জ্বলদর্চি

শ্রীরামকৃষ্ণের সন্ন্যাসী সন্তানেরা-৮৩/প্রীতম সেনগুপ্ত

পর্ব ৮৩
শ্রীরামকৃষ্ণের সন্ন্যাসী সন্তানেরা
প্রীতম সেনগুপ্ত

সাহিত্য প্রতিভা বিবেকানন্দ

 বহুমুখী প্রতিভাসম্পন্ন বিবেকানন্দের প্রতিভার প্রকাশ দেখা যায় তাঁর সাহিত্যকর্মে। প্রথমেই তাঁর লেখা ‘পরিব্রাজক’ গ্রন্থটির আলোচনায় প্রয়াসী হওয়া যাক। ১৮৯৯ সালের ২০ জুন স্বামী বিবেকানন্দ কলকাতা থেকে গোলকোণ্ডা জাহাজে দ্বিতীয়বার পাশ্চাত্যদেশে যাত্রা করেন। সঙ্গে ছিলেন স্বামী তুরীয়ানন্দ ও সিস্টার নিবেদিতা। স্বামীজী পরিকল্পিত ও প্রতিষ্ঠিত ‘উদ্বোধন’ পত্রিকার প্রথম সম্পাদক স্বামী ত্রিগুণাতীতানন্দের অনুরোধে স্বামীজী নিয়মিতভাবে তাঁর এই ভ্রমণবৃত্তান্ত পাঠাতে সম্মত হন। পত্রাকারে লিখিত তাঁর নানা অভিজ্ঞতাসমৃদ্ধ ভ্রমণকাহিনিই উদ্বোধন পত্রিকার প্রথম ও দ্বিতীয় বর্ষের বিভিন্ন সংখ্যায় ‘বিলাতযাত্রীর পত্র’রূপে প্রকাশিত হয়। কয়েকবৎসর পরে পরবর্তী সম্পাদক স্বামী সারদানন্দজীর উদ্যোগে ‘পরিব্রাজক’ গ্রন্থরূপে এটি প্রকাশিত হয়। এই লেখায় ‘তু’-ভায়া বলতে স্বামী তুরীয়ানন্দজীকে বোঝানো হয়েছে। পত্রে ‘স্বামীজি’ বলে সম্বোধন করা হয়েছে ত্রিগুণাতীতানন্দজীকে।
 গ্রন্থের ভূমিকাটি এইরকম --“স্বামীজি! ওঁ নমো নারায়ণায় -- ‘মো’কারটা হৃষীকেশী ঢঙের উদাত্ত করে নিও ভায়া। আজ সাতদিন হল আমাদের জাহাজ চলেছে, রোজই তোমায় কি হচ্চে না হচ্চে খবরটা লিখবো মনে করি, খাতা পত্র কাগজ কলমও যথেষ্ট দিয়েছ, কিন্তু ঐ বাঙ্গালী ‘কিন্তু’ বড়ই গোল বাঁধায়। একের নম্বর কুড়েমি -- ডায়েরি, না কি তোমরা বল, রোজ লিখবো মনে করি, তারপর নানা কাজে সেটা অনন্ত ‘কাল’ নামক সময়েতেই থাকে; এক পাও এগুতে পারে না। দুয়ের নম্বর -- তারিখ প্রভৃতি মনেই থাকে না। সেগুলো সব তোমরা নিজগুণে পূর্ণ করে নিও। আর যদি বিশেষ দয়া কর তো, মন কোরো যে মহাবীরের মত যার তিথি মাস মনে থাকতেই পারে না -- রাম হৃদয়ে বোলে। কিন্তু বাস্তবিক কথাটা হচ্ছে এই যে, সেটা বুদ্ধির দোষ এবং ঐ কুড়েমি। কি উৎপাৎ! ‘ক্ক সূর্য্যপ্রভবো বংশঃ’ থুড়ি হলো না --‘ক্ক সূর্য্যপ্রভববংশচূড়ামণিরামৈকশরণো বানরেন্দ্রঃ’ আর -- কোথা আমি দীন অতি দীন। তবে তিনিও শত যোজন সমুদ্র পার এক লাফে হয়েছিলেন, আর আমরা কাঠের বাড়ীর মধ্যে বন্ধ হয়ে, ওছল পাছল কোরে, খোঁটাখুঁটি ধোরে চলৎশক্তি বজায় রেখে, সমুদ্র পার হচ্চি। একটা বাহাদুরি আছে -- তিনি লঙ্কায় পৌঁছে রাক্ষস রাক্ষুসীর চাঁদমুখ দেখেছিলেন, আর আমরা রাক্ষস রাক্ষুসীর দলের সঙ্গে যাচ্চি। খাবার সময় সে শত ছোরার চকচকানি আর শত কাঁটার ঠকঠকানি দেখেশুনে তু-ভায়ার ত আক্কেল গুড়ুম। ভায়া থেকে থেকে সিঁটকে উঠেন, পাছে পার্শ্ববর্ত্তী রাঙ্গাচুলো বিড়ালাক্ষ ভুলক্রমে ঘ্যাঁচ করে ছুরিখানা তাঁরই গায়ে বা বসায় -- ভায়া একটু নধরও আছেন কিনা। বলি হ্যাঁগা, সমুদ্র পার হতে হনুমানের সি-সিকনেস হয়েছিল কিনা, সে বিষয়ে পুঁথিতে কিছু পেয়েছ?”
🍂

 গ্রন্থটির ভূমিকায় এই প্রারম্ভিক অংশটুকু পাঠ করলে চমকে যেতে হয়। স্বামী বিবেকানন্দের কলমে বাংলাভাষা নতুন প্রাণ ফিরে পেয়েছিল। এত গতিময়, সরস, সজীব সাহিত্য পরিবেশন বাংলা সাহিত্যকে এক নতুন মাত্রা এনে দেয় একথা নিঃসংশয়ে বলা যায়। সচেতন পাঠককে এর টানে বারংবার স্বামীজীর লেখনীর মুখোমুখি হতে হয়। অত্যাশ্চর্য ভাবময়, বৌদ্ধিক! এক ঈশ্বরপুরুষের সাহিত্যপ্রতিভা মুগ্ধ করে আপামর জনমানসকে। মুগ্ধতা এই কারণেই যে কোনও বদ্ধতা, কূপমণ্ডুকতা নেই স্বামীজীর ভাবনায়। উদার, মুক্ত হাওয়ার চলাচল উঠে এসেছে তাঁর কলমে।
 স্বামী বিবেকানন্দের পত্রাবলি পাঠে যে অনুপ্রেরণা ও সাহিত্য রসের সন্ধান পাওয়া যায় তার তুলনা মেলা ভার। সমসাময়িক সমাজ, রীতি-নীতি, দেশকাল নিজের ভাবনায় মন্থন করে কি অপূর্ব সাহিত্যশৈলীতে প্রকাশ করেছেন! আমেরিকার স্ত্রীজাতির প্রশংসায় মুখর হয়ে শোলাপুরের ফরেস্ট অফিসার হরিপদ মিত্র মহাশয়কে আমেরিকা থেকে লিখছেন ( পত্রের তারিখ, ২৮ ডিসেম্বর ১৮৯৩ ) -- “...এদেশে আশ্চর্য্যের বিষয় অনেক। বিশেষ, দারিদ্র্য নাই বলিলেই হয় ও এদেশের স্ত্রীদের মত স্ত্রী কোথাও দেখি নাই। সৎপুরুষ আমাদের দেশেও অনেক, কিন্তু এদেশের মেয়েদের মত মেয়ে বড়ই কম। যে দেবী সুকৃতি পুরুষের গৃহে স্বয়ং স্ত্রীরূপে বিরাজমানা, একথা বড়ই সত্য। এদেশের তুষার যেমন ধবল, তেমনি হাজার হাজার মেয়ে দেখেছি। আর এরা কেমন স্বাধীন। 
 ...বাবাজি, শাক্ত শব্দের অর্থ জান? শাক্ত মানে মদ, ভাঙ্গ নয়, শাক্ত মানে যিনি ঈশ্বরকে সমস্ত জগতে বিরাজিত মহাশক্তি বলে জানেন এবং সমগ্র স্ত্রী-জাতিতে সেই মহাশক্তির বিকাশ দেখেন। এরা তাই দেখে। এবং মনু মহারাজ বলিয়াছেন যে, ‘যত্র নার্যাস্তু নন্দন্ত্যে নন্দন্তে তত্র দেবতাঃ’ যেখানে স্ত্রীলোকেরা সুখী, সেই পরিবারের উপর ঈশ্বরের মহাকৃপা। এরা তাই করে। আর এরা তাই সুখী, বিদ্বান, স্বাধীন ও উদ্যোগী। আর আমরা স্ত্রীলোককে নীচ, অধম, মহা-হেয়, অপবিত্র বলি। তার ফল আমরা পশু, দাস, উদ্যমহীন, দরিদ্র।”
 বাংলা ভাষা বিষয়ে স্বামীজীর ভাবনা বা মত কী ছিল তা তাঁর প্রবন্ধ ‘বাঙ্গালা ভাষা’ পাঠ করলে অনুধাবন করা যায়। ১৯০০ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি আমেরিকা থেকে ‘উদ্বোধন’ পত্রিকার সম্পাদককে স্বামীজী এই বিষয়ে পত্র লেখেন। আদতে সেটিই হল এই আলোচিত প্রবন্ধটি। তিনি লিখছেন -- “আমাদের দেশে প্রাচীনকাল থেকে সংস্কৃতয় সমস্ত বিদ্যা থাকার দরুন, বিদ্বান এবং সাধারণের মধ্যে একটা অপার সমুদ্র দাঁড়িয়ে গেছে। বুদ্ধ থেকে চৈতন্য রামকৃষ্ণ পর্যন্ত -- যাঁরা ‘লোকহিতায়’ এসেছেন, তাঁরা সকলেই সাধারণ লোকের ভাষায় সাধারণকে শিক্ষা দিয়েছেন। পাণ্ডিত্য অবশ্য উৎকৃষ্ট; কিন্তু কটমট ভাষা -- যা অপ্রাকৃতিক, কল্পিত মাত্র, তাতে ছাড়া কি আর পাণ্ডিত্য হয় না? চলিত ভাষায় কি আর শিল্পনৈপুণ্য হয় না? স্বাভাবিক ভাষা ছেড়ে একটা অস্বাভাবিক ভাষা তয়ের করে কি হবে? যে ভাষায় ঘরে কথা কও, তাতেই তো সমস্ত পাণ্ডিত্য গবেষণা মনে মনে কর; তবে লেখবার বেলা ও একটা কি কিম্ভূতকিমাকার উপস্থিত কর? যে ভাষায় নিজের মনে দর্শন-বিজ্ঞান চিন্তা কর, দশজনে বিচার কর -- সে ভাষা কি দর্শন-বিজ্ঞান লেখবার ভাষা নয়?...ভাষাকে করতে হবে -- যেমন সাফ্ ইস্পাত, মুচড়ে মুচড়ে যা ইচ্ছা কর -- আবার যে-কে-সেই, এক চোটে পাথর কেটে দেয়, দাঁত পড়ে না। আমাদের ভাষা -- সংস্কৃত গদাই-লস্করি চাল -- ঐ এক-চাল নকল করে অস্বাভাবিক হয়ে যাচ্ছে। ভাষা হচ্ছে উন্নতির প্রধান উপায় -- লক্ষণ!”
 কতখানি বাস্তব, যুক্তিযুক্ত ভাবনা স্বামীজী এই বিষয়ে উপস্থাপিত করেছেন তা অনায়াসেই বোঝা যায়। এবং সবচেয়ে প্রয়োজনীয় যে সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন তা হল, ভাষা হচ্ছে উন্নতির প্রধান উপায় ও লক্ষণ!


Post a Comment

0 Comments