জ্বলদর্চি

জয়দীপ পণ্ডা (শিক্ষক, গবেষক, আঞ্চলিক ইতিহাসকার, প্রাবন্ধিক, তমলুক) /ভাস্করব্রত পতি

মেদিনীপুরের মানুষ রতন, পর্ব -- ৫৯
জয়দীপ পণ্ডা (শিক্ষক, গবেষক, আঞ্চলিক ইতিহাসকার, প্রাবন্ধিক, তমলুক) 

ভাস্করব্রত পতি

নিজের গ্রামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি নিয়ে ক্ষেত্র গবেষণা করে দু মলাটে বই ছাপানোর কাজ শেষ। প্রেসের মালিককে মেটাতে হবে বকেয়া টাকা। এদিকে তখনও চাকরি জোটেনি। পাকাপোক্ত ইনকাম নেই। হাতে টান। গৃহশিক্ষকতা করে যৎসামান্য উপার্জিত জমানো অর্থ দিয়ে বই ছাপানোর খরচ মেটানো হল। তাতেও কুলোয় না। প্রেসের টাকা পরিশোধ করতে নিজের শখের এবং সাধের ফিলিপস কোম্পানির টেপরেকর্ডারটিকেও বিক্রি করে দিতে হল। অবশেষে দেনা শোধ! এবার নিশ্চিন্ত। 

এভাবেই তিনি গ্রামেগঞ্জে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ইতিহাসকে একসূত্রে বেঁধে রাখতে অগ্রণী ছিলেন। লালিত করতেন নিজেকে। তমলুকের বিশিষ্ট তরুণ ইতিহাস গবেষক জয়দীপ পণ্ডার জীবনের এহেন ঘটনার কথা রোমাঞ্চিত করে। ইতিহাসকে ভালোবেসে ছুটে চলেন এ গ্রাম থেকে অন্য গ্রামে। এই অল্প বয়সেই তিনি জেলার বিভিন্ন প্রান্তের নানা মানুষের, নানা এলাকার এবং নানা ঘটনার পুঙ্খানুপুঙ্খ ইতিহাস খূঁজে পেতে লিপিবদ্ধ করেছেন কলমের আঁচড়ে। তাঁর সুচারু অন্বেষণ গবেষকদের দিয়েছে অনেক অজানা ইতিহাসের সন্ধান। অনেক না জানা কথার ফুলঝুরি। অনেক অবর্ণিত ঘটনার বিবরণ। অনেক হারিয়ে যাওয়া কথার সুললিত পরিস্ফুটন। আসলে তিনি চেয়েছেন বর্তমান নিয়ে ভাবিত বাঙালিকে ভবিষ্যতে আফসোসের হাত থেকে বাঁচাতে পুরোনো অতীতের ইতিহাসের সন্ধান চোখের সামনে তুলে দিয়ে মননের বিকাশ ঘটাতে। মেদিনীপুরের আনাচে কানাচে, অলিতে গলিতে তাঁর অনুসন্ধিৎসু মন বাইসাইকেলে চেপে প্রবেশ করে কাঁধে শান্তিনিকেতনী ব্যাগ আর কলম ডায়েরি নিয়ে। মেদিনীপুরের অসংখ্য অজানা কাহিনী তুলে ধরে সবার অলক্ষ্যে এবং অজান্তেই হয়ে উঠেছেন 'মেদিনীপুরের মানুষ রতন'। লেখনীর গুণে মেদিনীপুরকে করে তুলেছেন গর্বিত। 
তমলুকের নিশ্চিন্তবসান গ্রামে ১৯৭৮ এর ২৫ শে ডিসেম্বর জন্মগ্রহণ করেন। বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইতিহাসে স্নাতকোত্তর ডিগ্রী লাভ করার পথে ইতিহাস প্রেমে বুঁদ হতে সময় লাগেনি। তমলুক হাইস্কুলে সপ্তম শ্রেণীতে পড়ার সময় স্কুল ম্যাগাজিন 'তাম্রলিপি'তে প্রথম ছাপানো অক্ষরে প্রবন্ধ প্রকাশ পেল নিজের গ্রাম নিশ্চিন্তবসান নিয়ে। ইতিহাস অন্বেষণের গোড়াপত্তন সেখানেই। এরপর তাম্রলিপ্ত কলেজের প্রতিষ্ঠার ৫০ বছর উপলক্ষে ১৯৯৭ সালে এখানকার ম্যাগাজিন 'রুচিরা'তে লিখলেন ইতিহাসধর্মী প্রবন্ধ। যা পুরষ্কৃত হয়েছিল। সেই সময় তাঁকে উৎসাহিত করেছিলেন ড. প্রদ্যোত কুমার মাইতি। এই মহান ইতিহাস অন্বেষকের সাথে সম্পর্কটা আরও নিবিড় হয়ে ওঠে তখন থেকেই। ঠিক পরের বছর লিখে ফেললেন নিজের গ্রাম নিশ্চিন্তবসান নিয়ে পূর্ণ দৈর্ঘ্যের বই 'ইতিহাস ও ঐতিহ্যেপূর্ণ নিশ্চিন্তবসান'। কয়েক মাসের মধ্যেই একশো কপি শেষ। ফের ২০১০ এর দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশিত হয়। এই বইটির মুখবন্ধ লিখে দিয়েছিলেন প্রখ্যাত প্রত্নতাত্ত্বিক ও মন্দির গবেষক অধ্যাপক ড. প্রণব রায়। নিজের গ্রামের ইতিহাস অন্বেষণ করার মানসিকতা তাঁকে জারিত করেছে ছোট থেকেই। আসলে এটা ছিল একটা পদক্ষেপ। যেকোনো ধরণের ঘটনার এবং বিষয়ের পেছনে লুকিয়ে থাকা ইতিহাসের খোঁজ পেতে যিনি সচেষ্ট, তিনি তো প্রথমে নিজের জন্মস্থানের চারপাশের ইতিহাস খুঁজে দেখবেনই। সেই নিরিখে জয়দীপ পণ্ডার কার্যক্রম সঠিক পথেই। 
জয়দীপের বই ছাপানোর অদম্য ইচ্ছের কথা জানতে পেরে দি নিউ সৃজন প্রেসের কর্ণধার সদ্য প্রয়াত সুভাষ ভুঁইয়া দায়িত্ব নেন বই প্রকাশের। আর ফিরে তাকাতে হয়নি। একটার পর একটা অমূল্য ইতিহাসসমৃদ্ধ গবেষণা গ্রন্থ উপহার দিয়েছেন পাঠকদের। ২০০২ তে সতীপীঠ দেবী বর্গভীমার মাহাত্ম্য নিয়ে লেখা বইটির মুখবন্ধ লিখে দেন ময়নাগড়  রাজপরিবারের উত্তরসূরি অধ্যাপক প্রণব বাহুবলীন্দ্র। এটির পাঁচটি সংস্করণ নিঃশেষিত। এরপর ক্ষুদিরাম বসুকে নিয়ে তথ্যসমৃদ্ধ একটি বইয়ের উদ্বোধন করেন বিশিষ্ট স্বাধীনতা সংগ্রামী সুশীল কুমার ধাড়া। এ পর্যন্ত প্রায় ৩০ টি বই লিখে ফেলেছেন ইতিহাস অন্বেষক জয়দীপ পণ্ডা। 

জয়দীপ পণ্ডা লিখিত আঞ্চলিক ইতিহাস এবং লোকসংস্কৃতি বিষয়ক বইগুলি হল -- দেবী বর্গভীমা মাহাত্ম্য, শ্রীচৈতন্যের উপস্থিতির প্রেক্ষাপটে তমলুকের মহাপ্রভু মন্দির, ইতিহাস ও ঐতিহ্যেভরা তমলুক রামকৃষ্ণ মিশন সেবাশ্রম, স্বাধীনতা আন্দোলনে তমলুকের বীরাঙ্গণা ও বারাঙ্গণা চরিতকথা, তমলুকের গান্ধীবুড়ি বীরাঙ্গণা মাতঙ্গিনী দেবী, তমলুকের অগ্নিকন্যা বীরাঙ্গণা সাবিত্রীদেবী, স্বাধীনতা সংগ্রাম ও গণ আন্দোলনে মেদিনীপুর জেলার কমিউনিষ্ট নেতৃত্ব, মেদিনীপুর জেলায় অবিভক্ত তমলুক মহকুমায় বামপন্থী আন্দোলনের রক্তাক্ত ইতিহাস, ভারতের মুক্তি সংগ্রামে অবিভক্ত তমলুক মহকুমা, রাসবিহারী মিশ্র রচনা সমগ্র (সম্পাদনা), অধ্যাপক গবেষক ড. প্রদ্যোত কুমার মাইতির জীবনকথা (সম্পাদনা), নতুন তথ্যের আলোকে বীর শহীদ ক্ষুদিরাম, স্বাধীনতা সংগ্রামী ও জননেতা অজয়কুমার (যুগ্ম সম্পাদনা), ইতিহাস ও সংস্কৃতির নানা প্রসঙ্গ - ড. প্রদ্যোত কুমার মাইতি (সম্পাদনা), ইতিহাস ও ঐতিহ্যেপূর্ণ নিশ্চিন্তবসান, মেদিনীপুরের লোকশিল্পে গহনাবড়ি, তমলুকের সেকাল একাল, দেবী দুর্গা ও মেদিনীপুরে তার পূজার্চ্চনা (সম্পাদনা), শতবার্ষিকী- রামকৃষ্ণ মঠ ও রামকৃষ্ণ মিশন সেবাশ্রম তমলুক (সম্পাদনা), ইতিহাস ও প্রত্নতত্ত্বের আলোকে মোগলমারীর শ্রীবন্দক মহাবিহার, মেদিনীপুরের অতীত ঐতিহ্য, তমলুকের ঐতিহ্যময় বারুণী স্নান ও মেলা পরিক্রমা, মেদিনীপুরের সশস্ত্র বিপ্লব -- শহীদ ক্ষুদিরাম ও হেমচন্দ্র, তাম্রলিপ্ত - তমলুক : ইতিহাস ও লোকসংস্কৃতি, দেবী দুর্গা : মেদিনীপুরে তার পূজার্চনা, আগষ্ট বিপ্লবের অমর শহীদ বীর বিপ্লবী রামেশ্বর বেরা, ত্রয়ী (সতীশচন্দ্র সামন্ত, অজয় কুমার মুখোপাধ্যায় ও সুশীল কুমার ধাড়ার জীবনালেখ্য), জঙ্গলমহলের ইতিহাস, অবিভক্ত মেদিনীপুরের মনীষীগণ, ইতিহাস ও কিংবদন্তিতে লৌকিক দেবী ঝিঙ্গলেশ্বরী, দর্শনীয় তমলুক, স্মৃতির আলোয় নিমাইচরণ মিশ্র (সম্পাদনা), অবিভক্ত মেদিনীপুরের ইতিহাস ও লোকসংস্কৃতি, মেদিনীপুরের লৌকিক দেবদেবী, শতবর্ষের শ্রদ্ধাঞ্জলি স্বাধীনতা সংগ্রামী ও গণ আন্দোলনের নেতা রাসবিহারী মিশ্র (সম্পাদনা) ইত্যাদি। 
এই বইগুলির মধ্যে ১৭ টি বইয়ের মুখবন্ধ লিখে দিয়েছেন ঐতিহাসিক ড. প্রদ্যোত কুমার মাইতি। স্বাধীনতা যুদ্ধের কাহিনী আকর্ষণ করতো জয়দীপকে। বিভিন্ন সময়ে মুখোমুখি হয়েছেন সুশীল কুমার ধাড়া, সাবিত্রী দে, কুমুদিনী ডাকুয়া, রাসবিহারী মিশ্র, কৃষ্ণচৈতন্য মহাপাত্র, অমূল্যচরণ মাইতি, প্রিয়নাথ জানা, রাধাকৃষ্ণ বাড়ীদের। এঁদের সান্নিধ্যে এসে উজ্জীবিত করতে পেরেছেন বিভিন্ন বই লেখার কাজে। তার ফলে বিভিন্ন গ্রন্থে উঠে এসেছে স্বাধীনতা যুদ্ধের অনেক অকথিত কাহিনী। 

বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গ ইতিহাস সংসদের সদস্য। সেইসাথে মরণোত্তর দেহদান এবং চক্ষুদান আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত। ছবি আঁকাতেও সচল তিনি। মেদিনীপুরের এই গবেষকটি এপর্যন্ত ১৫০ টিরও বেশি গবেষণা মূলক প্রবন্ধ লিখেছেন। অন্তত ৫০ টি সংকলন গ্রন্থে তাঁর প্রবন্ধ স্থান পেয়েছে। কিন্তু মননে চিন্তনে আর লিখনে সবসময় প্রাধান্য পায় গ্রাম বাংলার ইতিহাস, আন্দোলনের ইতিহাস, লড়াইয়ের ইতিহাস, সংস্কৃতির ইতিহাস।
🍂

Post a Comment

0 Comments