জ্বলদর্চি

রবি দে (চিত্র শিল্পী, মেদিনীপুর)/ ভাস্করব্রত পতি

মেদিনীপুরের মানুষ রতন, পর্ব -- ৫৭

রবি দে (চিত্র শিল্পী, মেদিনীপুর) 

ভাস্করব্রত পতি

ঘাট বছর বয়স তাঁর কাছে 'বালাই ষাট'। তাই অবসরের পরেও তিনি 'ছাত্র' হয়েই থাকতে চান। শান্তিনিকেতনে ছোটেন ছবি আঁকা শিখতে। ভাস্কর্য শিখতে। 

তিনি মেদিনীপুর শহরের নজরগঞ্জ জানা পাড়ার রবি দে। বয়সে প্রবীণ হলেও মনের দিক থেকে চূড়ান্ত নবীন। তাঁর নেশা ছবি আঁকা। মূর্তি ভাস্কর্য গড়া। আর এই শিল্পকলাকে পাথেয় করেই মেদিনীপুরকে গৌরবান্বিত করেছেন। হয়ে উঠেছেন 'মেদিনীপুরের মানুষ রতন'। 
প্রাচীন বগড়ি পরগণার মহিতা গ্রামে জন্ম। বর্তমানে গড়বেতার অধীন। ১৯৪৮ এর ৩১ জানুয়ারি তাঁর জন্ম। এক সময় বাবা হরিপদ দে ভালো শিল্পী ছিলেন। তাই বাবার আদল পেয়েছেন তিনি তাঁর ভবিষ্যৎ জীবনেও। রবি দে'র কথায়, 'আমাদের বাড়িতে এক সময় রথ বানানো হত। সেই রথের কারুকার্য বানানো দেখতেন তিনি। আগ্রহ বাড়ে তখন থেকেই'।

পেশায় ব্লকের গ্রামসেবক ছিলেন। পরবর্তীতে সহ কৃষি সম্প্রসারণ আধিকারিক ছিলেন কোলাঘাট, গোয়ালতোড়, দাসপুর-১, মেদিনীপুর শহর ব্লকের। সেই চাকরি আজ আর নেই। অবসর নিতে হয়েছে বয়সের কারণে। কিন্তু ছোটবেলায় শেখা শিল্পপ্রেম এখনও সমানভাবে সতেজ এবং সরস। স্ত্রী এবং দু মেয়েকে নিয়ে সংসার। দুজনেই কর্মরত। পিছুটানহীন এই মানুষটি তাই সবসময় মেতে থাকেন শিল্পচর্চায়। বিছানায় শুয়ে শুয়ে তাঁর কল্পনার জগতে আঁকা হয় শৈল্পিক কারুকাজ। 
পটচিত্র শিখতে তিনি গিয়েছেন নির্ভয়পুরের গৌরী চিত্রকরের কাছে। যিনি রাষ্ট্রপতি পুরস্কার পেয়েছিলেন। এছাড়া গিয়েছেন পটের গ্রাম পিংলাতেও। বারবার গিয়েছেন শিল্পীর কাছে, শিল্পের কাছে। শিল্পের প্রতি এরকমই অমোঘ ভালোবাসা রয়েছে রবি দের। একসময় বিখ্যাত চিত্রকর রামকিঙ্কর বেজের সান্নিধ্যে এসেছিলেন। তাই তিনি জোর দিয়ে বলেন, তাঁর জীবনের একটা ভালো অংশ জুড়ে রয়েছেন এই চিত্রশিল্পী রামকিংকর।

২০০৮ এ চাকরিজীবন থেকে অবসরের পর বিশ্বভারতীর কলাভবনে ভাস্কর্য বিভাগের ছাত্র হয়েছেন। এক বছরের ইণ্ডিয়ান ক্যাজুয়াল কোর্স করেছেন অবসরের পর। 'ধন্যি ছেলের অধ্যবসায়' বলাই যায় এই অন্য ঘরানার মানুষটিকে৷

কখনও ছেনি হাতুড়ি, আবার কখনও রঙ তুলি নিয়ে তাঁর কাজকর্ম। বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে তাঁর হাতের কাজ। মেদিনীপুর শহরে রয়েছে তাঁর হাতে তৈরি বেশ কয়েকটি 'ম্যুরাল' এর কাজ। মেদিনীপুর শিশু উদ্যানে মিলবে 'আউটডোর স্কাল্পচার'-এর ইন্সটলেশন। এখানে স্কাল্পচারটির নাম 'মাশরুম'। বহু ব্যক্তির ব্যক্তিগত সংগ্রহে রয়েছে রবি দের হাতে তৈরি নানা উপাদান। আজ তিনি সেসবের জন্য আফসোস করেন। তাঁর হাতে তৈরি অনেক সামগ্রী তাঁর কাছে নেই। যেগুলো আর কখনো তিনি তৈরি করতে পারবেন না। যেমন একটি ৩ ফুট উচ্চতার কাঠের বুদ্ধ মূর্তি। সবচেয়ে প্রিয় কাজ ছিল তাঁর। কিন্তু তিনি তা দান করে দিয়েছিলেন। 

চোখ বন্ধ করলে সবকিছুর মধ্যে শিল্প দেখতে পান। আসলে তিনি মানেন যে শিল্প করার জন্য বেশি দেখার দরকার হয়না। পটুয়াদের পটশিল্প তাঁর কাছে বিস্ময়। এঁদের কাছে ছবি আঁকার যে আত্মবিশ্বাস দেখতে পেয়েছেন তা তিনি অকপটে স্বীকার করে নিয়েছেন। এই আত্মবিশ্বাস আসলে ঈশ্বরের আশীর্বাদ। সেই আত্মবিশ্বাস তিনি আত্মীকরণ করেছেন নিজের শিল্পচর্চার ক্ষেত্রে। তাঁর মতে, যতদিন বেঁচে থাকতে হবে, ততদিন খুব কাজ করে যেতে হবে। প্রচুর কাজ করে যেতে হবে। এই মুহূর্তে তিনি অসুস্থ। চোখের জ্যোতিও কম। তাই কাজের গতিও কম। কিন্তু মননে পুষে রেখেছেন শিল্প ভাবনা। চোখ বন্ধ করে দেখতে পান সারি সারি পাহাড়। আর সেই পাথরের চাঁই থেকে অসংখ্য শিল্পকলার সম্ভার ধরা পড়ে তাঁর শিল্পী চোখের দৃষ্টিতে। 
তিনি তৈরি করেন কাঠের মূর্তি। তৈরি করেন পাথরের মূর্তি। তৈরি করেন মাটির মূর্তি। জড় বস্তুর ভেতরে প্রাণ প্রতিষ্ঠা করতে চান তিনি। মূর্ত এবং বিমূর্ত জিনিসের মধ্যে মিলন ঘটাতে চান তিনি। শুধু নিজের শেখা নয়, যাঁরা শিখতে আগ্রহী, অনায়াসে তিনি তাঁদের পাশে দাঁড়ান। সহায়তার হাত বাড়িয়ে দেন। সম্প্রীতির কথা বলেন। সংস্কৃতির কথা বলেন।

অতি সাধারণ জীবনযাপন তাঁর। নামী শিল্পীদের মতো দেখনদারী ভাব তাঁর নেই। তাই কোথাও সংস্কৃতি চর্চার খবর পেলেই ছুটে যান চিত্র রসিক রবি। তাঁর প্রাণচঞ্চলতা কখনও অস্ত যায় না। দুর্বার বেগে ছুটে বেড়ান এপ্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে। ছবির স্বার্থে, ভাস্কর্যের স্বার্থে।
জ্বলদর্চি অ্যাপ ডাউনলোড করে নিন।👇



Post a Comment

0 Comments