জ্বলদর্চি

শব্দে গাঁথা মণি-মালা : ৮ / সালেহা খাতুন

শব্দে গাঁথা মণি-মালা : ৮ / সালেহা খাতুন 

শৈশবে প্রতি বছর অ্যানুয়ালের রেজাল্ট বেরোনোর আগে দাদুর সঙ্গে মাসির বাড়ি এবং মামার বাড়ি যাওয়া একটা রুটিনের মতো ছিল। পরীক্ষা হয়ে গেলেই দাদু আসতেন আর আমাকে নিয়ে প্রথমে ফুলেশ্বরে মেজো মাসির কাছে যেতেন আর ওখান থেকে পায়ে হেঁটে উলুবেড়িয়ায় বড়ো মাসির বাড়ি হয়ে নিজের বাড়ি বাগনানে ট্রেনে অথবা বাসে করে নিয়ে যেতেন। আসলে দাদু একসঙ্গে তিন মেয়ের বাড়িই পরিক্রমা করতেন। আমার বেলডুবি হাইস্কুলের স্যার সংস্কৃতের মাস্টারমশাই মাননীয় শ্রীধ্রুবকুমার চট্টোপাধ্যায় মহাশয়ের বাড়ি দাদুর বাড়ির খুব কাছাকাছি ছিল। ফলে স্যারের মাধ্যমে জিনিসপত্তর,চিঠিপত্র,সংবাদ আদানপ্রদান সবই চলতো। স্যারের মাধ্যমে বাবা বলে পাঠাতেন “ওমুক দিন রেজাল্ট বেরোবে মণিকে নিয়ে চলে আসুন”। ক্লাস ফাইভে রেজাল্ট বেরোনোর আগে বাড়ি ফিরতে বাবা মুচকি মুচকি হাসছিলেন আর বলছিলেন “কেমন রেজাল্ট হবে বলে মনে হয় তোর”? সারা উঠোন তখন শীতকালীন ধানের ঘ্রাণে ম ম করছে। আমি তো কুঁকড়ে যাচ্ছি। কী জানি কী হবে ভাবনা কুরে খাচ্ছে।
🍂

যাক উতরে গেলাম। ক্লাস সিক্সে প্রোমোশন পেয়ে গেলাম। ক্লাস ফাইভে হেড মাস্টারমশাই মাননীয় শ্রীবিশ্বনাথ কোলে মহাশয় নিজের লেখা ইংরেজি গ্রামারের বই আমাকে উপহার দিয়ে বলেছিলেন “ভার্বের সঙ্গে ভাব” রাখতেই হবে। যদিও আমরা অত্যন্ত দুর্ভাগা ব্যাচ, আমাদের সময়ে ক্লাস সিক্স থেকে ইংরেজি পড়ানো শুরু হয় “লার্নিং ইংলিশ” বইটির মাধ্যমে।

বেলডুবি হাইস্কুলে তখন ফাইভ সিক্সে হিন্দি পড়ানো হতো। পড়াতেন মাননীয় আব্দুল মাজেদ সাহেব। আমার স্যারদের তুলনা হয় না। আমি আজো মনে করি অতুলনীয় সব মাস্টারমশাই পেয়েছিলাম বলেই আমার মনের প্রসার ঘটেছে। আর স্কুলের সিনিয়ররাও পথ দেখাতো। নতুন ক্লাসে উঠতাম আর সিনিয়রদের পুরোনো বই হাফ দামে কিনে নিতাম। তাতে একটা সুবিধে হতো তারা কীভাবে পড়েছে সেটা বুঝতে পারতাম।

ঘরের মধ্যে বাবা সারাজীবন যে জায়গায় বসে পড়াশোনা করেছেন সেই জায়গাটি উত্তরাধিকার সূত্রে আমিও অর্জন করলাম। মাটির তৈরি মোটা দেওয়ালের বাড়ি ফলে ভীষণ চওড়া একটা জানালা ছিল আমার টেবিল আর তক্তপোশটা ছিল চেয়ার। তবে ক্লাস সিক্সে বাবা আমার কম্পিটিটর হয়ে গেলেন। দুজনেই পালা করে ঐ জায়গায় বসে পড়াশোনা করতে শুরু করলাম। আসলে সে বছর বাবা কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রাইভেটে ইসলামিক হিস্ট্রিতে এম.এ. পরীক্ষা দিচ্ছিলেন। কারণ ১৯৬০ সালে উলুবেড়িয়া কলেজের চতুর্থ বর্ষের ছাত্র থাকাকালীন অবস্থাতেই ১৯৬০ সালেরই এপ্রিল মাসে প্রতিষ্ঠিত বেলডুবি হাইস্কুলে ১৫ ডিসেম্বরের পরের দিন স্কুলের শুভাকাঙ্ক্ষীদের অনুরোধে বাবা যোগদান করেন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটিকে বাঁচানোর জন্য। অনেক ঝড় ঝাপটা পেরিয়ে স্কুলের অনুমোদনের পর জেলা পরিদর্শক মহাশয়ের নির্দেশে ১৯৬৬-৬৭ তে বি. টি. পড়তে যান। তারপর আমাকে নিজের স্কুলে ভর্তি করে আবার পড়াশোনা শুরু করেন।

আর ভালো করে অঙ্ক প্র্যাকটিশ করার জন্য আমাকে ঘোষ বাড়ির মানুদার কাছে পাঠালেন। সারাদিন স্কুলের পর সন্ধ্যায় পড়তে যেতাম। কী যত্ন করে মানুদা পড়াতেন। বাবা হ্যারিকেন নিয়ে আমাকে আনতে যেতেন। মানুদার বাড়িতে ইলেকট্রিকের আলোয় পড়তে পেলেও বাড়িতে কেরোসিনের আলোই ভরসা ছিল। একই গ্রামে বাস করেও এ বৈষম্য যে রাজনৈতিক কারণে তা ঐ ছোটো বয়সে বুঝতে পারতাম না।

 ১৯৮৪ এর অক্টোবরের শেষদিন সন্ধ্যায় আমাদের পড়াতে পড়াতে মানুদা তাঁর দাদা গোপালদাকে ডেকে বললেন দাদা সাংঘাতিক খবর, “ইন্দিরা গান্ধীকে তাঁর দেহরক্ষী গুলি করেছে”। ঐ ছোটো বয়সেই মানুদার কথা থেকে আন্দাজ করে নিয়েছি পরবর্তী পরিস্থিতি কী হতে চলেছে। দুপুর আড়াইটায় ইন্দিরা গান্ধীকে মৃত ঘোষণা করা হলেও সরকারীভাবে সন্ধ্যা ছটায় এ খবর ঘোষণা করা হয়। তখন ঘরে ঘরে টি ভি ছিল না। তবুও সংবাদ ছড়িয়ে পড়ল রেডিওর মাধ্যমে। মানুদা বোঝালেন রাজার মৃত্যু হলেও আগে সঙ্গে সঙ্গে ঘোষণা করা হতো না কেননা তাতে অরাজকতা দেখা দিতে পারে।সেদিন আর পড়া হলো না, শুধু সেদিনই নয় বেশ কয়েকদিন স্কুল বই খাতা বন্ধ থাকলো। ট্রেন চলাচল বন্ধ হয়ে গেল। ছোটোমামা সাঁকরাইল থেকে হেঁটে হেঁটে রেল পথ ধরে আমাদের বাড়ি এলেন। বাবার এম. এ.পরীক্ষা স্থগিত হয়ে গেল। বাবা পাঁচলা কেন্দ্র কংগ্রেসের দায়িত্বে আছেন তখন। বিষাদে আচ্ছন্ন হয়ে গেলেন। ‘অদুদদা’ বলে সবাই বাবার কাছে আছড়ে পড়লো।
নিজেদের ঘরে তখন টিভি ছিল না। আমাদের পাড়ার ক্লাবে টিভিতে তখন ইন্দিরা গান্ধীর শেষকৃত্য দেখানোর ব্যবস্থা করা হলো, ব্যাটারির সাহায্য নিয়ে। কেননা তখনও পাড়াতে ইলেকট্রিক আসেনি। শেষ দৃশ্য দেখে হাপুস নয়নে কেঁদেছিলাম। আমাদের স্কুলে তখন বাৎসরিক পরীক্ষায় ভালো ফল করলে বই উপহার দেওয়া হতো। ক্লাস ফাইভে পেয়েছিলাম লীলা মজুমদারের ছোটোদের শ্রেষ্ঠগল্প। ক্লাস সিক্সের রেজাল্টের জন্য পেলাম “ভারতরত্ন ইন্দিরা” গ্রন্থটি। গোগ্রাসে পড়ে ফেললাম। সুন্দর সুন্দর ছবি ছিল বইটিতে। উঁচু ক্লাসের দাদা দিদিরা অনেকেই আমার থেকে বইটি নিয়ে পড়েছিল।

ক্লাস সিক্সেই আমি কোরআন শরীফ পড়া সম্পূর্ণ করি, আমার বন্ধু মোসলেমার দাদুর কাছে। আমরা সমবয়সী। প্রাইমারির পর ও বাউড়িয়া গার্লসে ভর্তি হয়। কিন্তু ক্লাস সিক্সেই ওর বিয়ে হয়ে যায় আলকাশ চাচার সঙ্গে। আলকাশ চাচা বাবার ছাত্র। বেলডুবিতে পড়েছে। বিয়ের পর মোসলেমা আরো বছর তিনেক পড়াশোনা করে। কিন্তু বিয়ের পর স্কার্ট ফ্রক পরে স্কুলে যেতো বলে পাড়ার লোক প্রচুর সমালোচনা করতো। সংসার এবং পড়াশোনায় তাল মেলাতে না পেরে মোসলেমার স্কুল যাত্রায় ছেদ পড়লো।
( ক্রমশ)

Post a Comment

0 Comments