জ্বলদর্চি

মেদিনীপুরের কৃষিবিজ্ঞানী ড. রামচন্দ্র মণ্ডল-এর বর্ণময় জীবনের উত্থান-পতনের রোমহর্ষক কাহিনীউপপর্ব — ১৬/পূর্ণচন্দ্র ভূঞ্যা

বিজ্ঞানের অন্তরালে বিজ্ঞানী — ৮১
এগ্রিকালচারাল রেটুনিং

মেদিনীপুরের কৃষিবিজ্ঞানী ড. রামচন্দ্র মণ্ডল-এর বর্ণময় জীবনের উত্থান-পতনের রোমহর্ষক কাহিনী

উপপর্ব — ১৬

পূর্ণচন্দ্র ভূঞ্যা


(১)
রাজ্য বামফ্রন্টের শরীক দল ফরওয়ার্ড ব্লক। খেজুরী ব্লকে তখন এ হেন দলটির একচেটিয়া রাজত্ব ও সমর্থক। বিধানসভা ভোটে শাসক দলের নিশ্চিত জেতা একটি আসন। এলাকার বিধায়ক সুনির্মল পাইক। সময়টা ১৯৯৫–৯৬ সাল। সেবার বিধানসভা নির্বাচনে একজন যোগ্য নূতন মুখের সন্ধানে ফরওয়ার্ড ব্লক দলটির রাজ্য নেতৃত্ব। দলের মন্ত্রী মশাই কিরণময় নন্দ খেজুরীর উন্নতির স্বার্থে এক বলিষ্ঠ পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলেন। বিধানসভা নির্বাচনে টিকিট দিলেন একজন বর্ষীয়ান বৈজ্ঞানিক ড. রামচন্দ্র মণ্ডল স্যারকে। এর আগে পর্যন্ত আদ্যন্ত পরোপকারী রামচন্দ্র বাবুর দূর দূরান্ত পর্যন্ত কখনও রাজনীতির ছিঁটেফোঁটা সম্পর্ক ছিল না। শুধুমাত্র জনগণের সেবায় উন্নয়নমুখী কাজের গতি অক্ষুন্ন রাখতে তাঁর এ হেন সিদ্ধান্ত গ্রহণ। 

১৯৯৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনে হেসেখেলে জয়ী হয়েছিলেন রামচন্দ্র বাবু। নির্বাচন জিতে উঠে তিনি ঝাঁপিয়ে পড়লেন খেজুরীর উন্নতি সাধন করতে। অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে ১৯৯৯ সালে বারাতলায় খেজুরী কলেজ প্রতিষ্ঠা তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। তাঁর সাফল্যের ঝুলি বেশ লম্বা ও ঈর্ষণীয়। ১৯৯৬ সালের ৩০শে সেপ্টেম্বর। অন্ধকারাচ্ছন্ন খেজুরীকে বৈদ্যুতিকরণ করা তাঁর প্রথম প্রয়াস। এম এল এ নির্বাচিত হওয়ার ঠিক পরেই তিনি প্রথম বিদ্যুৎ এবং অপ্রচলিত শক্তি উৎস দপ্তরের মন্ত্রী ড. শঙ্কর কুমার সেনকে লিখলেন একখানা চিঠি। চিঠির প্রত্যুত্তরে মন্ত্রী মশাইয়ের ফিরতি জবাব আসে ১৪ই অক্টোবর।পত্রোত্তরে তিনি জানান —
'বর্তমানে রাজ্য সরকারের নীতি অনুযায়ী গ্রামীণ বৈদ্যুতিকরণের টাকা ডিস্ট্রিক্ট প্ল্যানিং কমিটি মারফৎ ব্যয় করা হবে। খেজুরী থানার অন্তর্গত হেঁড়্যাতে একটি ৩৩ kV (কিলো-ভোল্ট) সাবস্টেশন করার জন্য যে জমি পাওয়া গেছে, তাতে একটি বাড়ি ও কিছু গাছ আছে। এ গাছ কাটা ও বাড়ি ভাঙার ব্যবস্থা করে দিলে পর্ষদের পক্ষে তাড়াতাড়ি কাজটি হাতে নেওয়াও সুবিধা হবে।'

সেই শুরু। খেজুরী থানায় ইলেকট্রিক কারেন্টের কাজ আরম্ভ হল। মেদিনীপুর জেলা পরিষদের বিদ্যুৎ ও অচিরাচরিত শক্তি স্থায়ী সমিতির কর্মাধ্যক্ষ ছিলেন অসিত সিনহা। তিনি ১৯৯৭ সালের চৌঠা এপ্রিল শুক্রবার বেলা এগারটায় প্রস্তাবিত হেঁড়িয়া সাব স্টেশনের জায়গায় ভিত্তি স্থাপনের ব্যবস্থা করেন ও বৈদ্যুতায়নের শুভ উদ্বোধন হয়। পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য বিদ্যুৎ দপ্তর (WBSEB, বিদ্যুৎ ভবন, সল্টলেক সিটি, কলকাতা–৯১)-এর চিফ ইঞ্জিনিয়ার ভজহরি মণ্ডল উপস্থিত ছিলেন উদ্বোধন অনুষ্ঠানে। তারপর ১৯৯৮ সালের চব্বিশে এপ্রিল ট্রান্সফর্মারের জন্য রি-মাইন্ডার (Reminder) দিলে পর হেঁড়িয়া বিদ্যুৎ স্টেশন চালু হয়। বেশ কিছুদিন বাদে ২০০১ সালে বারাতলা অঞ্চলের মালদহে আরও একটি বিদ্যুৎ স্টেশন চালু করা হয়েছে বিধায়কের একান্ত প্রচেষ্টায়। 
🍂

কয়লা,‌ খনিজ তেল ও প্রাকৃতিক গ্যাস — এ হেন প্রচলিত প্রাকৃতিক শক্তি ব্যবহারে বিস্তর সমস্যা। বায়ু দূষণ ও বিশ্ব উষ্ণায়ন আজ সমার্থক শব্দগুচ্ছ। একটার উপর আরেকটা অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। এর অবশ্যম্ভাবী পরিণতি অকাল প্রাকৃতিক বিপর্যয় আর জলবায়ুর আকস্মিক পরিবর্তন। তাহলে, এর বিকল্প উপায় কী? বিকল্প পথ অপ্রচলিত শক্তির ব্যাপক ব্যবহার। বিশেষত সৌর শক্তি। নির্ভেজাল সৌর শক্তি দূষণের পরিপন্থী। সোলার এনার্জির সরাসরি প্রয়োগে এলাকার অন্ধকার আংশিক দূর করা সম্ভব। 

১৯৯৬ সালের কথা। খেজুরী-২ নম্বর ব্লকের সাতটা অঞ্চলে রাস্তার বৈদ্যুতিক বাতি অকেজো হয়ে পড়ে আছে দীর্ঘদিন। জনকা, মালদা, কুঞ্জপুর, বিদ্যাপীঠ, খেজুরী, মনসাদ-ই-আলা আর হলুদবাড়ি এলাকায় স্ট্রিট লাইটিং সিস্টেমে বৈদ্যুতিক খুঁটিগুলোর কারেন্ট কানেকশন না হওয়ায় প্রায় সবগুলো ব্যাটারি ও ল্যাম্প অকেজো হয়ে পড়ে আছে দীর্ঘদিন। রামচন্দ্র বাবু ওয়েস্ট বেঙ্গল রুরাল ইলেকট্রিসিটি ডেভেলপমেন্ট অথরিটি (WBREDA)-র ডিরেক্টর ড. এস পি গনচৌধুরী-কে সোলার এনার্জি ডেভেলপমেন্ট এবং এর বাস্তবায়ন সম্পর্কে লম্বা একখানা পত্র লিখে খেজুরী-২ অঞ্চলের সমস্যা ব্যক্ত করলেন। ইলেকট্রিসিটির বিকল্প সৌর শক্তি কাজে লাগাবার জন্য ধন্যবাদ জ্ঞাপনের মাধ্যমে ব্যাটারি ও বাতিগুলোর অকেজো অবস্থা দূরীকরণের অনুরোধ চিঠিতে জানান তিনি।
       
প্রত্যুত্তরে যা ঘটল, তা অতীব হাস্যকর। পাবলিকের কাছে লোক দেখানো ব্যাপার ছাড়া আর কি? রেকটিফিকেশনের পর স্থানীয় NGO-কে মেইনটেনেন্সের দায়িত্ব দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন WBREDA-এর ডিরেক্টর। ব্যাপারটা রামচন্দ্র বাবুর কাছে বেশ খটমটে ঠেকল। তাঁর চোখে, পরিচর্যা ও দেখাশুনার পাকাপাকি বন্দোবস্ত না করে অযথা প্রচুর অর্থ ব্যয় অপচয়ের সামিল। তাহলে মেনে নিতে অসুবিধা নেই– পঞ্চায়েত ও গ্রামোন্নয়নের দায়িত্ব সম্পর্কে সরকার সম্পূর্ণ উদাসীন। এ হেন উদাসীনতা অত্যন্ত পরিতাপের বিষয়। অপ্রচলিত শক্তি ব্যবহারে সৌর শক্তির সুষ্ঠু প্রয়োগ অঙ্কুরে বিনাশ হয়ে গেল সরকারী অব্যবস্থায়। 

সমুদ্র উপকূলবর্তী এলাকায় বৈদ্যুতায়নে বিস্তর সমস্যা। সমস্যা মূলত ট্রান্সফর্মার বসানো নিয়ে। তাহলে বিকল্প উপায় কী? সমুদ্রতটে মৎস্যজীবীদের ট্রান্সফর্মার বসানোর অবিচ্ছিন্ন খুঁটিগুলো দীর্ঘ দিন ফাঁকা পড়ে রয়েছে। সেগুলোতে সোলার সিস্টেম চালু করার জন্য নবগঠিত পঞ্চায়েত ও জেলা পরিষদে রামচন্দ্র বাবুর আবেদন শেষমেশ কার্যকর হয়। এভাবে গ্রামকে গ্রাম বৈদ্যুতায়ন আর সৌর শক্তির ব্যবহারে খেজুরীবাসীর অন্ধকার চিরতরে দূর হয়। 

আরও একটি অপ্রচলিত শক্তি বায়ু শক্তি। খেজুরীর সমুদ্রতটের পরিসর বেশ বিস্তীর্ণ না হলেও খুব সংকীর্ণ নয়। সমুদ্র উপকূলীয় এলাকায় সারা বছর কমবেশি জোরে বাতাস বয়। এই বায়ু শক্তি কাজে লাগাবার অভিনব কর্মসূচি খেলে গেল রামচন্দ্র বাবুর মাথায়। ১৯৯৬ সালে বায়ু শক্তি কাজে লাগিয়ে নিজকসবা সমুদ্র সৈকতে পাওয়ার জেনারেটর বসানোর আবেদন পত্র লিখলেন ড. এস পি গনচৌধুরী-কে। রামবাবুর চিঠির জবাব এল ২৭শে জুন ১৯৯৬ তারিখে। চিঠির সারসংক্ষেপ বেশ পরিষ্কার। ব্যাঙ্গালোরের এক নামকরা প্রতিষ্ঠান ইন্ডিয়া ইন্টারন্যাশনাল ট্রাভেল মার্ট (সংক্ষেপে, IITM)। নামী প্রতিষ্ঠানটি ইতোমধ্যে নিজকসবা অঞ্চলে এক বছর ধরে সার্ভের কাজ সেরে রেখেছে। সংগৃহীত তথ্য যাচাইয়ের কাজ আর দুই তিন মাসের মধ্যে শেষ হবে। তারপর তাদের সিদ্ধান্ত প্রকাশিত হবে। তিন মাস পর যথারীতি চিঠি এল। সার্ভের ফলাফল আশা ব্যঞ্জক নয়। নিজকসবা এলাকায় বাতাসের গতি বায়ু শক্তি কাজে লাগিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদনের পক্ষে যথেষ্ট নয়। প্রমাণ মানের চেয়ে বেশ কম। সুতরাং রামচন্দ্র বাবুর এই প্রোজেক্টটি আর এগোয়নি।

খেজুরীর অনেকটা এলাকা সমুদ্রতটের ধার ঘেঁষা। সাধারণ ভাবে এ হেন অঞ্চলের মানুষগুলোর প্রধান জীবিকা সমুদ্রে মাছ ধরা। পেটের টানে প্রায়শই গভীর সমুদ্রে তারা পাড়ি দেয় মাছ ধরতে। সমুদ্রের অসীম বিস্তীর্ণ জলরাশির মধ্যে দেশের কাঁটাতারের বেড়া থাকে না। সমুদ্রের সীমানা নির্ধারণ করতে তখন যথেষ্ট বেগ পেতে হয় মৎস্য জীবী মানুষদের। ভুলক্রমে সীমান্ত জলরাশির অদৃশ্য বেড়া টপকে পাশের দেশের জল সীমায় একবার ঢুকে পড়েছ কি মরেছ! হয়রানির একশেষ। তখন দুঃখের শেষ থাকে না। যে-দেশের জল সীমায় অনুপ্রবেশ করে মৎস্যজীবীরা, সে-দেশের নৌসেনা তাদের আটক করে রাখে। জিজ্ঞাসাবাদ চলে। অহেতুক সন্দেহের বাতাবরণ তৈরি হয়। সংশ্লিষ্ট দেশটি জঙ্গি কিংবা নাশকতার অভিযোগে গ্রেফতার করে মৎস্যজীবীদের। তাদের ট্রলার আটক করা হয়। কূটনৈতিক কথা কাটাকাটি চলে। নিয়মের যাঁতাকলে পড়ে লোকগুলোর জীবন ও জীবিকা দুটোই পেশাই হতে থাকে। এমনই একটি ঘটনা ঘটেছিল ১৯৯৯ সালে। সেবছর সমুদ্রে মাছ ধরার একটি ভারতীয় ট্রলার দশ জন মৎস্যজীবী সমেত বাংলাদেশের জলসীমায় ভুলক্রমে ঢুকে পড়ে। সেদেশের নৌসেনা আটক করে তাদের। মৎস্যজীবীদের অধিকাংশ খেজুরীর বাসিন্দা। রামচন্দ্র বাবু এলাকার বিধায়ক। মৎস্যজীবীদের আটকের সংবাদ শোনা মাত্রই তাঁর তৎপরতা বেড়ে যায়। তাদের পুনরুদ্ধারের জন্য সচেষ্ট হয়ে ওঠেন তিনি। তখন মিনিস্ট্রি অফ এক্সটারন্যাল এফেয়ার্স-এর ডেপুটি সেক্রেটারি ছিলেন মিঃ মানব পণ্ডা। রামচন্দ্র বাবু সরাসরি এম এল এ প্যাডে চিঠি লিখলেন ডেপুটি সেক্রেটারিকে। চিঠিতে কাজ হল। ২৪শে মে ১৯৯৯ সালে লেখা চিঠিতে মানব বাবু জানালেন— বাংলাদেশ হাইকমিশনে চিঠি লিখে অবিলম্বে মৎস্যজীবীদের মুক্তির ব্যবস্থা করেছিলেন তিনি। সে-যাত্রায় এক চিঠিতে সমস্ত মৎস্যজীবী মুক্তি পেয়েছিল। এমন আরও পরোপকারী কাজের লম্বা লিস্ট রয়েছে রামচন্দ্র বাবুর আমলে।

ভালো কাজের যেমন বিকল্প হয় না, তেমনি ভালো মানুষের পেছনে কাঠি করার লোকের অভাব নেই। বিধায়ক থাকাকালে রামচন্দ্র বাবু সিপিএম ক্যাডার সহ নেতাদের নেকনজরে পড়ে গেলেন। তাঁর স্বাধীন চিন্তা, খেজুরীর উন্নয়ন ভাবনা কম্যুনিস্টদের স্বার্থে আঘাত হানে। এর অবশ্যম্ভাবী পরিণতি বামফ্রন্টের শরীক দল হয়েও নানান রকম নিপীড়নের শিকার হন রাম বাবু। নেতাদের মদতে তাঁর খেজুরীর বাড়ি চুরি-ভাঙচুর করা হয়। বাসে যাতায়াতের সময় তাঁকে কামারদায় বাস থেকে নামিয়ে অপদস্থ ও অসম্মানিত করা হয়। এমনকি তাঁকে লাঞ্ছিত হতে হয়। ভাগ্যের কী পরিহাস! যে-ভাবনায় তাঁর বিধায়কের বাসনা, বিধায়ক জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তার অন্যথা হয়নি। অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছিলেন নিজের সৎ জীবনের আদর্শ ও নীতি। এত সব অবাঞ্ছিত ঘটনা ঘটে যাওয়ার পরেও তাঁর মননে খেজুরীর উন্নয়ন ভাবনা অটুট। খেজুরী সংলগ্ন হুগলি নদীর নদীতট বরাবর কোস্টাল হাইওয়ে তৈরির বাসনা। খেজুরী কলেজকে কেন্দ্র করে নানা বিভাগ প্রচলনের উদ্যোগ। খেজুরী বন্দর এলাকায় ট্যুরিস্ট স্পট গড়ার ভাবনা। বিভিন্ন খাল সংস্কার। কৃষি কেন্দ্রিক খেজুরীর বিভিন্ন উন্নয়নমূলক ভাবনায় সর্বদা জারিত তাঁর কোমল মন। গোল বাঁধলো রাজনৈতিক হস্তক্ষেপে। রাজনীতির জটিল ও কুটিল আবর্তনে তাঁর সব পরিকল্পনায় জল ঢালা হয়ে গেল। তাঁর মোহভঙ্গ ঘটল। আদপে তিনি রাজনীতির অঙ্গনে বেমানান একজন ব্যর্থ নায়ক। রাজনীতি কোনোদিনই তাঁর রক্তে ছিল না। রাজনীতির ছত্রছায়ায় খেজুরীর উন্নয়নের জোয়ার আনবেন – শুধু এই ছিল তাঁর ধারণা। কিন্তু নাহ! আর নয়। রাজনীতির জটিল পথ তাঁর জন্য নয়। নিরাস হয়ে তিনি বানপ্রস্থ গ্রহণ করলেন রাজনীতি থেকে। খেজুরী ইতিহাস সংরক্ষণ সমিতিকে কেন্দ্র করে নতুনভাবে শুরু হল তাঁর পথচলা।

(২)
'হ্যালো। আমি কি সায়েন্টিস্ট রামচন্দ্র মণ্ডল স্যারের সঙ্গে কথা বলছি?'
'হ্যাঁ, বলুন। আপনি কে বলছেন? কোত্থেকে বলছেন?'
'স্যার, আমার নাম পূর্ণচন্দ্র ভূঞ্যা। মেদিনীপুর থেকে বলছি।'
'কী দরকার, বলুন?'
'স্যার, মেদিনীপুরের এক নামকরা লিটল ম্যাগাজিন জলদর্চি পত্রিকা। সে-পত্রিকায় মেদিনীপুরের বিজ্ঞানীদের জীবনী ধারাবাহিক লিখছি আমি। বিশেষ কিছু সোর্স মারফৎ ক'মাস আগে আপনার জীবনের গল্প অল্প বিস্তর আমি জানতে পেরেছি। আপনাকে নিয়ে একটা ধারাবাহিক লিখতে চাই। সেজন্য আপনার অনুমতি চাইছি। আপনার সঙ্গে বাড়িতে একদিন সাক্ষাৎ করতে পারলে ভালো হতো।  আপনার একখানা এগ্রিম অ্যাপয়েমেন্ট যদি পাই, খুব উপকৃত হব। অনুগ্রহ করে যদি বলেন, কবে যাবো? কখন, কোথায় যাবো?' — কথা ক'টা বলে একটু থামি। 

মোবাইলের ওধারে বিজ্ঞানী খানিক দ্বিধায়। সাক্ষাৎকার দিতে হবে শুনে বৈজ্ঞানিকের কিন্তু কিন্তু ভাব। ইন্টারভিউ? ইন্টারভিউ-এর প্রশ্নে সব পণ্ডিতের এক সমস্যা। ইন্টারভিউ-এ এলার্জি। ইন্টারভিউ এড়িয়ে যাওয়ার হরেক রকমের কৌশল। ফোনের ওপ্রান্ত থেকে আমতা আমতা করে বৈজ্ঞানিক বলে উঠলেন – 'আমি কেন?'
আমিও নাছোড়বান্দা। ছাড়বার পাত্র নই।
তিনি আরও যোগ করে বললেন – 'আমাকে নিয়ে আর কী লিখবেন? আমি একজন ছাপোষা সামান্য লোক।'
আসলে যারাই অসামান্য, অসাধারণ; তাদের তীব্র অপছন্দ অপরের মুখে নিজের সুখ্যাতি শোনা ও হজম করা। আরও অপছন্দের ইন্টারভিউয়ের মাধ্যমে নিজের ঢাক নিজে পেটানো। কিন্তু তাঁদের হয়তো অজানা থাকবে তাঁরা কতজনের আদর্শ। তাঁদের কাহিনী শুনে কতজন উদ্বুদ্ধ হতে পারে। তাঁদের কর্মোদ্যম ও উদ্দীপনা কতটা অনুকরণীয়, কতখানি দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পারে জনমানসে। তাঁদের বৈজ্ঞানিক কৃচ্ছসাধন ও মোক্ষলাভের খবর সমাজের পক্ষে ভীষণ রকম প্রয়োজন। বিশেষত ইয়ং জেনারেশনের মোটিভেশনের জন্য। নীরবতা ভেঙে আমি বলে উঠি — 'আসলে আপনাদের মতো পণ্ডিত মানুষের কথা, বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের গল্প এখনকার ইয়ং জেনারেশন কিছুই জানে না। আমি চাই তারা জানুক — যে মাটিতে আমাদের জন্ম, সেখানেও সোনা ফলে, পৃথিবী বিখ্যাত বৈজ্ঞানিক জন্মায়। গ্যালিলিও, নিউটন, ডারউইন, আইনস্টাইনের সমকক্ষ বিজ্ঞানীর আতুঁরঘর আমার মাটি, আমার দেশ। রীতিমতো ঈর্ষা করার মতো বৈজ্ঞানিক এষণা ও অন্বেষা।'
দুপক্ষ খানিক চুপচাপ। বুকে একরাশ শ্বাস নিয়ে আবারও বলতে শুরু করি – 'অথচ পরিস্থিতির চাপে, পরিচিতির অভাবে মেদিনীপুরের বিজ্ঞানীদের কথা সকলের অজানা। অজ্ঞাত কারণে কখনও তাদের জীবনী লেখা হয় না। সেজন্য বর্তমান-সহ বিগত কয়েক জেনারেশন বেমালুম বিস্মৃত মেদিনীপুরের বিজ্ঞানীদের কথা। আমি চাই আমার ক্ষুদ্র লেখনীর মাধ্যমে তাদের প্রকাশ হোক।'
অবশেষে সম্মত হলেন পণ্ডিত। রাজি হলেন তথ্য, ভাব, সুখদুঃখ আদানপ্রদান করতে। আমার স্বস্তির নিঃশ্বাস পড়ল। 

উপরের ঘটনা ২০২১ সালে, সম্ভবত পুজোর পরে, ঘটা এক রূপকথার গল্প। তারপর হুগলি নদী দিয়ে বয়ে গেছে অনেক জল। এক প্রস্থ লকডাউনে সব উলট-পালট অবস্থা। বৈজ্ঞানিকের বাড়িতে সার্ভের কাজ অযথা আটকে গেল। ভিন্ন কাজে আমি ব্যস্ত হয়ে পড়ি। একবছর পার হয়ে গেল। তারপর এল সেই সন্ধিক্ষণ। ২৫ অক্টোবর ২০২২ সাল। মঙ্গলবার। আগের দিন কনফার্ম হয়েছে বৈজ্ঞানিকের সঙ্গে আলাপচারিতার অনন্য সুযোগ। এ সুযোগ হাতছাড়া করার প্রশ্ন নেই। বৈজ্ঞানিকের সঙ্গে আমার অ্যাপয়েন্টমেন্ট সকাল দশটায়। খুব সকালে ডাউন মেদিনীপুর হাওড়া লোকাল ধরে যখন মেছেদা স্টেশন পৌঁছি, তখন বেলা পৌনে ন'টা মতন বাজে। ওই সময়ে খেজুরী যাওয়ার একমাত্র বাস মেছেদা স্ট্যান্ডে দণ্ডায়মান। আপাদমস্তক লোকাল বাস। সুতরাং সময় বেশি লাগবে। কশাড়িয়া পৌঁছতে ঘণ্টা তিনেক সময় খাবে, জানতে পারি। গন্তব্যে পৌঁছাতে বারোটা বেজে যাবে। দুপুর সাড়ে বারোটার আগে পৌঁছনো আপাতত অসম্ভব। অবশ্য এর পূর্বে কেউ পৌঁছবে না। খুব আশাহত লাগছে। বিজ্ঞানীর সঙ্গে প্রথম সাক্ষাৎ। সেটাই লেট! কী করি? কী করি? শ্রদ্ধেয় বিজ্ঞানীকে ফোনে জানাই নিজের অক্ষমতার কথা। অহেতুক দেরি করে যাওয়ার জন্য দুঃখ প্রকাশ করে বলি — 'খুব ভোরের ট্রেনটা ধরলে হয়তো সময়ে পৌঁছে যেতাম। 
ধীর স্থির কণ্ঠে ওপার থেকে জবাব আসে — 'আপনি ধীরে সুস্থে আসুন। কোনও তাড়া নেই।'
বুকে বল পেলাম। মনে হল, ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়ল। স্বস্তির নিঃশ্বাস পড়ল। পছন্দসই একখানা বসার সিট দখল করে বাসে অসীম ধৈর্য্যের পরীক্ষা। অনন্ত অপেক্ষা কখন ছাড়বে বাস?

কশাড়িয়া মোড়ে পৌঁছতে পৌঁছতে বেলা দ্বিপ্রহর গড়িয়ে গেল। ঘড়িতে এখন সোয়া বারোটা বাজে। মোড়ে গুটি কয়েক দোকান। অধিকাংশ চা ও ছোটোখাটো স্টেশনারি দোকান। দু-একটা ভূসিমাল দোকানও চোখে পড়ল। ভাতের হোটেল সাকুল্যে একটি। হোটেলের ভেতরে জনাকয়েক লোক খোশগল্পে মত্ত। এখন ভাতের ব্যবস্থা নেই। দুপুর দুটোর পরে হবে। ভাবলাম বৈজ্ঞানিকের বাড়ি থেকে ফিরে এসে লাঞ্চ খাওয়া যাবে। এখন গন্তব্যে রওনা হওয়াই শ্রেয়। সুতরাং চা-বিস্কুট খেয়ে একখানা টোটো ধরলাম। রাস্তাখানি খুব সুন্দর। সবুজ মাঠের বুক চিরে এঁকে বেঁকে এগিয়ে চলেছে পল্লী প্রান্তর অভিমুখে। রাস্তার দুপাশে চিরসবুজ আকাশবানী, দেবদারু, অর্জুন গাছের সারি। রাস্তার উপর আলো-ছায়ার সুন্দর ছবি ভেসে বেড়ায়। মৃদু মন্দ বাতাস বইছে। মনের ভেতর অন্যরকম প্রশান্তি। আহা! কি শান্তি! কি মনোরম পরিবেশ! চোখ জুড়িয়ে যায়। ভালোলাগায় পরিপূর্ণ হয়ে যায় হৃদয়। শহুরে ইঁট বালি সিমেন্টের বহুতল আবাসনের জঙ্গলে হাঁপিয়ে ওঠা একাকি মন গ্রাম্য সবুজের সমারোহে চিরশান্তি খুঁজে পায়।
     
বৈজ্ঞানিকের বাড়িতে যখন পৌঁছলাম, পৌনে একটা বাজে। এর মধ্যে রামচন্দ্র স্যার বেশ ক'বার ফোন করে খোঁজ নিয়েছেন বাসে কতদূর পৌঁছেছি, কখন কশাড়িয়া পৌঁছব ইত্যাদি। শেষমেশ যখন শ্রদ্ধেয় বৈজ্ঞানিকের বাড়িতে পৌঁছলাম, প্রথম দর্শনে প্রিয় বৈজ্ঞানিককে চিনে নিতে অসুবিধা হয়নি। পায়ে হাত দিয়ে প্রণিপাত করি। ফুট ছয়েক উচ্চতার পণ্ডিত মানুষটিকে একঝলক দেখে চোখ জুড়িয়ে গেল। অসম্ভব অমায়িক তাঁর ব্যবহার। অকল্পনীয় যত্ন-আত্মী। বয়স নব্বই পেরোনো মানুষটির এখনও বেশ শক্ত পোক্ত চেহারা। ইচ্ছে মতন চারদিক ঘুরে বেড়ানো তাঁর চিরদিনের শখ। বয়সের কারণে শরীর সামান্য সামনের দিকে ঝুঁকে রয়েছে। আর কোনো সমস্যা নেই। ভালো মন্দ জিজ্ঞেসের পর শুরু হল কথাবার্তা। যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সুন্দর একখানা কোল্ড ড্রিংকস আর বেশ কয়েক পদ মিষ্টি। খুব খিদে পাচ্ছিল। গপাগপ খেয়েছি মিষ্টিগুলো, যদিও মিষ্টি একদম পছন্দ নয় আমার। ঘণ্টা খানেক কথা হয়েছে, কি হয়নি। ভাত খাবার ডাক পড়ল। মনে মনে ভাবলাম ভাত খাওয়ার তো কথা ছিল না। তাহলে? আসলে রামচন্দ্র বাবু উঁচু মনের ও মানের মানুষ। তাঁর অকৃত্রিম সাহচর্য, দক্ষতা ও হৃদ্যতায় যে কেউ আপ্লুত হবে। ভাত খেতে বসে আমার চক্ষু ছানাবড়া! তিন-চার রকমের মাছ, কয়েক দফা ভাজাভুজি, তরকারি, চাটনি, ভাত ও ডাল সহযোগে দুপুরের আহার। চব্য-চোষ্য-লেহ-পেয় সব রকমের খাবার খেয়ে পেট ফুলে ঢোল। তথ্য সংগ্রহ করব কী, ভাতঘুমে চোখ লাল। ঢুলু ঢুলু চোখে বিছানায় গড়িয়ে নেওয়ার অবকাশ। সময় বয়ে চলে। চকিতে ঘুম ভেঙে গেল। খাট থেকে উঠে দেখি দিনের শেষ আলোয় বাড়ির খামার রাঙা হয়ে গেছে। বিকেল চারটা মতন বাজে। আজকের মত কাজ মুলতুবি রেখে বের না হলে মেদিনীপুর ফেরা সমস্যা হবে। স্যারের লেখা দুটো বই এবং তাঁর জীবনী সংকলিত একখানি সম্পাদিত বই সংগ্রহ করে ফিরে এলাম মেদিনীপুর। রাত তখন দশটা।

জয়দেব মাইতি ও সুব্রত কুমার মাঝি সম্পাদিত 'মনীষী ড. রামচন্দ্র মণ্ডল' পুস্তকখানি এক আকর গ্রন্থ। তথ্য ও তত্ত্বে ঠাসা। অমূল্য সম্পদ। এক রাতের মধ্যে বইখানি পড়ে শেষ করলাম। আমার ক্ষিদে আরও বেশি। আরও ডিটেলস চাই। আরও ছোট ছোট ঘটনা। বৈজ্ঞানিকের আটপৌরে বারোমাস্যা জীবনের টুকরো টুকরো কথা। কঠিন জীবন সংগ্রামের বাস্তব দলিল লিখতে চাই। শূন্য থেকে শৈলের চূড়ায় পৌঁছানোর বন্ধুর উঁচু নিচু পথ পেরিয়ে লক্ষ্যে অবিচল থাকার কাহিনী। তাঁর কঠিন সংগ্রামের অনবদ্য দৃশ্য আঁকতে চাই কলমের ডগায়। যে-সংগ্রামের রোমহর্ষক বর্ণনা পড়ে উদ্বুদ্ধ হবে লক্ষ্য নিযুত কোটি তরুণ। বাড়ি থেকে ফোনে আমার সুপ্ত ইচ্ছের কথা বলি প্রিয় বৈজ্ঞানিককে। আবার ডাক পড়ল কশাড়িয়ায়। এবার চৌঠা ডিসেম্বর ২০২২ সাল। রবিবার। ছুটির দিন। বেরিয়ে পড়লাম তীর্থ দর্শন করতে। আসলে বৈজ্ঞানিকের বাড়ি, আমার কাছে, বিজ্ঞানের আতুঁরঘর। বিজ্ঞানের মূল্যবান এক তীর্থক্ষেত্র। যথারীতি খাবারদাবারের এলাহী আয়োজন। এবার মাছের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে মাংসের ঝোল। টকটকে লাল মশলাদার মাংসের ঝোল খেলাম কবজি ডুবিয়ে। আর বৈজ্ঞানিকের জীবনের অসংখ্য রোমহর্ষক, চোখে জল আনা গল্প শুনলাম একান্ত আলাপচারিতায়। এ এক পরম পাওয়া। আমার বেশ ক'জন্মের পুন্যের ফল এ হেন নামকরা বৈজ্ঞানিকের সংস্পর্শে আসা ও কথাবলা। এবার ফেরার তাড়া নেই। ভাতৃপ্রতিম বাপ্পা কশাড়িয়া এসেছে মোটরসাইকেলে আমাকে হেঁড়িয়া পৌঁছে দিতে। রামচন্দ্র মণ্ডল স্যারের বাড়ি থেকে বেরোব। এমন সময় বাড়ির নারকেল গাছের ডাবের জল খেলাম। পণ্ডিত মানুষটির পায়ে হাত প্রণাম করলাম। তারপর হাতে সময় নিয়ে বেরিয়ে পড়ি পূর্ব ভারতের সুপ্রাচীন প্রথম ডাকঘর দেখতে। ইতিহাসের সাক্ষী ভগ্নপ্রায় পোস্ট অফিসটি। সমাজ সেবক রামচন্দ্র বাবু এবং খেজুরী সার্বিক উন্নয়ন সমিতির মেলবন্ধনে পশ্চিমবঙ্গ পুরাতত্ত্ব বিভাগের ছাড়পত্র পেয়েছে ডাকঘর ও তৎসংলগ্ন এলাকাটি সংরক্ষণ করার। (ক্রমশ...)

তথ্য সূত্র :
• প্রণম্য বৈজ্ঞানিক ড. রামচন্দ্র মণ্ডল মহাশয়
• শ্রী সুদর্শন সেন বিশিষ্ট শিক্ষক ও আঞ্চলিক
   ইতিহাস গবেষক
• 'মনীষী ড. রামচন্দ্র মণ্ডল' – সম্পাদনা শ্রী জয়দেব
    মাইতি ও শ্রী সুব্রতকুমার মাঝি

Post a Comment

1 Comments

  1. AnonymousJune 22, 2023

    To be continued. its amazing to read the biography of that respected person. I am exited to learn the next.....

    ReplyDelete