বিস্মৃতপ্রায় সাহিত্যিক প্রণবেন্দু দাশগুপ্ত
নির্মল বর্মন
অধ্যাপক প্রণবেন্দু দাশগুপ্ত অধ্যাপনার পাশাপাশি সাহিত্যচর্চাতেও বদ্ধপরিকর ছিলেন। কবি প্রণবেন্দু দাসগুপ্ত কলকাতাতেই ২৯ শে জুলাই ১৯৩৩ সালে জন্মগ্রহণ করেন। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তুলনামূলক সাহিত্যে এম.এ পাস করেন। উত্তর ক্যারলিনা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্যে এম.এ পাস করেন। মিনেসোটা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পি.এইচডি.ডি ডিগ্ৰীলাভ করেন।
যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় তুলনামূলক সাহিত্যে বিভাগের অধ্যাপক ছিলেন, সঙ্গে সঙ্গে যত্ন সহকারে "অলিন্দ" পত্রিকার সম্পাদনা করতেন। কৃত্তিবাস পত্রিকা লেখালেখি করলেও , তিনি সম্পূর্ণ নতুন মেধাভিত্তিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছেন। বাংলা সাহিত্যে অবদানের জন্য পশ্চিমবঙ্গ সরকার ২০০৬ সালে "রবীন্দ্র পুরস্কার" এ পুরস্কৃত করেছেন। কবি প্রণবেন্দু দাসগুপ্ত আনন্দবাজার পত্রিকা , দ্য স্টেটসম্যান ও দেশ পত্রিকার আর্ট সমালোচক ছিলেন। কবি'র সময় ও সমাজে রাজনৈতিক স্থিতাবস্থা ভাঙ্গনের সূচনা পর্বে কবির মনে যে ভাব ও বিশ্বাস ফুটে উঠেছিল সেটাই সহজ সরল ভাষায় কবিতায় প্রয়োগ করেছেন।
২০০৭ সালে কবি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
কবি সাহিত্যিক প্রণবেন্দু দাশগুপ্তের উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থ গুলি হল ঃ--
'এক ঋতু' ; 'সদর স্ট্রীটের বারান্দা' ; 'নিজস্ব ঘুড়ির প্রতি' ;
'শুধু বিচ্ছিন্নতা নয় ' ; 'হাওয়া স্পর্শ করো' ; 'মানুষের দিকে' ; 'অন্ধ প্রাণ জাগো'; 'নিঃশব্দ শিকড় ; 'শ্রেষ্ঠ কবিতা' ''কবিতা সমগ্র' ; 'এখন গুজব নেই' ; 'পোপের সমাধি ' ; 'পুরি সিরিজ' ;'লোচনদাস কারিগর'।
কবি প্রণবেন্দু দাশগুপ্ত "আমি দিক চক্রবাল ঘুরে"
কবিতায় প্রেম প্রকৃতি সুন্দর ভাবে উপলব্ধি করেছেন। কবি এই কবিতায় প্রেমের সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক উপস্থাপিত করে পাঠক সমাজকে উপহার দিয়েছেন। দৃষ্টান্তস্বরূপ
"আমি দিকচক্রবাল ঘুরে
এটুকু বুঝেছি প্রেমের কাঙাল এই মানুষেরা
দীর্ঘদিন একা একা থাকতে পারে না।
সে যেমন বৃক্ষ থেকে নীরবতা শেখে, মানুষীর কাছ থেকে
সে আবার চঞ্চলতা বুঝে নিতে চায়"
অধ্যাপক প্রণবেন্দু দাশগুপ্ত র কবিতায় মানুষের ভালবাসা সম্পর্কে গভীর উপলব্ধি প্রকাশ করেছেন ঃ--
"ঘুরে ঘুরে দেখেছি যে, মানুষের ভালবাসা
এখনো কোথায় যেন বাধার সামনে এসে
হেঁট হয়ে আছে।
🍂এখনো বাঁশির মতো ব্যর্থ হতে পারেনি চকিতে"।
কবির "স্বপ্নবীণা" কবিতায় স্বপ্ন দেখার চালচিত্র এখানে তুলে ধরেছেন। উদাহরণ----
"কৃষ্ণা রাত্রির ব্যথা বুঝেছে তারাও,
দু-মুঠো শান্তির অর্ঘ্য রেখে গেছে তার পাদ মূলে,
সহানুভূতির জলে শান্ত ছায়া কাঁপে কোন কূলে!
সেখানে হৃদয় দিয়ে মিলেছে সাড়াও----
তাই তাকে প্রেম বলে ডাকি"।
কবি কবি প্রণবেন্দু দাসগুপ্ত'র কাব্য ভাবনায় নীরবতার মধ্যেও যে হৃদয়ের আত্মলীন স্বরূপ থাকে, তাকে গীতি কবিতার সুরে উদঘাটিত করেছেন তাঁর বিখ্যাত "হায়রে নীরব কবি " কবিতার মাধ্যমে----
"তোর দিকে চেয়ে থাকে, তোর দিকে নিভৃত আশায়
সে যদি বাড়াল হাত, তুই তাকে দিলি না তো ফুল,
দিলি না তো সেই গান , যার সুরে প্রাণের দুকুল
গভীর পুলকে দুলে মিশে যায় আকাশে বিশাল,
যা যদি ছড়ালি সুর, বৃথা এই প্রেমের সকাল"!
প্রণবেন্দু দাশগুপ্তের' কাব্য চিন্তায় নীরবতা ভেঙে চিরন্তন সত্যে পরিণত হওয়ার বাসনা জাগ্রত করেছেন কাব্যের মাধ্যমে ----
"যা তোর জাগে না গানে, হৃদয়ের মিলিত মায়ায়
হয়তো ছড়াবে প্রেম সেই দূর, গূঢ় সুরভার,
যে তোর গানের শ্রোতা, তাকে কর গানের সেতার"।
অধ্যাপক কবি জীবনের মুক্তি খুঁজেছেন প্রেমের দ্বারা। তাই কবির "আমি মুক্তি চাই " কবিতায় পরিষ্কার লিখেছেন---
"আমি মুক্তি চাই, আমি
তাবৎ অসুখ থেকে ছুটি নিতে চাই।
এ কি কখনো পোষায়, এই অধিক মুখোশ পরে আসর মাতানো,
এই পরাণুজীবিতা"!
কবি দাশগুপ্ত'র বিদ্রোহী সত্তা প্রতিবাদী চেতনা জাগরণ আমরা দেখতে পাই তার জেগে উঠেছি কবিতার যেমন--
"এখন কোথায় জেগে উঠবো একা?
হয়তো একা নই, আরো মানুষ জেগে উঠছে, তাদের
গলার শব্দ একটু পরে শোনা যাবে।
-------------------*-*------------
আপাতত আলো - আঁধার ছিঁড়ে
একটা কিছু গড়ে উঠছে"!
কবি প্রণবেন্দু দাশগুপ্ত অসুখীদের মধ্যে অন্যতম ভাবতেন নিজেকে। সুতরাং সেই অসুখীরা কেমন জীবন নির্বাহ করে তার ইতিবৃত্তি রচনা করতে তিনি ছাড়েননি। তাঁর বিখ্যাত "যেভাবে অসুখী যায়" কবিতায় আমরা দেখতে পাই--
যেখানে অসুখী যায়, সেখানেই যাব---
বত্যাতাড়িত মেঘ, তুমি জানো কোথায় ঠিকানা?
নীলযক্ষ বাড়িঘর, আগলিয়ে রেখেছে শহর!
সপ্তাহে দু'বার যাই গরচা রোডে পালক ফেরাতে---
ভালো কি ভালো না , আমি আজও বুঝতে পারিনি"।
১৩ ৮৩ সংখ্যা কৃত্তিবাস পত্রিকায় "প্রণবেন্দু দাশগুপ্তের কবিতা" নামে চারটি কবিতা প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে আড়োলন তুলেছিল। অন্যতম হলো
"আমি এই সূর্যাস্ত - ডোবানো বৃষ্টি, ফের কালো রং,
জলপাই পাতার স্তুপে কাঠখড়মের মতো
পড়ে থাকা পদচিহ্ন ভুলে
তার কাছে ছুটে যাই , তার দুই হাত ধরে টানাটানি করি।
বহু দীর্ঘদিন পরে জননীর সঙ্গে দেখা হলো"।
কবি দাশগুপ্ত'র কবিতায় স্বদেশ প্রীতিরপরিচয়, প্রকৃতি ও মানুষের সম্বন্ধে ভাঙ্গা ঘরের মানুষের দুর্দশা চিত্র আমরা দেখতে পাই। তাই শেষ পর্যায়ে " মানুষ, ১৯৬১" কবিতায় আমরা মশগুল থাকতে চাই---
"ভাঙা ঘরে, মস্ত একটা হাওয়ায়,
মানুষ কাঁপছে ;
একটা হাত পাশের মানুষীকে
ধরে আছে, আরেকটা হাত
কোথায় রাখবে--- বুঝতে পারছে না,
পায়রা এসে বসেছে নিমগাছে"।
1 Comments
খুব ভালো লাগলো
ReplyDelete