শ্রীরামকৃষ্ণের সন্ন্যাসী সন্তানেরা
পর্ব ৭৯
প্রীতম সেনগুপ্ত
যে প্রবল বৈরাগ্যের আগুন ঠাকুর নরেন্দ্রনাথের মধ্যে জ্বেলে দিয়ে গিয়েছিলেন তার নমুনা আমরা শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ কথামৃতে পাই। মাস্টারমশাই এই বিষয়টি বর্ণনা করার সময় শিরোনাম দিয়েছেন এইরকম -- নরেন্দ্রের তীব্র বৈরাগ্য-- নরেন্দ্রের গৃহস্থাশ্রম নিন্দা। মাস্টারমশাই লিখছেন --“...মাস্টার সকালবেলা মঠের বাগানের গাছতলায় বসিয়া আছেন। মাস্টার ভাবিতেছেন, ‘ঠাকুর মঠের ভাইদের কামিনী-কাঞ্চনত্যাগ করাইয়াছেন। আহা, এঁরা কেমন ঈশ্বরের জন্য ব্যাকুল! স্থানটি যেন সাক্ষাৎ বৈকুণ্ঠ। মঠের ভাইগুলি যেন সাক্ষাৎ নারায়ণ! ঠাকুর বেশিদিন চলিয়া যান নাই; তাই সেই সমস্ত ভাবই বজায় রহিয়াছে।
‘সেই অযোধ্যা! কেবল রাম নাই।
‘এদের তিনি গৃহত্যাগ করালেন কয়েকটিকে তিনি গৃহে রেখেছেন কেন? এর কি কোন উপায় নাই? নরেন্দ্র উপরের ঘর হইতে দেখিতেছেন, -- মাস্টার একাকী গাছতলায় বসিয়া আছেন! তিনি নামিয়া আসিয়া হাসিতে হাসিতে বলিতেছেন, ‘কি মাস্টার মহাশয়! কি হচ্ছে?’ কিছু কথা হইতে মাস্টার বলিলেন, ‘আহা তোমার কি সুর! একটা কিছু স্তব বল।’
নরেন্দ্র সুর করিয়া অপরাধভঞ্জন স্তব বলিতেছেন। গৃহস্থেরা ঈশ্বরকে ভুলে রয়েছে -- কত অপরাধ করে -- বাল্যে,প্রৌঢ়ে, বার্ধক্যে! কেন তারা কায়মনোবাক্যে ভগবানের সেবা বা চিন্তা করে না-- বাল্যে দুঃখাতিরেকো মললুলিতবপুঃ স্তন্যপানে পিপাসা,/ নো শক্তশ্চেন্দ্রিয়েভ্যো ভবগুণজনিতাঃ শত্রবো মাং তুদন্তি।...
স্তব পাঠ হইয়া গেল। আবার কথাবার্তা হইতেছে।
নির্লিপ্ত সংসার বলুন আর যাই বলুন, কামিনীকাঞ্চন ত্যাগ না করলে হবে না। স্ত্রী সঙ্গে সহবাস করতে ঘৃণা করে না? যে স্থানে কৃমি, কফ, মেদ, দুর্গন্ধ -- অমেধ্যপূর্ণ কৃমিজালসঙ্কুলে স্বভাবদুর্গন্ধ নিরন্তকান্তরে।/ কলেবরে মূত্রপুরীষভাবীতে রমন্তি মূঢ়া বিরমন্তি পণ্ডিতাঃ।।
‘বেদান্তবাক্যে যে রমণ করে না, হরিরস মদিরা যে পান করে না তাহার বৃথাই জীবন।
ওঁকারমূলং পরমং পদান্তরং গায়ত্রীসাবিত্রীসুভাষিতান্তরং/ বেদান্তরং যঃ পুরুষো ন সেবতে বৃথন্তরং তস্য নরস্য জীবনম্।।
একটা গান শুনুন--
‘ছাড় মোহ -- ছাড়রে কুমন্ত্রণা, জান তাঁরে তবে যাবে যন্ত্রণা।।/ চারিদিনের সুখের জন্য, প্রাণসখাকে ভুলিলে, একি বিড়ম্বনা।।
‘কৌপীন না পরলে আর উপায় নাই। সংসারত্যাগ।’
এই বলিয়া আবার সুর করিয়া কৌপীনপঞ্চকম বলিতেছেন:
বেদান্তবাক্যেষু সদা রমন্তো, ভিক্ষান্নমাত্রেণ চ তুষ্টিমন্তঃ।/ অশোকমন্তঃকরণে চরন্তঃ, কৌপীনবন্তঃ খলু ভাগ্যবন্তঃ।। ইত্যাদি।
নরেন্দ্র আবার বলিতেছেন, মানুষ কেন সংসারে বদ্ধ হবে, কেন মায়ায় বদ্ধ হবে? মানুষের স্বরূপ কি? ‘চিদানন্দরূপঃ শিবোহহং’ আমিই সেই সচ্চিদানন্দ।
আবার সুর করিয়া শঙ্করাচার্যের স্তব বলিতেছেন:
ওঁ মনোবুদ্ধ্যহঙ্কারচিত্তানি নাহং ন চ শোকজিহ্বে ন চ ঘ্রাণনেত্রে।/ ন চ ব্যোমভূমির্ণ তেজো ন বায়ুশ্চিদানন্দরূপঃ শিবোহহং শিবোহহম্।।
নরেন্দ্র আর একটি স্তব, বাসুদেবাষ্টক সুর করিয়া বলিতেছেন:
হে মধুসূদন! আমি তোমার শরণাগত; আমাকে কৃপা করে কামনিদ্রা, পাপ, মোহ, স্ত্রীপুত্রের মোহজাল, বিষয়তৃষ্ণা থেকে ত্রাণ কর। আর পাদপদ্মে ভক্তি দাও।
ওমিতি জ্ঞানরূপেণ রাগাজীর্ণেন জীর্যতঃ।/ কামনিদ্রাং প্রপন্নোহস্মি ত্রাহি মাং মধুসূদন।।...
মাস্টার ( স্বগত ) -- নরেন্দ্রের তীব্র বৈরাগ্য! তাই মঠের ভাইদের সকলেরই এই অবস্থা। ঠাকুরের ভক্তদের ভিতর যাঁরা সংসারে এখনও আছেন, তাঁদের দেখে এদের কেবল কামিনী-কাঞ্চনত্যাগের কথা উদ্দীপন হচ্ছে। তিনি কি কোন উপায় করবেন? তিনি কি তীব্র বৈরাগ্য দিবেন; না সংসারেই ভুলাইয়া রাখিয়া দিবেন?
আজ নরেন্দ্র ও আরও দু-একটি ভাই আহারের পর কলিকাতায় গেলেন। আবার রাত্রে নরেন্দ্র ফিরিবেন। নরেন্দ্রের বাটীর মোকদ্দমা এখনও চোকে নাই। মঠের ভাইরা নরেন্দ্রর অদর্শন সহ্য করিতে পারেন না। সকলেই ভাবিতেছেন নরেন্দ্র কখন ফিরিবেন।”
বিশ্বের কাছে তাঁর শাশ্বত বার্তা নরেন্দ্র পৌঁছে দেবেন একথা বুঝেছিলেন ঠাকুর। নরেন্দ্র'র প্রতি তাঁর ভালোবাসার আধিক্য ছিল। বহু পরে নরেন্দ্র যখন বিশ্বখ্যাত স্বামী বিবেকানন্দ, গুরু শ্রীরামকৃষ্ণ সম্বন্ধে বলেছিলেন ‘LOVE personified’। কেন তাঁকে এত ভালোবাসতেন ঠাকুর? সারদানন্দ-কৃত ‘শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ লীলাপ্রসঙ্গ’ গ্রন্থে এর উল্লেখ রয়েছে। তিনি একদিন পরম পূজনীয় লীলাপ্রসঙ্গকার স্বামী সারদানন্দজীর ( পূর্বাশ্রমের নাম শরৎ ) সঙ্গে নরেন্দ্রর তুলনা করে যদুনাথ মল্লিকের উদ্যানবাটীর প্রধান কর্মচারী জনৈক রতন নামক এক ব্যক্তিকে বলেছিলেন -- “এরা সব ছেলে মন্দ নয় -- দেড়টা পাস করিয়াছে, শিষ্ট, শান্ত; কিন্তু নরেন্দ্রের মতো একটি ছেলেও আর দেখিতে পাইলাম না। যেমন গাইতে বাজাতে, তেমনি লেখাপড়ায়, তেমনি বলতে কইতে, আর তেমনি ধর্মবিষয়ে। সে রাতভোর ধ্যান করে, ধ্যান করতে করতে সকাল হয়ে যায়, হুঁশ থাকে না। আমার নরেন্দ্রর ভিতর এতটুকু মেকি নেই; বাজিয়ে দেখ টং টং করছে। আর সব ছেলেদের দেখি, যেন চোখ-কান টিপে কোনরকমে দু-তিনটে পাস করেছে -- ব্যস্ এই পর্যন্ত! এ করতেই যেন তাদের সমস্ত শক্তি বেরিয়ে গেছে। নরেন্দ্রের কিন্তু তা নয়, হেসে-খেলে সব কাজ করে, পাস করাটা যেন তার কিছুই নয়! সে ব্রাহ্ম সমাজেও যায়, সেখানে ভজন গায়; কিন্তু অন্য সকল ব্রাহ্মের ন্যায় নয় -- সে যথার্থ ব্রহ্মজ্ঞানী। ধ্যান করতে বসে তার জ্যোতিঃদর্শন হয়। সাধে নরেন্দ্রকে এত ভালবাসি?”
এই বিষয়ে ঠাকুরের আর এক ত্যাগী অন্তরঙ্গ পার্ষদ প্রেমানন্দ মহারাজ ( তৎকালীন বাবুরাম ) একটি ঘটনার কথা উল্লেখ করেছেন। নরেন্দ্রের অদর্শনে ঠাকুর কীরকম ব্যাকুল হতেন সেই কথা জানিয়েছেন। একদিন তিনি ঠাকুরের ভক্ত রামদয়ালবাবুর সঙ্গে সন্ধ্যায় দক্ষিণেশ্বরে ঠাকুরের কাছে আসেন। সেদিন রাতে তাঁরা সেখানে ছিলেন। ঠাকুরের ঘরের পূর্বদিকে কালীবাড়ির উঠানের উত্তরদিকের বারান্দায় উভয়ে শয়ন করেন। এরপর যা ঘটেছিল সেই বিষয়ে প্রেমানন্দজীর বিবরণ এইরকম: “শয়ন করিবার পর একঘণ্টা কাল অতীত হইতে না হইতেই ঠাকুর পরিধেয় বস্ত্রখানি বালকের ন্যায় বগলে ধারণ করিয়া ঘরের বাহিরে আমাদিগের শয্যাপার্শ্বে উপস্থিত হইয়া রামদয়াল বাবুকে সম্বোধন করিয়া বলিলেন, ‘ওগো, ঘুমুলে?’ আমরা শশব্যস্তে উঠিয়া বসিয়া বলিলাম, ‘আজ্ঞে না।’ উহা শুনিয়া ঠাকুর বলিলেন, ‘দেখ, নরেন্দ্রর জন্য প্রাণের ভেতরটা গামছা নিঙড়ানোর মতো জোরে মোচড় দিচ্ছে, তাকে একবার দেখা করে যেতে বলো। সে সত্ত্বগুণের আধার, সাক্ষাৎ নারায়ণ; তাকে মাঝে মাঝে না দেখলে থাকতে পারি না।’ রামদয়ালবাবু কিছুকাল পূর্ব হইতেই দক্ষিণেশ্বরে যাতায়াত আরম্ভ করিয়াছিলেন, সেইজন্য ঠাকুরের বালকের ন্যায় স্বভাবের কথা তাঁহার অবিদিত ছিল না। তিনি ঠাকুরের ঐরূপ বালকের ন্যায় আচরণ দেখিয়া বুঝিতে পারিলেন, ঠাকুর ভাবাবিষ্ট হইয়াছেন, এবং রাত্রি পোহালেই নরেন্দ্রের সহিত দেখা করিয়া তাঁহাকে আসিতে বলিবেন, ইত্যাদি নানা কথা কহিয়া ঠাকুরকে শান্ত করিতে লাগিলেন। কিন্তু সেই রাত্রে ঠাকুরের সেই ভাবের কিছুমাত্র প্রশমন হইল না। আমাদিগের বিশ্রামের অভাব হইতেছে বুঝিয়া মধ্যে মধ্যে কিছুক্ষণের জন্য নিজ শয্যায় যাইয়া শয়ন করিলেও, পরক্ষণেই ঐ কথা ভুলিয়া আমাদিগের নিকট পুনরায় আগমনপূর্বক নরেন্দ্রের গুণের কথা এবং তাঁহাকে না দেখিয়া তাঁহার প্রাণে যে দারুণ যন্ত্রণা উপস্থিত হইয়াছে, তাহা সকরুণভাবে ব্যক্ত করিতে লাগিলেন। তাঁহার ঐরূপ কাতরতা দেখিয়া বিস্মিত হইয়া আমি ভাবিতে লাগিলাম, ইঁহার কি অদ্ভুত ভালবাসা; এবং যাহার জন্য উনি ঐরূপ করিতেছেন, সে ব্যক্তি কি কঠোর! সেই রাত্রি ঐরূপে আমাদিগকে অতিবাহিত করিতে হইয়াছিল।” প্রসঙ্গত উল্লেখ্য স্বামী প্রেমানন্দ তখনও নরেন্দ্রর সঙ্গে পরিচিত হন নি।
0 Comments