জ্বলদর্চি

লোকমাতা রানি রাসমণি —৪ /সুমিত্রা ঘোষ

লোকমাতা রানি রাসমণি —৪
সুমিত্রা ঘোষ

রাণী  রাসমণির মতো সন্তান জন্ম দিয়েছেন বলেই রামপ্রিয়া  ভাগ্যবতী। এভাবে মা-বাবার কাছে বিভিন্ন ধরনের ধর্মগ্রন্থ পাঠ শুনে রানি ক্রমে ক্রমে তিলোত্তমা হয়ে উঠেছিলেন। রানির ছেলেবেলার অভিজ্ঞতায় জানা যায় তাঁর বাবার কাছে রামায়ণ - মহাভারত ও পুরাণাদির পাঠ শুনে গ্রামবাসীরা যখন স্বগৃহে ফিরে যেতেন তখন গ্রামবাসীদের হাতে যে লণ্ঠন ধরা থাকত সেই সময়কার দৃশ্য রানির মনে গভীর প্রভাব ফেলেছিল। তখনকার দিনে মাঠ-ঘাট নিকষ অন্ধকারে মোড়া থাকত, বিরাট মাঠঘাটের পথ দিয়ে গ্রামবাসীরা লণ্ঠন হাতে ফিরে যেতেন। রাণী অবাক বিস্ময়ে তাদের গতিবিধি লক্ষ্য করতেন - তাঁর মনে হয়েছে-  অন্ধকার পথে একটি দুটি আলো মাঠ পেরিয়ে যেন বাতাসে ভাসতে ভাসতে চলে যাচ্ছে। রানির মনে হতো পুরাণের কাহিনি শুনে তৃপ্ত হয়ে মানুষ পল্লীর পথে ফিরে চলেছেন, তাঁদের পণ্যকুটিরে, হাতে  ধরা লণ্ঠন, লণ্ঠনের আলো খুবই কম। এই অভাবী পল্লীবাসীর মামলা-মোকদ্দমা, দলাদলি, মারামারি, অসুখ সবই আছে। রাতে অন্ধকার পথ যেন তাদের চেনা পথ। সঙ্গে লণ্ঠন না থাকলেও পথ ঠিক চেনা হয়ে যায় গ্রামবাসীর কাছে।
🍂

ইতিমধ্যে বাংলায় নবজাগরণের জোয়ার আসতে শুরু করেছে। তখনকার দিনে কলকাতায় ধনী লোকের সংখ্যা নেহাৎ কম ছিল না। রবীন্দ্রনাথের ঠাকুরদাদা প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুরের  ব্যবসা-বাণিজ্য ভালই ফুলে-ফেঁপে উঠেছে। ওদিকে সিমলায় দত্ত বাড়িতে নরেন্দ্রনাথের বাবা  বিশ্বনাথ দত্ত ওকালতি ব্যবসায় ভালই রোজগারপাতি করছেন। কলকাতার বিত্তবানদের মধ্যে কালীপ্রসন্ন সিংহ-র পরিবার যথেষ্ট উল্লেখযোগ্য পরিবার ছিল। রাজা রামমোহন রায় লর্ড বেন্টিকের সাহায্যে সতীদাহ প্রথা নিবারণ করেছেন। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর শিক্ষানীতির সঙ্গে সমাজ সংস্কারের কাজে হাত লাগিয়েছেন। ডেভিড হেয়ার সাহেবএবং বেথুন সাহেব কলকাতার উন্নতি এবং স্ত্রী শিক্ষার কাজে আত্মনিয়োগ করেছেন। ডাফ সাহেবও কলকাতার জনসাধারণকে ভালবেসে তাদের উন্নতির চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। ১৮১৭ সালে মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ জন্মগ্রহণ করেছেন। একের পর এক বাংলা সংবাদপত্র প্রকাশিত হয়েছে। বাংলা ব্যকরণ লেখা হয়েছে।ওই সময় কলকাতায় ধনীলোক বলতে জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবার, জানবাজারের জমিদার বাড়ি বিশেষ উল্লেখযোগ্য ছিল। এই জমিদার বাড়ির উল্লেখযোগ্য পুরুষ হচ্ছেন প্রীতরাম দাস।
প্রীতরাম দাসের সামান্য পরিচয় রাখছি। তাঁর আদি বাসস্থান ছিল হাওড়া জেলার ঘোষালপুর গ্রামে। প্রীতরাম দাসের পিসিমা বিন্দুবালা দাসীর নাম উল্লেখ করা প্রয়োজন। কারণ প্রীতরাম  তাঁর বাড়িতে আশ্রয় পেয়েছিলেন। পিসিমার স্বামীর নাম অক্রুরচন্দ্র মান্না। তিনি ধনী মানুষ ছিলেন। কলকাতায় ডনকিন সাহেবের দেওয়ান ছিলেন। ইতিমধ্যে বর্গীর হামলায় অতিষ্ঠ হয়ে প্রীতরাম দাস কলকাতায় পিসিমার বাড়িতে চলে আসেন, সঙ্গে ছিল তাঁর দুই ছোট ভাই রামতনু ও কালীপ্রসাদ, প্রীতরাম দাস কলকাতায় এসে মান্নাবাবুর (পিসেমশাই) সাহায্যে স্কুলে ভর্তি হলেন। প্রখরবুদ্ধি সম্পন্ন প্রীতরাম যথাসময়ে লেখাপড়া শেষ করলেন। তখন তাঁর পিসেমশাই তাঁকে ডনকিন সাহেবের বেলেঘাটার লবণ কারবারে মুহুরির কাজে নিযুক্ত  করলেন। সেসময়  কলকাতায় অনেকেই নুনের কারবার করে ধনী হয়েছিলেন। এঁদের মধ্যে প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুরের নাম উল্লেখযোগ্য। সে যা হোক প্রীতরাম নিজের চেষ্টায় যশোহরে (বর্তমান ওপার বাংলা) ম্যাজিষ্ট্রেট সাহেবের সঙ্গে পরিচিত হলেন। তাঁর সাহায্যে প্রীতরাম কিছুদিন ঢাকা শহরে চাকরি করেন। সেসময় তাঁর প্রখর  বুদ্ধি ও পারদর্শিতাৰ খবর চারিদিকে ছড়িয়ে পড়েছিল।
ক্রমশ  

Post a Comment

0 Comments