রোশেনারা খান
পর্ব ৭৮
কলেজ থেকে ফেরার সময় যখন গাড়ির জন্য দাঁড়িয়েছিলাম, বিষ্ণুপুরের রামানন্দ কলেজের প্রিন্সিপ্যাল স্বপ্নার ফোন এল, ‘দিদি ২১ ফেব্রুয়ারি বা ৮মার্চ, কবে আপনাকে পাওয়া যাবে’? ৮ মার্চ ওর কলেজে যাব বলে কথা দিলাম। এই যে বাইরে এসেছি, বাড়ি ফিরে সব খুঁটিনাটি ওনাকে বলতে হবে। আসলে নিজে তো কোথাও যেতে পারেন না। যাওয়া বলতে নার্সিংহোম আর ডাক্তারের ক্লিনিক। আমাকে তো এখান সেখান যেতে হচ্ছে। যেমন দুপুরে মণিকাঞ্চন ফোন করে বলল, আজ ওর মেয়ের জন্মদিন, সন্ধ্যাবেলা একটু সময় হলেও যেতে হবে। এদিকে আমাদের কাউন্সিলার নির্মাল্য চক্রবর্তীর ছেলের অন্নপ্রাশনের নিমন্ত্রণ রয়েছে সন্ধ্যাবেলা পোর্টস কমপ্লেক্সে। তবুও গিফট কিনে নিয়ে রানী আমি গেলাম। ওখান থেকে পোর্টস কমপ্লেক্স গেলাম। এলাহি আয়োজন। ওর বাবা নিজে এসে খাওয়ার সময় খোঁজ নিচ্ছিলেন। নির্মাল্যর মা দেবী চক্রবর্তী আমাদের ২নাম্বার ওয়ার্ডের কাউন্সিলর ছিলেন। তিনি একদিন ছেলে বৌমা ও একরত্তি নাতিকে নিয়ে দুরগাপুর থেকে মেদিনীপুর ফিরছিলেন। গাড়ি ড্রাইভ করছিল ছেলে নির্মাল্য। গড়বেতা পার হয়ে তুলসীচটির জঙ্গলে গাড়িটি গাছে ধাক্কা মারে। এই এক্সিডেন্টে নির্মাল্যর মা, স্ত্রী, ও বাচ্চা মারা যায়। মায়ের জায়গায় এলাকার মানুষ ভোটে জিতিয়ে ওকেই কাউন্সিলর করেছে। জীবন তো থেমে থাকে না। ও আবার নতুন করে জীবন শুরু করেছে।
🍂 আজ মেজদিকে ডাক্তার দেখালাম, ইসিজি আর ব্লাড টেস্ট দিয়েছে, বাকি সব নর্মাল আছে। উনিও মোটামুটি আছেন। আমার বর্তমান অবস্থার কথা ভাবলে পাগল পাগল লাগে। তাই সবসময় নিজেকে কাজের মধ্যে ব্যস্ত রাখার চেষ্টা করি। কেন আমার এই দুর্ভোগ জানিনা। অথচ ৭/৮ বছর আগে কত সুখি ছিলাম। বেশি চাহিদা ছিল না। আমার পরিবারে এমন এক ঐশ্বর্য ছিল, যা কাউকে দেখানো যেত না, শুধু অন্তর দিয়ে অনুভব করা যেত।
আজ খুব পরিশ্রম হল। ওনার ডায়ালিসিস ছিল, মেজদির রিপোর্ট নিয়ে ডাক্তারকে দেখালাম। বাড়ি ফিরে রান্না করে খেতে দিলাম। নিজে স্নান করে, খেয়ে পেনশন অফিসে গেলাম। আজ কাজটা হল। আজ(২০/০২/১৯)রানীর রঙ্গলি আনন্দবাজারের জেলার পৃষ্ঠায় প্রকাশিত হয়েছে। সুদীপ সকালে ফোন করে জানাল। আসলে যারা প্রতিভা নিয়ে জন্মায়, তারা না শিখেও অনেককিছু পারে। রানী (নাতাশা)কোনদিন শেখেনি, তাছাড়া আমাদের মধ্যে আলপনা, রঙ্গলি দেওয়ার রেওয়াজ নেই, প্রতিযোগিতার আগের দিন ছাদে একবার প্রাকটিস করেই কলেজের প্রতিযোগিতায় পর পর দু’বছরই রঙ্গলিতে প্রথম ও আল্পনায় দ্বিতীয় স্থান অধিকার করেছে। কিছুদিন আগে ঘটে যাওয়া কাশ্মীরে পুলওয়ামা হত্যাকাণ্ড ওর মনকে ভীষণভাবে নাড়া দিয়েছে বলেই ও এত সুন্দরভাবে দৃশ্যটি ফুটিয়ে তুলতে পেরেছে।
ভাষা দিবসে ভাদুতলার বিবেকানন্দ হাই স্কুলে গেছলাম। কবি নির্মাল্য, আধিকারিক অনন্যা মজুমদার এবং ঈশিতা ও শতাব্দী ওদের নাচের গ্রুহ নিয়ে গেছল। প্রধান শিক্ষক অমিতেশ চৌধুরি খুব ভাল ব্যবস্থা করেছিলেন। ছাত্রছাত্রীদের পারফর্মেন্সও ভাল হয়েছে। আজ আরও তিন জায়গায় যাওয়ার নিমন্ত্রণ ছিল, না করে দিয়েছি। পরদিন দুপুরে আনন্দবাজার থেকে ফোনে বলা হল, দেশের বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে আমার মতামত লিখে জানাতে। পুলয়ামায় জঙ্গি হামলাতে ৪০ জন জোয়ান মারা গেছে। আনেকের দাবি পাকিস্তানের সঙ্গে যুদ্ধ চাই। আবার অনেকে যুদ্ধের বিরুদ্ধে। বিরুদ্ধে যারা, তাদের বাক্যবাণে অতিষ্ঠ হতে হচ্ছ। আমি লিখে পাঠালে আমার ছবি চাওয়া হল।
সকালে পেপার আসার আগেই ওনাকে নিয়ে নাসিংহোমে চলে এসেছি। সুদীপ ফোন করে জানাল, আজ আনন্দবাজারে আমার ছবিসহ মতামত প্রকাশিত হয়েছে। মেদিনীপুরের পুলিশ সুপার, সাহিত্যিক অচিন্ত্য মারিক ও একজন প্রধান শিক্ষকেরও মতামতে রয়েছে। সুদীপই জানাল, আজ সংবাদ প্রতিদিনে চুয়াডাঙ্গায় অনুষ্ঠিত চলচিত্র বিষয়ক সেমিনারের ছবিসহ খবর প্রকাশিত হয়েছে। সকালে খড়গপুর আই আই টি থেকে ঝর্ণাদি ফোন করে বললেন, ‘রোশেনারা আনন্দবাজারে তোমার মন্তব্য পড়লাম, আমাদের সবার মনের কথাটাই তুমি তুলে ধরেছ। তবে ছবিটা তোমার মত সুন্দর হয়নি’।
সন্ধ্যাবেলা স্বপ্না এসেছিল ওর কলেজে যাওয়ার জন্য নিমন্ত্রন জানাতে। অনেক্ষণ আড্ডা হল। ও এসেই একবার প্রণাম করন, যাবার আগে আর একবার করে। অনেকেই করে। আমি কি এতটা শ্রদ্ধা পাওয়ার আদৌ যোগ্য? মুসলিমদের মধ্যে পা ছোঁয়ার ব্যপারটা আর নেই বললই চলে। মাঝরাত থেকে তুমুল বৃষ্টি। উনি এমনিতে ঠিক আছেন, কিন্তু দুদিন ধরে দাঁতের ব্যথায় কষ্ট পাচ্ছেন। ডাক্তারের অ্যাপয়েন্টমেন্ট নিয়ে আজ ডাক্তারের কাছে নিয়ে এসেছি। ডাক্তার দেখে বললেন, দুটো দাঁত নষ্ট হয়ে গেছে, তুলে ফেলতে হবে। কিছু ওষুধ দিলেন।
সবকিছু সামাল দিয়ে চলা দিন দিন মুশকিল হয়ে উঠলেও আমার থামলে চলবে না। কিছুক্ষণ আগে রামানন্দ কলেজ থেকে ফোন করে জানতে চাইছিল, ৮ মার্চ বলার জন্য আমি কিছু বিষয় ঠিক করেছি কিনা। আমি না বলাতে, বলল ঠিক আছে ম্যাম, বিষয় উল্লেখ করছি না। আপনি আপনার মত বলবেন।
আজ আবার ওনার শরীরটা খারাপ হয়েছে, হাঁটতে পারছেন না। তলপেটে প্রচণ্ড ব্যথা। ডাঃ দাস বললেন, ‘ওখানেই কোন ইউরোলজিস্টকে দেখান’। খুড়তুতো ভাই,খোকন(ই এন টি)অ্যাপয়েন্টমেন্ট নিয়ে দিলে, ডাক্তারকে দেখালাম। উনি কিছু ওষুধ ও কয়েকটা টেস্ট লিখে দিলেন। রাতে মেজদার শ্যালক এসেছিল ওর ছেলে মেয়ের আকিকাতে(নামকরণের অনুষ্ঠান) নিমন্ত্রণ জানাতে। সারা সারা রাত কীভাবে কাটছে, তা আমিই জানি। হাঁটাচলা বন্ধ হয়ে যাওয়া বেশি সমস্যা করছে। সকালেই স্পন্দনে নিয়ে গিয়ে ইউজিসি করে নিয়ে এলাম, রিপোর্ট নিয়ে এল চন্দ্রিমা। সামনের শনিবার ডাকটার মেদিনীপুরে বসবেন যখন তখন রিপোর্ট দেখবেন।
আজও হাঁটতে পারছে না, ভুল বকছে, বার বার টয়লেট যাচ্ছে। এবার দেখছি একটা আয়া রাখতেই হবে। এইসবের মধ্যেই একটা লেখা তৈরি করলাম। গতকাল কথা বলে আজ মেল করেছি। পছন্দ হবে কি না জানিনা। এই মানসিক অবস্থা, তার ওপর সময়ের অভাব। এভাবে কি লেখা যায়?
ডায়ালিসিসে নিয়ে এসেছি, দেখা যাক কী পরিবর্তন হয়। নার্সিংহোম থেকে শীর্ষকে ফোন করে জানলাম, লেখাটি ওদের পছন্দ হয়েছে। কবে যাবে সেটা বলল না। বিশ্বনাথ বাবুকে বলে রাখতে হবে। আজ অনেকদিন পর অশোক গাঙ্গুলির সঙ্গে কথা হল। নার্সিংহোম থেকে ফিরে দেখছি উনি বেশ সুস্থ। একা একা ছাদে গিয়ে ঘুরে এলেন। বিকেলে ঘুমিয়েছিলেন, ৭ টার সময় ওঠালাম। বার ঘুমিয়েছে, ১০টায় উঠিয়ে খাইয়েছি। সারারাতও ঘুমিয়েছে। ডাক্তার রিপোর্ট দেখে বললেন, সোডিয়াম কমে যাওয়াতে এটা হয়েছে।
আনন্দবাজারের লেখাটা নিয়ে খুব চাপে ছিলাম, আজ( রাতের মধ্যে পাঠাতে হবে। লেখটা প্রায় শেষ করে এনেছি। এখন উঠতে হবে। বিদ্যাসাগর হলে আজ একটি নতুন সংগঠন ‘আওয়াজ’ এর অনুষ্ঠান আছে। ধর্ম, ভাষা, শিক্ষা ইত্যাদি দিক দিয়ে যারা সংখ্যালঘু, তাদের নিয়ে এই সংগঠন। কার্ড পাঠিয়েছে, গাড়িও পাঠিয়েছে। তাই যেতেই হল এবং ছোট্ট বক্তব্যও রাখতে হল। সন্ধ্যায় ফিরে লেখাটা শেষ করে আনন্দবাজারে মেল করলাম। আজই আনন্দবাজারের সাংবাদিক বরুণ ফোন করেছিল। পরশু রাতে এক আদিবাসী মহিলা গ্যাং রেপের শিকার হয়েছে। তাই শহরের নিরাপত্তার বিষয়ে আমার মতামত জানতে চাইল।
আজ ৮মার্চ, আন্তর্জাতিক নারীদিবস, স্বপ্নার সঙ্গে গাড়িতে ওর কলেজে চলেছি। মেদিনীপুর কলেজের অধ্যাপিকা আপরনিতা ট্রেনে যাচ্ছে। আমাদের কিছু পরে ও এসে পৌঁছাল। অনুষ্ঠান শুরু হল প্রদীপ জ্বালিয়ে। বিষ্ণুপুরের লন্ঠন বিখ্যাত, প্রদীপটিও লন্ঠনের ভিতরে। বাতাসে নিভে যাবে না। অপরনিতা আগে বলল, তারপর আমি। আমি যেমন বলি তেমনই বললাম। স্বপ্না বলল, দিদি আপনার কাছে মাঝে মাঝে যেতে হবে। অনেকেই এসে প্রণাম করল, ফোন নাম্বার নিল। লাঞ্চের পর আমি আর অপরনিতা গাড়িতে ফিরলাম। স্বপ্না আসতে পারল না। বলল,আমি চলে গেলে এখুনি কলেজে তালা পড়ে যাবে। একটা কথা বলাই হয়নি, আজ অনলাইন আনন্দবাজারে আমার লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে। আমি যখন বিষ্ণুপুর পৌঁছেছি সেই সময় অঞ্জনের ফোন পেলাম,- দিদি লেখাটা ঠিক আছে তো? বল্লাম, আমি বাইরে, তাই লেখা দেখা হয়নি। পরদিন সৌনক বলল, আনন্দবাজারের লেখাটায় প্রচুর লাইক ও কমেন্ট দেখলাম। নারী দিবসের কথা মাথায় রেখে লেখা আজকের আর্টিকেলটির শিরোনাম ‘তিন তালাক আইন নিয়ে বহু প্রশ্নের উত্তর এখনও অজানা’।
রাতে কী স্বপ্ন দেখেছি মনে পড়ছে না, ভিতরটা কেমন অস্থির অস্থির লাগছে। দুপুরে খুব কাঁদলাম। অসুস্থ স্বামী ও ঘরে ঘুমিয়ে আছে। ছেলেমেয়ে কেউ কাছে নেই, আমি একা। একসময় নিজেই শান্ত হলাম। তাপসকে ফোন করে আনন্দবাজারের কমেন্টসগুলো ওদের ফেসবুকে খুঁজে পেলাম। ২৮৩ টা লাইক, ১৮৫টা কমেন্টস, ২৬টা সেয়ার হয়েছে। বাংলাদেশর কিছু গোঁড়া মুসলিম আর পশ্চিমবঙ্গের কিছু হিন্দু পরস্পরকে কাদা ছোঁড়াছুঁড়িও করেছে।
এসবের মধ্যেই খান সাহেবের ডায়ালিসিস চলছে। কোনদিন ভাল তো কোনদিন খারাপ থাকছেন। খাবার পর বমি হয়ে যাচ্ছে। গতকাল আনন্দবাজারের তাপস সিংহ আমার প্যানকার্ড ও চেকের ছবিসহ ব্যাঙ্ক ডিটেলস মেল করতে বলেছে। কবি নির্মাল্য বলেছিল, অনলাইনে লেখার জন্য আনন্দবাজার ভাল সাম্মানিক দেয়। অঞ্জন কিন্তু কোনদিন কিছু পাঠায়নি। আমি সঙ্কোচের কারণে কিছু বলতে পারিনি। এদিকে বাড়িতে একটার পর একটা জিনিস খারাপ হচ্ছে। কত দিক সামলাব? কেন্টের ভিতরে পাইপ ফেটে গেছল। আজ সারানো হল। চিমনিটা আর চলবেনা, নতুন কিনতে হবে।
আজ এই অভাগা অভাগিনীর ৪৯তম বিবাহবার্ষিকী। আমরা এখন আর এসব মনে রাখি না। চন্দ্রিমাটা নাছোড়বান্দা, সন্ধ্যাবেলা কেক, মিষ্টি, ফুলেরতোড়া সেইসঙ্গে জারার বিভিন্ন বয়সের ছবির কোলাজ করে, সেটা ল্যামিনেসন করেছে, আমাদের দুজনের ছবি দেওয়া দুটি কাপ, এই সমস্ত নিয়ে এসেছিল।
ক্রমশ
0 Comments