জ্বলদর্চি

কবিতার আলো ও কবির স্বাধীনতা /প্রতাপ সিংহ

কবিতার আলো ও কবির স্বাধীনতা
প্রতাপ সিংহ

বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময়ে রানিগঞ্জে গিয়েছিলাম একটি সাহিত্য বাসর অনুষ্ঠানে। আমার দুই মাস্টারমশাই রামদুলাল বসু ও অসিত দত্ত আন্তরিকভাবে ডেকেছিলেন আর আমিও সানন্দে হাজির হয়েছিলাম সেখানে। সেদিনের অনুষ্ঠানটি ছিল স্বাধীনতা দিবসকে কেন্দ্র করে। তাই পতাকা উত্তোলন হলো, স্বাগত সংগীত পরিবেশিত হলো। এরপর অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি এলেন, দেখলাম আমাদের প্রিয় সুমিতাদি। বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও প্রখ্যাত প্রাবন্ধিক সুমিতা চক্রবর্তী। তাঁকে বরণের পর প্রথম পর্বের অনুষ্ঠানে তাঁর মনোগ্রাহী আলোচনা শুনলাম। এরপর শুরু হলো কবিতাপাঠের আসর। এই অনুষ্ঠানের শুরুতেই আমার স্যার অসিতবাবু বলে উঠলেন -- কবিতামাত্রই স্বাধীন, তাই যে কোনো কবিতাই আমি মনে করি স্বাধীনতা বিষয়ক এবং এই কথা বলে তিনি তাঁর 'আউটডোরে একলব্য' কাব্যগ্রন্থের অন্তর্গত কয়েকটি কবিতা পাঠ করেছিলেন। প্রিয় পাঠক, আমার এখানে যেটা বলার সেটা হল পরবর্তী শ্রদ্ধেয় কিংবা তরুণ কবি যাঁরা সেদিন কবিতা পড়তে মঞ্চে এসেছিলেন, তাঁদের জন্য এটা ছিল একটি চমৎকার ও অভূতপূর্ব বন্দোবস্ত আর এই সুযোগে যে কোনো কবিতাই যেন হয়ে উঠল সতেজ আর সুখশ্রাব্য। সেখানে সেদিন স্যারের এই চমকপ্রদ পন্থাটি আজও আমার মনে গেঁথে আছে। দেখেছিলাম কী সুন্দর জড়তা-আড়ষ্টতা কাটানো আলোবাতাসে স্নিগ্ধ আর দরজা-জানলা খোলা এক উন্মুক্ত মনোরম পরিবেশ। সেদিন কবিদেরও বেশ স্বচ্ছন্দ, প্রাণবন্ত লাগছিল। কবিতা পাঠের এমন সুচারু ব্যবস্থায় আরো অনেকেই যে চমৎকৃত হয়েছিলেন তা আর নিশ্চয়ই বলার অপেক্ষা রাখে না।

কবিতার আলো ব্যাপ্ত হওয়ার জন্য ঐতিহ্য ও পরম্পরায় অন্তরঙ্গ পাঠ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। কবিতার ধারাবাহিক ইতিহাস ও নিবিড় পাঠেই পাঠক কবিতার বিভায় আলোকিত হন। একজন কবি সৃষ্টির স্বাতন্ত্র্যেই আমাদের কাছে উজ্জ্বল থাকেন। তাই তিনি তাঁর কবিতা এক লাইনে লিখতে পারেন আট-দশ লাইনেও লিখতে পারেন। লিখতে পারেন অণুকবিতার পাশাপাশি দীর্ঘকবিতা এমনকি কাব্যোপন্যাসও। তাঁর লেখায় গল্পরস থাকতে পারে, থাকতে পারে নাটকীয়তা কিংবা দীর্ঘ আখ্যান-বিবৃতি বা ন্যারেটিভ প্যাটার্ন। সেখানে থাকতে পারে সংগীত কিংবা লোকজীবন আশ্রিত বাস্তব আলেখ্য বা ছড়া। সেই কারণে কবিতা অন্ত্যমিলের হতে পারে আবার গদ্যকবিতাও হতে পারে। কবি ছেদ ও যতি তথা বিরাম চিহ্নের ক্ষেত্রে দাঁড়ি, কমা, সেমিকোলন, বিস্ময়সূচক চিহ্ন প্রভৃতি কোথায় কীভাবে ব্যবহার করবেন অথবা স্পেসই-বা কীভাবে ব্যবহার করবেন বা আদৌ করবেন কি-না এক্ষেত্রে তাঁর ভাবনাই তো শেষকথা। কবি ছোটকাগজ বা লিটল ম্যাগাজিনে যেমন লিখতে পারেন, বাণিজ্যিক কাগজ বা তথাকথিত বড় কাগজেও তিনি লিখে থাকেন। কবি দ্বিপদী-ত্রিপদী-পয়ার-মহাপয়ারে লিখবেন না দলবৃত্তে লিখবেন সে তাঁর নিজস্ব ব্যাপার। কবি সনেট লিখতে পারেন আবার শ্রুতিকবিতাও লিখতে পারেন। এমনকি কবিতা তিনি ভক্তি-সুফি-বৈষ্ণবীয় মরমিয়া রসে জারিত বিষয়ে লিখতে পারেন অথবা জাদুবাস্তবতা-পরাবাস্তবতার আশ্রয়েও লিখতে পারেন। শিরোনামবিহীন কবিতাও অনেক সময়ে কবিরা লিখে থাকেন -- এটিও তাঁর একান্ত অভিপ্রায় বা দৃষ্টিকোণেই ধরা থাকে। নির্জন প্রকৃতি বা গ্রাম নিয়ে কবিতা না জনকোলাহলে পূর্ণ মহানগর নিয়ে লিখবেন; তিনি "দিনগুলি রাতগুলি' নিয়ে লিখবেন নাকি 'যদিও সন্ধ্যা আসিছে মন্দ মন্থরে, সব সংগীত গেছে ইঙ্গিতে থামিয়া' নিয়ে লিখবেন তা-ও কবিরই ব্যাপার। আবার কবি রোমান্টিক প্রেমের কবিতার পাশাপাশি দ্রোহ-প্রতিবাদের কবিতাও লিখতে পারেন। হৃদয়ের প্রাধান্য না বুদ্ধি বা মননের প্রাধান্যে লেখা হবে -- সবই কিন্তু কবির মর্জিমাফিকই হবে। এতকিছুর পরেও শেষপর্যন্ত কবিতার হয়ে ওঠার ব্যাপারটি অত্যন্ত জরুরি, তাই রবীন্দ্রনাথ থেকে নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী কিংবা শঙ্খ ঘোষ বা আরো অনেকেই মনে করতেন কবিতায় ছন্দ অত্যন্ত স্বতঃস্ফূর্তভাবে অনুরণিত হয় তা অন্ত্যমিলেই লেখা হোক কিংবা টানা গদ্যকবিতায় লেখা হোক-না কেন। কবিতায় প্রাচীন আলংকারিক বা সমালোচকের দৃষ্টিভঙ্গিতে কখনো অলংকার কখনো রীতিকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। তবে শেষ পর্যন্ত শব্দ-বাক্য অতিক্রম করে রসকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে কবিতা হবে মানুষের জীবন ও যাপনের প্রক্রিয়ায় সৃষ্ট এবং বাচ্যকে অতিক্রম করে ব্যঞ্জনায় ঋদ্ধ পাঠকহৃদয়ে তৃপ্তি ও শুশ্রূষা প্রদানকারী এক সুসম্পন্ন শিল্প।
সমকালে পাঠকের রুচি ও চাহিদায় স্বীকৃত কোনো কবির কবিতা যা একবার পড়লেই খুব সহজে বোঝা যায়, অভিনিবেশের বা পুনরায় পাঠের প্রয়োজন পড়ে না, এমনকি তাঁর কবিতা নিয়ে কোনও ইশারা সংকেত রহস্য নিয়ে মাথা না ঘামালেও চলে, দেখা যায় সেই কবিতাটি খুব জনপ্রিয় আর শ্রোতারা মঞ্চে কবিকণ্ঠে বা কোনো বাচিকশিল্পীর কণ্ঠে সেই বহুশ্রুত বা চর্চিত কবিতাটি শুনে হাততালিতে হলঘর মাতিয়ে রাখেন। এরকম বহু নজির আমাদের সারস্বত সমাজে অলংকৃত হয়ে আছে কিন্তু তার মানে এই নয় যে সেটি কোনো অসামান্য কবিতা। অসামান্য হতেও পারে, না-ও হতে পারে। বিগহাউসের ছটায় বা বিজ্ঞাপনের চাতুর্যে কিংবা বিপণনের কৌশলে অনেক কবি তাঁর সমকালে আলোকিত থাকেন, হয়ে ওঠেন পাঠকপ্রিয় এবং নিয়ত প্রচারিত হতে হতে একজন খ্যাতিমান কবিতে পরিণত হন কিন্তু সমকালের এই বহুপঠিত, আলোড়িত, হয়তো-বা বির্তকিত সেই কবির (এমনকি লেখকও হতে পারেন) লেখা যে চিরকালীন সাহিত্যস্রষ্টার গৌরব অর্জন করবে এমন নিশ্চয়তা বা গ্যারান্টি কেউ কখনো দিতে পারে না। আবার এমন অনেক কবি আছেন যিনি লোকচক্ষুর আড়ালে বা অন্তরালে থেকেই দিনের পর দিন নিরালায় বা নিভৃতে কাব্যচর্চা করে চলেন, একটার পর একটা অসামান্য কবিতা রচনা করেন কিন্তু সমকালে ততখানি আলোচিত হননি বা পরিচিতি পাননি কিন্তু পরবর্তী সময়ে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং অন্যতম প্রধান কবি হিসেবে পরিগণিত হয়ে ওঠেন। পাঠকও ক্রমশ তাঁর সৃষ্টির প্রতি আকৃষ্ট হয়ে থাকেন।
কবি ও কবিতার আকাশে স্বাধীনতা একান্তই কাম্য বা কাঙ্ক্ষিত কিন্তু তা যেন কখনোই স্বেচ্ছাচারিতার পর্যায়ে না যায় সেক্ষেত্রেও আমাদের সকলের সজাগ থাকা অত্যন্ত প্রয়োজন‌। একজন বাচিকশিল্পী বা আবৃত্তিশিল্পীর মতো গায়কেরও স্বাধীনতা থাকে স্বরলিপি বা কাঠামো অনুসরণ করেও স্বাতন্ত্র্য বজায় রেখে গান গাওয়ার এবং তিনি গেয়েও থাকেন নিজস্বতাটুকু বজায় রেখে। সেজন্য একই রবীন্দ্রসংগীত বিভিন্ন শিল্পীর গায়কিতে একই সুর তাল লয়ের হলেও সহজেই প্রকৃত শ্রোতা শনাক্ত করতে পারেন দেবব্রত বিশ্বাস, সুচিত্রা মিত্র কিংবা কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং পরবর্তী প্রজন্মের শিল্পীদের সহজাত সাধনালব্ধ কণ্ঠগুলিকে। তাঁরা সেই গানটি পরিবেশন করেন নিজের মতো করেই এবং রবীন্দ্রনাথকে অবশ্যই আত্মস্থ করে। এই বোধ বা চেতনা সকলের মধ্যে সমানভাবে আত্মস্থ বা সঞ্চারিত হয় না, তাই আমাদের চারপাশে সাংস্কৃতিক পরিবেশে নাটক-সিনেমা-জলসা বা উৎসব-অনুষ্ঠানে মুষ্টিমেয় কিছু জনপ্রিয় কবিতা বা গান বারবার উপস্থাপন করার একটা কৌশল বা চল লক্ষ করা যায়। নির্দিষ্ট কয়েকটি কবিতা বা গান মঞ্চে বা অনুষ্ঠানে নিরন্তর পরিবেশিত হয়, যা কবি ও কবিতার পক্ষে দুর্ভাগ্যজনক। কবি সমরেন্দ্র সেনগুপ্ত হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের স্নেহধন্য ছিলেন এবং অনেক আধুনিক গানও লিখেছেন যেগুলো একটা সময়ে রেডিওতে প্রচারিত হয়েছে বহুবার কিন্তু তবুও তাঁর মনে হয়েছে সুর দিয়ে জীবনানন্দের কবিতাকে খুন করা হয়েছে। অনেকে মনে করেন যে আবৃত্তি কোন শিল্পই নয়। আমরা তেমনটা মনে করতে পারি না কারণ ছোটবেলা থেকে রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, সুকান্ত এবং অন্যান্য কবিদের সরণিকে সামনে রেখে যে কবিতার চর্চা হয় তা আবৃত্তিশিল্পীদের সৌজন্যেই হয়ে থাকে। সেজন্য কবিতার প্রচার এবং প্রসারে আবৃত্তিশিল্পীদের ভূমিকাটি কখনোই অবহেলার নয়। সমস্যা একটা আছে তা হলো অধিকাংশ বাচিকশিল্পী বা গুরুস্থানীয় আবৃত্তিকারেরা নির্বাচিত কয়েকটি কবিতার বাইরে আর কিছু পাঠ করার প্রয়োজন মনে করেন না (ব্যতিক্রম অবশ্যই আছে)। কবিতার দীর্ঘ ভূখণ্ড এবং পরম্পরাগত পাঠ আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের কাছে যত বেশি প্রসারিত হবে কবিতার রস এবং আলোয় আমরা তত বেশি করে আলোকিত হতে পারব। অন্যথায় ওই অজস্র অকবিতা বা অপাঠ্য লেখাগুলো ফেসবুক এবং মুষ্টিমেয় কিছু সামাজিক মাধ্যমে ঘুরপাক খেতে থাকবে যা কবি বা কবিতার জন্য বিড়ম্বনা ছাড়া অন্য কিছু নয়।
বর্তমানে অনেক কবি অজস্র কবিতা লেখেন। শুধু তাই নয় কারও কারও শুনি শারদীয় সংখ্যায় দুশো- আড়াইশো কবিতা ছাপা হয়। এতে কার ভালো হয়? এটাতো সৃজন নয়, উৎপাদন। শিল্প গুণান্বিত কীভাবে হতে পারে একসঙ্গে এত লেখা? জার্মান দার্শনিক ফ্লবেয়ার বলেছিলেন --
'Use more often your eraser rather than your pen.' অর্থাৎ তুমি তোমার কলমের চেয়ে ইরেজার বা রবারকে বেশি ব্যবহার কর। সুমন চট্টোপাধ্যায় (কবীর সুমন) তাঁর একটি গানের কথায় বলেছিলেন - 'সাহিত্য মরে পুজো সংখ্যার চাপে।' শুধুমাত্র সোশ্যাল মিডিয়ায় বিরাজিত হওয়ার জন্য আজকাল অনেক তাৎক্ষণিক লেখা ও লেখকের দর্শন মেলে কিন্তু কবিতার চর্চা বা সৃষ্টি-সাধনা কোনো চটজলদি ব্যাপার নয়, সাহিত্যের নন্দনকানন নিছক চমৎকারিত্ব বা ফেসবুকীয় জাঁকজমকে সম্পন্ন হতে পারে না। একথা অনস্বীকার্য যে ফেসবুক বহু অনামা কবি বা শিল্পীদের আত্মপ্রকাশের সুযোগ করে দিয়েছে এবং জীবনে জীবন যোগ করার বহু ক্ষেত্রও প্রস্তুত করেছে কিন্তু অনেকের স্বাভাবিক স্বাধীন পথচলাকে যে ব্যাহত করেছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। ইনফ্যাচুয়েশন আর লাভ, দুয়ের মধ্যে পার্থক্য আছে। মোহ কমে যায় একদিন, কিন্তু ভালোবাসা চিরন্তন এক ব্যাপার। এজন্যই এত কিছুর পরেও সাহিত্য-সংস্কৃতির আসরে একটি বিষয় একান্তই জরুরি, তা হ'ল সঠিক সম্পাদনা। আমরা প্রতিদিনের জীবনে নানারকম অধিকার যেমন ভোগ করে থাকি তেমনি কর্তব্য পালনের ব্যাপারেও আমাদের সজাগ থাকতে হয়। সাহিত্যের বিপুল সংসারে তাই সম্পাদকের অগ্রণী ভূমিকাটিও যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। এলিয়টের অসামান্য লেখা 'দি ওয়েস্টল্যান্ড' এজরা পাউন্ড অর্ধেক কেটে দিয়েছিলেন। সদ্যপ্রয়াত বুদ্ধদেব গুহর 'লবঙ্গীর জঙ্গলে'র দীর্ঘ অংশ শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায় বাদ দিয়েছিলেন। এরকম বহু লেখা নির্দিষ্ট মান ও পরিমিতিবোধ যাতে পাঠকের মনে সঞ্চার করতে পারে সেজন্য লেখা সুসম্পাদিত হওয়া অত্যন্ত জরুরি। পূর্ণেন্দু পত্রী মহাশয় তাঁর 'কবিতার ঘর ও বাহির' বইটিতে সেজন্য আক্ষেপ করে বলেছিলেন আমাদের কলকাতাতেও যদি একজন এজরা পাউন্ড থাকতেন!
অনেক বড় কবিই নির্দিষ্ট সময়ের পরে তাঁর লেখা বন্ধ করে দেন নতুন শব্দ ভাষা বা নিজস্বতা খুঁজে না পেয়ে। সমর সেন তাঁর দীর্ঘ জীবনে মাত্র বারো বছর কবিতা লিখেছেন, তারপর পাঠক শুধু তাঁর মননঋদ্ধ প্রবন্ধ পড়েছেন ফ্রন্টিয়ার পত্রিকায়।একটা সময়ের পরে আর লেখেননি কবি উৎপল কুমার বসু। পুরী সিরিজের পরে দীর্ঘদিন তিনি লেখেননি, 'আমার ব্যক্তিগত লিখন ভঙ্গিমা আমি হারিয়ে ফেলেছি বাদাম পাহাড়ে'-- এই উপলব্ধিতে। অনেক লেখকই কবিতা লেখা দিয়ে তাঁর লেখক জীবন শুরু করে পরে গদ্যের আঙিনায় চলে যান। আমাদের প্রিয় কথাসাহিত্যিক তপন বন্দ্যোপাধ্যায়, তিনি একটা সময় কবিতা দিয়েই তাঁর সারস্বত জীবন শুরু করেছিলেন। এরকম আরো অনেকেই আছেন। আবার অনেক কবি মাত্র তিন বছর, পাঁচ বছর কিংবা দশ-বারো বছরের কবিতা জীবনেই কত অসামান্য লেখা আমাদের উপহার দিয়েছেন। তাঁরা দীর্ঘসময় ধরেও লেখেননি আর অজস্র কবিতাও প্রসব করেননি। স্বনামধন্য মাইকেল মধুসূদন দত্ত এক্ষেত্রে এক জ্বলন্ত উদাহরণ। সমর সেন সারাজীবনে মাত্র আড়াইশোটি কবিতা লিখেছেন। পোল্যান্ডের নোবেলজয়ী প্রখ্যাত কবি শিমবোর্সকা সারাজীবনে কবিতা লিখেছেন মাত্র সাড়ে তিনশো।
কবিতা কবির কাছে স্বাধীন-স্বতন্ত্র এক চিত্তবৃত্তি। তাই তা কখনো দুরূহ আভিধানিক শব্দমালায় সেজে ওঠে, কখনো দুঃসহ কিংবা দুর্বোধ্য হয় আবার কখনো সহজ-সরল অথচ গভীর হয়ে আমাদের উপশম বা শুশ্রূষার আলো দান করে। ইশারায় সংকেতে উপমায় প্রতীকে চিত্রকল্পে এবং সর্বোপরি ধ্বনি মাধুর্যের ব্যঞ্জনায় কবিতা হয়ে ওঠে এক সুসংহত নান্দনিক প্রকাশ তথা 'সহৃদয় হৃদয় সংবাদী'। এজন্য পাঠকের দীক্ষিত হবার ব্যাপারটিও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ সকলেই তো আর ঠিকমতো পাঠক হয়ে উঠতে পারে না। বাইরের স্বাধীনতার মতো কবিচৈতন্যের স্বাধীনতায় মধুসূদনের অমিত্রাক্ষর ছন্দে লেখা 'মেঘনাদবধকাব্য' সেই অমর সৃষ্টি, যেখানে দু'শো বছরের আগুয়ান কবিআত্মাকে আমরা পাই ছকভাঙা এক বিপ্লবী পথিকৃৎকে। 'স্বাধীনতা- হীনতায় কে বাঁচিতে চায় হে, কে বাঁচিতে চায়?' রঙ্গলাল বন্দ্যোপাধ্যায়ের এই উচ্চারণ কবিতার ক্ষেত্রেও সত্য আমাদের কবিদের জন্যও সত্য। 'আমার সন্তান যেন থাকে দুধে-ভাতে' -- যুগসন্ধিতে দাঁড়িয়ে ভারতচন্দ্রের এই অমোঘ উক্তি সমকালের গণ্ডি ছাড়িয়ে এক চিরকালীন সর্বব্যাপী স্বাধীন পরিসরকে চিহ্নিত করে। প্রেম বা প্রকৃতি বিষয়ক কবিতা না লিখে 'পদাতিক' দিয়ে যাত্রা শুরু করেন সুভাষ মুখোপাধ্যায়, যা কবির স্বাধীন শিল্পীসত্তাকেই উন্মোচন করে পাঠকের কাছে। রবীন্দ্রনাথ কবির জীবনচরিতে কবিকে খুঁজতে বারণ করেছিলেন। স্বাধীনচিত্তেই সুকান্ত উপলব্ধি করেছিলেন - বিপ্লবস্পন্দিত বুকে লেনিনস্বরূপে নিজেকে। সাম্যচৈতন্যে উদ্বেলিত নজরুল রব বা শ্লোগানকে কবিতায় প্রতিষ্ঠা দিতে পেরেছেন। 'চে, তোমার মৃত্যু আমাকে অপরাধী করে দেয় ' - তখন কবি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের আর্তি ও অসহায়তার যন্ত্রণায় স্বাধীনতার প্রবল স্পৃহাই প্রতিধ্বনিত হয় আমাদের রক্তমাংসের সারা শরীরজুড়ে। ব্যক্তি জীবনে স্বভাবনম্র বিনয়ী মানুষটি কবি হিসেবে যখন পাঠকের সামনে আত্মপ্রকাশ করেন তখন তিনি বিদ্রোহী বিপ্লবী ঝঞ্ঝাতাড়িত হয়ে ওঠেন অন্তর্গত চেতনায় অত্যন্ত স্বাধীন বলেই। কবিতা বিশুদ্ধ পবিত্র স্বতঃস্ফূর্ত এক অনুভূতি এবং অবশ্যই পূর্বঘোষিত রহস্যময় নান্দনিক শিল্প। সকলেই কবি নয়, কবিতার মতো দেখতে হলেও সেই লেখাগুলোও সবক্ষেত্রে কবিতা নয়। আবার সবাই দীক্ষিত পাঠক নন। ঐতিহ্য ও পরম্পরার নিরিখে কবি ও কবিতার সঙ্গে পাঠকের সম্পৃক্ত থাকার প্রসঙ্গে হোর্হে লুইস বোর্হেস ভারী সুন্দর কথা বলেছেন। তাঁর কথানুসারে সব কবিতা সবার জন্য নয় অর্থাৎ কোনো একজন পাঠক সবার কবিতার অনুরাগী হবেন এমনটা আশা করা সমীচীন নয়। তোমার জন্য অন্য কোথাও অন্য কেউ নিশ্চয়ই অপেক্ষা করছেন এবং যোগাযোগ নিশ্চয়ই হবে। কবিতার রসাস্বাদনে প্রতিমা প্রকাশের ব্যাপারটি অনিবার্য থাকে, তাই বাক্- প্রতিমার আলোকে পাঠকেরও মুক্তি হয় কবিতার দ্যুতিময় আলোয়। প্রকৃতির রাজ্যে বসন্ত শুধুই ফোটাফুলের খেলা নয়, ঝরাফুলেরও মেলা -- এই বিষাদচৈতন্য কবির কাছে এক গভীর মর্মোপলব্ধি।আবার হেমন্তের দুঃসহ অধ্যায় পেরিয়ে, পরাধীনতার সমস্ত বাধা পেরিয়ে প্রতীক্ষিত মুক্তির স্বাদ একদিন আসবেই -- এই স্বপ্নও কবিরা নিয়ত লালন করেন। তাই স্রষ্টা হিসেবেও কবিকে স্বাধীনচেতা হতেই হয় আর তাঁর সৃজনপথের শোভাবর্ধনকারী বিচিত্র বই আমাদের কাছে এক মায়াময় জগৎ সৃষ্টি করে। পাঠকের স্নিগ্ধ স্পর্শেই বইগুলো প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে, নড়াচড়া করে, নতুন পুরনো গন্ধ ছড়ায়, প্রশ্নের উত্তরে নিরসন করে। কবি তাঁর সৃষ্টির দক্ষতায়, মুন্সিয়ানায় কিংবা স্বাতন্ত্র্য চিহ্নিত কবিতায় হয়ে ওঠেন স্বাধীন, সেখানে পাঠকের কোনো জবরদস্তি চলে না। সেজন্য মধুসূদন রবীন্দ্রনাথ নজরুল জীবনানন্দ সুভাষ মুখোপাধ্যায় শামসুর রহমান সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় শক্তি চট্টোপাধ্যায় বিজয়া মুখোপাধ্যায়,নবনীতা দেবসেন, কিংবা কালীকৃষ্ণ গুহ, দেবারতি মিত্র, শংকর চক্রবর্তী, শ্যামলকান্তি দাশ, জয় গোস্বামী ও তাঁর পরবর্তী সময়ের কবিদের কবিতা যখন আমরা পড়ি তখন সহজেই সেগুলো চিহ্নিত করতে পারি যদি সেই পাঠ অভিজ্ঞতা আমাদের থাকে। কবিদের সেই স্বাধীন স্বতন্ত্র অনুভবের সঙ্গে যখন পাঠক হৃদয় একাত্ম হয়ে ওঠে তখন সেখানে অবশ্যই সঞ্চারিত হয় এক অপার্থিব আনন্দ। কবির সৃষ্টি গাছের মতো ফুল ফোটায়, ফল জোগায়, সূর্যের মতো চিরকাল আলো দেয় আর বৃষ্টির মতো সম্ভাবনার ফসলে বসুন্ধরাকে রাখে শান্ত-স্থিতধী-সুশীতল এবং প্রভূত সম্ভাবনায় কানায় কানায় পূর্ণ। 
🍂

Post a Comment

4 Comments

  1. ভালো হয়েছে।

    ReplyDelete
  2. খুব গুরুত্বপূর্ণ লেখা

    ReplyDelete
  3. সমৃদ্ধ হলাম দাদা, খুব ভালো লাগলো

    ReplyDelete
  4. খুব ভালো লাগলো

    ReplyDelete