জ্বলদর্চি

শব্দে গাঁথা মণি-মালা : ৬ / সালেহা খাতুন

শব্দে গাঁথা মণি-মালা : ৬ 

সালেহা খাতুন 

আমার শিক্ষাদীক্ষার গোড়াপত্তন বাড়ির কাছের যে প্রাইমারি স্কুলে তার নামটাই তো বলিনি। চারদিক খোলা সামনে উন্মুক্ত মাঠ সম্বলিত স্কুল “সন্তোষপুর বোর্ড প্রাথমিক বিদ্যালয়”। এখন চেনার উপায় নেই। চারধারে প্রাচীর দিয়ে একে অচলায়তন বানিয়ে তোলা হয়েছে। আগে সেখানে ক্লাস ফোর পর্যন্ত পড়ানো হতো। এখন পড়ানো হয় ক্লাস এইট পর্যন্ত। 
পড়াশোনার অগ্রগতিতে আনন্দ হলেও খেদ এই যে সবুজের সমারোহ দূরে সরিয়ে কংক্রিটের জঙ্গল বানিয়ে তোলা হলো। যে মাঠে আমাদের শৈশব কেটেছে নানান খেলাধুলায় – কুমিরডাঙ্গা, বউবসন্ত, কবাডি কিতকিত ইত্যাদি নানানভাবে আজ সেখানে গেটে পড়েছে তালা। জানিনা ভেতরে কী হচ্ছে খেলা। 

খেলার কথায় মনে চলে এলো আমরা যখন ফোরে তখন নতুন মাস্টারমশাই সুনীল বাবু এলেন। তিনি অন্যান্য স্যারদের তুলনায় বয়সে অনেক ছোটো। উদ্যমে ভরপুর। শুরু করলেন বাৎসরিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতা। প্রতি শুক্রবার খেলার ক্লাস। গাছ ওড়ে, পাখি ওড়ে, ট্রেন ওড়ে ইত্যাদি শব্দ উচ্চারণ করতেন আর আমাদের দুহাত প্রসারিত করে ওড়ার ভঙ্গিমা করতে হতো।

 ট্রেন ওড়ে বললেই আমরা হেসে ফেলতাম। কেননা ট্রেন তো ট্রাক বরাবর চলে। কিন্তু হায় এ সপ্তাহেই করমণ্ডল যে ট্র্যাক থেকে প্রায় উড়েই গেল। কত মানুষের প্রাণ নিল কেড়ে।
দীর্ঘ তিরিশ বছর ধরে নিয়মিত : জ্বলদর্চি। 
জ্বলদর্চি অ্যাপ ডাউনলোড করে নিন।👇
🍂
 স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের রোজকার যাতায়াত তো ট্রেনেই করেছি। খুব ছোটোবেলায় বাউড়িয়ার রেলের কোয়ার্টারে যাতায়াত ছিল। ওখানে আমার এক দিদি- দুলাভাই থাকতেন। মসুদিদির বর ট্রেন চালাতেন। তাই নিয়ে আমাদের খুব গর্ব ছিল। উলুবেড়িয়া কলেজে যখন পড়ছি ট্রেন থেকে নেমে বাউড়িয়া ডাউন প্লাটফর্মের ধার বরাবর হেঁটে চলে যাচ্ছি হঠাৎ কানের কাছে থেমে থাকা ট্রেনটা জোরে হর্ণ বাজালো। চমকে তাকিয়ে ট্রেনের মধ্যে চালকের আসনে দেখি ফজল দুলাভাই। কী আনন্দ হতো তখন।
 পরে ইউনিভার্সিটিতে যাওয়ার সময় কখনো কখনো ছুটে ছুটে ট্রেন ধরতে গিয়ে হাল ছেড়ে দিলে দেখতাম আমার কাছাকাছি এসে ট্রেনটা যেতো থেমে। ড্রাইভারের দয়ার নিদর্শন দেখে মনে মনে প্রীত হয়ে তাঁর মঙ্গলকামনা করতাম। হাওড়া স্টেশন থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সময় দেখতে পেতাম চালকের আসনে মসুদিদির বরই রয়েছেন। গুডস ট্রেন, এক্সপ্রেস ট্রেন  এবং লোকাল ট্রেন চালানোর ফারাকের কথা তাঁর কাছেই শুনেছিলাম।

 পশ্চিম বাউড়িয়ায় বড়ো পিসিমার বাড়ি গেলে তিনি তাঁর মেয়ে ফরিদা বুবুর বাড়ি বেড়াতে নিয়ে যেতেন। যাওয়ার পথে বাউড়িয়া-চেঙ্গাইলের মাঝে রেললাইনের ধারে উল্টে পড়ে থাকা লোকাল ট্রেনের কয়েকটি বগি দেখতে পেতাম। ওটাও ছিল ট্রেন দুর্ঘটনার ফল। ১৯৭৯ এর ১৮ মে আপ হাওড়া-খড়গপুর লোকালের সঙ্গে আপ হাওড়া ম্যাড্রাস মেলের কলিশন হয় ওই স্থানে। মিনিস্ট্রি অব রেলওয়ে পাবলিকেশনসেও এই তথ্য প্রকাশিত হয়েছে।

 একেবারে শৈশবে শুনেছি ওই ট্রেনে আমার বড়োমামা ছিলেন। আমি তখন মামার বাড়িতেই ছিলাম। দাদু দিদা রেডিওর খবর শুনে মুষড়ে পড়েছিলেন। বড়োমামা কে মেজোমামা ছোটোমামা খুঁজতে বেরিয়ে পড়েন। ভাগ্য সুপ্রসন্ন ছিল। বড়োমামা গভীর রাতে অক্ষত শরীরে বাড়ি ফিরে আসেন। বড়োমামা তখন হাওড়া হোমসে শিক্ষানবীশের কাজে নিযুক্ত ছিলেন। 

বড়োমামার বড়োমেয়ে তুলি আমার সমবয়সী। দুজনে একসঙ্গে খেলাধুলা করতাম এবং মারপিটও হতো। তুলি সন্ধ্যেবেলা পড়ার ভয়ে মামাকে বলতো "মামণি  আমার বুকে ঘুষি  মেরেছে তাই আমার বুক ব্যথা করছে পড়তে পারবো না"। সম্পূর্ণ বানিয়ে বলতো ও। কেননা আমার দুই হাতে তখন দগদগে ঘা, মেজো মেসো হোমিওপ্যাথি ট্রিটমেন্ট করছেন ওষুধ দিয়ে ঘা বাড়িয়ে দিয়েছেন তারপর কমাবেন। সবাই ওর চাতুরী ধরে ফেলতো। 
ওর সঙ্গে একবার চন্দ্রভাগ গার্লস স্কুলে গিয়েছিলাম, যে স্কুলে ও পড়তো এবং আমার মা মাসিরাও পড়েছেন। দিদিমণিরা আমাকে খুব স্নেহ করেছিলেন। আজ তুলি নেই। সন্তানের জন্ম দিতে গিয়ে ও-ও চলে গেছে। 

আসলে জীবন বড়ো ক্ষণস্থায়ী। শৈশবের সরল সুন্দর সম্পূর্ণ স্বর্গখানি মধ্য বয়সে আঘাত ও অনুতাপে দগ্ধ হতে থাকে। প্রভাতের স্নিগ্ধতা মধ্যাহ্ন তাপে খররৌদ্রে হয়ে যায় প্রখর। ভার বেড়ে যায় জীবনের।

(ক্রমশ)

Post a Comment

0 Comments