবি করেছিল না, এরা জঙ্গলকেই নিজের বলে জানত। সহজ সরল জীবন  ছিল এদের। নুন আর তেল ছাড়া সবই নিজেরা উৎপাদন করত। এদের মধ্যে  বিনিময় প্রথা থাকায় এরা টাকাপয়সার হিসেব নিকেশ জানত না। মহাজনরা এই সুযোগটা নিয়ে সেই সময় বংশানুক্রমে ওদের ক্রীতদাস/দাসী করে রেখেছিল।।

      আজ ‘রুরাল ডেভেলাফমেন্ট এ্যাসোসিয়েশন’এর ম্যানেজিং কমিটির মিটিং এ যেতে হয়েছিল। যেহেতু আমি এই কমিটির মেম্বার, সবদিক মানিয়ে গুছিয়ে  চলতে হচ্ছে। তবে আমার কাছে সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ কাজ বা দায়িত্ব যাই বলা হোক না কেন, আমার মনের প্রাণের মানুষটিকে ঠিক রাখা। যে কোনও ভাবে তাঁর কষ্ট  লাঘবের চেষ্টা করা। কোথায় ছিলাম, পরিস্থিতি আজ আমাকে কোথায় নিয়ে এসেছে!সেটাও আমার কাছে কিছুই না।  

     মেদিনীপুর ও খড়গপুরের মাঝখানে মেন রোডের ওপর ‘গ্লোকেল’ নামে একটি নতুন হাসপাতাল হয়েছে। ওরা একদিন আমাকে হাসপাতালটি ভিজিটে যাওয়ার অনুরোধ করলে, আমি গেছলাম। যেহেতু নতুন, তাই সবই বেশ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। ডায়ালিসিসের রুমটি বেশ বড়। দুটি মেশিন আছে, দুজন এক্সপার্ট আছে।  আমার বেশ পছন্দ হল। কিন্তু এতদুরে নিয়ে আসা ব্যায়সাপেক্ষ ব্যপার। ওরা বলল,  আমরা এ্যাম্বুলেন্সে করে নিয়ে আসব এবং পৌঁছেও দেব। সময় আমার অনেকটাই যাবে, তবুও দ্বিতীয়বার ইনফেক্সনের ভয়ে রাজি হয়ে গেলাম।  

    আজ ১ এপ্রিল, আমাদের জারা সোনার শুভ জন্ম দিন। আজই প্রথম খান সাহবকে গ্লোকেল হাসপাতালে নিয়ে এসেছি। জোর করেই নিয়ে এসেছি। উনি মনস্থির করতে পারছিলেন না। একবার না, একবার হ্যাঁ করছিলেন। এখানে প্রথমে ব্লাড টেস্ট করল, তারপর ডায়ালিসিস শুরু হল। ৪ ঘণ্টাই হয়েছে, তবে জল বেশি বের হয়নি। যেদিন যেদিন ডায়ালিসিস থাকে, রানী সকালে ভাত করে, সেদ্ধভাত  খেয়ে কলেজে চলে যায়, আমি ফিরে এসে বাকি রান্না করি। এভাবেই চলছিল।

    কিন্তু ধিরে ধিরে হাসপাতালের অব্যবস্থা চোখে পড়তে লাগল। স্টাফরা মাসের পর মাস মাইনে পাচ্ছে না বলে, এক এক করে কাজ ছেড়ে চলে যাচ্ছে। আমার  পরিচিত কয়েকজন ছিলেন, তাঁরাও চলে গেছেন। এর মধ্যে একটি মেশিন খারাপ হয়ে গেল। তখন বুঝলাম ওনাকে অন্য কোথাও শিফট করতে হবে। মেদিনীপুরে আবার নার্সিংহোম খোঁজা শুরু করি। বেশ কয়েকটা দেখার পর,  ‘মেদিনীপুর নার্সিংহোমে’এ কথা বলে ডেট ফ্যাইনাল করি। যাতায়াতের জন্য পরিচিত একটা  টোটো ঠিক করি। আমার সুবিধা মত এরা ৭টায় টাইম দিয়েছে। ডায়ালিসিস শুরু হল।এখানে আমার পরিচিত পার্থ শ্যামের ডায়ালিসিস হচ্ছে। ও একজন ফিল্ম মেকার, শর্টফিল্ম বানায়। সেইসূত্রে আলাপ। বয়স ৫৫/৫৬ হবে। ওর স্ত্রী দোলাও আমার পরিচিত। অন্যদের সঙ্গেও ধিরে ধিরে পরিচয় হল। খড়গপুর থেকে এক ভদ্রলোক ড্রাইভ করে আসেন। সঙ্গে স্ত্রী রীতা ও মাঝে মাঝে ছোট মেয়েও আসে। স্ত্রী, দুই মেয়ে ও বৃদ্ধা মাকে নিয়ে ওনার সংসার। নিজের রেস্টুরেন্ট আছে, নতুন বাড়ি বানিয়েছেন, কিছুদিন আগে গৃহপ্রবেশ হল। পার্থরও এক মেয়ে, কলেজ পাশ করে গেছে। দোলা বাড়িতেই একটি বিউটি পার্লার চালায়। ফিক্সড ইনকাম বলতে বিধবা মায়ের পেনশন টুকু। তবুও ওরা সেকেন্ড  ওপিনিয়ন নেয়ার জন্য পার্থকে হায়দ্রাবাদ নিয়ে যায়। সেখানে ডাক্তার বলেছেন, কিডনি ও লিভার দুটোই গেছে। দোলা কথাপ্রসঙ্গে একদিন বলল, ‘দিদি এভাবেই চলুক। ডোনার, টাকা, কিছুই নেই। থাকার মধ্যে পুরনো বাড়িটা আছে। সেটাই বিক্রি করে দিতাম, যদি ডাক্তার নিশ্চিত করে বলতেন পার্থ সুস্থ হয়ে যাবে।

     এই সবকিছুর মধ্যে থেকে সৃজনশীল ভাবনা আসবে কী করে? আজ বাড়িতে আছি, তাই রান্না শেষ করে ব্যাংকে গেলাম। ফেরার সময় ওষুধ, ফুলগাছের কিছু চারা কিনে বাড়ি ফিরলাম। উনি খুব গাছ ভাল বাসেন। একদিন নার্সিংহোমে নিয়ে গেছলাম ৮ টার সময়, শুরু হল ৯টা ৩০শে। বসে বসে উল বুনছিলাম। আনন্দবাজার থেকে ফোন এল, দিদি, আপনি যে জঙ্গল নিয়ে লিখতে চেয়েছিলেন, ওরা রাজি আছে। লেখাটি ৬০০ শব্দের মধ্যে হতে হবে। ৩/৪ দিনের মধ্যে লিখে পাঠান। তার আগে আপনাকে হোয়াটস আপে কয়েকটা প্রশ্ন পাঠিয়েছি, সেগুলোর উত্তরসহ ২০০ শব্দের মধ্যে একটা লেখা দুপুর ২ টোর মধ্যে মেল করে দিন, তাই করলাম. ১৮ তারিখে আনন্দবাজারের জেলার পাতায়  প্রান্তিক এলাকার স্কুল ছাত্রীদের স্যানিটারি ন্যাপকিন ব্যবহারের বিষয়ে আমার অভিমত প্রকাশিত হল।

       ঘরে বাইরে শুধু কাজ, কাজ আর কাজ। কাজের মধ্যেই ভাল আছি, বেঁচে আছি। এই মাসেই মেচেদাতে ভারতে প্রথম কুইজ বইয়ের লাইব্রেরির উদ্বোধন হল। মৌসমের জন্যই যেতে হয়েছিল। উপস্থিত ছিলেন কুইজের ব্রান্ড অ্যাম্বাসেডার সিধু, বাংলা সিনেমার পরিচালক সুজিত মণ্ডল, মহিষাদলের রাজকুমার শৌর্যপ্রসাদ গরগ। ওঁদের সঙ্গে পরিচয় হল। আমরাই প্রদীপ প্রজ্বলন করে লাইব্রেরির উদ্বোধন করলাম। এই ঐতিহাসিক মুহূর্তের সাক্ষী রইলেই আরও অনেক বিশিষ্ট জনেরা।
    ১০ এপ্রিল আনন্দবাজারের জেলার পাতায় ‘আপনিই সাংবাদিক’ বিভাগে আমার লেখা ‘আশ্রমের স্কুল স্বীকৃতি পাক’ লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে। আশ্রমের মাতাজিরা খুব খুশি।

   চন্দ্রিমাকে সঙ্গে নিয়ে কলকাতা গেছলাম ভারতসভা হল’এ  ‘সেকুলার মিশন’  আয়োজিত সেমিনারে যোগ দিতে। বিকেলে অনুষ্ঠান, তাই দুপুরে রওনা হতে হয়েছিল। গাড়িতে এসি চলছিল, তাপ বুঝতে পারিনি, বাইরে বেরহতেই যেন  ঝলসে গেলাম। এদিনের সেমিনারে মুসলিম মহিলাদের অধিকার নিয়ে আলোচনা হল। আলোচনায় যোগ দিয়েছিলন ওসমান মল্লিক, শ্বাশতী ঘোষ, রোশেনারা খান প্রমুখ। শ্বাশতী ‘বাঙালি মুসলিম সমাজ ও নারী’ বইটির একটি কপি  কিনলেন। এছাড়াও আরও কয়েক কপি বিক্রি হতে দেখলাম।

      শহরের ‘বিদ্যাসাগর বিদ্যাপীঠের(বালিকা) হীরকজয়ন্তী বর্ষে পদার্পণ উৎসবে শহরের বিশিষ্ট নাগরিক হিসেবে আমন্ত্রিত ছিলাম। স্কুলের শিক্ষিকা সুতপা বসু স্বাদরে বরণ করে বসালেন। পাশে বসলেন ‘বিদ্যাসাগর শিক্ষক শিক্ষণ মহাবিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ বিশ্বজিৎ সেন, চুয়াডাঙ্গা স্কুলের শিক্ষক সুদীপ খাঁড়া। দুজনেই আমার ভ্রাতৃস্থনীয়। আজ অনুষ্ঠানে না এলে অনেকখানি বঞ্চিত হতাম। শিক্ষাবিদ শ্রদ্ধেয় সুদিন চট্টোপাধ্যায়ের মূল্যবান বক্তব্য শোনা হত না।  অনুষ্ঠান শেষে সুদীপ পরিচয় করিয়ে দিলে, উনি বললেন, আমি তো ওনাকে চিনি। ওনার লেখা পড়েছি। প্রধান শিক্ষিকার রুমে বসে বেশ কিছুক্ষণ কথা হল। ওনাকে ‘বাঙালি মুসলিম সমাজ ও নারী’ বইটির একটি কপি দিলাম। উনি পরদিনই সোশাল মিডিয়ায় আমার কথা পোস্টে লিখেছিলেন। পড়ার পরে বইটি কেমন লেগেছে? সে বিষয়েও পোস্ট দিয়েছিলেন। এগুলোই আমার কাছে বহুমূল্য পুরস্কার।

                          ক্রমশ

Post a Comment

0 Comments