জ্বলদর্চি

লোকমাতা রানি রাসমণি—২ /সুমিত্রা ঘোষ

লোকমাতা রানি রাসমণি—২
সুমিত্রা ঘোষ


বাংলার ঘোর দুর্দিন যেন বেড়েই চলল। ইংরাজী ১৭৭০ (বাংলা১১৭৬) সালে অনাবৃষ্টির ফলে সমগ্র বাংলায় দারুণ দুর্ভিক্ষ দেখা দিল। সেই মর্মান্তিক আকালের সময় ইংরেজ দেওয়ান রাজস্বের হার আরও বাড়িয়ে দিল। সাধারণ কৃষক ও গরীর লোকেরা অনাহারে মারা যেতে লাগল। জমিদার ও বিত্তবান লোকেদের  অবস্থাও খারাপ হতে থাকে, সময়মত খাজনা মেটানো তাদের পক্ষে সম্ভব হচ্ছিল না। ঘরে যেটুকু পুঁজি ছিল তাও শেষ হয়ে গেছিল। সেই বছরটা বাঙালির স্মৃতিতে ছিয়াত্তরের মন্বন্তর (৭৬) নামে ইতিহাসের পাতায় এক চরম অভিশাপ হয়ে বেঁচে আছে বা ঠাঁই নিয়েছে। সেই মন্বন্তরে আনুমানিক এককোটি লোকের মৃত্যু হয়েছিল।

এই দুর্বিষহ অবস্থার মধ্যে জন্ম নিয়েছিলেন বাংলা নবজাগরণের প্রাণপুরুষ রামমোহন রায়। অনুমান ১৭৭২ (মতান্তরে ১৯৭৪) সালে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। এই শতাব্দীকে অনেকে অন্ধকারাচ্ছন্ন যুগ বলে অভিহিত করলেও এই শতাব্দীতেই জন্মগ্রহণ করেন বাবা লোকনাথ, সাধক কবি রামপ্রসাদ, প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর এবং আমাদের সকলের অতি আপনজন লোকমাতা রানি রাসমণি।

সময়টা ছিল বাংলা শতাব্দীর শেষ বছর অর্থাৎ ১১শ সাল শেষ হয়ে ১২০০ সাল পড়েছে। ইংরাজী ১৭৯৩ সালের ১১ই আশ্বিন বুধবার এক যুগসন্ধিক্ষণে বাংলার এক গণ্ডগ্রামের অতি দরিদ্র মাহিষ্য বংশে জন্ম নিলেন রানি রাসমণি। তাঁদের পরিবার ছিল কৃষক পরিবার। রাসমণির বংশ কোনদিক দিয়েই উচ্চ ছিল না, গতানুগতিকভাবে দিন গুজরান করত এই পরিবার।
দীর্ঘ তিরিশ বছর ধরে নিয়মিত : জ্বলদর্চি। 
জ্বলদর্চি অ্যাপ ডাউনলোড করে নিন।👇
🍂

রামমণির জন্মের পর নাম রাখা হয় রাসমণি,কিন্তু তাঁর মা রামপ্রিয়া রাসমণি নামের সাথে রানি শব্দটি যোগ করে দেন। তিনি রানি  হয়ে জন্মেছেন এমন ভাবনা হয়তো-বা মা রামপ্রিয়ার মনে হতে পারে। রানি খেতাব পাওয়া নাম নয়, গর্ভধারিণীর দেওয়া নাম। যে নাম বাংলার ইতিহাসে চিরকালের জন্য স্বর্ণাক্ষরে জ্বল জ্বল করবে। তখন ইংরাজী অষ্টাদশ শতাব্দী চলছিল। এই শতাব্দী আর সাত বছর পর পা রাখবে উনবিংশ শতাব্দীতে। ঊনবিংশ শতাব্দীতে বাংলায় নবজাগরণের সূচনা হয়। বাংলার রত্নগর্ভা মায়েদের সন্তানরা একে একে জন্মগ্রহণ করতে থাকেন। এই সময় সমাজ কুসংস্কারে আছন্ন ছিল। জাত-পাতের ব্যবধান রচনায় সমাজপতি তথাকথিত পুরোহিত মণ্ডলীরা অতি তৎপর ছিল। ধনীদের অহংকার, দরিদ্রের নীরব-ক্রন্দন আর বিদেশী শাসকদের লাঞ্ছনা-অত্যাচার একসঙ্গে সম্মিলিত হয়ে অষ্টাদশ শতাব্দীর অন্ধকারময় যুগকে তমসাচ্ছন্ন করে রেখেছিল। উনবিংশ শতকের প্রথম পাদেও এমন দুর্বিষহ অবস্থা বর্তমান ছিল।

১৭৯৩ সালে (১২০০ সাল) বাংলার এ হেন সমস্যাসঙ্কুল সামাজিক পরিবেশে রাসমণি জন্মগ্রহণ করেন। দরিদ্রের কন্যা রাসমণি। পিতার নাম হরেকৃষ্ণ দাস, মাতার নাম রামপ্রিয়া দাস। হারু ঘরামি নামে পরিচিত ছিলেন রাসমণির-পিতা হরেকৃষ্ণ দাস। হরেকৃষ্ণ দাসের বংশ মাহিষ্য-বংশ নামে পরিচিত ছিল এবং সামাজিক বিচারে এই বংশ নীচু-স্তরের ছিল। হিন্দুর ঘরে নীচু বর্ণে জন্মগ্রহণ করাটা সেইকালে ছিল এক মহা অভিশাপের মতো। নীচু জাতের মানুষ ধন-কুবের হলেও সমাজে সে ব্রাত্য। ব্রাহ্মণ হতদরিদ্র হলেও উচ্চবর্ণের বলে সামাজিক বিচারে নিগৃহীত বা লাঞ্চিত হত না।

নীচজাতির ঘরে জন্মগ্রহণ করলেও রাসমণির গায়ের রং ছিল টুকটুকে ফর্সা, অপূর্ব লাবণ্যময়ী মুখশ্রী, একপিঠ চুল। 

Post a Comment

0 Comments