জ্বলদর্চি

মেদিনীপুরের কৃষিবিজ্ঞানী ড. রামচন্দ্র মণ্ডল-এর বর্ণময় জীবনের উত্থান-পতনের রোমহর্ষক কাহিনী /উপপর্ব — ১৫ /পূর্ণচন্দ্র ভূঞ্যা

বিজ্ঞানের অন্তরালে বিজ্ঞানী — ৮০

এগ্রিকালচারাল রেটুনিং

মেদিনীপুরের কৃষিবিজ্ঞানী ড. রামচন্দ্র মণ্ডল-এর বর্ণময় জীবনের উত্থান-পতনের রোমহর্ষক কাহিনী

উপপর্ব — ১৫

পূর্ণচন্দ্র ভূঞ্যা

'পরিচয় করিয়ে দিই। ইনি রামচন্দ্র মণ্ডল। খেজুরীর বিধায়ক।' 
'নমস্কার, স্যার। বসুন' — টেবিলের উল্টোদিকে দাঁড়িয়ে থেকে যে ভদ্রলোক আন্তরিক শুভেচ্ছা জ্ঞাপন করলেন, তিনি কৃষ্ণনগর মনীন্দ্রনাথ হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক ড. প্রবালকান্তি হাজরা।
প্রতি নমস্কার জানিয়ে চেয়ারে বসে পড়লেন বিধায়ক মশাই। যিনি পরিচয় করিয়ে দিলেন, বাক্য শেষ করে তিনি একটু থামলেন। দম নিয়ে বৃহস্পতিবাবু আবারও শুরু করলেন – 'খেজুরীতে কলেজ গড়ার জন্য স্কুলে স্কুলে শিক্ষক মশাইদের কাছে সাহায্যের জন্য আবেদন নিয়ে এসেছি।'
'আগে বসুন, স্যার। আমি একটু টিফিন আনাই' – হেড মাস্টার মশাই ব্যস্ত হয়ে পড়লেন।
'আমরা এখন পাশের স্কুলে যাবো। সেখান থেকে ফিরে এসে আপনার স্কুলে শিক্ষক শিক্ষিকাদের সঙ্গে মিলিত হব' — বৃহস্পতিবাবুর চটজলদি প্রত্যুত্তর। বেলা তখন সকাল সাড়ে দশটা। জানুয়ারি মাস। ১৯৯৮ সাল। শীতের সকাল। সূর্যদেবের দেখা মিললেও সে-তেজ একদম নেই। উত্তুরে বাতাসে এখনও হালকা ঠাণ্ডা আমেজ। গাঁ-গঞ্জের ছেলে মেয়েদের গায়ে গরম পোশাক খুব একটা নেই। স্কুলের ইউনিফর্ম টুকুই সম্বল। তাতেই ওরা ছুটোছুটি করছে। ছোটাছুটিতেই গা গরম হয়ে যাওয়ার কথা। বিদ্যালয়ে প্রার্থনার ঘণ্টা বাজল। জাতীয় সংগীত গাওয়ার পরে বিদ্যালয়ে পঠনপাঠন শুরু হব হব করছে। পাশের স্কুল থেকে ফিরে আসতে দুপুর গড়িয়ে যাবে সন্দেহ প্রকাশ করেন হেডস্যার। শীতকালের বেলা নাকি দ্রুত শেষ হয়। সাতপাঁচ ভেবে প্রবাল বাবু ঈষৎ আবদারের সুরে বলে উঠলেন — 'তাহলে হোস্টেলে রান্না করে রাখি, ফিরে এসে খাবেন।'
'আসলে যেখানে যাচ্ছি, সেখানে খাওয়ার ব্যবস্থা হবে। ওই বিদ্যালয়ের প্রধান আমার অনুরাগী মানুষ কিনা' — বাক্যটা শেষ করে স্মিত হাসলেন বৃহস্পতিবাবু। আর এক প্রস্থ নমস্কার-প্রতি নমস্কারের পর্ব সাঙ্গ করে রামবাবু ও অন্যান্যরা পাশের স্কুলে চলে গেলেন। প্রবালকান্তি বাবু অতিথি বর্গের চলে যাওয়া পথের দিকে চেয়ে রইলেন বেশ কিছুক্ষণ। শুরু হল বিদ্যালয়ের লেখাপড়া। তিনি ব্যস্ত হয়ে পড়লেন কাজকর্মে। কাজের চাপে বেমালুম বিস্মৃত হয়ে গেছেন অতিথিগণের কথা। তাদের ফিরে আসার প্রতিশ্রুতি। 

বৃহস্পতিবাবুর পুরো নাম বৃহস্পতি মণ্ডল। কশাড়িয়া বাণীতীর্থ হাইস্কুলের ছাত্র ছিলেন। ১৯৫৫ সাল থেকে রামবাবুর সঙ্গে তার আলাপ পরিচয়। দুজনের অভিন্ন দাদা - ভাই সম্পর্ক।

ঘড়িতে কাঁটায় কাঁটায় তখন দুটো বাজে। মধ্যাহ্ন সূর্যের আলোয় সে তেজ আর নেই। বায়ুতে অল্প বিস্তর হিমের ছোঁয়া। হু হু বইছে শীতল বাতাস। মধ্যাহ্নকালীন ছায়া দীর্ঘ হচ্ছে। শোয়েটার গায়ে চাপিয়ে হেড মাস্টার প্রবাল বাবু নিজের অফিসে কাজে ব্যস্ত। বাইরে একদল ছাত্র চিৎকার চেঁচামেচি করছে। কেউ কেউ ডাংগুলি খেলায় মত্ত। এখন টিফিন চলছে। কাজের চাপে ভুলেই গিয়েছিলেন, কখন ঘড়িতে বেলা দুটো বাজে। আগন্তুক অতিথি অভ্যাগতদের ফিরে আসার কথা বেমালুম স্মরণে নেই। অফিসে বসে তিনি ভাবুক বনে গেলেন ক্ষণিকের জন্য। জানলার ভিতর দিয়ে তাঁর দৃষ্টি দূরে নিক্ষিপ্ত।
        
আনমনে দূর থেকে তিনি দেখতে পাচ্ছেন অতিথিরা তাঁর অফিস মুখো হনহন হেঁটে ক্রমশ সামনে আসছে। তাঁদের অবয়ব ক্রমশ বড় হচ্ছে। দরজায় টোকা পড়তেই সম্বিত ফিরল প্রধান শিক্ষকের। ফিরে এসে অব্দি অতিথিগণের একরাশ বিষন্নতা। কারণ, পাশের স্কুলে তিক্ত অভিজ্ঞতা। সকলের মুখ চোখ শুকিয়ে কাঠ। তখনও দুপুরের খাওয়া হয়নি। জিজ্ঞাসার ঢঙে প্রবালকান্তি বাবু বললেন —
'আমি হোস্টেলে ভাতে ভাত রান্না করতে বলে দিই?'

তাঁরা রাজি হলেন না। এখান থেকে আবার অন্য স্কুলে যাবেন। স্কুল ছুটির আগে সেখানে পৌছতে পৌছতে বেলা গড়িয়ে যাবে। খামোখা বিলম্ব হবে। তার চাইতে চটজলদি আলোচনায় বসা-ই শ্রেয়। হেড মাস্টার মশাই শশব্যস্ত। পাশের দোকান থেকে তড়িঘড়ি কিঞ্চিৎ মিষ্টি এনে টিফিন করালেন সবাইকে। টিফিন পর্ব সেরে বিদ্যালয়ের শিক্ষক মশাইদের সঙ্গে আলাপ আলোচনার পর্ব শুরু হল। খেজুরী ব্লকে কলেজ গড়তে সাহায্যের জন্য অনুরোধ করলেন বিধায়ক রামবাবু। একবাক্যে সবাই রাজি। সকলে সম্মত হলেন অর্থ সাহায্য করতে। অতিথিদের একান্ত অনুরোধ —
'প্রবালকান্তি বাবু, আপনাকে হাজার টাকা দিতে হবে।'
রাজি হলেন প্রধান শিক্ষক। মিটিং-এ তিনি রামবাবুর কাছে একটা শর্ত রাখলেন —
'কলেজ খোলা হলে সেখানে গতানুগতিক বিএ, বিএসসি না পড়িয়ে যেন এই অঞ্চলের উপযোগী বিষয় কৃষি-মাছ চাষ, টেকনিক্যাল কিছু বিষয় পঠনপাঠনে জোর দেওয়া হয়। তাহলে কলেজ পাস করে ছেলে মেয়েরা বেকার না থেকে হাতে কলমে শিক্ষা বিষয়কে অবলম্বন করে স্বাবলম্বী হতে পারবে।'
রামবাবু বেজায় খুশি। হেড স্যারের প্রস্তাবে তিনি রাজি। সম্মতিসূচক ঘাড় নেড়ে সন্তোষ ব্যক্ত করলেন তিনি। ঘড়িতে তিনটে বাজল। আলোচনা সমাপ্ত। এইবার গন্তব্য অন্য স্কুল। এইভাবে স্কুলে স্কুলে গিয়ে কলেজের জন্য অর্থ সংগ্রহ করেছেন তিনি। কোথাও বাধাপ্রাপ্ত হয়েছেন। আবার কোথাও দারুণ অভ্যর্থনায় যারপরনাই আপ্লুত তিনি।
দীর্ঘ তিরিশ বছর ধরে নিয়মিত : জ্বলদর্চি। 
জ্বলদর্চি অ্যাপ ডাউনলোড করে নিন।👇
🍂
(২)
১৯৮৯ সাল। তাঁর চাকুরী জীবনে সদ্য ছেদ পড়েছে। অবসর। অবসর। এখন তাঁর অনন্ত অবসর সময়। কীভাবে কাটবে তাঁর অবসরের দিনগুলি? চিরাচরিত অলসতায়, নাকি অন্তহীন কাজের ভীড়ে? আকাশে ধবল বক যে রূপে খুঁজে বেড়ায় নতুন ঠিকানা, ঘুরে বেড়ায় সারাদিন; এতদিন ঘরের বাইরে সেভাবেই তাঁর দিন কেটেছে। দিনের শেষে ধবল বকের মতো স্বগৃহে ফিরতে কার না ইচ্ছে হয়? তাই চাকরি থেকে অলস অবসরের অনুভূতি মিলিয়ে যাওয়ার আগে এক অকৃত্রিম আকর্ষণ অনুভব করলেন ষাটোর্ধ্ব রামচন্দ্র বাবু। ঘরের ছেলে ঘরে ফিরল। জন্মভূমির প্রতি টান। বড় কঠিন সে টান! দমন করা যায় না, এমন আকর্ষণ! সে-টানেই সুদূর দক্ষিণ ভারত থেকে অবসর নিয়ে পাকাপাকিভাবে নিজের গ্রামে তাঁর ফিরে আসা। সেটা ১৯৯৪ – ১৯৯৫ সালের কথা। দেশ ও দশের সেবায় উন্নয়নমুখী কাজের ভাবনা তাঁর মনে। কশাড়িয়া গ্রামে তাঁর পৈত্রিক সম্পত্তি। বাপ-ঠাকুরদার সাত পুরুষের ভিটা মাটি। সেই মাটিতে নির্মিত হল ছোট্ট একখান পাকাঘর। কশতলা হাইস্কুলের কাছে পাকা রাস্তার ধারে সে-ঘরই তাঁর বর্তমান নিবাস। পাকা ঠিকানা। রামচন্দ্র বাবুর দুই ছেলে আর এক মেয়ে। সকলেই পাকাপাকি ভিন রাজ্যের বাসিন্দা। ব্যাঙ্ক কিংবা এগ্রিকালচারাল ফার্মে উঁচু পদে কর্মরত। কিন্তু শেষ বয়সটা গ্রামের বাড়িতে অতিবাহিত করার বাসনায় অটল বিজ্ঞানী। শিক্ষিত বেকার বিশ্বতোষ মণ্ডল তাঁর আপন ভাইয়ের বড় ছেলে। জীবিকা নির্বাহের জন্য খেজুরী বটতলায় একটি মুদি দোকানের ব্যবস্থা করে দিলেন বড় ভাইপোকে। সেই মুদি দোকানের পেছনে একটা লাইব্রেরী স্থাপনার উদগ্র বাসনা তাঁর। লক্ষ্য স্থানীয় জনগণকে শিক্ষিত করে তোলা। এলাকার দুঃস্থ ছেলে মেয়েদের জন্য পাঠাগার গড়ার প্রয়োজন অনুভব করলেন তিনি। গরীব স্টুডেন্টদের পড়াশুনার জন্য মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক ক্লাসের পাঠ্যবই, ব্যকরণ বই সংগ্রহ করে গড়ে উঠেছিল একটি বুক ব্যাঙ্ক (Book Bank)। পুস্তক বিপণি। বইয়ের এ হেন ব্যাঙ্কে ঠাঁই পেত সেই সমস্ত বই, যে-গুলি বছর বছর পাল্টায় না। সময় পাল্টায়, কিন্তু বদলায় না বই। বইয়ের গুরুত্ব। অতএব, শুরু হল বই সংগ্রহের পালা। জমে উঠল পুরনো আর নতুন বইয়ের সম্ভার। কলেজ স্ট্রিটের বইপাড়ার ফুটপাতে চলল বই সংগ্রহের কাজ। বিশিষ্ট লেখক লেখিকার পুরাতন দুষ্প্রাপ্য বই, নতুন বই, আরও কত কি বই। স্থানীয় যারা বিয়ের উপহার বা পুরস্কার স্বরূপ বই পেয়েছে, তাদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে তিনি বইগুলো সংগ্রহ করতেন। বই মেলায় শিশুসাহিত্য, মজার মজার আধুনিক লেখা বইয়ে ভরে উঠল পাঠাগার। মাস চারেক কিংবা পাঁচেকের মধ্যে দেড় হাজার বইয়ের বিপুল সম্ভারে সমৃদ্ধ হয়ে ভরে গেল পাঠাগার। জনসাধারণের ভরসার প্রতীক 'খেজুরী সার্বিক পাঠাগার'। 
        
পাঠাগারটি পরে 'খেজুরী সার্বিক উন্নয়ন সমিতি'র অন্তর্ভূক্ত করা হয়। উন্নয়ন সমিতি'র সম্পাদক লাইব্রেরীর গ্রন্থাগারিকের সাময়িক দায়িত্ব সামলেছিলেন। ক'দিন পর একজন অভিজ্ঞ বেতনভুক লাইব্রেরিয়ান নিযুক্ত করা হয় এবং লাইব্রেরীর রেজিষ্ট্রেশন করানো হয়। রেজিষ্ট্রেশন নম্বর S/76956। যে উৎসাহ ও উদ্যোগ নিয়ে দেড় হাজার মত বই সংগৃহীত হয়েছিল এবং গ্রাহক সংখ্যা পঞ্চাশের উপর পৌঁছেছিল, বছর ঘুরতে না ঘুরতেই সেই উৎসাহ উদ্দীপনায় ভাটা পড়ে গেল। সময়ের স্থবির চাকায় আটকে গেল অভিমুন্যর বীরগাথা। এক বছরের বেশি সময় চলার পর লাইব্রেরিয়ান চলে গেলেন। ঢিলেমি গ্রাস করল পরিচালন ব্যবস্থায়। পরিচালনার অব্যবস্থার ফলে বন্ধ হয়ে গেল পাঠাগার। ১৯৯৬ সালের দিকে। রামচন্দ্র বাবুর একটি স্বপ্নের অকাল মৃত্যু ঘটল। দমবার পাত্র তিনি নন। অসীম ইচ্ছা শক্তি সম্বলিত করে তাঁর উল্কা গতির উত্থান। দু-একটা তারা খসে পড়লে কষ্ট হয় বৈকি! তবে, বেদনা তো ক্ষণস্থায়ী। তাকে জয় করার কৌশল জানতে হয়। তিনি অন্য ধাতুতে গড়া। আঘাত সইতে সইতে, জীবনে ধাক্কা খেতে খেতে তিনি যেন সাক্ষাৎ লৌহপুরুষ বনে গেছেন। তাই হাজার আঘাতেও তিনি অটুট। অক্ষয়। অমর।

(৩)
দিনটা ছিল রবিবার। ২৫শে সেপ্টেম্বর, ১৯৮৩ সাল। সেদিন খেজুরীর কলাগেছিয়া জগদীশ বিদ্যাপীঠে একটি আলোচনা সভা বসল। মিটিং-এর আহ্বায়ক খেজুরীর তৎকালীন বিডিও আবদুল মতিন এবং কাঁথির তৎকালীন এসডিও। আলোচনায় হাজির স্বাধীনতা সংগ্রামী থেকে বিধায়ক-সহ খেজুরীর একঝাঁক শিক্ষানুরাগী মানুষ। স্বাধীনতা সংগ্রামী ডাক্তার রাসবিহারী পাল, বলাইলাল দাস মহাপাত্র, সত্যব্রত মাইতি প্রমুখ বিশিষ্টজনের ভীড়। সর্বমোট পঁচানব্বই জন শিক্ষানুরাগী উপস্থিত ছিলেন সেদিনের সভায়। সভায় সভাপতিত্ব করেন অখণ্ড মেদিনীপুর তথা দেশের বিশিষ্ট স্বাধীনতা সংগ্রামী ও প্রাক্তন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী শ্রীমতী আভা মাইতি মহাশয়া। আলোচনার বিষয়বস্তু পূর্ব নির্ধারিত। খেজুরীতে কলেজ গড়ার জন্য স্থান নির্ধারণের একখানা প্রস্তুতি কমিটি গঠন। 

খেজুরীর তৎকালীন বিধায়ক ছিলেন সুনির্মল পাইক। তিনি উদ্যোগী হয়েছিলেন খেজুরী থানার বুকে একখানি বৃত্তিমূলক কলেজ স্থাপনের লক্ষ্যে। সেবছরের গোড়ায় সুনির্মল বাবু হাজির হলেন মেদিনীপুর কালেক্টরেট অফিসে। সঙ্গী খেজুরীর দুজন সাংবাদিক বন্ধু। নিজের বিধানসভা এলাকায় কলেজ গড়ার লিখিত আবেদন করলেন মেদিনীপুর জেলার তৎকালীন জেলাশাসক অমিতকিরণ দেব মহাশয়ের কাছে। জেলাশাসক অত্যন্ত ভালো মানুষ। তিনি সঙ্গে সঙ্গে রাজি। কলেজ গড়তে সম্মত হলেন। বিধায়কের আবেদনে সাড়া দিয়ে অমিতকিরণ বাবু নির্দেশ পাঠিয়ে দিলেন কাঁথির মহকুমা প্রশাসক আর খেজুরীর (অখণ্ড) বিডিও সাহেবকে। তিনি নির্দেশ দিয়েছেন কলেজ গড়ার লক্ষ্যে একটি প্রস্তুতি সভা ডাকতে। সেই উপলক্ষে পঁচিশে সেপ্টেম্বর কলেগেছিয়া হাইস্কুলে উপস্থিত একঝাঁক গণ্যমান্য ব্যক্তি।

এযাবৎকাল অব্দি একটিও সরকারী ডিগ্রি কলেজ গড়ে ওঠেনি খেজুরীর বুকে। অথচ কান পাতলে শোনা যায় হাহাকার। চোখ খোলা রাখলে ভালো মতন টের পাওয়া যায় এলাকায় শিক্ষিত যুবকের আর্তনাদ। লেখাপড়ার জন্য এলাকার দ্বাদশ উত্তীর্ণ বিদ্যার্থীদের কৃচ্ছ্রসাধন। উচ্চতর শিক্ষা লাভের আশায় প্রায়শই তাদের পাড়ি দিতে হয় হলদিয়া, কাঁথি কিংবা সুদূর মেদিনীপুর। কাছেপিঠে আর কোনো কলেজের নামগন্ধ নেই। তাই খেজুরীর উন্নয়নের স্বার্থে সবাই একবাক্যে রাজি। সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয় কলেজ স্থাপনের জন্য স্থান নির্বাচনে একটি প্রস্তুতি কমিটি। জোরকদমে এগোতে থাকে কাজ। কিন্তু একখানা ভালো কাজের মধ্যে একফোঁটা চোনা থাকবে না, সে কি হয়? প্রস্তুতি কমিটি কাজ আরম্ভ করতেই শুরু হয়ে গেল কিছু অশুভ শক্তির বিরোধিতা। কাজ যত এগোয়, শাসক দলের তরফে বাধা তত বাড়তে থাকে। অথচ, বারাতলায় এক লপ্তে বিস্তর জমি মিলে গেল বিনা বাধায়। স্রেফ দান হিসেবে। ওদিকে, শিক্ষা দফতর থেকে সবুজ সংকেত এসে গেছে কলেজ গড়ার জন্য। তাহলে স্থানীয় শাসক দলের নেতাকর্মীদের এত কিসের অনীহা? এলাকায় শিক্ষার আলো জ্বালাতে কীসের এত আপত্তি? কারণ আজ পর্যন্ত অজানা। কিন্তু যা হবার তাই হল। খামোখা ষোল-সতেরো বছর পিছিয়ে গেল খেজুরীতে সরকারী ডিগ্রি কলেজ গড়ার স্বপ্ন। 
         
পয়লা সেপ্টেম্বর ১৯৯৯। বুধবার। এই সেই শুভ ক্ষণ। খেজুরীবাসীর অধরা স্বপ্ন সাকার করার প্রিয় একটা দিন। বহু কাঠ খড় পুড়িয়ে খেজুরীর বুকে গড়ে উঠেছিল প্রথম ডিগ্রি কলেজ 'খেজুরী কলেজ'। ইঁটের দেওয়াল ঘেরা টালির ছাউনি ঘরে শুরু হয়েছিল লেখাপড়া। প্রথম বছর সাকুল্যে ২১৩ জন ছাত্র ছাত্রী। বিধায়কের আসনে তখন সর্বজন শ্রদ্ধেয় বৈজ্ঞানিক রামচন্দ্র মণ্ডল। তাঁর ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় শুরু হল কলেজের পথ চলা। তিনি কলেজের কার্যনির্বাহী অধ্যক্ষ। কিন্তু কলেজ শুরুর আগে রামবাবুর অভিজ্ঞতা মসৃণ ছিল না। অনেক বাধা-বিপত্তি-উপেক্ষা-কষ্ট-যন্ত্রণা সহ্য করতে হয়েছে তাঁকে। তবে কখনও হার বা কারও বশ্যতা স্বীকার করেননি। রোজ ঘুরে বেড়িয়েছেন কলেজের জন্য অর্থ সংগ্রহ করতে। প্রতিদিন খেজুরীর কোনো না কোনো গ্রাম পঞ্চায়েত এলাকায় হাজির হয়েছেন কারও সাইকেল কিংবা মোটর সাইকেলের পিছনে বসে। কলেজ গড়ার স্বার্থে হাত পেতেছেন মানুষের কাছে। শত কষ্টে দমে যাননি। এমনও ঘটনা ঘটেছে যে, পঞ্চায়েতে বিভিন্ন পর্যায়ের দলীয় প্রতিনিধিগণ কলেজের জন্য নির্ধারিত চাঁদা তুলে সে টাকা আর জমা করেনি, নিজেদের পকেট ভরেছে। এমনকি মহকুমার একটি সংবাদপত্র খেজুরী কলেজকে বিধায়কের গোয়াল ঘরের সঙ্গে তুলনা করে টিটকারি করেছে। তাঁর সম্পর্কে মন্দ-ভালো লিখেছে। তিনি গায়ে মাখেননি। শুধুমাত্র উপেক্ষা করেছেন। এড়িয়ে চলেছেন। যুক্তি -প্রতিযুক্তির মিথ্যে ফানুস ওড়াননি। নীরব থেকেছেন। প্রত্যুত্তর দেননি। কটুক্তি হজম করেছেন। রাগ সংবরণের সীমাহীন যে কৌশল তাঁর অনায়াস করায়ত্ত, তা শিক্ষনীয় একটি বিষয়! সকল গঞ্জনা মাথায় নিয়ে রোজ রোজ সকাল ছ'টা - সাড়ে ছ'টায় তিনি কলেজে হাজির হয়েছেন। নির্দ্বিধায় কলেজে ছেলেমেয়েদের পড়িয়েছেন। অস্থায়ী প্রিন্সিপালের গুরু দায়িত্ব সামলেছেন। সারাদিনের হাড়ভাঙা কাজের পর সন্ধ্যে ছ'টায় বাড়ি ফিরে নিজে রান্না বসিয়েছেন। নিজের জামা কাপড় নিজের হাতে কেচেছেন। আবার বিধায়কের দায়িত্ব পূর্ণমাত্রায় সামলে চলেছেন। নিঁখুতভাবে জনসংযোগ রক্ষা করে চলেছেন।

কলেজে সারাদিন রামচন্দ্র বাবুর অত্যন্ত ব্যস্ততায় কাটে। কাজের চাপে খাওয়ার সময় অমিল। আটপৌরে সাদাসিধে জীবন যাপন তাঁর জীবনের মোক্ষ। দুপুর বেলায় কলেজের একটি রান্নাঘরে শাকভাজা, জলের মতো স্বচ্ছ ডাল আর কুচো চিংড়ি মাছের তেঁতুলের টক দিয়ে দ্বিপ্রাহরিক আহার সারতেন তিনি। তারপর এগ্রো সার্ভিসে ন্যূনতম গোটা চারেক ক্লাস নিতেন। প্রশাসনিক কাজকর্মে তিনি দারুণ দড়। কাজের এত শক্তি তাঁর কোত্থেকে আসে? বয়স পেরিয়েছে বাহাত্তরের গণ্ডি। অথচ চোখে মুখে দেহে একফোঁটা বয়সের ছাপ নেই। বয়স থাবা বসায়নি শরীরে ও মনে। ২০০১ সাল অব্দি নিয়মিত ক্লাস করে গেছেন নির্দ্বিধায়। নূতন প্রিন্সিপাল আসার আগে পর্যন্ত তিনি অক্লান্ত পরিশ্রম করে গেছেন কলেজটিকে শক্ত খুঁটির উপর দাঁড় করাতে। পাশাপাশি স্কুল বা কলেজ থেকে ধরে ধরে শিক্ষক এনেছেন কলেজে পড়াতে। রামচন্দ্র বাবুর মুখের দিকে তাকিয়ে তাঁরা কেউ না বলেননি। বিনা বেতনে কলেজে পড়িয়ে গেছেন শনিবার স্কুল ছুটির পর এবং সপ্তাহের একমাত্র ছুটির দিন রবিবারে। রামবাবুর চা পানে অথবা মশলা যুক্ত মিষ্টি পান ভক্ষণে তীব্র অরুচি। ধূমপান! অ্যালকোহল পান! নৈব নৈব চ। এসব নাকি শরীরের অবাঞ্ছিত বস্তু! তা গ্রহণ করলে শরীর নামক শুদ্ধ মন্দিরখানি অপবিত্র হয়। এমন পবিত্র আধ্যাত্মিক ভাবনা চিন্তায় আচ্ছন্ন তাঁর নিষ্কলুষ মন। তিনি আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন একজন কৃষি বিজ্ঞানী। অথচ, সম্পূর্ণ নিরহংকার। আটপৌরে গ্রামের জীবন তাঁর ব্রত। দশের সেবায় নিয়োজিত এক মহাপ্রাণ তিনি। প্রণিপাত করি এ হেন অনন্ত কর্মোদ্যম ও পরোপকারী মানুষটিকে।  (ক্রমশ...)

তথ্য সূত্র :
• প্রণম্য বৈজ্ঞানিক ড. রামচন্দ্র মণ্ডল মহাশয়
• শ্রী সুদর্শন সেন বিশিষ্ট শিক্ষক ও আঞ্চলিক
   ইতিহাস গবেষক
• 'মনীষী ড. রামচন্দ্র মণ্ডল' – সম্পাদনা শ্রী জয়দেব
    মাইতি ও শ্রী সুব্রতকুমার মাঝি

Post a Comment

0 Comments