মেদিনীপুরের মানুষ রতন, পর্ব -- ৬০
গণপতি কর (মেদিনীপুরের সমস্ত শিশুতোষ খেলনা বিক্রয়কারীর প্রতিনিধি, খড়গপুর)
ভাস্করব্রত পতি
আজ যাঁকে 'মানুষ রতন' হিসেবে স্থান দিয়েছি, তিনি হয়তো অশিক্ষিত। তিনি হয়তো গবেষক, সমাজসেবক, শিক্ষক, চিকিৎসক, বিজ্ঞানী, অধ্যাপক, রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব নয়। আখেরে একজন ফেরিওয়ালা। তথাকথিত সমাজের জন্য তাঁর তেমন কোনো অবদান নেই। এরকম ফেরিওয়ালা মেদিনীপুরের বুকে অজস্র বলে ধারণা অনেকের। কিন্তু তিনি অন্য ধরনের ফেরিওয়ালা। তিনি 'স্বপ্ন' ফেরি করেন। তিনি 'শৈশব' ফেরি করেন। তিনি কুসুম কোমল শিশু মনগুলোতে নিখাদ আনন্দ ফেরি করেন। তিনি আজ জেলার এরকম আপামর ফেরিওয়ালাদের প্রতিনিধি। এরকম মানসিকতার এবং কর্মদক্ষতার সকল ফেরিওয়ালাদের হয়ে 'মানুষ রতন'! আজ তাই গতানুগতিক ধারার স্বীকৃত 'মানুষ রতন'দের বাইরে সম্পূর্ণ মানবিক দৃষ্টিভঙ্গিতে তুলে আনলাম রাস্তার এক অনালোকিত, অনালোচিত এবং অনাবিষ্কৃত সাদামাঠা শিশুতোষিক প্রিয়জনকে। 'ফটাফট' বিক্রেতাকে। যিনি কিনা নিজের অজান্তেই বছরের পর বছর ধরে শিশু কিশোরদের মন থেকে হারিয়ে যেতে দেননি নির্মল আনন্দের উন্মাদনা! পোষণ করে রাখতে বাধ্য করেছেন নস্টালজিক ইতিহাসকে।
যার সম্পর্কে এবারের আলোচনা, তিনি মোটেও কেউকেটা নন। পুঁথিগত কচকচানিও নেই। আমরা তাঁকে দেখি। তাঁর কাছ থেকে অপূর্ব এক খেলনা কিনি। কিন্তু মনের কোনে তাঁকে কোনোদিন বসাতে পারিনি। অথচ তিনি বিগত ৫০ বছর ধরে আমাদের শিশু কিশোর মনকে আন্দোলিত করে রাখেন সম্পূর্ণ অন্য স্বাদের খেলনা উপহার দিয়ে।
তিনি গণপতি কর। 'ফটাফট' বিক্রেতা। উৎসবের দিনগুলোতে ব্যস্ততা বাড়ে তাঁর। নাওয়া খাওয়ার সময় জোটেনা। জেলার এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত ছুটে চলেন। বাসের টায়ার কেটে তৈরি চটি পায়ে দিয়ে কেবল 'হন্টনম্’। পথচলায় বিরাম নেই। রোদ, বৃষ্টি, ঝড় তাঁকে ভয় করে। তাঁর 'যাত্রাপথ'কে সমীহ করে। শ্রদ্ধা করে।
এই অশীতিপর বৃদ্ধের আদি বাড়ি পূর্ব মেদিনীপুরের ভগবানপুরের বেতলা চকলালপুরে। কাজের প্রয়োজনে পরিবার সহ থাকেন খড়গপুরের রেল স্টেশনের কাছাকাছি। বাবা তারকনাথ কর এবং মা হাজিবালা করকে কেবল মনে রেখেছেন। দেশের বাড়ির কথা কিছুই মনে নেই তেমন।
তিনি বিক্রি করেন ‘ফটাফট'! যে কোনো শিশু কিশোর যুবা এই নামটির সাথে অতি পরিচিত। দক্ষিণবঙ্গ এলাকায় তিনিই এই ‘ফটাফট' এর একমাত্র কারিগর ও বিক্রেতা বলা যায়। সর্বশেষ প্রতিনিধি বললেও অত্যুক্তি হয়না। নিজেই তৈরি করেন, নিজেই বিক্রি করেন। গ্রামবাংলার একটা হারিয়ে যাওয়া লৌকিক খেলার উপকরণ। ফুটবল, ক্রিকেট, তাস, দাবা, লুডো ভলিবলদের তুলনায় ধারে ভারে মোটেও কুলীন নয়। কিন্তু গণপতির ফটাফটে লুকিয়ে আছে শৈশবের উন্মাদনা, মিশে আছে আগুন মাখা অন্তরঙ্গতা, জড়িয়ে আছে অনাবিল ভালোবাসা। শৈশবের আবেগ যেন পরতে পরতে প্রকট এবং প্রকাশ পায় ফটাফটের চালচলনে।
খেলনাটা এমন কিছু আহামরি নয়। তবে বেশ মজার। মারবেলের মতো সাইজের মাটির গোল বল। তার সাথে সুতো আটকানো। বলটির গায়ে লাল রঙের রঙ কাগজ জড়ানো। আর সুতোতে আটকানো একটা এক ফুট দৈর্ঘ্যের রাবার। তার মাথায় একটা ফাঁশ লাগানো। সেখানে আঙুল ঢুকিয়ে ঐ বলটিকে ছুঁড়ে দিলেই ‘ফটাফট’ ফের চলে আসে হাতের তালুতে।
দারুণ জনপ্রিয় এই 'ফটাফট' এর দাম মাত্র এক টাকা। গণপতি করের কথায়, একসময় ৫ পয়সা, ১০ পয়সা হিসেবে বিকিয়েছে এক একটা। এখন দুর্মূল্যের বাজারেও মাত্র এক টাকাতে তিনি বেচছেন ফটাফট। তবে আগের চেয়ে ক্রেতা কমেছে। খদ্দের কমেছে। বর্তমান প্রজন্মের বেশিরভাগ ছেলে ছোকরারাই এ জিনিস চোখে দেখেনি। যাঁরা দেখেছে তাঁরা প্লাস্টিকের বল যুক্ত 'ফটাফট' ব্যবহার করেছে। এরকম শুকনো মাটির তৈরি নয়।
প্রায় হারাতে বসা এই খেলনাটি একটা স্টিলের থালায় নিয়ে বেরিয়ে পড়েন পশ্চিম বাংলার বিভিন্ন স্থানে। মেলা, উৎসব হলে তো কথাই নেই। মুখে কেবল আওয়াজ 'অ্যাই দিল্লি কা লাড্ডু, বোম্বাই কা মাল..... ফটাফট'।
এই রব শুনলেই ক্রেতারা বুঝতে পারেন কি জিনিস বিক্রি হচ্ছে। প্রতিদিন গড়ে ১০০ পিস বিক্রি করেনই। ১৩৭৪-৭৫ নাগাদ বাড়ি ছাড়া হয়ে খড়গপুরে চলে এসেছিলেন। পরে পুরীতে গিয়ে প্রথম দেখেন উত্তরপ্রদেশের এক ব্যক্তি এটা বিক্রি করছে। তা দেখে আগ্রহ হল। সেবার কিনে নেন এক গ্রোস মাল। মাত্র ৪ টাকায়। এরপর থেকে নেমে পড়লেন এই ব্যবসায়। ছেদ নেই আজওআজও। শুরু করে দেন মানুষের মনপ্রাণ সবুজ সতেজ রাখার কাজ।
বাড়িতে বুড়ি ননিবালাকে রেখে সকাল সকাল বেরিয়ে পড়েন ফটাফট বেচতে। ছেলে, বউমা, নাতি, নাতনি নিয়ে ভরাট সংসার। কিন্তু কেউই তাঁর এই পেশাতে মাথা ঘামায়না। সাহায্য করেনা।
কয়েকটা দাঁত ভাঙা। মুখময় পাকা দাঁড়ি। পায়ের চেটো ফুটিফাটা। গায়ের জামাটায় ছাতা ফুটেছে। ঘামের গন্ধ বিধকুটে। মাথায় বাঁধা তেল চিটানি গামছা, চোখে চশমা। রাতে দেখতে পাননা, দুকাঁধে দুটো তাপ্পি মারা ব্যাগ। একটাতে জলের বোতল। হেঁটে চলেন অনবরত। এপাড়া থেকে ওপাড়া ঘুরে ঘুরে তিনি বেচেন ‘ফটাফট’। একটা হারাতে বসা খেলনাকে টিকিয়ে রাখার অন্তিম প্রয়াস এই থুড়থুড়ে বুড়োর।
‘উৎসব’ তাঁর মনকে ছোঁয়না। তাঁর প্রাণে উদ্যম আনেনা। তাঁর হৃদয় আন্দোলিত করেনা। তবুও তিনি নিরলসভাবে উৎসবের আঙিনায় আনন্দ বিতরণ করেন। ভিড় ভিড়াক্কার এলাকায় কেবল শুনতে পাওয়া যায় ফেরিওয়ালা গণপতি করের গলার আওয়াজ : 'অ্যাই, দিল্লিকা লাড্ডু, বোম্বাই কা মাল... ফটাফট'!
0 Comments