জ্বলদর্চি

দ্বাদশ রবি /মৌমিতা চ্যাটার্জী

দ্বাদশ রবি 
মৌমিতা চ্যাটার্জী


"দ্বাদশ রবির বহ্নিজ্বালা ভয়াল তাহার নয়ান কটায়"
প্রলয়োল্লাস কবিতায় কবি কাজী নজরুল ইসলাম ক্ষয়িষ্ণু সমাজের ধ্বংসের শেষে নতুন এক অধ্যায়ের সূচনার চাহিদায় আহ্বান করেছেন 'দ্বাদশ রবি' কে। রবির দীপ্ত তেজ উদ্ভাসিত হয়ে অশুভ শক্তির বিনাশ ঘটিয়ে প্রতিষ্ঠা করবে শুভশক্তির। 
   'প্রলয়োল্লাস' কবিতার ‌এই পংক্তিটির সাথে আমরা সকলেই বিশেষ পরিচিত, পরিচিত 'দ্বাদশ রবি' কথাটির সঙ্গেও।
এই বার প্রশ্ন এই দ্বাদশ রবি কে?
'রবি' বলতে আমরা বুঝি সূর্যকে। তার অন্যান্য নাম ভানু, আদিত্য, ভাস্কর, দিবাকর, দিনমণি, মার্তন্ড ইত্যাদি। দ্বাদশ শব্দের অর্থ বারো। অর্থাৎ সেই অর্থে বললে বারো সূর্যকে একসাথেই বলা হয় দ্বাদশ রবি। কিন্তু সূর্য বারোটি?? আমরা তো দিনমানে আকাশে একটি মাত্র সূর্যকেই দেখি।  তাহলে?
আসলে এই বারো সূর্য হল পৌরাণিক অনুষঙ্গ।পুরাণমতে  বারো জন আদিত্য একত্রিত হয়েই প্রকটিত হন সূর্য রূপে। বলা হয় এঁনারা দেবমাতা অদিতি ও মহামুনি কশ্যপের পুত্র। অনেকে দ্বাদশ রবিকে বারো মাস এর সঙ্গেও তুলনা করে থাকেন।এঁনারা হলেন যথাক্রমে- সবিত্র বা সবিতা, অর্যমা, ভগ, বরুন, দক্ষ,অংশ, ত্বষ্টা, পূষা, মিত্র, বিষ্ণু, ধাত্রী ও বিবস্বান।
এঁনাদের কিছু পরিচয় পাওয়া যাক।
""""""""""""""""""""""""""""""""""":::
১) সবিত্র বা সবিতা- 
সূর্যের অপর নাম সবিতা। সেই কারণে সূর্যকে জগৎস্রষ্টা বলা হয়। ঋগ্বেদের তৃতীয় মণ্ডলের ৬২ সূক্তের ১০ম শ্লোকে রয়েছে "তৎ সবরিতুর্বরেণ্যং ভর্গো দেবস্য ধীমহি। ধিয়ো যো নঃ প্রচেদয়াৎ অর্থাৎ যিনি আমাদের ধীশক্তি প্রেরণ করেন, আমরা সে সবিতাদেবের তেজের ধ্যান করি। এই অর্থে সবিতা ধীশক্তির অর্থাৎ জ্ঞান, প্রাজ্ঞতার অধিষ্ঠাত্রী দেবতা।


২) অর্যমা-
ঋগ্বেদের ২য় মণ্ডলের ২৭ সূক্তে ছয়জন আদিত্যের নাম পাওয়া যায়। 
এঁরা হলেন মিত্র, অর্যমা, ভগ, বরুণ, দক্ষ এবং অংশ। কশ্যপ -এর ঔরসে অদিতি'র গর্ভে এঁর জন্ম হয়েছিল। অর্যমাকে ঘোড়ার রক্ষক হিসাবে বর্ণনা করা হয়েছে, এবং আকাশগঙ্গা ছায়াপথকে তার পথ বলা হয়। ইনি রীতিনীতির দেবতা। হিন্দু বিবাহ রীতিতে অর্যমাকে সাক্ষী রাখা হয়। তিনি আতিথেয়তার ও দেবতা।
 

৩) ভগ
হিন্দু পৌরাণিক কাহিনি মতে– ইনি দ্বাদশ আদিত্যের একজন। এঁর ভগ্নি ঊষা। পূর্বফল্গুনী নক্ষত্রের অধিষ্ঠাত্রী দেবতা। ইনি প্রেম ও বিবাহের দেবতা।



৪) বরুন

হিন্দু বৈদিক দেবতা।  বেদে বরুণকে সহস্রলোচন বলা হয়। বেদে আলোর দেবতা মিত্র ও জলের দেবতা বরুণ একত্রে মিত্রাবরুণ নামে পূজিত হন। আবার, আকাশ ও সমুদ্রের মিলনস্থানকে বরুণের অবস্থান হিসাবে চিহ্নিত করা হয়। 
আর্যরা বরুনকে আকাশ ও সূর্যকে তাঁর চক্ষু মনে করত।
পৌরাণিক মতে , ইনি দশদিকের অধিকর্তা ও জলের দেবতা। ইনি বারুণী নামে সমুদ্র থেকে উত্থিত সুরা পান করতেন। মহাভারতের মতে― ইনি কর্দম ঋষির পুত্র। জলের দেবতা হিসাবে ইনি 
অম্বুপ, অম্বুপতি নামেও পরিচিত। আবার দ্বাদশ আদিত্যের একজন হ‌ওয়ার জন্য তাঁকে মতান্তরে ঋষি কশ্যপ ও মাতা অদিতির পুত্র হিসেবেও গণ্য করা হয়।
কথিত আছে একই সময় মিত্র ও বরুণ উর্বশীকে দেখে কামনায় অধীর হয়ে একটি কুণ্ডে বীর্যপাত করেন। এই কুণ্ড থেকে প্রথমে অগস্ত্য ও পরে বশিষ্ঠ মুনির জন্ম হয়। ইনিই খান্ডব দহনের শেষে অর্জুনকে গান্ডীব ও কপিধ্বজ রথ প্রদান করেন।

৫)দক্ষ

হিন্দু পৌরাণিক কাহিনি মতে ইনি প্রজাপতি বিশেষ। এঁর জন্ম এবং সন্তানাদি সম্পর্কে বিভিন্ন মতবাদ রয়েছে। এনাকে ব্রহ্মার মানসপুত্র ও বলা হয়।ব্রহ্মার অঙ্গুষ্ঠ থেকে জন্মেছিলেন বলে  এঁর নাম হয় দক্ষ। প্রজাপতি ব্রহ্মা প্রথমে সপ্তর্ষির সৃষ্টি করেন। এঁদের মধ্যে ঋষি অত্রির বংশধর প্রাচীনবর্হির পুত্র সংখ্যা দশ। এঁরা একত্রে প্রচেতা নামে পরিচিত। এঁদের একমাত্র পুত্র হলেন দক্ষ। কালিকাপুরাণ মতে, ইনি মহামায়ার কঠোর তপস্যা করেন ও বরপ্রাপ্ত হয়ে , কোনো স্ত্রীসঙ্গ ছাড়াই সহস্র পুত্রের জন্ম দেন। পরবর্তী কালে ইনি প্রজাপতি বীরণের কন্যা অসিক্লী কে বিবাহ করেন ও এঁনার মাধ্যমেই মহামায়াকে সতী রূপে, কন্যা হিসাবে লাভ করেন।
আবার মার্কন্ডেয় পুরাণ বলে, তিনি মনু এবং শতরূপার কন্যা প্রসূতিকে বিবাহ করেন। এঁদের ২৪ টি কন্যা , যার মধ্যে ১৩ জন হলেন ধর্মের স্ত্রী। বাকী ১১ জনের সঙ্গে বিভিন্ন ঋষির বিবাহ হয়। দেবী অনুসূয়া,নাগমাতা কদ্রু, অরুন ও গরুড়দেবের মাতা বিনতাও এঁনার‌ই সন্তান।  ইনিই দক্ষরাজ যিনি  ভরা সভায় পুত্রী সতীর সামনে মহাদেবকে অপমান করায় দেবী সতী আত্মহুতি দেন।

৬)অংশ

ঋগ্বেদের ২য় মণ্ডলের ২৭ সূক্তে এঁনার উল্লেখ পাওয়া যায়। ইনি অংশুমান নামেও পরিচিত।অংশুমান বায়ুতে বসবাস করেন। শীতে তিনি রথে চড়ে চারিদিক পরিদর্শন করেন। 

৭) ত্বষ্টা

ইনি দ্বাদশ আদিত্যের একজন। বিষ্ণুপুরানে এঁনার উল্লেখ আছে। ত্বষ্টাকে বিশ্বকর্মা নামেও চিহ্নিত করা হয়। এনার কন্যা হলেও শরণ্যু বা সন্ধ্যা যিনি সূর্যের স্ত্রী। ইনিই দেবরাজ ইন্দ্রের বজ্র, দেবগুরু বৃহস্পতির কুঠার তৈরী করেন। ইনি সোমরসের রক্ষাকর্তা। দেবরাজ ইন্দ্রের সাথে সোমরস অধিকার নিয়েই তারা ধারাবাহিক বিবাদের সৃষ্টি হয়। তাঁর পুত্র বিশ্বরূপ গরু র রক্ষক ছিলেন। তৈত্তরীয় সংহিতায় বলা হয় বিশ্বরূপ দেবরাজ কর্তৃক পরাজিত ও নিহত হন। মতান্তরে ত্বষ্টাকে দেবরাজ এর পিতা হিসাবেও গণ্য করা হয়।

৮) পূষা

পূষা বা পূষন্, হিন্দু  বৈদিক দেবতা এবং আদিত্যদের একজন। পূষা বিবাহ, যাত্রা, রাস্তা ও গবাদি পশুদের খাওয়ানো ইত্যাদি বিষয় পর্যবেক্ষন করেন। এছাড়াও তিনি দস্যু ও বন্য জন্তুদের হাত থেকে যাত্রীদের রক্ষা করেন এবং অন্য পুরুষদের দ্বারা শোষিত হওয়া থেকে পুরুষদের রক্ষা করেন। ঋগ্বেদের দশটি স্তোত্র পূষাকে উৎসর্গ করা হয়েছে। শতপথ ব্রাহ্মনে তাঁকে দন্তহীন দেবতা হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।
জ্বলদর্চি অ্যাপ ডাউনলোড করে নিন।👇

৯) মিত্র
ঋগ্বেদ, বিষ্ণুপুরাণ, শতপথ ব্রাহ্মনে এঁনার উল্লেখ রয়েছে। ইনি বৈদিক যুগে আর্যদের দ্বারা পূজিত হতেন। ইনি আলোর দেবতা। আর্যরা এঁনাকে বন্ধু হিসেবে মনে করতেন।

১০) বিষ্ণু

বিষ্ণুপুরান ও লিঙ্গপুরাণে (হিন্দুধর্মের আঠেরোটি পুরাণের মধ্যে শৈবধর্মীয় পুরাণ) বিষ্ণুর উল্লেখ আছে। এখানে বিষ্ণু অর্থাৎ প্রভু নারায়ণকেও দ্বাদশ আদিত্যের অন্তর্ভুক্ত করা হয়। আসলে বিষ্ণু আক্ষরিক অর্থেই সর্বত্র ব্যপ্ত। তাঁকে বাদ দিয়ে এই জগৎসংসার চলতে পারেনা। বৈষ্ণবমতে তিনিই পরমাত্মা যিনি ক্ষীরসাগরে সহধর্মিনী লক্ষ্মী র সাথে সহাবস্থান করে । অনন্তনাগ বা শেষনাগের শয্যায় শায়িত থাকেন। প্রসঙ্গতঃ শেষনাগ ত্রেতায় লক্ষ্মণ ও দ্বাপরে বলরামরূপে প্রভুর মানব অবতারের অংশীদার ছিলেন। নিরুক্ত গ্রন্থে বলা হয়, "অথ যদ্বিষিতো ভবতি তদ্ বিষ্ণুর্ভবতি।‌‌‌" অর্থাৎ যিনি মায়া ও মোহমুক্ত তিনিই বিষ্ণু।

১১) ধাত্র বা ধাত্রী

হিন্দুধর্মে, ধাত্রী বা ধাত্র হল একজন বৈদিক দেবতা, আদিত্যদের মধ্যে একজন। তিনি স্বাস্থ্য ও গার্হস্থ্য শান্তির দেবতা। তন্ত্রচিহ্ন অঙ্কন করে, বৈদিক স্তোত্র উচ্চারণ করে তাকে তন্ত্রে আমন্ত্রণ জানানো হয়। অশ্বমেধ যজ্ঞের মতো প্রধান যজ্ঞের সময় প্রায়ই আহ্বান করা হত।


১২) বিবস্বান

ইনিই হিন্দুধর্মের প্রধান সূর্যদেবতা। সূর্য পঞ্চায়তন বা পঞ্চদেবতার অন্যতম দেবতা। হিন্দু পন্ডিত ও দার্শনিক আদি শঙ্কর বা শঙ্করাচার্য্য পঞ্চদেবতার পূজা প্রচলন করেন। এঁনারা হলেন শিব, দুর্গা, গণেশ, সূর্য, বিষ্ণু। দিবাকর,অর্ক, ভানু, ভাস্কর, মার্তণ্ড- এঁনার‌ই ভিন্ন, ভিন্ন নাম। শঙ্খ, চক্র, তীর-ধনুক এঁনার অস্ত্র।
সপ্তাশ্ববাহিত রথে , অরুন সারথি সঙ্গে তিনি আকাশপথে পরিভ্রমণ করেন। তাঁর রথের ঘোড়াগুলি সাতটি পৃথক পৃথক রঙের, যা রঙধনুর সাত রঙের প্রতীক।কিছু প্রাচীন গ্রন্থে ও শিল্পকলায সূর্যকে ইন্দ্র, গণেশ বা অন্যদের সাথে একত্রিতভাবে উপস্থাপন করা হয়।
রামায়ণ ও মহাভারতে, সূর্যকে যথাক্রমে সুগ্রীব ও কর্ণের আধ্যাত্মিক পিতা হিসাবে উল্লেখ করা হয়েছে।সূর্যকে চক্র দিয়ে চিত্রিত করা হয়েছে, যাকে ধর্মচক্র (এই চক্র জ্ঞানের প্রতীক। হিন্দুধর্ম, বৌদ্ধধর্ম, জৈনধর্মে এই চক্রকে সম্মান দেওয়া হয়) হিসেবেও ব্যাখ্যা করা হয়েছে। ঋগ্বৈদিক স্তোত্রে সূর্যকে আকাশের রত্ন বলা হয়।
যম, যমুনা বা যমী, শনিদেব, মনু, অশ্বিনীকুমারদ্বয়, ভদ্রা, তাপ্তি, সুগ্ৰীব, কর্ণ তাঁর সন্তান। সংজ্ঞা (উষা), ছায়া ও রাত্রি তাঁর দাম্পত্যসঙ্গিনী।

আমাদের হিন্দুপুরাণের বিশালতা অপরিমেয়। আমরা কিছু কিছু বিষয় হয়ত অনুধাবন করতে পেরেছি। এছাড়াও পুরাণ সম্পর্কে বিভিন্ন মতবাদ থাকে যার সত্যাসত্য বিচার করা ক্ষুদ্র জ্ঞানে একপ্রকার অসম্ভব।  শতপথ ব্রাহ্মণ, ঋগ্বেদ, মহাভারত দ্বাদশ রবি, একাদশ রুদ্র, অষ্টবসু, অশ্বিনীকুমার ভ্রাতৃদ্বয় সম্পর্কিত নানা তথ্য দিয়ে থাকে। এঁনার‌ই একত্রে তেত্রিশ কোটি দেবতা নামে পরিচিত।

Post a Comment

3 Comments

  1. তথ্য সমৃদ্ধ। অবাক লাগে এটা ভেবে যে বেশিরভাগ হিন্দু ধর্মাবলম্বী দ্বাদশ রবি সম্পর্কে জানেই না , অথচ একজন ভিন ধর্মী হয়েও হিন্দু পুরাণ সম্পর্কে কতটা অভিজ্ঞতা ছিল কবি নজরুলের !!! ধন্যবাদ লেখিকাকে ।

    ReplyDelete
  2. সুন্দর তথ‍্য সমৃদ্ধ লেখা। পুরাণ সম্বন্ধিত আরও এমন লেখা পড়ার ইচ্ছা রইলো।

    ReplyDelete
  3. কতো বিশদে, সুন্দর করে পৌরাণিক তথ্যগুলি অবগত করিয়েছেন লেখিকা।
    অভিনন্দন রইলো তাঁকে। পুরো নিবন্ধটি টুকে রাখলাম। আন্তরিক কৃতজ্ঞতা।

    ReplyDelete