পশ্চিমবঙ্গের লৌকিক উৎসব, পর্ব -- ৮১
বাহা পরব
ভাস্করব্রত পতি
'বাহা' অর্থে [সংস্কৃত ৰাহু > প্ৰাকৃত ৰাহা] হাত বোঝালেও সাঁওতালি ভাষায় তা 'ফুল' বোঝায়। গোপীচন্দ্রের লেখায় বাহা শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে হাত বা বাহু বোঝাতে -- “দুই বাহাএ তুলিয়া নিলে নয়শ রুপার তার"। ফার্সী শব্দ 'বাহ' অর্থে বেশ বা ধন্য বোঝায়। বাংলায় তা ব্যবহৃত হয় প্রশংসা, আনন্দ, উপহাস কিংবা বিস্ময় প্রকাশে। যেমন -- বাহা বাহা! বেশ বেশ!
মাঘ মাস হল বছরের শেষ মাস। আর তাই ফাল্গুন হল সাঁওতালদের বছরের প্রথম মাস। ফাল্গুনের শুক্লপক্ষের দ্বাদশী তিথি থেকে বাহা পরব শুরু হয়। যতদিন না বাহা পরব শুরু হয়, ততদিন সাঁওতালরা মহুয়া ফুল খায় না। শালগাছকে লক্ষ্য করেই এঁদের এই উৎসব যাপন। আর তাছাড়া নতুনকে আপন করে নেওয়ার উৎসব হিসেবে স্বীকৃত বাহা পরব। একে 'শালুই উৎসব'ও বলে। বসন্তের হিল্লোলে গাছ জুড়ে পুরোনো পাতার বদলে নতুন পাতার সমারোহ আসে। কচি কচি পাতা আর ফুলের কলতানে মুখরিত হয়ে ওঠে শালবন। এই বাহা উৎসব আসলে একটি কৃষিবর্ষের সমাপ্তির কথা জানান দেয় আর সেই সাথে নতুন এক কৃষিবর্ষের সূচনা তুলে ধরে।
বাহা পরবের বিস্তার তিনদিন। প্রথম দিনটি হল 'উম'। দ্বিতীয় দিন 'সার্দি' এবং তৃতীয় তথা শেষ দিন হল 'বাহা সেঁদরা'। প্রথমে গ্রামের জাহের থানে মুখিয়ারা বসে সিদ্ধান্ত নেয় কিভাবে উৎসবটি পালন করা হবে। ফাল্গুন মাস আসার আগেই তা আলোচনা করে ফেলা হয়। উৎসবের খরচাপাতি কিভাবে উঠবে তাও নির্ধারণ করা হয়। সব কিছু ঠিক হয়ে গেলে উৎসবের জন্য কুটুম বাটুম ডাকার (পেড়া নেওতা) তোড়জোড় পড়ে। বিবাহিত মহিলারা এই সময় বাপের বাড়ি আসে।
উম -- এই 'উম' এর দিন গ্রামের পুরোহিত বা নায়ক এবং জগমাঝি স্নান করে চলে আসেন জাহের থানে। এখানে এসে তেল সিঁদুর দেন। কোনো একটি গাছের তলায় খড় দিয়ে গ্রামের লোকেরা তৈরি করেন জাহের সাড়িম। সন্ধ্যায় নায়কের বাড়িতে নারী পুরুষ মিলে সবাই একত্রিত হন। সেখানে রাখা হয় পূজার উপচার হিসেবে টাঙ্গি, তীর ধনুক, কুলো, দাউড়া ইত্যাদি।
এবার দেবতাদের নামানো হয়। যাকে বলা হয় 'রুম বঙ্গা ডাকা'। এসময় দেবতা কয়েক জনের শরীরে ভর করেন। যাঁকে ভর করে সে নিজের অস্ত্র নিয়ে ছুটে যান জাহের থানের দিকে। ধামসার তালে তালে বাকিরা তাঁদের ধাওয়া করেন। বিশ্বাস যে, দেবতারা আসেন সাদম বা ঘোড়ায় চেপে এবং ছাতা নিয়ে। তাই ঐ লোকজনকে সাদম চাতম দিয়ে বিদায় করার জন্য প্রতীকীভাবে ধূপধুনা দিয়ে বিদায় জানানো হয়। এরপর সারারাত ধরে চলে বাহা নাচ ও গান। এইদিন রুম বঙ্গারা গাছে উঠে ফুল পাড়েন। ঐ ফুল মাটিতে পড়তে দেওয়া হয় না। হাত পেতে নিয়ে নেওয়া হয় ফুল। জাহের সাড়িম জাহের থানে হয় ২ টি এবং মাঝি থানে ১ টি। উমের রাতে নায়ককে মাটিতে শুইতে হয়।
সার্দি -- এই উৎসবের দ্বিতীয় দিনটি পরিচিত 'সার্দি' নামে। এদিন ভোরে পশুপাখিদের জল খাওয়ার আগেই নায়ক বা পুরোহিতদের বৌ'রা স্নান করে এসে দাউড়াতে বড় মাপের ডালায় পূজার সামগ্রি সাজানোর কাজ করে। পুরোহিত এবং সরকারী পুরোহিত অথবা কোনও অবিবাহিত ছেলে সেই সময় পুকুর থেকে পবিত্র কলসিতে করে জল এনে জাহের সাড়িমের নিচে রাখেন।
এরপর প্রতি পরিবার থেকে চলে মাগন। যা শেষ হলে ফের গান করতে করতে সবাই জাহের থানে যায়। অবশেষে সূর্য যখন হেলে পড়ে তখন জাহের থানে শুরু হয় পূজা।
জাহের সাড়িমের নিচে চালের গুঁড়ি দিয়ে ডানদিক থেকে বাঁদিক পর্যন্ত একটি গোলাকার ঘর তৈরি করা হয়। সেইসাথে মণ্ডলী হয় ৩ টি। গোলমণ্ডলীটি পৃথিবীর আকৃতির। এখানে মারাংবুরুর পূজা হয়। মারাংবুরুর সামনে সাদা মোরগ বলি দেওয়ার রীতি। অন্য গোলমণ্ডলীটিতে পূজা হয় জাহের এরার। এখানে ধূসর মুরগী (হেড়াৎ) বলীদান হয়। আর আয়তাকার খড়ে মডেক তুরুইক পূজা হয়। সেখানে লাগে লাল মোরগ। এইভাবে চারদিকে দেবতাদের উদ্দেশ্যেও পূজা করা হয়। ইতিমধ্যে হাঁড়িয়া নিয়ে হাজির পুরোহিতের স্ত্রীরা। বলী দেওয়া ছোট ছোট মুরগীগুলি দিয়ে বানানো হয় খিচুড়ি। বড় মোরগ গুলি দিয়ে বানানো হয় নানারকম পিঠা। তবে এই সাদা মোরগের পিঠা খাওয়ার বিধি নেই মেয়েদের।
পূজোর শেষে গ্রামের সবাই নিজেদের সাধ্য মতো নতুন পোশাক পরে জাহের থানে আসে। তখন নতুন কুলোতে শালফুল নিয়ে অপেক্ষায় থাকেন পুরোহিত। সবাই তখন মারাংবুরু, জাহের এরাকে প্রনাম নিবেদন করে পুরোহিতকে প্রনাম করে। তখন পুরোহিত তাঁর হাতে তুলে দেন একটি শালফুল। মেয়েরা তা খোঁপায় আর ছেলেরা কানে গুঁজে নেয়। সহকারী পুরোহিত সকলের মাথায় নতুন ভাঁড়ে রাখা পবিত্র জল ছিটিয়ে মঙ্গল কামনা করে।
এবার সবাই খিচুড়ি (জাহের সড়ে) খেতে যায়। এ প্রসঙ্গে উল্লেখ্য যে জাহের থানে আসার আগে গ্রামের লোকেরা মাঝিথানে প্রনাম করে আসে। এটি একটি অত্যন্ত পবিত্র স্থান হিসেবে পরিচিত। খিচুড়ি খাওয়ার পর শুরু হয় বাহা নাচ। সারা গ্রাম প্রদক্ষিণ করে পুরোহিতের বাড়িতে এসে চলে বাহা নাচ ও গান। বাহা উৎসবে নাচের নাম ‘বাহা - এনেচ’ বা ‘বাহা নাচ’। এই বাহা নাচের সঙ্গে গান গাওয়া হয় বলে গানের নাম ‘বাহ সেরেঞ’ বা ‘বাহাগীতি’। এই সময় গাওয়া হয় --
“অকায় মায় চিয়ারা হো বির বিশ্বম্ দ?
অকায় মায় দহয় হো আতোরে পায়রি।
মারাং বুরুয় চিয়ায়া হো বির দিসম্ দ
জাহের এরায় দহয় হো আতোরে পায়রি।”
অর্থাৎ—
বনভূমি কে খুঁজবে?
গ্রামে কে বসতি স্বাপন করবে?
মারাং বুরু বনভূমি খুঁজবেন।
জাহের এরা, গ্রামে বসতি স্থাপন করবেন।
(ড. অজয় রায়)
সবশেষে শান্তি জল এনে পুরোহিতের বাড়ির চালে ছিটিয়ে দেওয়া হয়। ড. নারায়ণ কুইল্যার অভিমত, "এই বাহা গানের মাধ্যমে দেবীর নিকট আদিবাসীদের জীবনের কামনা বাসনার বিনীত ভাব ফুটে ওঠে। জঙ্গলে বসবাসকারী আদিবাসীরা জঙ্গলের সঙ্গে নিবিড় সম্পর্ক স্থাপন করে। তাই অরণ্য সম্পদকে টিকিয়ে রাখার জন্য জাহেরা মায়ের কাছে নাচের দ্বারা আর গানের ভাষায় তা প্রকাশ করে থাকে।"
বাহা সেঁদরা -- বাহা উৎসবের শেষ দিন হল 'বাহা সেঁদরা'। এই দিনে পুরুষেরা দলবেঁধে শিকারে যায়। এছাড়াও কেউ কেউ নাচতে নাচতে অন্যের বাড়িতে গিয়ে হাঁড়িয়া খেয়ে আসে। আর পরিবার গুলিও হাঁড়িয়া তৈরি করে অপেক্ষা করে থাকে অতিথি আপ্যায়নের জন্য। শিকার করে যা পাওয়া যায়, তা সবাই মিলে ভাগ করে খায়। বাহা উৎসব আসলে সুন্দর সবুজ পরিবেশে নিজেকে বিলিয়ে দেওয়ার উৎসব। ফুল পাতা প্রকৃতি সেখানে মুখ্য বিষয় হয়ে ওঠে জীবনের গল্পের সাথে। আর তাই তাঁরা গেয়ে ওঠে --
"সারা জম্ বাহাহো মাতকন গেলে
না ও আ বাহা হো নাও আ গেলে
মুলুর বঁসা হো বাহা বঁসা
হিসিৎ হয় হো সঁধাড় ময়
জিউই না ওয়ায় হো হড় না ওয়ায়
আতো দিশম হো হেঁসেক সেকেচ্
জিউই হড়ম্ যে লেগেচ্ লেগেচ্"!
অর্থাৎ -
ওগো শাল মহুয়ার ফুল
ওগো নতুন ফুল নতুন ফল
আঁধার নিশার শেষে
ওগো বাসন্তী চাঁদ
তোমাদের মন্দ মদির বাতাসে
ভরে উঠুক জীবন সুবাসে
আনন্দ মুখর হোক গ্রাম
উথলে উঠুক মন আর প্রাণ।
প্রবন্ধকার জলধর মল্লিক লিখেছেন, "পল্লী প্রকৃতি যখন মুকুলিত বৃত্তের আগায় সহস্র শাখায় হেসে ওঠে, কুসুম গাছের গোটা শরীর জুড়ে জড়িয়ে ধরে অসংখ্য রক্তলাল কচি কচিপাতা, নিস্পত্র পলাশের সরু সরু ডালে, কালো কালো কুঁড়ি ফাটিয়ে উন্মোচিত হয় সিঁদুরে লাল পাঁপড়ি, মহুয়া গাছে অজস্র মহুয়ার ফুল, অন্যদিকে আকাশে ফাল্গুনি পূর্ণিমার চাঁদ, ঠিক সেই সময়কালে সাঁওতাল সহ ওরাঁও, মুণ্ডা, কোল, কিষাণ, হো, বিরজিয়া, খেঁড়িয়া প্রভৃতি আদিবাসী মানুষ পালন করেন বাহা উৎসব।"
1 Comments
অসাধারণ লেখা। ধন্যবাদ
ReplyDelete